২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এক অনন্য রাষ্ট্রপতির কথা

-

নিরপেক্ষতার মানদণ্ডে কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রোববার বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে। এর আগে হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠে তার নামাজে জানাজায় অংশ নেন দেশের সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক মানুষ। শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানানো হয়।

শনিবার সকাল ১০টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচে ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। ওই দিনই বিকেলে তার লাশ শেষ শ্রদ্ধা জানাতে নেয়া হয় জন্মভূমি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার পাইকুড়া ইউনিয়নের পেমই গ্রামে। সেখানে তার প্রথম নামাজে জানাজা হয়। তার বড় ছেলে সোহেল আহমদ সাংবাদিকদের জানান, তার বাবার ইচ্ছা ছিল গ্রামের বাড়িতে এসে কয়েক দিন থাকবেন। সে ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ ছিলেন তিনি। ১২ ফেব্রুয়ারি তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। তার ফুসফুসে পানি জমাসহ নানা জটিলতায় শারীরিক অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করে। শুক্রবার রাতে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন জাতীয় জীবনে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আন্দোলনের মুখে এরশাদের পদত্যাগের পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজনৈতিক দল বিএনপির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে প্রধান বিচারপতির পূর্ব পদে ফিরে যান। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তিন জোটের অনুরোধে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে দৃঢ় পদক্ষেপে দেশকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রে। তবে সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।

স্বৈরাচারের ফেলে যাওয়া জঞ্জাল সাফ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ ও নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়েছে। তার সততা ও নির্মোহ আচরণ ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দেয়। দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হন ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর। তাকে রাষ্ট্রপতি করার আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিল। এ নিয়োগকে বিএনপিও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিল। সেবারও তিনি তার দৃঢ়তা এবং নিরপেক্ষতার নজির রাখেন। রাজনীতির মানুষ না হয়েও রাজনীতিকে উজ্জ্বল্যদানের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির পদকে আলোকিত করেছেন। সততায় অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তিনি।

কোনো দিন রাজনীতি না করলেও এবং রাজনীতিতে কখনো আসবেন না ঘোষণা দিলেও রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করুক এবং জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো মিলেমিশে কাজ করুক মনেপ্রাণে তা চাইতেন তিনি। চাইতেন রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি সম্মান নিয়ে রাজনীতি করুক। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হয়নি। অমায়িক অন্তর্মুখী মানুষটি চলাফেরায় যেমন ছিলেন সাদাসিধে, তেমনি সৎ এবং কথাবার্তায় ছিলেন সহজ-সরল স্বচ্ছ। অবসর জীবনে বাসায় নিভৃতচারী হিসেবেই কাটিয়েছেন। গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল ছিল তার আস্থা। তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতার ভিত্তিতেই কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে হবে।’ তার ছিল অগাধ দেশপ্রেম। দেশের যেকোনো ভালো খবরে উচ্ছ্বসিত হতেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল জয়ের পর এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে গিয়ে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। দৈনিক আমার দেশের জন্য আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি সাধারণত ঘরের বাইরে যাই না। কিন্তু দেশের জন্য এ গৌরবের আনন্দ উপভোগ করতেই এখানে এসেছি; কারণ ড. ইউনূস বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।’ আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার অসামান্য অবদান ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

সাহাবুদ্দীন আহমদের সত্যভাষণ
সত্য সবসময়ই কঠিন ও অপ্রিয়। অপ্রিয় সত্যকে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অপ্রিয়ভাবেই; অর্থাৎ কারো মুখ না চেয়ে কিংবা নিন্দা-প্রশংসার তোয়াক্কা না করে উচ্চারণ করেছেন। সত্য ছাড়া যদি আর কোনো কিছুর প্রতি তার দায় থাকে তবে সেটি ছিল দেশ ও জনগণের স্বার্থ এবং জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। দু’বার দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে তার কর্মই এর বড় প্রমাণ।

একানব্বইয়ের নির্বাচনের পর দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব শেষে আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বের শেষ পর্যায়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে ওই সময় তার মন্তব্য ছিল ‘মিলাদ পড়া ও কবর জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো কাজ নেই।’ শুনতে ভালো না লাগলেও তিন দশক ধরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এর চেয়ে বেশি আমরা দেখিনি। তার এ সত্যভাষণ আজো প্রযোজ্য। নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বলেই সত্যকথা এমনভাবে বলতে পেরেছিলেন।

১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর দৈনিক বাংলায় তার একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নিজেদের সরকারকে ‘ঐকমত্যের সরকার’ নাম দিয়েছিল। রাজনীতিতে এ নিয়ে তখন বেশ বিতর্ক হচ্ছিল। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ঐকমত্যের সরকার সম্পর্কে মন্তব্য কী? বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এর চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। বলা যায়, আওয়ামী লীগের জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের ¯স্লোগানের বেলুনকে তিনি তার স্পষ্ট মন্তব্য দিয়ে তখন ফুটো করে দিয়েছিলেন। অথচ আওয়ামী লীগই তাকে রাষ্ট্রপতি করেছিল। সত্য উচ্চারণ করতে তিনি কোনো দ্বিধাবোধ করতেন না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তখন বলেছিলেন, ‘সংবিধানে ঐকমত্যের সরকারের কথা লেখা নেই। সংসদীয় পদ্ধতিতে সংসদের বিরোধী দল থাকা অপরিহার্য। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দল থাকবে এটিই সংসদীয় গণতন্ত্র। কোনো একটি দল থেকে একজন বা দু’জনকে এনে মন্ত্রী বানালেই সেটি ঐকমত্য হয় না। ঐকমত্য হয় জাতীয় বড় বড় ইস্যু নিয়ে। যেমন ধরুন আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা, গঙ্গার পানি সমস্যা এসব ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য হতে পারে। ধরুন ভারতের সেচমন্ত্রী বাংলাদেশে এলেন কিংবা বাংলাদেশের সেচমন্ত্রী ভারতে গেলেন। মন্ত্রী যাওয়ার আগেই যদি আমাদের সব রাজনৈতিক দল বসে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সিদ্ধান্ত যদি মন্ত্রী বৈঠকে উপস্থাপন করেন কিংবা জানান এবং তার ভিত্তিতে ফায়সালা হয় তবে প্রকৃত অর্থে সেটি হলো জাতীয় ঐকমত্য। সেই ঐকমত্যই আমরা গড়ে তুলতে পারি।’ (দৈনিক বাংলা, ২৪ জুলাই, ১৯৯৬) তার প্রতি প্রশ্ন ছিল- বিএনপির পরাজয়কে তিনি কিভাবে দেখেন? বিএনপি সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু না বলে সে দিন বলেছিলেন, ‘দেখুন আমাদের দেশের জনসংখ্যা এত বেশি যে, রাজনৈতিক দলগুলো যেসব অঙ্গীকার করে তা বাস্তবায়ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে ক্ষমতায় যাওয়ার পর দ্রুত জনপ্রিয়তা হারায়।’

দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে তার তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। সংসদে আওয়ামী লীগ সরকার ‘জননিরাপত্তা আইন’ নামে একটি কালো আইন পাস করেছিল। সংসদে পাস করা আইনটি তার কাছে সইয়ের জন্য গেলে তিনি বিতর্কিত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। আইনটি তিনি ফেরত পাঠিয়ে দেন। এ নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। এ জন্য ক্ষমতাসীনদের অনেকেই তাকে ‘বেঈমান’ বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি নিজেকে যতদূর সম্ভব সরকারি বাধা-নিষেধের প্রভাবমুক্ত করে এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যা তৎকালীন সরকারের অনেকেরই পছন্দ হয়নি। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অধিকারী হলেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তার নিরপেক্ষ ভূমিকার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন দেশের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে।

একানব্বইয়ের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গেলে একবার তার সাথে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ারও কিছুটা মতবিরোধ হয়েছিল। সেটি ছিল ৯ জন বিচারপতির নিয়োগ নিয়ে। পরে বিচারপতি টি এইচ খানের উদ্যোগে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক হয়। বৈঠকে বিষয়টি সুরাহা হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার নীতিতে ছিলেন অটল।

১৯৯৭ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার ২৬তম বার্ষিকীতে মেহেরপুরে দেয়া ভাষণে তিনি সত্য উচ্চারণ করেন যে, জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। ভাষণে তিনি বলেন, ‘ওয়্যার অব লিবারেশন ডকুমেন্ট ভলিয়ম-৩-এর ২৫ পৃষ্ঠায় এম এ জি ওসমানীর নিয়োগের কথা বলা আছে। আর ইংরেজি টেক্সটে ওসমানীকে বলা হয়, ‘জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ অব দ্য মুক্তি ফৌজ’ এবং বাংলায় শিরোনামে উল্লেখ করা হয়, ‘কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক পদে নিয়োগ।’ এর পর থেকে বিভিন্ন ওয়্যার অব লিবারেশন ডকুমেন্টে জেনারেল ওসমানীকে মাঝে মধ্যে প্রধান সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করা হলেও অধিকাংশে ‘মুক্তিবাহিনীর সর্বধিনায়ক’ বলা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের ঘোষণা বা প্রক্লেমেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা সুপ্রিম কমান্ডার বলা হয়। এর কারণ এ প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার বা সর্বাধিনায়ক ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এক জিনিস বা এক পদ নয়। ১৯৭২ সালে জেনারেল ওসমানী যখন মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করেন, তখন তিনি লক্ষাধিক সার্টিফিকেট দিয়েছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের। সেই সার্টিফিকেটে তিনি দস্তখত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক হিসেবে, প্রধান সেনাপতি হিসেবে নয়। তখন এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি বা বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। আজ ২৬ বছর পর এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠানো মোটেই ঠিক নয়।’

রাজনীতিই এসেছে তার কাছে
ছাত্রজীবন থেকে চাকরিজীবন- বিচারপতি সাহাবুদ্দীন কোনোকালেই সক্রিয় রাজনীতি করেননি। রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ তার কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু তিনিই রাজনীতিকে আলোড়িত করেছেন। তার রাজনৈতিক বিশ্বাস একান্তভাবেই ছিল তার নিজের। কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়। কিন্তু তার জীবন এক দিন এমন এক দিকে মোড় নেয়, যা তাকে রাজনীতির মূল আসনে বসিয়ে দেয়। অন্যভাবে বললে তিনি নিজে রাজনীতিতে আসেননি, রাজনীতিই তাকে রাজনীতির প্রয়োজনে টেনে নিয়ে আসে।

নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে তাকে মনোনীত করে। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর তিন জোট জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি ফর্মুলা যৌথভাবে দিয়েছিল। সেটি ছিল জেনারেল এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে প্রথমে পদত্যাগ করবেন। সেই পদে নিযুক্তি দেয়া হবে একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে। তিনি হবেন তিন জোটের সম্মিলিতভাবে পছন্দ করা ব্যক্তি। এরপর তার কাছেই জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। উপরাষ্ট্রপতি হবেন অস্থায়ী ও অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি। তিনিই তিন মাসের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনের পথ সুগম করবেন।

নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি কে হবেন এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কয়েক দিন তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদল ও বাম দলগুলোর জোট পাঁচ দলের পছন্দ ছিল প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলের পছন্দ ছিল এ কে খন্দকারকে। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার একাধিক বক্তব্যে বলেন, ‘আমরাই বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে প্রথম নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে বাছাই করি। পাঁচ দলও তার ব্যাপারে একমত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজি হচ্ছিল না। একপর্যায়ে শেখ হসিনাকে টেলিফোন করে আমি বলি, আমরা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে বাছাই করেছি। আমার অনুরোধ আসুন আমরা যৌথভাবে তার নামই ঘোষণা করি। কারণ এর চেয়ে নিরপেক্ষ কাউকে পাওয়া যাবে না।’
যাই হোক, পরবর্তীতে জোটের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে রাজনীতির মঞ্চ আলোকিত করেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। এক পাশে শেখ হাসিনা অন্য পাশে খালেদা জিয়া আর মাঝখানে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। রাজনীতির সাড়াজাগানো ঘটনা হিসেবে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় এ ছবি। তবে এ পদে আসার জন্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রথমে রাজি ছিলেন না। তাকে দায়িত্ব শেষে প্রধান বিচারপতির পূর্বপদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে সেই শর্তে পরে তিনি রাজি হন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংসদের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি আবার ২৭ আগস্ট, ১৯৯১ প্রধান বিচারপতির পূর্বপদে ফিরে যান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবার তাকে মনোনীত করা হয়। তিনি ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সংসদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে তাকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করলেও বিএনপি তার প্রতি সম্মান জানিয়ে কোনো প্রার্থী দেয়নি। ফলে ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই তিনি রাষ্ট্রপতি হন। তবে দু’বারই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে দেশবাসী দেখেছে তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতার ব্যাপারে তিনি নির্লোভ, নির্মোহ ছিলেন। তার এমন ক্ষমতানির্মোহ দেশে কিংবদন্তি হয়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, তিনি প্রচারবিমুখও ছিলেন। ছিলেন নিভৃতচারী। একজন ছোটখাটো গড়নের মানুষ ছিলেন তিনি। কম কথা বলতেন। সাধারণ জীবনযাপন করতেন। পদ কখনোই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশ ও মানুষ। বঙ্গভবনে থাকাকালে পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতিদের আমলে যে বরাদ্দ ছিল, তিনি তা কয়েকগুণ কমিয়ে এনেছিলেন। তিনি বলতেন, জনগণের অর্থ যথেচ্ছ খরচ করার অধিকার তার নেই। তবে সব কিছু ছাপিয়ে ব্যক্তিত্বের মাধুর্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়, যা রাজনীতিকে মহিমান্বিত করেছিল।

সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন
বাংলাদেশে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদই প্রধান ভূমিকা ও নজির রেখে গেছেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা এলেই উদাহরণ হিসেবে আসে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। এ নির্বাচন হওয়ার পরপরই ঢাকার বেতার স্টুডিওতে বিবিসির একটি পর্যালোচনা বৈঠক হয়েছিল সিরাজুর রহমানের উপস্থাপনায়। এতে যোগ দেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও ভারতীয় সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী। নিখিল চক্রবর্তী বলেন, ‘১৯৪৫ থেকে আজ অবধি ১১টি ইলেকশন কভারেজ করেছি রিপোর্টার হিসেবে। এর চেয়ে সুন্দর, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আমার চোখে পড়েনি।’ ব্যারিস্টার ইশতিয়াক বলেছিলেন, ‘এমন নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যই বাংলাদেশের মানুষ আত্মত্যাগ করেছে।’ আর অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মন্তব্য ছিল, ‘এ নির্বাচনে মানুষের আস্থা ফিরেছে’। বিদেশী পর্যবেক্ষক দলগুলো একবাক্যে বলে, ‘২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ বাংলাদেশের নির্বাচন এত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য তা নতুন দৃষ্টান্ত।’

দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১ অক্টোবর ২০০১ অনুষ্ঠিত নির্বাচনটিও ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচনের আরেকটি দৃষ্টান্ত। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ছিলেন তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। বঙ্গভবনে ২৪ অক্টোবর ২০০১ সাংবাদিকদের সাথে চা-চক্রে মিলিত হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ‘১ অক্টোবর নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ভোট কাস্টিংও হয়েছে সর্বাধিক। বোঝা গেছে, প্রত্যেকে তার ভোট দিতে পেরেছে। তরুণ-তরুণীরা ব্যাপকহারে ভোট দিয়েছে। আমি নিজেও নতুন ভোটারদের ভোট দিতে দেখেছি। নির্বাচনটি সারা বিশ্বে নন্দিত হয়েছে।’

শিক্ষকের চোখে সেই ছাত্রটি
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে পড়েন। সেখান থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত অর্থনীতিতে অনার্স ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে এমএ ডিগ্রি নেন। ১৯৫৪ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং ১৯৬০ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিসে চলে যান। জেলা জজের পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে হাইকোর্টের বিচারক হন ১৯৭২ সালে, ১৯৮০ সালে হন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং পরে প্রধান বিচারপতি। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবসরে যান।

ছাত্রজীবনে কেমন ছিলেন তিনি। তারই একটি বর্ণনা পাওয়া যায় তার শিক্ষক সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইনের বর্ণনায়। ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ, গণতন্ত্র বিনির্মাণ’ শীর্ষক বইয়ে তিনি লিখেন, ‘১৯৪৭-এর ২ ফেব্রুয়ারি। আমার কর্মজীবনের তথা শিক্ষকজীবনের প্রথম দিন। কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে ক্লাস নিতে গেছি। ইতিহাসের ক্লাস। কাঠের প্ল্যাটফর্মে উঠে টেবিলে ছাত্র-হাজিরার খাতা রেখে সামনে-বসা ছাত্রদের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ডান দিকে প্রথম সারিতে সবার প্রথমে বসা ছাত্রটির দিকে। হ্রস্ব আকৃতি, শীর্ণকায়, কিন্তু চোখেমুখে একটা দীপ্তি আত্মপ্রত্যয়ের, একটা ঔজ্জ্বল্য আত্ম-নিবিষ্টতার। পরনে খুবই সাদাসিধে পোশাক ও পাজামা। কিন্তু তার সমগ্র অবয়বটি যেন এক পরম আগ্রহ দিয়ে পরিপূর্ণ। সে আগ্রহ শিক্ষক ক্লাসে যে লেকচার দিচ্ছেন তা শোনা, বোঝা এবং যতটুকু সম্ভব নোট করে নেয়া। তার পর যত দিন ক্লাস নিয়েছি সব দিনই তাকে এক জায়গায়ই বসা দেখেছি- প্রথম সারির প্রথমে। আজকে সেই ছাত্রটিই রাষ্ট্রিক পদমর্যাদা প্রথম সারির প্রথমে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসন, রাষ্ট্রপতির আসনে আসীন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
চুয়াডাঙ্গায় হিট‌স্ট্রো‌কে যুবকের মৃত্যুর ৭ ঘণ্টা পর নারীর মৃত্যু ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াল, যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৬ শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু বাকৃবির এক্স রোটারেক্টরর্স ফোরামের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠিত পাবনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু ১

সকল