২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ও চৈতন্যোদয়

- ছবি : নয়া দিগন্ত

১৭ মার্চ বাংলা একাডেমির বইমেলার শেষ দিন। কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার নেতৃস্থানীয় অনেকেই ছিল শেষ দিনের বইমেলায়। সেখানেই চ‚ড়ান্ত হয় ১৯ মার্চ ঘর উদ্বোধন। আনোয়ার হোসেনের নতুন ঘর। আনোয়ার হোসেন গোয়ালঘর থেকে প্রথম নতুন ঘরে প্রবেশ করবেন। আয়োজন থাকবে খানাপিনারও। খানাপিনার নাম শুনে জানতে চেয়েছিলাম খাবারের মেনু। সাম্প্রতিক আনুষ্ঠানিক খানাপিনার মেনু শুনলেই পিলে চমকে ওঠে। পোলাও-মাংস, বিফ বিরিয়ানি ও মাটন কাচ্চি এসব নামি-দামি খাবারের নাম শুনলে জিহবায় জল আসার কথা। জল আসার পরিবর্তে পিলে চমকানোর কারণ! কারণ উল্লেখ রয়েছে ২৩ অক্টোবর ২০২১ দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার উপসম্পাদকীয়,‘হারিয়ে গেছে বাঙালি সংস্কৃতির বিয়ে পার্বন’ প্রবন্ধে। প্রকাশিত প্রবন্ধে গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া বাঙালিয়ানা খাবারের বর্ণনাও রয়েছে। প্রবন্ধের একাংশে, ‘মনে পড়ে ১৯৬৩ সালের একটি বিয়ে পার্বণের কথা। বরের বাড়ি কুমিল্লা জেলার বর্তমান মেঘনা উপজেলার কান্দারগাঁও আর কনের বাড়ি একই উপজেলার মির্জানগর গ্রামে। বর আমার দোস্ত। বরের ভাতিজা মোসলেহ উদ্দীন আমার সমবয়সী, দু’জনই তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। চাচা-ভাতিজা হলেও ভাব জমতে সময় লাগেনি।’

কথোপকথনে জানা গেল, আমি যে মোসলেহ উদ্দিনের কথা বলছি, উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সে মোসলেহ উদ্দিনই অল-ইন-অল। সে-ও বাঙালিয়ানা খাবারের পক্ষে। ১৯৬৩ থেকে ২০২২ সাল। ছয় দশক। ছয় দশকে বদলে গেলে সমাজ-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-ভালোবাসা এমনকি বদলে গেছি নিজেও। আমার বদলানোটা একটুও টের পাইনি। টের পাই, মাথার চুলের রঙ পরিবর্তনসহ পথ-ঘাটের লোকজন ‘চাচা-দাদু’ সম্বোধন করতে শুরু করলে।

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে চাচার বই পড়তে চায় ভাতিজা। ভাতিজাকে বইমেলায় আসতে বলি। বইমেলায় জনসমাগম। জনসমাগমে পরিবারের লোকজনের বারণ। বারণ সত্ত্বেও মেয়ে, জামাই ও নাতি সাথে করে এক বিকেলে বইমেলায় হাজির ভাতিজা। বই বড়ে জানতে পারেন, ‘সালমার সংসার’ এর সালমাই তার চাচী।

মোসলেহ উদ্দিন কতটুকু বদলে গেছে, জানতে মন চায়। তাই মেঘনা পাবলিকেশন্সের মালিক আবুল হোসাইনকে সাথে নিয়ে রওনা হই ঘর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। সেখানে মোসলেহ উদ্দিনসহ মেঘনা গর্বিত সন্তান যাদের নাম শুনতাম তাদের অনেকেই ছিলেন। অবসরে গিয়ে তারা মানুষের কাজ করছেন। তাদের নির্দেশে কাজ করছে যুবসম্প্রদায়। যে যুবসম্প্রদায় মানুষের জন্য কাজ করছে সে সম্প্রদায়ের কচি মস্তিষ্কে একবার ‘মানুষের জন্য মানুষ’ এই চিন্তা ভালোভাবে প্রবিষ্ট করতে পারলে তাদের দ্বারা ভবিষ্যতেও মানুষের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।

ছয় দশক পর ঘণ্টা ছয়েক সময় কাটাই মোসলেম বাহিনীর সাথে। বাইরে শ্মশ্রুমণ্ডিত হলেও কথা, কাজ ও আচার-অচরণে সেই চঞ্চল মোসা (ডাকনাম)টিই রয়ে গেছেন। সেদিনের ‘চঞ্চল মোসা’ আজ অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর ক্যাপটেন পদ থেকে অবসর নিয়ে নৌবাহিনী কলেজেই প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। শিক্ষাদান থেকে অবসরে যাওয়ার আগেই ভাবলেন, কী করবেন বাকি জীবন? সারাজীবনে অর্জিত মেধা ঘরে বসে অপচয় করলে ‘ব্রেন ড্রেন’-এর শামিল হবে। তাই ঠিক করলেন, যে মানুষের দোয়ায় এতদূর এসেছেন সে মানুষের জন্য কাজ করবেন। মানুষের কাজ করার জন্য সংগঠন দরকার। ২০১৬ সালের শেষ দিকে মেঘনার সাকিব মিয়াজী, নাসরিন সুলতানা, ফারুক হোসেন, মহিউদ্দিন মুহিন, রাইয়ান জহির, শফিউল্লাহ রুবেল, নজরুল ইসলাম লিটন, ইব্রাহিম মিলন, রেদোয়ান রাছেল, শাহেদ মিয়াজি, সাদিয়া ফারহানা, তাহমিনা আক্তার তুলি, ফারজানা ইসলাম ছোটন, আতিকুর রহমান, সবুজ তালুকদার, সুমন মিয়া একঝাঁক যুবক-যুবতী নিয়ে গঠিত সংগঠনের নাম ‘আদর্শ মেঘনা সামাজিক সংগঠন’।

যুবসম্প্রদায়ই দেশের চালিকাশক্তি। এ শক্তিকে যে কাজে লাগানো যায় সেই কাজেই সফলতা আসে। যুব শক্তিকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য দক্ষ পরিচালক দরকার। আহ্বান করলেন তারই সমসাময়িক বন্ধু ড. মোহাম্মদ আলী (সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ পরমাণু কমিশন), প্রফেসর মো: আমির হোসেন (অধ্যক্ষ, সরকারি ঘিওর কলেজ, মানিকগঞ্জ), অধ্যক্ষ মো: রেজাউল করিম (ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কলেজ), মো: সুরুজ্জামান (প্রধাান শিক্ষক সাহেরা লতিফ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়), মো: মজিবুর রহমান (সহকারী প্রধান শিক্ষক ঐ), পিয়ারা বেগম (কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক), এসএম ওবায়েদ (সিনিয়র অফিসার, বাংলাদেশ নৌ বাহিনী), জিল্লুর রহমান শাহীনসহ আমার নামও রাখা হয়।
করোনাকালে বেকার হয়ে পড়ে শহরের কর্মজীবী ও দিনমজুর। ছুটে আসে গাঁয়ে। যারা একদিন বাঁচার জন্য গাঁ ছেড়ে শহরে গিয়েছিল তারাই আবার বাঁচার জন্য গাঁয়ে আসতে শুরু করে। গাঁয়ে যাদের কিছুই নেই- তারা কী করবে গাঁয়ে এসে? পরিবার-পরিজনসহ কোথায় যাবে? কে দিবে আশ্রয়, শীতবস্ত্র ও খাবার? সক্রিয় হয়ে ওঠে সংগঠন। করোনাকালীন সময়ে ১০০০ পরিবারকে খাদ্য প্রদান, ২০০ কম্বল বিতরণ, কন্যাদায়গ্রস্ত ১০ পিতাকে আর্থিক সহায়তা, ৫০০ জন রোগীর সিরিয়াল সেবা, ৫০ জনকে স্বেচ্ছায় রক্তদান, ২টি মাদরাসায় এতিমদের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, বৃক্ষরোপণসহ পরিবেশ উন্নয়নে সচেতনতা সৃষ্টি করেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা, যৌতুক নিরোধ, নারী নির্যাতন দমন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন করা ছাড়াও স্কুল-মাদরাসায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ ভবিষ্যতে সেবামূলক জ্ঞানদানের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠারও পরিকল্পনা রয়েছে।

জনৈক স্থানীয় সাংবাদিক মাহমুদুল হাসান বিপ্লব শিকদার-এর ১২ জানুয়ারি ২০২২ ইং তারিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘গোয়ালঘরে বসবাস’ শিরোনামে সচিত্র সংবাদটি ভাইরাল হয়। ভাইরাল সংবাদটি নজরে আসে সংগঠনের। সংবাদটির যথার্থতা যাচাই করার জন্য সংগঠন থেকে লোকজন ঘটনাস্থলে যায়। লোকজন গিয়ে দেখতে পায়, মেঘনা উপজেলার দড়িকান্দি গ্রামের আনোয়ার হোসেন। কয়েকটা বাঁশের খুঁটির ওপর দণ্ডায়মান ছাপড়াঘর যা একসময় গরুরঘর ছিল। যবুথবু মুলির বেড়া। দরজা নেই। উপরে নিচে অনেক ফাঁকা। ফাঁকাস্থান বন্ধ করাসহ দরজার কাজ চলছে মশারির ছেঁড়া নেট দিয়ে। এতে, কাক-পক্ষী থেকে রক্ষা পাওয়া গেলেও রোদ-বৃষ্টি, ইঁদুর-বিড়াল আর কুকুর থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।

ভাইরাল হওয়া সংবাদ যথার্থ হওয়ায় সংগঠনের উপদেষ্টা মণ্ডলী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য, কার্যনির্বাহী সদস্য ও পরিচালকদের জরুরি জুম মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে সদস্যদের নিজস্ব অর্থায়নে একটা ঘর করে দেয়া হবে। চৌচালা ঘর। সেই ঘরেরই উদ্বোধন।

নতুন ঘরের ভেতরেই চেয়ার টেবিল পেতে খানাপিনার আয়োজন। খাবারের আয়োজনেও সংগঠনই। খানাপিনার পরপরই আমি আমার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিলাম, ‘অনেক দিন পর পেটভরে ভাত খেলাম। আরো খেতে ইচ্ছে করছিল। কী করে খাই! আমার বামপাশে ক্যাপটেন মোসলেহ উদ্দিন, তার পাশে প্রফেসর আমির হোসেন। ডান পাশে ড. মোহাম্মদ আলী, সামনে ঔপন্যাসিক পিয়ারা আপা। বেশি খেতে গেলে ধরা পড়ে যাব- সেই লজ্জায় মন চাইলেও বেশি খাওয়া হয়নি। বেশি খেতে ইচ্ছে করার কারণ, সাদা ভাত, গুঁড়া চিংড়ি মিলিয়ে উচ্ছেকরলা, দেশি ঝাল মুর্গি, শোল মাছ দিয়ে মাষকলাইর ডাল, খাঁটি দুধের পায়েশ ও টকদই। সাথে চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা ও গুঁড়া মাছের টক থাকলে ফাটাফাটি কাণ্ড হয়ে যেত।’

বাঙালি বান্ধব খানাপিনা খেয়ে মনে পড়ে গেল ১৯৬৩ সালের কথা। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বাঙালিয়ানা খাবার খেয়েছিলাম। কাকতালীয়ভাবে তখনো আমার পাশে ছিল মোসলেহ উদ্দিন। ২৫ মার্চ মেঘনা উপজেলায় আবার বিয়ের দাওয়াত। মেঘনায় এমনই এক গরমের দিনে বিয়ের দাওয়াত খেতে বসে আমার স্ত্রী সালমা ঢলে পড়েন। সে ঢলে পড়ায়ই শেষ। তাই ভয় পাই। যিনি দাওয়াত দিয়েছেন তাকে ফোন করে ১৯ মার্চের মেনুর কথা জানাই। আরো জানাই, ১৯ মার্চের মতো খাবার খাওয়াতে পারলে দাওয়াত কবুল, নয়তো সন্দেহ। আমার মুখে খাবারের বর্ণনা শুনে বলেন- ভাই, যেসব খাবারের কথা বললেন সেসব খাবার খাওয়ালে বরযাত্রীর কাছে মান বাঁচবে?

উত্তরে বলেছিলাম, ‘আমরা যে কয়জন এ খাবার খেয়েছি সেই কয়জনের চেয়ে বেশি গণ্যমান্য লোক মেঘনা উপজেলায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একসময় রুটি, ডাল-ভাত, মাছ ও শাকসবজিই ছিল নিম্নবিত্তের প্রধান খাদ্য। আর ঘি, বাটার, গোশত, পেস্তা-বাদাম, গরু ও খাসি ছিল উচ্চবিত্তের খাবার। সময় পাল্টে গেছে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য এখন চিকিৎসক নিম্নবিত্তের খাবারই পথ্য দিচ্ছেন। বাধ্যতামূলক খেতে হচ্ছে উচ্চবিত্তদেরও। ডায়াবেটিস আর হার্টের রোগ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আটার কদর। চিনির নাম দিয়েছেন ‘হোয়াইট পয়জন’। এর পরও আমাদের চৈতন্যোদয় হচ্ছে না। 
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement