২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সব ‘রতন’ আমলাদের ভাণ্ডার কোথায়?

-

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটি সনেটের প্রথম ছত্র ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। প্রাসঙ্গিক কারণেই সনেটের এই ছত্রটি মনে পড়ল। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনকে কেন্দ্র করেই সেটি মনে উদয় হয়েছে। কেননা, ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী জোটে অন্যতম মিত্র একটি ছোট দল; পরপর দুই দফা নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত সার্চ কমিটিতে তাদের পেশকৃত নামের তালিকা থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও একজন ব্যক্তি কমিশনার পদে অভিষিক্ত হন বলে পত্রিকার খবরের প্রকাশ। হুদা কমিশন ও আউয়াল কমিশনের দুই সিইসি এবং দুই কমিশনে একে একে দুই ব্যক্তি কমিশনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। সার্চ কমিটিতে নাম পেশকারী দলটির ‘গঞ্জ’ কপালই বলতে হবে। জানি না, এটা কতটা কাকতালীয়। কিন্তু মনে একটা প্রশ্নের উদয় হয়েছে যে, ‘রতন আমলাদের’ নাড়ি-নক্ষত্র সব কিছু সেই দলের ‘ভাণ্ডারে’ জমা থাকল কিভাবে! তারা কি পাঁচ বছর ধরে ‘রতন’ আমলাদের অনুসন্ধান করতেই ব্যস্ত থাকেন, ইসি গঠন নিয়ে সার্চ কমিটিতে নাম পেশের জন্য? তাদের ভাণ্ডারে, আমলা-রূপ খনি, পূর্ণ কি তাদের মনিজাল? আমাদের আর একটা জিজ্ঞাসা, একটি ছোট দলের সন্ধানে যদি সব ‘রতন’ আমলাদের তালিকা মজুদ থাকতে পারে, তবে প্রবীণ আমলানির্ভর সার্চ কমিটির এত দৈন্য কেন?

সৎ যোগ্য দক্ষ দৃঢ় শিরদাঁড়াসম্পন্ন আমলাদের খবর তাদের কাছে থাকবে না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য! তবে কেন তারা পরের মুখে ঝাল খেতে চান? হয়তো সেটি কারো কাছেই বোধগম্য নয়! কথা হচ্ছে, জনগণ চায়, নির্ভাজ সৎ যোগ্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি গঠন। রাজনৈতিক দলের বাছাই করা ব্যক্তিরা কি নিজ দলের পছন্দের বাইরের কোনো ব্যক্তি হবেন? রাজনৈতিক দলের কাছে নাম চাওয়ার অর্থই হচ্ছে নিরপেক্ষ চেতনাপরিপন্থী, এটা সার্চ কমিটির বোধগম্য হয়নি! জাতি যে দায়িত্ব তাদের ওপর দিয়েছিল সেখানে কাজ করতে অপারগ হলে তাদের তো সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কারেজ থাকা উচিত। জাতির সাথে ‘গেইম’ খেলার প্রয়োজনটা কী? মানুষ মুখে কিছু বলে না বটে কিন্তু সব কিছু বোঝার ক্ষমতা এখনো লোপ তাদের হয়নি।

নতুন সিইসি প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি ও তার সহযোগীরা কাজ করবেন। আমরা তার শুভ কামনা করি এবং তাকে স্বাগত জানাই। তার অঙ্গীকারের পাশাপাশি তিনি যদি বলতেন, বিগত দুই নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতাগুলোকে স্মরণ করে তা থেকে দূরে থাকার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা থাকবে বলে আমরা আশা করি। তাদের দুর্বলতাগুলোর কারণে দুই সংসদ নির্বাচন ‘ফান’ বলে দেশে-বিদেশে সর্বত্রই সেটি গভীর হতাশা এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। তা ছাড়া বিগত দিনে তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য এতটুকু অনুতাপ তারা তো প্রকাশ করেননি, বরং আত্মপ্রসাদের ঢেঁকুর তুলেছেন বারবার। বিগত দুই কমিশনই সংবিধান সংরক্ষণের শপথ গ্রহণ করেছিল বটে; কিন্তু তাকে উচ্চকিত করেনি। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে স্বশাসিত এবং তাদের কর্মসম্পাদন তথা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্বাধীন হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু তাদের সামগ্রিক কার্যক্রম তাদেরকে একটি ‘অনুগত প্রতিষ্ঠান’ বানিয়ে দিয়েছে। তাদের আচরণে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ‘অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী’ বলে মনে হয়েছে। আমাদের সংবিধানকে নানা বিবেচনায় ‘অনন্য’ অভিহিত করা হয়। তার একটি কারণ হয়তো এটাই যে, এই সংবিধান দেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সেখানে যথেষ্ট বিধিবিধান সন্নিবেশিত রয়েছে। আর গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু তো নির্বাচন, তাকে পরপর দু’টি কমিশন ধ্বংস করে দিয়েছে।

আমরা দেখেছি বর্তমান সিইসি ও একজন কমিশনার তো পুরোপুরি আইনের মানুষ, তাদের জীবন আইন নাড়াচাড়ার মধ্যে কেটেছে। অপর একজন নির্বাচন কমিশনের সচিবের দায়িত্ব পালনে সুবাদে নির্বাচনী আইন কানুন তার নখদর্পণে। তাই সবাই আশা করেন, এই কমিশন আইনের চেতনার প্রতি তাদের বিনম্র শ্রদ্ধা রাখবেন এবং তার বিধানগুলো প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কিছুমাত্র ব্যত্যয় তাদের হবে না যে ব্যত্যয় আমরা অতীতে লক্ষ করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, আইন মানুষ ও সমাজকে শৃঙ্খলার বাঁধনে আবদ্ধ করে। মানুষের অধিকারের সুরক্ষা, যাবতীয় বৈষম্য বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করে। সেই সমাজেই সব সুরক্ষিত, সভ্য, সুন্দর সুশৃঙ্খল যেখানে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত।

তবে একটা কথা ব্যক্তি সমাজকে অবশ্যই মনে রাখতে এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিতে হবে - সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ষোলো আনার ১০ আনা, বাকি ৪ শতাংশ কিন্তু পুরোপুরি সরকারের এবং বাকি ২ শতাংশ ক্ষমতাসীনদের বাইরে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের। সে জন্য সব দায় কমিশনের ঘাড়ে চাপানো যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং বিগত নির্বাচনগুলোতে দেখেছি, সরকারি প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের ভূমিকা।

সেসব নির্বাচনে দেখা গেছে, নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এবং ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনী কেন্দ্রকে ঘিরে এমন অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করে যার ফলে সাধারণ নিরীহ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে আর নিরাপদ বোধ করে না। এর পরও কেউ যদি সাহস করে কেন্দ্রে যান তাদের নাজেহাল হতে হয়। কেউ নির্বাচনী বুথে পৌঁছে দেখেন তার ভোট কে বা কারা দিয়ে দিয়েছে। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে দায়িত্ব না হয় নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের; কিন্তু সেখানে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ঢোকে কিভাবে? ভোটকেন্দ্রের চত্বরের শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব সরকারের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের ওপর। এরা তো কখনোই এসব বিশৃঙ্খলা বন্ধের জন্য ভ‚মিকা রাখে না। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের কেন্দ্রের ধারে কাছে যে প্রলয়নৃত্য করতে দেখা যায় আর গগনবিদারী স্লোগানে কেন্দ্রকে প্রকম্পিত করে থাকে, এসব কে দেখবে, বিহিত করবে কে? তাদের তো বলে কয়ে কিছু করার সাহস কেউ দেখাতে পারে না। কোথাও কোথাও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী সমর্থকরা নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য বুঝে এমনই কাণ্ড ঘটায়।

অথচ ১০ বছর আগে তো পরিস্থিতি এমন ছিল না। ভোট এলে দেশের জনগণ তাকে উৎসব আনন্দের মৌসুম হিসেবেই দেখেছে। কেউ ভোটদানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, পরিবেশ বিনষ্ট করা, ভোটকেন্দ্র জোর-জবরদস্তি দখল, ভোটের বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্রে হাঙ্গামা সৃষ্টি, মারধর, লাঠি মারামারি, অস্ত্রবাজি, মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। কিন্তু সেটিা এখন ভোটের সাথে একীভূত হয়ে গেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া, পরমতসহিষ্ণুতা, নির্বাচনে ফলাফল মানুষের ভোটকে ভিত্তি করে, যা এখন উঠে গেছে। উচ্ছেদ করা হচ্ছে সব সদাচরণ, শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা; বহু দিনের গড়ে ওঠা নির্বাচনী শৈলী তিরোহিত হয়েছে।

আসা যাক, নতুন কমিশন গঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা নিয়ে। সেখানে মিশ্র প্রতিক্রিয়াই লক্ষ করা যায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নবগঠিত কমিশনকে স্বাগত অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি সব কাজে কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই ইসির অধীনে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। অন্যতম বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে সৃষ্ট সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আন্দোলন-সংগ্রামের বিকল্প নেই। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। ১৯৯১ সালের মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে। এভাবেই এই সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, এই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাদের কার্যক্রমে বোঝা যাবে তারা কতটা নিরপেক্ষ।

রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম সংগঠন, ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রধান চরমোনাইয়ের পীর নতুন কমিশনের কাছ থেকে ইতিবাচক কিছু আশা করেন না। অতীতে দুই কমিশনের মতো নতুন কমিশন স্বতন্ত্র কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না বলে মনে করেন। যা হোক, এখনো সরকারি দলের বাইরে কোনো সংগঠনই নতুন ইসিকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেনি। তবে নতুন ইসি এমন আশ্বাস দিচ্ছেন যে, তারা ভালো কিছু করার চেষ্টা চালাবেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে আরো অনেকেই নবগঠিত ইসি নিয়ে তাতে মতামত দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নিয়ে গবেষণা কার্যক্রমে লিপ্ত তোফায়েল আহমদ বলেছেন, আমরা আশা করব ভালো নির্বাচন আয়োজনের জন্য জাতির যে প্রত্যাশা, সেই লক্ষ্যে তারা (নির্বাচন কমিশন) কাজ করবে। এ কাজে তারা সবসময় যে সফল হতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তারা চেষ্টা করছেন, এটি বুঝতে পারলে জাতি হয়তো খুশি হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে গত দুই কমিশনের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। তারা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। বিশেষ করে সদ্যবিদায়ী কমিশন সবচেয়ে খারাপ কাজ করে গেছে। বর্তমান কমিশনকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্তরা যদি তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন এবং সে মোতাবেক কাজ করেন তবে অবশ্যই ভালো কিছু করতে পারবেন। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করবেন কি না বা করতে পারবেন কি না তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণারত অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন প্রধানের একমাত্র কাজ হবে ভালো নির্বাচন করা যা দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেসব কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন তাতে সংশয় তৈরি হচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এখনই বলছেন, নির্বাচন খারাপ হলে শুধু কমিশনের ওপর দোষ চাপিয়ে কোনো লাভ নেই - শুরুতেই এসব কথা বলা সমীচীন নয়। তাহলে কি তারা মনে করছেন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন না।

‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আস্থার সঙ্কট কাটিয়ে সবার অংশগ্রহণে ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই নতুন ইসির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। আগের মতো এবার অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সদ্যবিদায়ী কমিশন সবচেয়ে খারাপ কাজ করে গেছে। তাদের প্রতি মানুষের আস্থার সঙ্কট থেকেই গেছে। এটা কাটিয়ে ওঠাই তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক আরো বলেন, আইনে পরিষ্কার বলা আছে স্বচ্ছতার সাথে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে, কোন রাজনৈতিক দল কাদের নাম প্রস্তাব করেছে তা প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মহলের দাবির মুখেও সেটি করা হয়নি। কোন দল কার নাম প্রস্তাব করেছে তা প্রকাশ করা দরকার ছিল। উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেটি করা হয়নি। এতে আগের মতোই এই নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হওয়ায় জনগণের আস্থার সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছে। এতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অনুসন্ধান কমিটি।

যেসব সুধীজনের প্রতিক্রিয়া এখানে উদ্ধৃত করা হলো সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ নতুন ইসি সম্পর্কে খুব একটা আশাবাদী বা উৎসাহ বোধ করছেন, তেমন আভাস নেই। তবে একটি জাতীয় দৈনিক সম্প্রতি শিক্ষিতজন, প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ও ব্যবহারে সক্ষম লোকদের মাঝে অনলাইন একটি জরিপ পরিচালনা করেছেন। সে জরিপে অংশ নিয়েছিলেন ৩০ লাখ ১৮ হাজার ৪৫১ জন। সে জরিপের একটি মাত্র প্রশ্ন ছিল, প্রশ্নটি হলো, ভোটাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার ফাঁকা বুলি নয় - সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই বক্তব্যের সাথে আপনি কি এক মত? ‘হ্যাঁ’ সূচক মত দিয়েছেন মাত্র ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ। আর ‘না’ সূচক মত দিয়েছেন জরিপের অংশগ্রহণকারী ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ। মতামত নেই, এমন কেউ ছিলেন না। ৩০ লক্ষাধিক মানুষের মতামতের গুরুত্ব আশা করি, ইসি উপলব্ধি করবেন। ইসি সম্পর্কে মানুষের মনোভাব যে কত তিক্ত, এ থেকে তা বোধগম্য হয়। এই মতামতের একটা পটভূমি রয়েছে। গত ১০ বছরে রকিব-হুদা কমিশন তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ইসির ভাবমর্যাদা যে কোন তলানিতে নিয়ে গেছে তার প্রতিফলন এই জরিপে উঠে এসেছে। আসলে ইসির প্রতি কোনো আস্থা বিশ্বাস এখন আর মানুষের মধ্যে নেই। এটা ফেরানো সহজ নয়। এখানে সরকারি ভূমিকা গৌণ করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। স্মরণ রাখা দরকার, সাবেক সিইসিদ্বয়ের ভূমিকা আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো কোন ঘরোয়া বিষয় আর নেই। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তা এখন যথেষ্ট ছড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রের হালহকিকত নিয়ে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা, সংগঠন গবেষণা-অনুসন্ধান চালায় তাদের সেসব মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ পায়, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান লজ্জাজনক পর্যায়ে রয়েছে। তা ছাড়া মার্কিন প্রশাসনও বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের যে পর্যবেক্ষণ তাও প্রকাশ করে। সেখানেও আমাদের সম্মানজনক অবস্থান নেই। এ জন্য দায়ী তো ইসি বটেই। তবে এ জন্য ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দায়মুক্তির অনুমোদন দেয়া যায় না। যে দেশের প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, গত ৫০ বছরে তা প্রতিষ্ঠা পায়নি। এ জন্য দায়িত্ব তো বহুপক্ষকে নিতে হবে। নতুন কমিশনের কাছে সুধী সমাজের প্রত্যাশা, ভোট ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করা তথা প্রতিষ্ঠানকে একটা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যাতে কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা মজবুত ভিত্তি পায়। নিছক ‘বোল চালে’ তা সম্ভব নয়। রকিব-হুদা কমিশনের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে তা ‘মেরামত’ করে কমিশন এমন জায়গা নিয়ে যাওয়া উচিত, যেখানে চাপতাপ উভয়ই আসবে সন্দেহ নেই। তা থেকে উতরে যাওয়ার কৌশলটা এখনই রপ্ত করতে হবে, শিরদাঁড়াকে অবশ্যই শক্ত করতে হবে। এসব নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করা জরুরি। কমিশনকে সামনে চলার একটি রোডম্যাপ তৈরি করে নিতে হবে। সামনে তো কয়েক হাজার নির্বাচন রয়েছে। প্রথম অগ্নিপরীক্ষাটি হবে কুমিল্লায়। সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে এ বছর মে মাসে। একটি দেশের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে সে দেশের গণতন্ত্রের ব্যারোমিটার হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সবার জানা, বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্র, এ নিয়ে সরকার প্রশাসন গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে জন্য একটি অযোগ্য অদক্ষ পক্ষপাতদুষ্ট একটি নির্বাচন কমিশন কতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেটি সবার কাছেই বিরাট একটা প্রশ্ন। ত্রয়োদশতম ইসিকে ভাবতে হবে যে, ফ্রিস্টাইল নির্বাচন বিগত দুই ইসির আমলে চলেছে, তার ইতি ঘটাতে হবে। সেসব কর্মকাণ্ড মানুষের ভোটাধিকার তথা সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করেছে। অথচ সব কমিশনের নেতাই এই শপথবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘আমি সংবিধান সংরক্ষণ সমর্থন নিরাপত্তা বিধান করিব’। এই শপথবাণীর মূল চেতনা হচ্ছে কমিশনের নেতা হিসেবে গণতন্ত্রকে সমুন্নত করা।

কমিশনে নেতাদের বিবেচনায় রাখতে হবে নেতৃত্ব অর্থ হলো, ক্ষমতা, নেতাদের শোনা ও পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা। সব স্তরের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আলোচনা করা ও উৎসাহদানের জন্য নিজেদের দক্ষতাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা, জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে নিজেদের মূল্যবোধ, জন আকাঙ্ক্ষাকে বোঝা ও দূরদর্শিতাকে স্পষ্টভাবে করার ক্ষমতা। এসব তাত্ত্বিকদের বিবেচনা। আজ জাতির অনেক আশাভরসাই নয়া নির্বাচন কমিশনের কাছে। স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কামনা করে মানুষ অনেক দৌড়েছে, জাতি এক ক্লান্ত প্রাণ, তাকে একটু শান্তি স্বস্তি দেয়া প্রয়োজন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি, ভাবি, এই চেতনার সাথে সংযুক্ত রয়েছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র যদি আহত হয় সেই চেতনাও আহত হবে। আজ তো শুধু আহত মুমূর্ষু অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। নয়া কমিশনকে তার যথাযথ শুশ্রূষা করতে গণতন্ত্রে প্রাণ নির্বাচনের প্রাণ বায়ু এখন বেরিয়ে যেতে বসেছে। এটা তাদের রুখতে হবে।

আমরা দেশের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে উন্নয়নের নানা কথা শুনি। বলা হচ্ছে, আমরা নাকি এখন উন্নয়নের মহাসড়কে খরগোশ গতিতে চলছি। অবশ্য দেশে কিছু কিছু বড় স্থাপনা, ব্রিজ, মেট্রোরেল, সুড়ঙ্গ পথ এসব দেখছি। এসব কেবল উন্নয়নের প্রতীক নয়। ঢাকা শহরে এখন দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ন্যাযমূল্যে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে হাজারো মানুষের দীর্ঘ সারি। এর সাথে উন্নয়নের সাযুজ্য কতটা?

যাক, সে বিতর্কে যেতে চাই না। দেশে আরেকটা বিষয় সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে, যা মহামারীর মতো সর্বত্র ছড়ানো, তা হচ্ছে দুর্নীতি। এর কারণ ব্যক্তি সমাজ প্রশাসনে এখন কোনো জবাবদিহিতা নেই, জবাবদিহিতা তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সজীব সক্রিয় থাকে। একটা কথা মশহুর আর সেটি হলো উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পরস্পর সমান্তরালভাবে চলে, একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অপরটি সুস্থ থাকার কথা নয়। দেশে গণতন্ত্রের অধোগতির জন্য এখন রাষ্ট্রীয় জীবনে জবাবদিহিতাও নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। তাতে দুর্নীতির প্রসার ঘটে এবং উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ লোপাট হয়। উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন হতে পারে, জবাবদিহিতার সংস্কৃতি কিভাবে পোক্ত হতে পারে? তার একটি পথ, যদি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সৎ, যোগ্য মানুষ জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদে আসতে পারে।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement