২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এ স্রোতধারা রুধিবে কে!

-

বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা, স্বাধীনতার পূর্বাপর দেশের যুবক-যুবতী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আশাবাদ ও স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন, তা নিছক স্বপ্ন হয়ে থাকেনি। সে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে, যেটি প্রাপ্তির জন্য পাগলপারা হয়ে উঠেছিল দেশের সমস্ত মানুষ। স্বাধীনতার আগে এই জনপদের মানুষের মধ্যে যে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল সেটি প্রতিটি মানুষের ভেতর অমিত শক্তির আধার হয়ে ওঠে এবং তাদের চিন্তাচেতনায় বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। গান আর ধানের দেশ বাংলাদেশের কোমলপ্রাণ জনতাকে রাতারাতি অসম সাহসী ও লৌহ কঠিন এক যোদ্ধার জাতিতে পরিণত করে। সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে শৌর্য বীর্যে তারা রচনা করে বীরত্বের এক মহাকাব্য। অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করে অসম প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। সেই অপূর্ব গাথা শুনে বিশ্ব চমৎকৃত, বিস্ময়াভিভূত হয়। সে বিজয় গোটা জনপদকে আনন্দে উদ্বেলিত করেছিল।

সে যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল দেশের কোটি মানুষের ভাগ্য বদলের সোনালি দিনের নতুন সূর্যোদয়কে দূর দিগন্তের পার থেকে তুলে আনা। দেশে শীর্ণকায় দেহ থেকে জীর্ণ বস্ত্র পাল্টে দেয়া, বসবাসের অনুপযোগী পর্ণকুটিরগুলোকে খানিকটা বসবাসের উপযোগী করে তোলা, আধপেট খেয়ে পুষ্টির অভাবে নানা রোগ-ভোগে হীনবল মানুষগুলোর দেহে সঞ্জীবনী সুধা সঞ্চারিত করা। এ জন্য প্রথম কাজটি ছিল, দেশকে কোন পথে পরিচালিত করতে পারলে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় সেই নীতিমালা প্রণয়ন করা। তথা দেশের সংবিধান রচনা করা। সে কাজও যথাসম্ভব ত্বরিত গতিতেই সম্পন্ন করা হয়। সে সংবিধানের মুখবন্ধের সূচনায় সন্নিবেশিত করা হয়, ‘...যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনীতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা।’ মাত্র এক বছরের মাথায় ১৫৩ ধারা সংবলিত বাংলাদেশের সেই সংবিধানে মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদা পূর্ণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে ধার্য করা হয়। রাষ্ট্রের স্কন্ধে রয়েছে নগর-গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগত দূর করার প্রয়াস। সবার মৌলিক অধিকার সমুন্নত করা ও সুরক্ষার জন্য সন্নিবেশিত হয়েছে একগুচ্ছ বিধিবিধান। সংবিধানে রয়েছে ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ সংবিধানের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, সেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চিয়তা থাকিবে...’। ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা হইবে জনগণের সেবক’।

সংবিধানে সংযুক্ত রয়েছে ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ নাগরিকগণ যাতে রাষ্ট্রের নির্বাহীদের হাতে কোনোরূপ নিগ্রহের শিকার না হন, ন্যায্য আচরণ পেতে পারেন, তাতে কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে জন্য দেশের নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়। সংবিধানে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধি রয়েছে। যেমন- ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথিকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ নাগরিকের কল্যাণার্থে আরো বিধিবিধান রয়েছে। নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি পরিহারের লক্ষ্যে সব বিষয়ের উল্লেখ করছি না। বস্তুত দেশকে একটি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ তথা কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণায় উন্নীত করাই এই শাসনতন্ত্রের মূল চেতনা। সে লক্ষ্যটি পাঠকের কাছে স্বচ্ছ করে তোলার জন্য সংবিধানের প্রস্তাবনার কিছু অংশ উদ্ধৃত করে প্রসঙ্গান্তরে যাবো। ‘... আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি সে জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’

আমাদের সংবিধান মণি-মুক্তা-মাণিক্য রতনে ভরপুর। এ কথা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংশোধন করা হয়েছে। অবশ্য কয়েকটি সংশোধনী আনা হয় সময়ের প্রয়োজনেই। সে যা-ই হোক, যত ভালো কথা, আর কল্যাণ্যের বাণীই সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকুক না কেন তা যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা না হয়, সংবিধানের সুফল যদি জনগণ ভাগ না করতে পারে, তবে তো সবই গরলি ভেল। সংবিধানের সুষ্ঠু ব্যবহার না হলেও এর অপব্যবহার হয়েছে এবং হচ্ছে। গত ৫০ বছরে কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণে কোনো মৌলিক প্রয়াস ঘটেনি। এই সময়কালে যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন অথবা যেকোনো পন্থায় ক্ষমাতসীন হয়েছেন, তারা সংবিধানের অনুশাসন একপাশে ঠেলে রেখে, যার যার মতলব বা এজেন্ডা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। তারা চলনে বলনে ও ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজে’ দেশের মানুষকে এটাই বলতে, বোঝাতে চেয়েছেন যে, তাদের থলিতে রোগবালাই আক্রান্ত দেশ ও দেশের মানুষকে সুস্থ করে তোলার মহৌষধ মজুদ রয়েছে। বেলা শেষে দেখা যায়, দেশের মানুষের ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ এতটুকু উপশম হয়নি। যে ঘোর অন্ধকার মানুষের জীবনে বিরাজ করছিল, তা আরো নিকষ কালো হয়ে ওঠে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা যা ছিল তা বরং বেড়েছে। তারা হারিয়েছে মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষ তাদের জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। জীবন সায়াহ্নে এসে তারা অনুভব করেন, হতাশা দুর্ভোগের দুঃসহ সব গ্লানিকর অনুভূতি।

আজকের বিশ্বকে বলা হয় ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন বিশ্বের যেকোনো নিভৃত কোণে কোনো বৃক্ষ চারা অঙ্কুরিত হলে তা মুহূর্তে পৃথিবীময় ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়। এসবের মাধ্যমে দেশের হাজারো তরুণ মন উজ্জীবিত। তারা বিশ্বের এগিয়ে যাওয়ার যত রূপ-রস-গন্ধে উদ্বুদ্ধ। অথচ সে যখন তার নিজের চার পাশে তাকায় তখন সে দেখে কোথাও কোনো আলো নেই। টানেলের শেষ প্রান্তেও জ্বলছে না এতটুকু স্ফুলিঙ্গ। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাঙ্গনের কদাকার চেহারা আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বেহাল অবস্থা, মিথ্যাচার, ভণ্ডামি, আর নীতিহীন ভ্রষ্টাচারে সয়লাব, রাজনৈতিক সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রনেতাদের দুরাচার অনিয়ম অযোগ্যতা আর বাগাড়ম্বর ছাড়া তার চোখে আর কিছুই ধরা পড়ে না। কোথাও গুণ-মানের কদর নেই। এসব দেখে তার মন হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়। এজন্যেই আজকে হাজারো মেধাবী তরুণ দেশ ছাড়ছে। মেধাবী ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন তরুণরা চলে যাচ্ছে ভিন দেশকে এগিয়ে নিতে ‘কনট্রিবিউট’ করতে।

আমাদের দেশের নেতাদের মন-মানসে, চিন্তাচেতনায় এখন গ্লানি নেই যে, গত ৫০ বছরে দেশের জন্য তারা খুব বেশি কিছু করতে পারেননি। তার জের কতটা সর্বনাশ ঘটিয়েছে আজ গোটা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। নেতারা দেশ নিয়ে রাতের বেলায় স্বপ্ন দেখেন হয়তো; কিন্তু সুবেহ সাদিকের শেষে ঘুম ছুটলে সে স্বপ্ন আলেয়ার মতো মিলিয়ে যায়। এখানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের একটি স্মরণীয় বাণী আমাদের নেতৃত্বকে স্মরণে নিতে হবে, তিনি এক নিবন্ধে লিখেছেন, নেতৃবৃন্দকে দেশ নিয়ে দিবাভাগে স্বপ্ন দেখতে হবে, যে স্বপ্ন তাদের রাতের সুখনিন্দ্রা কেড়ে নেবে। নেতাদের ভিশন থাকতে হবে, দিব্যদৃষ্টির অধিকারী হতে হবে। আমরা সবাই জানি মাখন পানির উপর ভাসে আর সর্বক্ষেত্রেই বর্জ্যটা দূষণ নিয়ে তলিয়ে যায়। আমাদের মেধাবী প্রজন্ম দেশ ছাড়লে মেধাহীনদের দিয়ে দেশ গঠন করার স্বপ্ন বোনার অর্থ হবে আহম্মকের স্বর্গে বাস করা। যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তি থাকলেও ‘ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন’, কোথায় পাওয়া যাবে!

এ পর্যন্ত ‘ব্রেন ড্রেইন’ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। এ বিষয়ে দেশে কোনো তথ্য ভাণ্ডার খুঁজে পাইনি। ইউনেস্কোর কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও তা হালনাগাদ নয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল অবধি প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি। ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ থেকে দেশান্তরী হয়েছিল সাত হাজার ১৬৯ মেধাবী তরুণ। ১৫ বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সালে দেশ থেকে ৩৩ হাজার ১৩৯ জন তরুণ বাইরে চলে গেছে। এখন ছয় বছরের মাথায় সে সংখ্যা কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অনুন্নয়ন অবশ্যই দেশান্তরের একটা বড় কারণ। তাদের মত হচ্ছে, যতটুকু যা হয়েছে, উন্নতির পরশ পাওয়া ভাগ্যবান ব্যক্তিদের সবাই ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট। সরকারি কর্তৃপক্ষ উন্নয়নের যে কথামালা গাঁথে তার সাথে বাস্তবতার কোনো ছোঁয়া নেই। উন্নয়নের সাধারণ অর্থ বেকারত্ব দূর করা তথা প্রতিটি মানুষের হাতে কাজ থাকবে, তার যোগ্যতার অনুসারে, তার সংসার জীবন পরিচালনার জন্য যা তার প্রয়োজন সেটির সংস্থান করার জন্য অর্থকড়ি তার হাতে ন্যূনতম পর্যায়ে থাকতে হবে। স্বাচ্ছন্দ্য না থাকুক, কষ্ট আর গ্লানিকর জীবন নয়।

তরুণ প্রজন্মের দেশ ছাড়ার বহু কারণের মধ্যে বেকারত্ব অন্যতম। উচ্চশিক্ষা নিয়েও দেশে কাজের কোনো সংস্থান হয় না। বিজ্ঞজনদের অভিমত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এখন শিক্ষাকে কিভাবে যুগোপযোগী করা যায় তা দেখতে হবে। তবে তারা এ কথা বলেন না যারা উপযুক্ত তাদের কর্মসংস্থানের কী ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সেখানে তারা নীরব, সে ব্যাপারে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষা যুগোপযোগী করতে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা নিয়েও কিন্তু তারা মূক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন সব বিভাগ যুক্ত করা হয়েছে, যার সাথে চাকরির বাজারের বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই।

সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরির মুখ দেখতে পাননি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তারা শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজার সুবিধা রয়েছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো। প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন, যার উল্লেখযোগ্য অংশ উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তাদের সবার চাকরি হয় না। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরিপ্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা ও চাহিদা মতো কাজ পাচ্ছেন না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতক বেকার। আর সমস্যাটি কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, তাদের চাকরির বাজারও ভালো নয়। অন্য দিকে আমাদের শিল্প ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা মোট ১৩৭টি। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪৫ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯২টি। বিশ্বসেরা এক হাজারের বেশি বিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।

বাংলাদেশের উল্লিখিত তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু প্রথিতযশা শিক্ষক রয়েছেন, যাদের পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের গৌরবোজ্জ্বল অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের অনেকে গবেষণা পরিচালনা করছেন- ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিয়ে বা একান্ত নিজস্বভাবে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য তহবিল রয়েছে যৎকিঞ্চিৎ, আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দু-একটিতে কিছু ফান্ড থাকলেও বাকিদের নেই বললেই চলে।

বিশ্বের উন্নত দেশ ও সেসব দেশের নাগরিকরা সময়ের মূল্য দেয় খুবই বেশি। যে মুহূর্তের কাজ সেই মুহূর্তে সেটি সম্পন্ন করাই তাদের ‘লাইফ স্টাইল। ওই সব দেশ ও দেশের উন্নয়ন এবং নাগরিকদের স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের এটা মৌলিক কারণ। তাদের অভিধানে ঢিলেমি বলে কোনো শব্দ নেই। ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য ‘টাইম ইজ মানি’। আমাদের এখানেও একটা কথা প্রচলিত রয়েছে, ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ’। এসব আমাদের মুখস্থ; কিন্তু জীবনচর্চায় তার কোনো প্রতিফলন নেই। আজকের কাজ, কাল করব, এটাই যেন আমাদের নিত্যদিনের জীবনশৈলী। অথচ আজ তরুণ প্রজন্ম এটা সহজভাবে নিচ্ছে না। আর একটা উদাহরণ দিতে চাচ্ছি, আমাদের যত উন্নয়ন প্রকল্প তা কখনো নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন হয় না। এ জন্য রাষ্ট্রকে দু’দিক থেকে ক্ষতি ও ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, প্রকল্প কাজ শেষ করতে সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের মেয়াদ বৃদ্ধির পেলে সাথে এ জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের সেবা পেতে বিলম্ব হয়, মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘতর হয়।

মহানগরী ঢাকা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাজধানী হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে ৫০ বছর থেকে। মহানগরীর উত্তরাংশের সামান্য কিছু অংশ খানিকটা পরিকল্পিতভাবে বিকাশ লাভ করছে বটে। কিন্তু নগরীর বৃহত্তর অংশ অপরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। তাই এই নগরী অদূরভবিষ্যতে আর বসবাসের উপযোগী না-ও থাকতে পারে। বিশেষ করে যানজটের কারণে। এখন যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন মানুষের ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে, এ তথ্য বিশ্বব্যাংকের। আর যানজটের কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে আর্থিক ক্ষতির এ আনুমানিক পরিমাণ বলে জানা গেছে। ঢাকা শহরে এখন ঘণ্টায় গড়ে মাত্র সাত কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। বিশ্বব্যাংক বলছে, এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরের যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
উন্নয়ন কার্যক্রম ও সড়ক অবকাঠামো অপর্যাপ্ততায় রাজধানীর যানজট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও এর অশুভ প্রভাব এখন ক্রমেই দৃশ্যমান। বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে আসছে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণের সব তথ্য। এর কারণ অতিমাত্রায় যানজট। সর্বশেষ বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য মতে, শুধু রাজধানীর যানজটের কারণেই প্রতি বছর প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে জিডিপির আড়াই শতাংশের মতো। আর পরোক্ষ লোকসান যুক্ত হলে এ ক্ষতি পৌঁছাবে ৬ শতাংশের কাছাকাছি।
সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ পেয়েছে, বিশ্বের দূষিত বায়ুর শীর্ষে বাংলাদেশ! বিশ্বের ১১৭টি দেশ ও অঞ্চলের ছয় হাজার ৪৭৫ শহরের বায়ুমান পর্যালোচনা করে এই তথ্য উঠে এসেছে। সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের বিশ্বের বায়ুমান প্রতিবেদন-২০২১-এর তথ্য অনুসারে, দেশভিত্তিক পরিসংখ্যানে শীর্ষ অবস্থানের পাশাপাশি দূষিত রাজধানী শহরের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

দেশের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে নেতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে, যা মানুষকে হতাশ চিন্তিত বিষণ্ন এবং বিষাদাক্তক করে ফেলেছে। এমন পরিবেশ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হচ্ছে। যে কারণে দেশান্তরী হওয়ার মিছিল অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এখন এই স্রোতধারা রুধিবে কে! এর একমাত্র ‘রিমেডি’ দেশের ‘খোলনলচে’ বদলে দেয়া, তথা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তরুণদের হাতে যথাযোগ্য কাজ তুলে দেয়া। কিন্তু আফসোস হচ্ছে, সে আশা করা তো দুরাশা। দেশের পরিকল্পনামন্ত্রী রেখে ঢেকে বলতে গিয়েও বলেছেন, উন্নয়ন কার্যক্রমে দুর্নীতি হচ্ছে, বাণিজ্যমন্ত্রীও স্বীকার করছেন, টিসিবির পণ্য কিনতে আসছেন মধ্যবিত্তরাও। তিনি বলেছেন, সরকারি হিসাবে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। গরিব মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের পকেটেও টান পড়েছে।

লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : belaYet_1@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement