২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্বজনের টানে বাড়ির পানে

-

‘যেখানে ঐশ্বর্য বেশি সেখানে স্বস্তি কম, যেখানে স্বস্তি বেশি সেখানে ঐশ্বর্য কম।’ হিসাবটা নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতোই নির্ভুল। এ উক্তির মর্ম বুঝতে যে চর্চার দরকার সে চর্চা থেকে পিছিয়ে রয়েছে সমাজ। সমাজের ধারণা, যত ঐশ্বর্য তত সুখ। তাই অন্ধ হয়ে সবাই ছুটছে ঐশ্বর্যের পেছনে। আমাদের পরিবার এর বাইরে ছিল না। এই কঠিন বাস্তবের মূল্য দিতে হয়েছিল সালমাকে। যে বয়সে একটি মেয়েকে সংসারযুদ্ধের জন্য শরীর গড়তে হয়; সেই বয়সে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে শরীর রক্ষার জন্য।

সালমাকে বাড়ি নিয়ে আসার পর, চাকরি ও লেখাপড়ার চাপ ছাড়াও আরো একটি ইন্দ্রিয় সতর্ক রাখা জরুরি হয়ে পড়ে। আমাদের বাড়ির পরিবেশে তাকে উৎফুল্ল রাখা। বাবার কথার ঘায়ে ওর ক্ষত-বিক্ষত কচিমন জোড়াতালি দিয়ে মেরামতসহ ঠিক করে রাখার দায় আমার সাথে মা-ও নিয়েছেন। বাড়ি থেকে প্রতি শনিবার কর্মস্থলে আসার পথে একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাই। তাকালেই মা বুঝতে পারেন আমি কী বলতে চাই। আমার চাহনির উত্তরে বলতেন, ‘বাবারে, তুই তোর কাজ ঠিকমতো কর, আমি আমার কাজ করে যাবো। আমার নিজেরও দুটো মেয়ে আছে। এখন থেকে আমার তিনটি মেয়ে। এ বাড়িতে যুগ যুগ ধরে মাটি কামড়ে পড়ে রইছি আমি। তোর বউকেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। তোর বাবা মুখে যাই বলুক, বউকে বাড়ি থেকে জোর করে তাড়াতে যাবে না। তার মুখ বেঁধে রাখতে পারব না, বরং তোর বউকেই কানে তুলা দিয়ে থাকতে বলিস।’

সালমার মন খারাপ হলেই আমার মন খারাপ হয়। এই দৃশ্য মা সহ্য করতে পারতেন না। তাই আমার মন ভালো রাখার জন্যই সালমার মন ভালো রাখা আবশ্যক হয়ে পড়ে। ওর জন্য মন উদগ্রীব হয়ে থাকার বিষয়টি মা ছাড়া আর কেউ বুঝতেন না। একই গাঁয়ে বাড়ি হলে কী হবে, শ্বশুরবাড়িতে রাত কাটানো দূরের কথা, সময় কাটানোর মতো পরিবেশও ছিল না। তাই যেখানেই থাকুক, আমার ছুটির দিনগুলোতে সালমাকে বাড়ি এনে রাখতেন মা। আমিও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সালমাকে চোখের আড়াল করতাম না। এসব বিষয় নিয়ে পাড়া-পড়শি ও বন্ধু-বান্ধব মহলে রয়েছে নানা মুখরোচক গল্প। ‘বৃহস্পতি’ আমার প্রিয়দিন। শৈশব থেকে প্রথমে মায়ের টানে, পরে মা ও সালমার টানে বৃহস্পতিবারের অপেক্ষায় থাকতাম। এ নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা।

আষাঢ় মাস। ‘আষাঢ়স্য’ শুরু হয়েছে সকাল থেকেই। আমি যে বাড়িতে থেকে শিক্ষকতা করি ওই বাড়ির মালিক চেয়ারম্যান। তিনি নতুন স্কুল করতে যাচ্ছেন। স্কুলের কাগজপত্র দেখাশোনা করি আমি। চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করে শিক্ষক তালিকায় আমার এক কাজিনের নাম দিয়েছি। বিনা বেতনের চাকরি। সরকার স্কুল মঞ্জুরের পর বকেয়াসহ বেতন শুরু হবে। কাজিন বাড়ি থেকে সাইকেলে করে আমার সাথেই আসা-যাওয়া করে। বারোটার দিকে প্রস্তুত থাকতে তাকে আগেই বলে দিয়েছি। দুপুরের দিকে বৃষ্টি কমতেই বাসা থেকে বের হয়ে পড়ি। কাজিনের বাসার সামনে গিয়ে তাড়া করি বের হতে; বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে সাইকেলে করে বাসা থেকে বের হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। লজিং বাড়ি থেকে একবার বের হয়ে গেলে ফেরার কোনো সুযোগ নেই।

আকাশের গুমোট ভাবের সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দেখে কাজিনের মন সায় দিচ্ছিল না। আমার তাগিদে বিরস মুখে সে-ও রওনা হয়। হাইওয়েতে উঠে শরীরের সব শক্তি দিয়ে প্যাডেল চাপতে শুরু করি। কেওঢালা পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই বাড়তে থাকে বাতাসের বেগ। সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মাইল দুয়েক যাওয়ার পর আর এগোতে পারছি না। জাঙ্গাল অতিক্রম করে প্রবল হয় বাতাস, বৃষ্টি দুই-ই। দু’পাশে নেই বাড়িঘর। কী করি!

লাঙ্গলবন্দ এসে নামতে বাধ্য হই। যেমন বৃষ্টি তেমন ঝড়। পেশীতে যত জোরই থাকুক দক্ষিণ থেকে আসা ঝড়-বৃষ্টি ঠেলে দু’জন নিয়ে লাঙ্গলবন্দ ব্রিজে ওঠা সম্ভব নয়। আশপাশে নেই ঘর-বাড়ি। রাস্তায় নেই তেমন যানবাহন। লাঙ্গলবন্দ স্টেশনের ঠিক উল্টো দিকে ছোট্ট একটি দোচালা ঘর চোখে পড়ে। নিরুপায় হয়ে সাইকেল বাম দিকে ঘুরিয়ে দিই। ঘরের কাছে নিয়ে সাইকেল কাত করতেই সামনে বসা কাজিন নেমে পড়ে। বাম হাতে ব্যাগ ধরে ঢুকে পড়ে ঘরে। কাকভেজা হয়ে মুখের পানি মুছতে মুছতে অনুমতি না নিয়ে আমিও ঘরে ঢুকি।

ঢুকেই বুঝতে পারি, এটি কোনো থাকার ঘর নয়। পাগল-ফকিরদের গঞ্জিকা সেবনের আস্তানা। শালু পরিচ্ছদ পরিহিত, জটাধারী, শ্মশ্রুমণ্ডিত কয়েকজন পাগল। গাঁজার কল্কি এক হাত থেকে আরেক হাতে যাচ্ছে আর নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঘর ধোঁয়াময়।

আমাদের দু’জনের উপস্থিতিতে ত্যক্ত-বিরক্ত হলেও বের করে দেয়ার মতো ছিল না। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি; তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরই এক পাশে বসে পড়ি আমরা। কাজিন আমার ওপর বিরক্ত হয়ে বলে, বারবার বলছিলাম, এমন কুদিনে বাসা থেকে বের হবো না, এখন কী করবেন? লজিংবাড়ি ফিরে যাবেন, না বাড়ি যাবেন?

আমি কোনো কথা না বলে মনে মনে ঝড়বৃষ্টির চৌদ্দগোষ্ঠীর শ্রাদ্ধ করছিলাম। আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার বলতে শুরু করে, চলেন ফিরে যাই, এক সপ্তাহ বাড়ি না গেলে কী এমন ক্ষতি হবে!
ফিরে যাওয়ার জন্যও তো বৃষ্টি থামতে হবে। থামলে তো বাড়িতেই যেতে পারি, পনেরো মিনিট সময় পেলেই পৌঁছাতে পারি বৈদ্যেরবাজার। বাকি থাকে নদী পারাপার। ডজন ডজন নৌকা থাকে বৈদ্যেরবাজার ঘাটে। নদী পার হলেই নিজের বাড়ি নিজের ঘর। এ অবস্থায় নিজের বাড়ি নিজের ঘরে না গিয়ে ফের পরের বাড়িতে ফিরে যাওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।

আচ্ছা কেমনে যাইবেন যাইয়েন (অনুচ্চস্বরে বলে কাজিন)।

আমি ও কাজিন এক বাড়িতে এক সাথে বড় হয়েছি। খেলাধুলা ও লেখাপড়াও একই সাথে একই সময়ে। শৈশব থেকে আমাদের তুইতুকারি সম্পর্ক। বিয়ে করার সময় দিদিমার কাছে জানতে পারি, আমি কাজিনের চেয়ে তিন মাসের বড়। তখন থেকে ‘আপনি-তিনি’ সম্বোধন শুরু।

ঘণ্টা দেড়েক পর বৃষ্টি কমতেই বের হয়ে পড়ি। তবে বাতাসের জোর কমেনি। সামনেই লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ। স্বাভাবিক অবস্থায় দু’জন নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠতে পারলেও আজ পারছি না। সাইকেল নিয়ে প্রায় দৌড়ে ব্রিজে উঠি। ব্রিজের ওপর থেকে একটানে ট্রিপহরদী। এখন আর বাড়ি যাওয়া ঠেকায় কে? বাতাস বাড়ছে, বাড়ুক। মোগড়াপাড়ার মোড় ঘুরলে ১০ মিনিটে বৈদ্যেরবাজার। ঘাটে বাঁধা নৌকা। নৌকায় ঠেলতে হবে উজান পানি। কোনো চিন্তা নেই। দক্ষ মাঝি এক ঘণ্টায় পার করে দেবেন মেঘনা।

আমরা যখন বৈদ্যেরবাজার তখন ঘন কালো মেঘে দিনের আলো ফিকে হয়ে আসছিল। তালেব ভাইয়ের দোকানে সাইকেল রেখে খেয়াঘাটে যাই। হায় আল্লাহ, খেয়াঘাট খালি। দক্ষিণ দিক থেকে বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে খেয়াঘাটে। কেউ কেউ বলছে, ঢেউ থেকে বাঁচানোর জন্য মেনিখালির খালে ঢুকে পড়েছে সব নৌকা।’ দৌড়ে যাই মেনিখালির মুখে। সেখানেও কোনো নৌকা নেই।

এমন সময় ঘাটে একটি লঞ্চ ভেড়ে। নারায়ণগঞ্জ থেকে রামচন্দ্রপুরগামী। লঞ্চটি চন্দনপুর হয়ে হোমনা, তার পর রামচন্দ্রপুর। আমাদের বাড়ি তো চন্দনপুর ইউনিয়নে। চন্দনপুর যাওয়া মানে, মেঘনা পার হয়ে নিজের ইউনিয়নে যাওয়া। চন্দনপুর ঘাটে কোষা নায়ের অভাব নেই। চন্দনপুর থেকে আমাদের গাঁয়ে আসতে আর কোনো নদী পার হতে হবে না। ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে লগি ঠেলে অল্প সময়ের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছা যাবে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা পর্যন্ত থাকে কোষা নায়ের চলাচল।

আল্লাহর নামে তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠি। আমাদের গাঁয়ের পাশ দিয়েই যায় লঞ্চ। এতক্ষণ মা ও সালমা নিশ্চয়ই আমার কথা ভাবছেন। শত ঝড়বৃষ্টি হোক, আমার বাড়ি আসার বিষয়ে মা নিশ্চিত। আমার মনের কথা আগেই টের পেয়ে যান মা। ওই তো আমাদের ঘর দেখা যায়। ঘরে মায়ের সাথে নিশ্চয়ই রয়েছে সালমাও। লঞ্চ দিয়ে যখন বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ইচ্ছে করছিল, দিই এক লাফ। লাফ দিয়ে নেমে পড়ি নদীতে। সাঁতরে চলে যাই বাড়িতে। ভেজা কাপড়ে সালমার সামনে গিয়ে, তোমার কাছে চলে এসেছি; আটকে রাখতে পারেনি ঝড়-বৃষ্টি, নদী; মেঘনা সাঁতরে এখন আমি তোমার সামনে। বিশ্বাস না হয় ছুঁয়ে দেখো।

ভাবনা শেষ হওয়ার আগে মৌশার চর ঘুরে লঞ্চ চন্দনপুরের দিকে। লঞ্চ যখন চন্দনপুর ঘাটে ভিড়ে তখন দিনের আলো শেষ। দোকানে দোকানে হারিকেন জ্বলছে। দিন খারাপ দেখে বাজারেও নেই লোকজন, নেই পারাপারের নৌকাও। এখন উপায়? উপায় একটা আছে। শিবনগর আমার বড় ফুফুর বাড়ি। ফুফুর বাড়ি গেলে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার সব ব্যবস্থা তারাই করে দেবেন। চন্দনপুর পার হয়ে তার পরেই শিবনগর।

বর্ষা-বাদলের এরকম দুর্যোগময় রাতকে বলা হয় ‘মেঘআন্ধারি রাত’। মেঘআন্ধারি রাতে কেউ বাইরে বের হয় না। গাঁয়ের মানুষ সুখের ঘুম যায় এমন রাতে। আহ মেঘআন্ধারি রাতে সালমা পাশে থাকলে কী মজা হতো। যেই না বাড়ির কথা ভাবতে শুরু করেছি অমনি আচমকা পা পিছলে ছিটকে পড়ি এক গাছের গোড়ায়। উহ ডান পা-টা বুঝি মচকেই গেল। গাছের তলা দিয়ে পুরান এলাকার রাস্তাঘাট, দিনের বেলা খুঁজে বের করাই কঠিন। উঁচু-নিচু পিচ্ছিল অমসৃণ পথ। রাস্তায় কোনো মানুষজন নেই।

অন্ধকারে এক হাত দূরেরও কিছু দেখা যায় না। এ এলাকার রাস্তাঘাট সম্পর্কে আমাদের তেমন একটা পরিচয় নেই। পথ খুঁজতে গিয়ে একবার চলে যাই পাকের ঘরে, আবার চলে যাই গোয়ালঘরে। একবার পা পিছলে হুড়মুড় করে পড়ি ছাগলের খোঁয়াড়ে। পায়ের তলায় পড়ে ভ্যাঁ করে ওঠে ছাগল ছানা। ঘর থেকে লাঠি হাতে ‘চোর চোর’ বলে বের হয় লোকজন।

আমরা চোর নই, অমুক গাঁয়ের লোক।

অমুক গাঁয়ের লোক তো এই অন্ধকারে এখানে কী? প্রতি রাতে গাঁয়ে ছাগল চুরি হচ্ছে, তোমরা যে ছাগল চোর নও তার প্রমাণ কী?

চন্দনপুর মাদরাসার হাফেজ সাব আমাদের পরিচিত, বাড়ি থেকে দুঃসংবাদ পেয়ে অসময়ে রওনা হয়ে চন্দনপুর এসে কোনো নৌকা পাইনি। গাঁয়ের পথঘাট চেনা নেই, পায়ের চটি হাতে নিয়ে দু’জন দাঁড়াই গিয়ে ঘরের দরজার সামনে, ভালো করে দেখেন তো, আমরা কি দেখতে চোরের মতো?

বিস্তারিত পরিচয়ের পর এক লোকের দয়া হয়, হারিকেন হাতে আমাদের পৌঁছে দেয় চন্দনপুরের খাল পর্যন্ত। খালের ওপর পুল। পুল পার হয়ে নতুন রাস্তা। চন্দনপুর পুলের গোড়া থেকে লইট্টার বাগের দক্ষিণ দিক দিয়ে শিবনগর পর্যন্ত নতুন সড়ক।

আর চিন্তা নেই, নতুন সড়ক ধরে রাজার হালে হাঁটতে হাঁটতে সোজা বড় ফুফুর বাড়ি। বড় ফুফুর বড় ছেলে বাছেদ আমাদের সমবয়সী। বাছেদ নৌকার ব্যবস্থা করে দেবেই।

নতুন সড়ক মানে, একেবারে নতুন। মাটি ফেলার কাজও শেষ হয়নি। বৃষ্টির পর এসব নতুন সড়ক হাঁটার জন্য কী পরিমাণ বিপজ্জনক তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝানো যাবে না। তদুপরি ঘুটঘুটে অন্ধকার। একবার পা পিছলে ডান দিকের খাদে পড়ি, আবার পড়ি বাম দিকের খাদে। কাজিন যতবার খাদে পড়ে ততবারই অভিসম্পাত দেয় আমাকে। এখন আর প্রতিবাদ করি না। প্রতিবাদ না করে সব অভিসম্পাত মুখবুজে হজম করে যাচ্ছি।

যখন বড় ফুফুর বাড়ির উঠানে আসি তখন রাত একটা। এঁটেল মাটির ভেজা কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দু’জনই মাটির মূর্তি। এ মূর্তি নিয়ে কারো সামনে যাওয়া যাবে না। এই দুর্গতির রহস্য উদ্ধার করতে গেলেই হাসির পাত্রে পরিণত হবো। তাই সত্য বলা যাবে না কিছুতেই।

দু’জন নতুন গল্প বানিয়ে বাছেদ ভাইকে ডাকি। ঝড়বৃষ্টির রাতের কাঁচা ঘুম। কঠিন ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে। দুর্গতির কারণ সম্পর্কে আমাদের গল্প শোনার পর, মাঝির বাড়ি নিয়ে যায়। আরামের ঘুম ভাঙতে চায়নি মাঝিরও। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর ঘুম ভাঙে। এত রাতে কিছুতেই যাবে না মাঝি। ততক্ষণে মেঘ কেটে আকাশে ঝলমল করছে তারা। পরিশেষে ভাড়ার পরিমাণ ১০ টাকায় পৌঁছার পর মাঝির বউ মাঝিকে রাজি করায়। ঠিক হয়, নামিয়ে দিয়ে আমাদের বাড়ির ঘাটেই নৌকা রেখে শুয়ে থাকবে মাঝি।

নৌকা দিয়ে আসার পথে পরিধেয় বস্ত্রাদি একে একে খুলে ধোয়া-মোছা শুরু করি। গামছা পরে গাঙের পানিতে কাদামাখা জামাকাপড় ধুয়ে ফেলি। ঝুপ করে পানিতে নেমে ধুয়ে ফেলি শরীরও। কাদাজল লাগা বস্ত্রাদি স্রোতের পরিষ্কার পানিতে খলাই। ভেজা বস্ত্রাদি ব্যাগের এক কোণে রেখে শুকনো জামাকাপড় পড়ে মাথা চিরুনি করে জামাই জামাই সাজে সজ্জিত হয়ে আবার নতুন গল্প বানাতে শুরু করি। প্রকৃত ঘটনা কিছুতেই বউকে জানানো যাবে না। বলতে হবে পুরুষোচিত গল্প।

কাজিন আমার ওপর অমনিতেই চটে ছিল। তাই বারবার মিথ্যা গল্প বলতে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলাম না। কাজিনকে বোঝাতে চাই, সত্যি কথা বলতে গেলে বউয়ের কাছে চিরদিনের জন্য ছোট হয়ে যাবো। বউয়েরা নিজেরা যা নয়; তা ভেবে কথায় কথায় আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, স্ত্রৈণ ও বউ-পাগল বলে সারাজীবন খোঁটা দেবে। বউয়ের কাছে ছোট হয়ে গেলে আমাদের স্বামীত্বের কী হবে, একবার ভেবে দেখেছ?

ছোট হলে আপনি হবেন, আমি হবো না, আমি সব বলে দেবো, আমি কিছুতেই আসতে চাইনি, আপনি আমাকে জোর করে নিয়ে এনেছেন।

(মনে মনে বলি, আসতে চাইবি কেন, তোদের একেকজনের বউ তো শ্যাওড়া গাছের পেতœী। একজন বাড়িতে আসতেই চাসনে, আরেকজন বউ দেখলে পালায়। মেল-দরবার করে একসাথে রাখতে হয়। আর আমার বউ ঠিক যেন জীবনানন্দ দাশের--

“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চার দিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”

হাজার ক্লান্তির পর যে দু’দণ্ড শান্তি দিতে পারে সে-ই-তো বউ। দু’দণ্ড শান্তিদায়িকা বনলতা সেনের কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যাই।)

এখনো ঢের রাত বাকি। আমার বনলতা সেনের জন্য আজই হবে সেরা সারপ্রাইজ।

এখন ঘরে প্রবেশের বিষয়টি কিছুতেই বাবাকে জানতে দেয়া যাবে না। এমনিতেই বাবা ‘ছলেমোনের জাত’কে ছলনাময়ী মায়াবিনী আখ্যা দিয়েছেন, আজকের ঘটনা জানাজানি হলে বাবার অভিধানে সালমার নামের সাথে নতুন একটা ‘জাদুকরী’ খোঁটা যোগ হবে। আমার কারণে নতুন খোঁটা সে সহ্য করবে না। খোঁটা সালমার পোড়াঘায়ে নুনের ছিটা মনে হবে। নুনের ছিটায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতাম আমি। আজকের ঘটনা বাবার কানে পৌঁছালে সালমাকে খোঁটার অস্ত্র আরো একটি বাড়বে। তাই কাজিনকে ফের অনুরোধ করে--

মিথ্যা বলিস না, অন্তত এইটা বলিস, আমরা দিনের বেলায়ই আইছিলাম। চন্দনপুর ছাত্র ইউনিয়নের মিটিং ছিল। নতুন কমিটি গঠনের মিটিং। সেখানে ছিল ভূরিভোজের আয়োজন। মিটিংসহ খানাপিনা শেষে ওরাই নৌকা করে বাড়ি দিয়ে গেছে। সত্যিকার বিষয়টি জানাজানি হলে সবাই আমাকে বউপাগল আখ্যা দিবে ভাই।

এ আর নতুন কী! আপনাকে সবাই এমনিতে বউ পাগল বলে। আপনি এক মুহূর্ত বউয়ের আঁচল ছাড়তে পারেন না। বউয়ের সাথে দেখা করতে যারা ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে দিনের ১২টায় রওনা হয়ে রাতের ৩টায় বাড়ি আসে তারা বউপাগল নয়তো কী?

পরিশ্রম করে লব্ধ জিনিসের দাম আর অনায়াসে প্রাপ্ত বস্তুর মূল্য এক নয়। জীবনে কত রাতই তো আসে যায়, হাজার রাতের মধ্যে আজকের রাত না হয় নতুন বউয়ের জন্য সেরা সারপ্রাইজ হয়ে থাকবে।

অনেক তেলমারার পর কাজিন মিথ্যা বলতে রাজি হয়। আরো রাজি হয় চুপচাপ ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে যেন শুয়ে পড়ে। কাজিনের বেলায় চুপচাপ শুয়ে পড়া সম্ভব হলেও আমার তা সম্ভব হলো না। বছরের সেরা সারপ্রাইজ দিতে মাকে না ডেকে জানালার ফাঁক দিয়ে কাঠি ঢুকিয়ে বউকে জাগানোর চেষ্টা করি। কাঠির সাথে অনুচ্চস্বরে নাম ধরে ডাকাডাকিও করি। সালমা টের পাওয়ার আগেই টের পান মা। দরজা খুলে আমায় দেখে বিস্মিত হয়ে--

এত রাতে?
মা তুমি দরজা খুলেছ সালমা কোথায়?
(অপরাধীর মতো) বাবারে এমন দিনে তুই কেমন করে এলি? ঝড়-বৃষ্টির কারণে সালমাকে আনার জন্য ঘর থেকে বেরই হতে পারিনি।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের চুয়াডাঙ্গায় হিট‌স্ট্রো‌কে যুবকের মৃত্যুর ৭ ঘণ্টা পর নারীর মৃত্যু ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াল, যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৬ শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু

সকল