২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গরিবের ঘরে জন্ম

- ছবি : সংগৃহীত

জীবনের শুরুটা প্রতিকূল না হলে শেষটা অনুকূল হয় না। নাবালিকা সালমা। বড় ভাইয়ের ইচ্ছায় আকস্মিক বিয়ে। ভয়ানক প্রতিকূল অবস্থা শুরু হয় বিয়ের পরপর। সালমার পরিবার ঢাকার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। ঢাকাইয়া দুলাভাইয়ের অধীনে কাজ করতেন বড় ভাই। আকস্মিক বিয়ে দুলাভাই মেনে নেননি। ঢাকার কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে আসেন বড় ভাই। শুরু হয় ১৯৭১ সালের অসহযোগ।

আমাদের পরিবার কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সারা বছর থাকত উঠানভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, মাঠভরা ফসল। হেঁশেল থেকে ফসলের মাঠ, কাজ আর কাজ। দিন দিন বাড়ছে কাজ, বাড়ছে মায়ের বয়স, কমছে গায়ের বল। আমার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই। যখন তখন কাজের মহিলা পাওয়াও কঠিন। মা আর সংসারের ঘানি টানতে পারছেন না। বিয়ের আগের দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অনুষ্ঠান করে বউ উঠিয়ে আনার সব সম্ভাবনা শেষ। এক সন্ধ্যায় এক কাপড়ে সালমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসেন মা।

সালমা গৃহস্থালি কাজে অভ্যস্ত নয়। সে নানাপ্রকার সূচিকর্ম, ঘর সাজানোসহ রান্নায় পারদর্শী। সুন্দর রান্না খাইয়ে বাবাকে বশে আনতে ওকে সারাক্ষণ রান্নার কাজে লাগিয়ে রাখেন মা।

সালমার চঞ্চলতা ও হাসি মিলিয়ে যায় আমাদের বাড়িতে পা রাখার পরপরই। শ্বশুরের ভয়ে সবসময় জড়োসড়ো হয়ে থাকে। ভুলেও শ্বশুরের সামনে বের হয় না। সালমাকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না আমার বাবা। এক দিকে মা চাইতেন, সালমা তার কর্ম, বুদ্ধি ও মজাদার এবং পরিচ্ছন্ন রান্নাবান্না দিয়ে বাবার মন জয় করুক। অন্য দিকে বাবা চাইতেন, ছলেমোনের (বাবার ফুফু) বংশের চিহ্নও যেন এ বাড়ির ত্রিসীমানায় তিষ্টাতে না পারে।
বাবার মতে, মা ফকিরনির জাত (বড় মামা বাউল ফকির ছিলেন), এত দিনে মিলছে একটি বাজইন্না (সালমাদের বাড়িতে পীরের মাজারে ওরসসহ গান-বাজনা হয়) জাতের সাথে। ফকিরনি আর বাজইন্না জাত মিলে বাবার সাজানো সংসার পাতালে ডুবিয়ে ছাড়বে।

মা চাইতেন, সালমা নিজের যোগ্যতায় শ্বশুরের মন জয় করুক। শ্বশুর চাইতেন, তার সংসার থেকে ছলেমোনের রক্তের বিতাড়ন। পুত্রবধূ-শ্বশুরের এ যুদ্ধে পুত্রবধূ যখন শম্বুকগতিতে এগোচ্ছিল তখনই বাবার কানে এলো আগুনে ঘৃতাহুতির মতো সংবাদটি। কী কারণে যেন সালমার মেজো ভাইও এ বিয়েতে সম্মত ছিলেন না। মেজো ভাই তার নিজের বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে আংটি ও ঘড়ি পেয়েছিলেন। বিয়ের সময় আমি যখন ছাতা মাথায় দিয়ে সালমাদের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াই তখন গাঁয়ের প্রচলিত রীতি অনুসারে জামাই বরণ করতে হয়। জামাই গাঁয়ের বিশিষ্ট মোড়ল ই. আলী প্রধানের ছেলে। ই. আলী প্রধানের একমাত্র ছেলেকে কী দিয়ে বরণ করবেন? দিশেহারা বড় ভাই, তড়িঘড়ি করে মেজো ভাইয়ের হাতের পুরনো আংটি ও ঘড়ি খুলে এনে আমার হাতে পরিয়ে দেন। আমি আদিখ্যেতার মতো ঘড়ি, আংটি হাত থেকে আর খুলতেই চাইতাম না। বিয়ের কয়েক দিন পর মেজো ভাই বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে আমার হাত থেকে ঘড়ি ও আঙটি খুলে নিয়ে যান। এ লজ্জাকর ঘটনাটা বাবাকে জানানো তো দূরের কথা, কষ্ট পাবেন বলে মাকেও জানাইনি। একই কারণে জানানো হয়নি সালমাকেও। তার পরও কিভাবে যেন মা জেনে যায়। একসময় বাবার কানেও যায়। আর থামায় কে? অনলে ঘৃতাহুতির মতো দাউদাউ করে জ্বলে ওঠেন বাবা। দশ গাঁয়ে যার রয়েছে মোড়ল হিসেবে খ্যাতি, তার ছেলের বউ এক কপর্দকহীন পরিবারের মেয়ে! ই. আলী প্রধানের ছেলের হাত থেকে পুরনো ঘড়ি ও আংটি খুলে নেয়া শুধু লজ্জাজনকই নয়, চরম অপমানকরও বটে।

এসব বিষয় মনে পড়লে, বাবা মুখ দিয়ে যা আসে তাই বলে গালিগালাজ শুরু করেন। শুধু গালিগালাজ করেই ক্ষান্ত হতেন না, পুত্রবধূর সেবা গ্রহণও বন্ধ করে দেন। অজু করতে গিয়ে যখন জানতে পারেন, লোটার পানি সালমার আনা, তখন ফেলে দিয়ে নতুন করে পানি ঢেলে অজু করতেন।

সালমার হাসি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমাদের বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই। শব্দ করতাম না আমিও। সালমা আমাদের বাড়িতে থাকার সময়, ভয়ে আমি টুঁশব্দও করতাম না, সারাক্ষণ কচ্ছপের মতো হাত-পা গুটিয়ে থাকতাম। বউয়ের সাথে রোমান্টিক কথা দূরে থাক; জোরে হাঁচি-কাশিও দিতাম না। বন্ধু-বান্ধবের সাথে খোশ আলাপকালে বাবাকে দেখলে কথা বন্ধ করে দিতাম। আমাকে সালমার কাছে দেখলে বাবার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। এ রকম এক অঘোষিত যুদ্ধের ভেতর দিয়ে চলছিল আমাদের পরিবার।

সালমা প্রকাশ্যে টুঁশব্দটি না করলেও জ্বলত মর্মে মর্মে। সালমার মর্মজ্বালা পোড়াত আমাকেও। তার খুব গোসসার বাতিক ছিল। শক্ত গোসসায় দিনের পর দিন না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারত। বাবার বকাবকিতে সারাদিন মুখ ভার করে থাকত। গোসসা ভাঙানোর কৌশল আমাকেই বের করতে হতো। ঘরে রাগ-ক্ষোভ ও মানভঞ্জনের শব্দ যাতে বাবার কানে না যায়, তাই নানা অজুহাতে তাকে নিয়ে যেতাম বাইরে। নির্জন মাঠে খড়কুটোর টালে কিংবা ঝিলের ধারেও নিয়ে যেতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোয়াজ করে মান ভাঙাতাম। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের হানিমুনের সময়গুলো মাঠঘাট, বিল-ঝিলের ধারেই বেশি কেটেছে।

যে দিন সালমাকে বাড়ি নিয়ে আসি, সে দিন আনন্দে আমার পা মাটিতে পড়ছিল না। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত রান্নাঘরে। নানা ছুতায় সারাদিন পাকের ঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। বাড়িতে বাবার ছায়া দেখলেই সটকে পড়তাম। সালমা তার যত অশান্তি ও অঘটনের জন্য আমাকেই দায়ী করত। জলের মাছ ডাঙ্গায় তুললে যে অবস্থা হয়, আমাদের বাড়িতে আসার পর সালমার সে অবস্থা হতে শুরু করে।

মাঝে মধ্যে সালমার ধনাঢ্য দুলাভাই বিশাল লটবহর নিয়ে গাঁয়ে বেড়াতে আসেন। ডেকে নেয়া হয় আমাদেরও। তখন আমার খুব অস্বস্তি হয়। অস্বস্তির আরো কারণ, সালমার বড় বোনের সারা গায়ে থাকে স্বর্ণালঙ্কার। বড় বোন যে ক’দিন থাকেন; সে ক’দিন বাড়িতে খানাপিনার উৎসব লেগে থাকে। সালমার নাকে তার বড় বোনের দেয়া একটি মুক্তার নাকফুল ছিল, তা দেখেও অস্বস্তি বোধ করতাম। ভাবতাম, টাকা হলে প্রথমেই একটা নাকফুল গড়িয়ে দেবো। আমি চাই না, অন্যের দেয়া নাকফুল সালমার নাকের শোভাবর্ধন করুক। গাঁয়ের পাশের নদীতে বেদেরা ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ করতে আসে। তাদের কাছ থেকে একবার ১০ টাকা দিয়ে একটি গোল চকচকে মুক্তা কিনেছিলাম। কিনেই চলে যাই চন্দনপুর বাজারে। এক স্বর্ণকারের কাছ থেকে আট টাকার স্বর্ণ কিনে দুই টাকা মজুরি দিয়ে এক দিনে একটি নাকফুল গড়িয়ে আনি। রাতে তার বোনের দেয়া নাকফুলটি খুলে নতুন নাকফুলটি পরতে দিই। প্রথমে আপত্তি করলেও পরে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে পরতে রাজি হয়। আমার পক্ষ থেকে সালমাকে দেয়া এটিই ছিল প্রথম উপহার।

সালমার না বলা যন্ত্রণাও টের পেতাম। এটাও টের পেতাম, আমি বিয়ে না করলে, ভবিষ্যৎ যাই হোক, বর্তমানে সে রাজরানী থাকত। তার জীবন সামনে না এগিয়ে পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। সে আমাদের বাড়ি আসার আগে কোনো কাজ করত না। আমাদের বাড়িতে পা দিয়েই কঠিন কায়িক শ্রমের মুখোমুখি হয়। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাকে পরিশ্রমের কাজ করতেই হতো। মা রাতভর ধান সিদ্ধ করলে সালমা শুয়ে থাকতে পারত না। তাকেও মায়ের সাথে গৃহস্থালির সব কাজই করতে হতো। সে নিজের অকাল বিয়ের জন্য আমার সাথে তার বড় ভাইকে দায়ী করত। বড় ভাই আমাদের বাড়ি আসেন, তবে আগের মতো বড় বড় কথা বলেন না। মাথা নিচু করে বোনের কাজ করা দেখেন। সালমাও ভাইয়ের সাথে তেমন কথা বলে না। একদিন ধান ভানতে দেখে কাছে গিয়ে বলেন, দেখি, তোর হাত দু’টি! (হাতে ফোস্কা দেখে সখেদে) তোরা এমন নরম হাত নিয়ে আমাদের মতো গরিব ঘরে জন্মাইলি কেন? বড় ঘরে জন্মাইতে পারলি না? আমাদের মতো গরিব ঘরে জন্মাইছিস বলে, তোদের যেটা প্রাপ্য ছিল, সেটি দিতে পারিনি। দিতে পারিনি মনের মতো ঘর-বরও। গোলাপের পাপড়ির মতো সুন্দর এক বোনকে ধন দেখে বিয়ে দিয়েছি সতীনের ঘরে। তোকে বিয়ে দিয়েছিলাম, জাত আর জমি দেখে। তোর শ্বশুরের কাছে সন্তানের চেয়েও সম্পদের মূল্য বেশি। তোর শ্বশুরের কাছে পালের গরুগুলোর যে মূল্য তোদের (বউ-শাশুড়ির) সে মূল্যও নেই। (মাকে লক্ষ করে) চাচী, গুনে দেখেন আমার বোনের হাতে কয়টা ফোস্কা।

বাবারে কাজ করতে করতে আমাদের হাত কামারের হাতের মতো শক্ত হয়ে গেছে। তোমার বোন এত দিন তোমাদের বাড়িতে কোনো কাজই করেনি। তাই তোমার বোনের হাত এত নরম। -আমি বাবা সব বুঝি, বুঝলে কী হবে, শাশুড়িকে কাজ করতে দেখলে বউ তো আর বসে থাকতে পারে না। আমার একটাই তো পোলা! একটাই ছেলের বউ, যাদের মাধ্যমে আমাদের বংশ রক্ষা হবে। আমি এটিও জানি, গাছ সবল তো ফল সবল। জানলে কী হবে! বউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না। আজ আমি তোমার বোনকে ধান ভানতে দিইনি। পিঠার জন্য কয়টা আওলা ধান নিয়েছি। কথা দিয়েও কাজের মেয়েটা আসেনি। আমি নিজেই ভানতে শুরু করেছিলাম। আমাকে ধান ভানতে দেখে, তোমার বোন আমাকে সরিয়ে দিয়ে জোর করে ধান ভানতে শুরু করেছে।

মার কথা শেষ হওয়ার পর, বড় ভাই কিছু না বলে তাদের বাড়ির দিকে পা বাড়ান। কতক্ষণ পর দুই বউকে সাথে করে ফিরে আসেন। সালমার হাত থেকে ছিয়া (ভারী ও মোটা কাঠির দণ্ডবিশেষ) কেড়ে নিয়ে বলেন,
Ñআমাদের ধনের জোর কম হলেও মনের জোর কম নেই। সবাইকে দেখতাম এক দিকে, আর আমার এই অভিমানী বোনটাকে দেখতাম এক দিকে। ওকে চোখের আড়াল করতে পারব না বলে সবার অমতে বাড়ির কাছে বিয়ে দিয়েছি। (মাকে লক্ষ করে) চাচী, ধন দিয়ে আপনাদের মন জয় করতে না পারলেও জন দিয়ে মন জয় করতে পারব। কাজ করতে যত বউ দরকার, সব বউ আমাদের বাড়ি থেকে আনবেন, তবু আমার এই অভিমানী জেদি বোনটাকে জোরের কাজ করতে দিয়েন না।

Ñবাবারে, আমি তোমার বোনকে জোরের কাজ করতে দিই না। ও জোর করে কাজ করে, বাধা দিলে রাগ করে। মেয়েদের রাগ থাকা ভালো, অতিরিক্ত ভালো না।
নানা কারণে কিছু দিন থেকে বড় ভাই অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেছেন। নিজে নিজেই কথা বলেন, রাতভর পাড়াময় ঘুরে বেড়ান। গ্রাম থেকে দূরে মাঠে ঈদগাহ। কখনো বা ঈদগাহের গাছতলায় একা একা বসে থাকেন, অকারণে হাসেন, মাঝে মধ্যে এসে নিঃশব্দে সালমার মাথায় হাত বুলান।

এক বিকেলে খবর পেলাম, ভাইকে লোহার জিঞ্জির দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাড়াতাড়ি ভাইদের বাড়ি যাই। দেখি, ঘরের খুঁটির সাথে শিকল বেঁধে তার সাথে ভাইয়ার ডান পা তালা দিয়ে আটকানো। ভাইয়া আমাকে দেখেÑ
Ñ তুই না আমার বোনের জামাই, আবার চাচাত ভাই, গাঁয়ের সবাই বলে তোর মাথা অনেক ভালো। আচ্ছা ভাই, তুই-ই ক’, আমি কি পাগল? সবাই আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। পাগল বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধেও রেখেছে। চেয়ে দেখ ভাই, শিকলের ঘষায় ঘষায় পায়ের গোড়ালি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ভাই আমার, আমার তালাটা খুলে দে, বিশ্বাস কর, আমি মোটেও পাগল না।’

আমি ভাইয়ের পায়ের তালা খুলে দিই। ক্ষুধায় তার পেটের চামড়া পিঠের সাথে লেগে গেছে। তার এ অবস্থা দেখে আমার দুই চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসছে। সাথে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসি। ভাইকে খেতে দিয়েই সালমা মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগল। বোনকে কাঁদতে দেখেÑ
Ñকাঁদিস না, তোর দিনও ফিরবে। দেখিস, একদিন তুইও রাজরানী হবি।
ভাইকে উদ্দেশ করে আমি বলিÑ

Ñভাই, আপনি বাড়িতে বেকার বসে না থেকে ঢাকায় আবার যান। বাদামতলী ঘাটের সবাই আপনার পরিচিত। ভালো কোনো কাজ না পেলে ফল বিক্রি করেন। আড়ত থেকে বাকিতে ফল কিনবেন, বিক্রির পর টাকা বুঝিয়ে দেবেন।
Ñগণ্ডগোল শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি ঢাকা শহরে যাবো না।
Ñকেন যাবেন না?

Ñআমার ঢাকা না যাওয়ার কারণ দু’টি। প্রথমতÑ যার কাছে যাবো তার কাছে একদিন তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম। যে দিন তুই ওর কাছ থেকে চলে আসলি সে দিন আমিও ওর কাছ থেকে চলে এসেছি।

দ্বিতীয়ত; বয়স আর রূপই আমার কাল। আর্মিরা দেখতে পেলে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে ধরে নিয়ে যাবে; আর মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলবে আমাকে পাকসেনা মনে করে।

Ñকিন্তু এভাবে কত দিন চলবেন, শুনলাম ভাবীসাবও ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছেন। কেউ কেউ (সালমার মা) চলে গেছেন ঢাকা। এ অবস্থায় আপনার রান্নাবান্না করে কে? দেখা-শোনাই বা করে কে?
Ñখাওন দিতে না পারলে রক্তেরগুলাই পর হয়ে যায়, আর ও (স্ত্রী) তো পরের মেয়ে, সে চলে গেলে আর দোষ কী? আমি কোথায় খাই জানতে চাইছিস; এই যে, এখন তোদের এখানে খাইলাম। আবার যে খুশি হয়ে ডাক দেয় তার ওখানে খাব। যত দিন যার এখানে খোরাকি লেখা রয়েছে তার এখানে তত দিন খেতে হবেই। খোরাকি শেষ, আমিও শেষ।

এই ছিল ভাইয়ার সাথে আমার শেষ কথা। দুই দিন পরের ঘটনা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে উঠানে পা রাখতেই, আউসি কাকা (বাবার চাচাত ভাই) কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাদের ঘরে ঢুকে মাকে লক্ষ করে বলেন,
Ñভাবী গো ভাবী, চেরাগালি (সালমার বড় ভাইয়ের নাম) গলায় ফাঁস দিছে।
চাচার মুখ থেকে এ কথা শুনে আমার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা বের হচ্ছিল না। জানতে চাইÑ
Ñকী কী, কী বলছেন আপনি? কো কো কোথায় কিভাবে ফাঁস দিয়েছেন?

Ñ‘ভাইয়া ফাঁস দিয়েছেন’, এ কথা সালমা শোনা মাত্র প্রথম চিৎকারেই অজ্ঞান হয়ে পড়বে। জ্ঞান হারানোর সাথে সাথে দাঁতও লেগে যাবে। আজকাল মাঝে মধ্যেই ওর দাঁত লেগে যায়। রাগ করে অনশন শুরু করলেও দাঁত লেগে যায়। রাতে শোয়ার পর বাবার বকুনি শুনতে শুনতেও দাঁত লেগে থাকে। কোনো কোনো সময় ঘুমন্ত সালমাকে জাগাতে গিয়ে দেখি, দাঁতে দাঁত লেগে রয়েছে। দাঁত লেগে থাকা অবস্থায় দু’পাটি দাঁতের মাঝে পয়সা ঢুকিয়ে মোচড় দিয়ে দাঁতের পাটি ফাঁক করতে হয়। দাঁত ফাঁক করতেই গোঁঙানো দিয়ে জ্ঞান ফিরে আসে। সবসময় পকেটে পয়সা থাকে না। পয়সার কাজ চামচ দিয়েও চলে। তাই একটি পিতলের চামচ কাছে রাখি। শোকের তীব্রতা বেশি হলে জ্ঞান ফিরতেও সময় লাগে। একবার ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। সব শোনার পর জানান, প্রচণ্ড পেইনসহ মানসিক শকে কারো কারো অজ্ঞানতা রোগ দেখা দিতে পারে। তবে এর তীব্রতা যেন অস্বাভাবিক না হয়। অস্বাভাবিক আঘাত পেয়ে জ্ঞান লোপ পেলে, আর ফিরে নাও আসতে পারে।

বড় ভাইয়ের দুঃসংবাদ সালমা শোনামাত্র কণ্ঠ থেকে একটিই চিৎকার ধ্বনি বের হয়। চিৎকারের পরপরই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। এ সমস্যার কারণে তাকে না জানিয়েই দৌড় দিই ঈদগাহ বরাবর। তখন পূর্বাকাশ লাল হলেও ফর্সা হয়নি। দূর থেকেই দেখতে পাই, দক্ষিণের আমগাছের পশ্চিম দিকের সমান্তরাল একটি ডালের মাঝামাঝি নিচের দিকে কালো ছায়ামতো কিছু একটা ঝুলে রয়েছে। কাছে গিয়ে বুঝতে বাকি রইল না যে, ঝুলে থাকা কালো ছায়াটাই আমাদের বড় ভাইয়া।

আমার একান্ত শুভাকাক্সক্ষী অনন্তযাত্রার পথিক। দুধে আলতায় মিশানো গাত্রবর্ণের চেরাগবাতির মতোই উজ্জ্বল রঙ দেখে দাদী নাম রেখেছিলেন ‘চেরাগ আলী’। ভাইয়ের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল বাদামতলী ঘাটের কথা, ‘ও আমার ছোট ভাই, রুই মাছের বড় মাথাটা ওর পাতে দে।’

আমরা পৌঁছার অনেক আগেই ভাই না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। শৌখিন ভাইয়ার গায়ে ছিল হাতাওয়ালা মেরিগোল্ডের কোড়া গেঞ্জি আর কোমরে গিঁটমারা একখান রুহিতপুরী লুঙ্গি। মৃত্যুর পরও যাতে লাশের কোমর থেকে লুঙ্গি খসে না পড়ে সে জ্ঞানও ছিল ভাইয়ের। হ
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট কারীদের চিহ্নিতকরণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ১২ দলীয় জোটের কলিং ভিসায় প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরার সময় মারা গেল মালয়েশিয়া প্রবাসী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিবকে আটকের অভিযোগ হাতিয়া-সন্দ্বীপ চ্যানেলে কার্গো জাহাজডুবি : একজন নিখোঁজ, ১১ জন উদ্ধার হঠাৎ অবসরের ঘোষণা পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়কের বগুড়ায় গ্যাসের চুলার আগুনে বৃদ্ধা নিহত বগুড়ায় ধানের জমিতে পানি সেচ দেয়া নিয়ে খুন জিআই স্বীকৃতির সাথে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে হবে : শিল্পমন্ত্রী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ সখীপুরে সাবেক ও বর্তমান এমপির সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ তীব্র গরমের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার অন্যতম দায়ী : মির্জা আব্বাস

সকল