১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইউক্রেনের হার লুকানোর প্রক্রিয়া শুরু?

-

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি শেষ? না, ঠিক শেষ নয় তবে বাইডেন-জেলেনস্কির হার লুকানো যায় কিভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে; তা বলা যায়। কথাটা আরেকভাবে বললে, মূলত আমেরিকার বাইডেন আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছেন যে, এই যুদ্ধ তারা এখন শেষ করবেন। মানে কি তারা হার স্বীকার নেবেন? এটিই সবচেয়ে মুশকিলের কাজ। তাই যদিও এ কথাটা স্পষ্ট করে তারা উভয়ে স্বীকার করবেন না; মনে হচ্ছে এটিই তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তারা যুদ্ধে হেরে গেছেন এটি স্বীকার না করেও কিভাবে যুদ্ধটা শেষ করা যায় এটিই তারা এজেন্ডা নিয়েছেন ইতোমধ্যেই। আর তা বাস্তবায়ন করতে এক তৎপরতা তারা উভয়েই শুরু করে দিয়েছেন। আর সে তৎপরতার প্রথম এবং প্রধান প্রকাশ ঘটেছে এক সাক্ষাৎকারে। আমেরিকার স্থানীয় মানে অভ্যন্তরীণ দর্শকের (গ্লোবাল দর্শক নয়) কথা মাথায় রেখে প্রচারিত হয়, এমন এক টিভি প্রোগ্রামের নাম হলো এবিসি নিউজ। নিউ ইয়র্কের এবিসি নিউজ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির এক সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে আমেরিকার গত ৭ মার্চ রাত আটটায়। এজেন্ডা-ঘটনার প্রকাশ্য পাবলিক অ্যাকটিভিটি শুরু হয়েছে এখান থেকে।

বাইডেন ঠিক কিসে হারলেন?

বাইডেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে গেলেন। কী ছিল এই যুদ্ধ, বাইডেনের কাছে? সেটিই আগে স্পষ্ট জেনে নেয়া যাক। সংক্ষেপে শিরোনামে বললে, ডেমোক্র্যাট নেতা বাইডেন বলতে চেয়েছিলেন, রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প মাথা মোটা। তুলনায় তার মাথা ঠাণ্ডা এবং সূক্ষ্ম ও কূটবুদ্ধি তার বেশি। তাই তিনি দেখতে পেয়েছেন, আমেরিকার নেতাগিরি ফুরিয়ে যায়নি। আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব এখনো অটুট আছে ও থাকবে আর তা রাখা যাবে; যদি বাইডেনের মতো প্রেসিডেন্ট আমেরিকার সক্ষমতা হিসেবে যেসব টুলস বা হাতিয়ার এখনো অ-ব্যবহারে পড়ে আছে সেগুলো ব্যবহার করতে শুরু করেন। এমন দুটো আমেরিকান অস্ত্র হলো এক. অবরোধ আরোপ (মানে অপছন্দ বা শত্রু বিবেচিত দেশকে আমেরিকান ডলারে বৈদেশিক বাণিজ্য করতে না দেওয়া) আর দুই. মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা।

তাই এই দুই হাতিয়ার ব্যবহার করেই বিনা অস্ত্রে ও সামরিক তৎপরতা ছাড়াই তিনি চীন ও রাশিয়াকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করতে পারবেন আর এভাবে আমেরিকার নেতৃত্ব অটুট রাখতে পারেন।

বাইডেন এ উদ্দেশ্যেই ইইউকে পাশে নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে যুদ্ধে এনেছিলেন। এখন বাইডেন রাশিয়া-ইউক্রেন এই যুদ্ধেই হেরে গেলেন। তিনি এখন রাশিয়া-ইউক্রেনের আপস কিভাবে ঘটানো যায় তা নিয়ে ব্যস্ত!

মজার কথা হলো, এখন বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতার শপথ নেয়ার পরেই যখন তিনি এ দুই (অবরোধ ও মানবাধিকার) মহা অস্ত্রের কথা ইইউ নেতাদের জানান তারা এটাতে বিশ্বাস করেছিলেন। পেছনের গল্প-ভাবনাটা ছিল সম্ভবত এরকম যে, আমেরিকার হাবিলদার হয়ে যদি আরো কিছু দিন দুনিয়ায় ‘রুস্তমি’র ভাগ পাওয়া যায় তা হলে আর চীনের পেছনে পেছনে লাইন ধরে ব্যবসা বদল করে বাঁচতে চাওয়ার দরকার কী!

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিনা যুদ্ধে ও বিনা অস্ত্র ব্যবহারে প্রতিদ্ব›দ্বী চীন ও রাশিয়ার উপরে অবরোধ আর মানবাধিকার এ দুই অস্ত্র ব্যবহার করে বিজয় লাভের ভাবনায় তারা (পশ্চিম মানে আমেরিকা ও ইউরোপ) এবার কাজে নেমে পড়েছিলেন।

আর এ কাজে বলির বখরা বানিয়েছিল পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে ১৪ রাষ্ট্রের যারা এখনো ন্যাটোর সদস্য হয়নি, এদেরই এক রাষ্ট্র ইউক্রেনকে।

গত ২০১৪ সাল থেকে ইইউ, আমেরিকাসহ ন্যাটো ইউক্রেনকে প্রলুব্ধ করে তাকে ন্যাটোর সদস্য করে নেয়া হবে বলে - তাই ন্যাটোর সদস্যপদ ইউক্রেনের কাছে এক সোনার হরিণ করে গড়ে তোলা হয়েছিল। আবার এর উল্টা দিকও আছে।

বলা হয় ১৬৬৭ সাল থেকে ইউক্রেন রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে যায়; অর্থাৎ ৪০০ বছরের বেশি হলো এই অধীনস্থতা যার শেষভাগটা মানে, ১৯১৭ সাল থেকে তা সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনস্থতায় কাটিয়েছিল। আর সেটিই এবার হাজির হয়েছিল বর্তমান রাশিয়ান আধিপত্য থেকে বাইরে থাকার খায়েশ হিসেবে। খায়েশ করা মোটেও খারাপ বা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু বাস্তবতা হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে না। তাই এখানে প্রধান সমস্যাটা হলো, এবারের চেষ্টাটা আসলেই ‘আগের সব অধীনতা থেকে বের হওয়া হবে না উল্টা ব্যবহৃত হয়ে যাওয়া হবে!’ এ দিকটা বাস্তব সম্মতভাবে ভেবে দেখা হয়নি। কাজেই এখন অপমান ও বিড়ম্বনা দিয়ে যদি ব্যাপারটা শেষ হতো সেটিও ভালো। কিছু আরো খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে।

এটি বলার এখন সম্ভবত সময় হয়েছে যে, এই চলতি যুদ্ধ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে এক কঠিন বাস্তবতার উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছে যে তিনি বোকা হয়ে গেছেন, প্রতারিত হয়েছেন - ন্যাটোর সদস্যপদ এক সোনার হরিণ ছিল - এই লোভ দেখিয়ে তাকে প্রতারণা করে বেপথে নেয়া হয়েছে।

কিন্তু আবারো সেই মূল কথা। বাইডেন এই যুদ্ধে হেরে গেছেন, যাচ্ছেন। তার যুদ্ধের শখ মিটে গেছে হয়তো! তবে তিনি হেরে গেছেন এ কথা আড়ালে ফেলে যুদ্ধের কী করে সমাপ্তি টানা যায় এটিই এখন তার প্রধান লক্ষ্য। তিনি এবিসি নিউজকেই বেছে নিয়েছেন কারণ তার যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরাজিত ও পালিয়ে যাওয়াটা কোনো এক ভিন্ন গল্পের আড়ালে ফেলার কাজে বাইডেনের কাছে এখন সবচেয়ে মুখ্য শ্রোতা হলো আমেরিকার সাধারণ মানুষ, ভোটার। যেন তিনি আমেরিকাকে ইউক্রেন যুদ্ধে হারাননি - অন্তত এটুকু প্রতিষ্ঠিত করাই তার এখন একমাত্র লক্ষ্য। আগামী নভেম্বর ২০২২ হবে বাইডেনের ‘বিচারের দিন’ - সেটি আমেরিকার মিডটার্ম নির্বাচনের। যেখানে গত বছর থেকে মূলত মুদ্রাস্ফীতির কারণে আমেরিকার বিভিন্ন সার্ভে রিপোর্টে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, বাইডেনের দল এখানে খারাপ ফল করবে। এর ওপর যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে গেছেন বাইডেন এই বয়ান স্থিতি পায় তবে বাইডেন সব ক‚ল-ই হারাবেন। এ জন্য সম্ভবত হেরে যাওয়ার বয়ানকে বিজয়ী ও থিতু হতে না দেয়া তার প্রধান লক্ষ্য। এতে তিনি কতটুকু সফল, আদৌ হতে পারেন কিনা তা দেখার বিষয়!

বাইডেন হেরেছেন, জেলেনস্কি প্রধান সাক্ষী

কথাটা হলো, জেলেনস্কির হাতে বাইডেনের ভাগ্য আটকে গেছে - এটিই মূল কথা। কিভাবে?
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেন হামলা শুরু করে ইউক্রেনের সবাইকে পর্যুদস্ত করা শুরু করেছেন। আর জেলেনস্কি অবাক চোখে দেখেছিলেন তার পাশে কেউ নেই, কেউ আসেনি। না ন্যাটো, না ইইউর কোন দেশ, না আমেরিকা। তিনি এই ক্ষোভ ও অপমান না লুকিয়ে পরের দিন সকাল থেকে অভিযোগ করতে থাকেন যে, ‘কেউ পাশে আসেনি, তারা একাই লড়ছেন’। আমেরিকার জন্য এ অভিযোগ মারাত্মক!
আর জেলেনস্কির এ অভিযোগই ছিল প্রথম সাক্ষ্য যে, বাইডেন হারতে যাচ্ছেন। আসছি সে কথায়। কিন্তু এতে বাইডেনের পক্ষে আর মূল সত্যটা লুকিয়ে রাখাই অসম্ভব হয়ে যায়। পরদিনই বাইডেনের মুখপাত্র জেন সাকিকে দিয়ে বাইডেন পরিষ্কার করে বলে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না যে, আমেরিকা ইউক্রেনের পক্ষে কোনো যুদ্ধেই যাবে না; যাবার ইচ্ছাও কখনোই ছিল না। সেটা রাশিয়ার সাথে সরাসরি কোনো যুদ্ধে তো নয়ই, এমনকি ইউক্রেনের মাটিতেও আমেরিকা কোনো যুদ্ধে যাবে না।’

কারণ বাইডেনের পরিকল্পনা অনুসারে রাশিয়ার সাথে তিনি তো লড়বেন বিনা-অস্ত্রে ও বিনাযুদ্ধে এবং তা কেবল অবরোধ ও মানবাধিকার এ দুই হাতিয়ার দিয়ে। কিন্তু এসবের চেয়েও সবচেয়ে অনৈতিক কথাটা হলো, এ দিকটা জেলেনস্কিকে জানানো হয়নি। পশ্চিমের কেউ-ই জানাতেই চায়নি। শুধু তা-ই না, তাকে ন্যাটোর সদস্যপদের লোভ দেখিয়ে যুদ্ধে টেনে আনা হয়েছে। সরাসরি বললে, যেটা শ্রেফ একটা প্রতারণা; অর্থাৎ আগামীতে এ নিয়ে যদি জেলেনস্কি প্রতারণার অভিযোগ তোলেন তবে এটিই হবে বাইডেনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য যে, তিনি এই যুদ্ধে হেরে গেছেন!

তাই বাইডেন এখনই জেলেনস্কির সাথে নিজের ভাগ্যকে বাঁধাবাঁধি শুরু করেছেন। কারণ জেলেনস্কিও তো তার ইউক্রেনীয় নাগরিকদের ভুল ও মিথ্যা বুঝিয়েছেন, যুদ্ধে টেনে নিয়ে গেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবেও এটি তার অযোগ্যতা যে, তিনি বুঝতেও পারেননি, পশ্চিমও যুদ্ধে তাদের পাশে আসবেই না; আসলে সবই ছিল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি; অর্থাৎ জনগণকে প্রতারণার মুখে ফেলে দেয়া এটিই জেলেনস্কির সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং অযোগ্যতাও যে তিনি বুঝতেই পারেননি, এরা প্রতারক!

কাজেই জেলেনস্কি আর বাইডেনের ইজ্জত বাঁচানো এখন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে! দু’জনকেই নিজ নিজ পাবলিকের হাত থেকে বাঁচতে হবে।

সম্ভবত এ কারণেই জেলেনস্কির এই সাক্ষাৎকারটা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ শ্রোতা বিবেচনায় এবিসি নিউজে দেয়া, প্রশ্নও ইংরেজিতে করা হবে কিন্তু জেলেনস্কি এর জবাব দেবেন তার স্থানীয় ভাষায়। যেটা আবার এবিসি অনুবাদ করে ইংরেজিতে প্রকাশ করবে। এই হলো অ্যারেঞ্জমেন্ট, অর্থাৎ জেলেনস্কির অনুমান যে, নিজ ভাষায় বললে ইয়ার জনগণ বুঝবে ভালো আর কি বলেছেন, কেন বলেছেন তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদ কম হবে। আমরা এখানে মনে রাখতে পারি যে, কোনো যুদ্ধে পরাজিত হওয়া বা পাবলিককে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে ফেলার দায়ে যুদ্ধ শেষে সব শাসককে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। সবাইকে দায় নিয়ে ‘আইয়ুব খান’ হয়ে যেতে হয়। ফলে এ যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্রই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদ, কার দোষে এই দুর্ভোগ, মিস-হ্যান্ডলিং - এ অভিযোগে ইউক্রেন শাসকের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবলই হবে। তাই এই সাক্ষাৎকারের যুদ্ধের জন্য স্ক্রিপ্টে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গে বাইডেনকে দায়ী না করে জেলেনস্কির উপায় নেই। আবার এই দায়ে বাইডেনও হেরে গেছেন এই সাক্ষ্য দেয়া হয়ে যাচ্ছে এর প্রধান সাক্ষী হয়ে থাকছেন ওই জেলেনস্কিই।

তবু এই সাক্ষাৎকারে তিনি পশ্চিম বা বাইডেনকে অভিযুক্ত না করে পারেননি। ‘ন্যাটো সদস্য না করা’ আর ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ওপর দিয়ে রাশিয়ার জন্য চলাচলে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণা না দেয়ার জন্য অভিযুক্তই করেছেন। এ সাক্ষাৎকারেই তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ন্যাটোর এই প্রশ্নে আমি নিজেকে ঠাণ্ডা করে নিয়েছি বেশ আগেই; যখন আমি বুঝে গেছি, ন্যাটো ইউক্রেনকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। এটিই আসলে পরিষ্কার করে বলা যে, মিথ্যা আশ্বাসে পশ্চিম (আমেরিকা ও ইইউ) ইউক্রেনের সাথে প্রতারণা করেছে। এ কারণে নিজেই নিজের আকাক্সক্ষাকে দমন করতে হয়েছে, মেরে ফেলতে হয়েছে যদিও এখন এভাবে বলার কারণে ইউক্রেনবাসী কাকে মাফ করবেন, কাকে ছুড়ে ফেলবেন আমরা জানি না।

আর ন্যাটো নিয়ে তিনি পরোক্ষে বলে দিয়েছেন, ‘ন্যাটো জোট রাশিয়ার সাথে সঙ্ঘাতে যেতে বা বিতর্কে জড়াতে ভয় পায়, ভীত।’ তিনি আরো বলছেন, ‘আর আমিও অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা করে পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাওয়ার বিনিময়ে কিছু আনব, এমন প্রেসিডেন্ট হতে চাই না।’

আর এটিই হলো, যতটা সম্ভব বাইডেনের ইজ্জতের দিকে খেয়াল করে জেলেনস্কির নিজ ইজ্জত বাঁচানোর চেষ্টা। সেটি বৃথা যাবে কারণ তাহলে ইউক্রেনের জনগণকে ন্যাটোর কাছে নিয়ে গিয়েছিল কে? কিসের ভরসায়? কে দিয়েছিল সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি - এসব প্রশ্নে জেলেনস্কি লা-জবাব থাকতে পারেন না।

রাশিয়ার সাথেও কথা হয়েছে

এটি এখন পরিষ্কার যে, বাইডেন-জেলেনস্কির হার লুকানোর প্রক্রিয়ায় রাশিয়ার সাথেও তাদের কথা হয়ে গেছে। এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ এ পর্যন্ত দুটো পাওয়া যাচ্ছে। এক হলো রাশিয়া যুদ্ধ থামাবে কি শর্তে, সে কথাটা আবার এক রাশিয়ান মুখপাত্রকে দিয়ে স্পষ্ট করে বলানো। মুখপাত্র স্পষ্ট করে তিন শর্তের কথা বলেছেন, যেটা আগেও রাশিয়া-ফ্রান্স আলোচনায় পুতিন স্পষ্ট করে বলেছিলেন। তবে এবার বাড়তি হলো যে, শর্ত মানলে রাশিয়া যুদ্ধ থামাবে তো? এর নিশ্চয়তাই নিশ্চিত করেন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। এ নিয়ে রয়টার্সের রিপোর্টের শিরোনামই স্পষ্ট। শিরোনাম হলো, “ইউক্রেনকে দেয়া শর্ত পূরণ হলেই ‘মুহূর্তের মধ্যে’ রাশিয়া থেমে যাবে - ক্রেমলিন।”

এ নিয়ে বাইডেন-জেলেনস্কির যে কথা হয়েছে এর প্রমাণ হলো, জেলেনস্কি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলছেন, এক. তিনি আলোচনায় আপস করতে প্রস্তুত। দুই. রাশিয়া প্রভাবিত ইউক্রেনের দুই প্রদেশের স্বাধীনতা নিয়ে আপসে তিনি প্রস্তুত। তিনি এদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে চেয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু এত সহজে কেন জেলেনস্কির এই উদারতা? উত্তর আসলে খুব সোজা। কারণ ওদিকে পুতিনও আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক জেলেনস্কিকে ক্ষমতাচ্যুত করা বা কোনো রেজিম চেঞ্জ রাশিয়ার আক্রমণের লক্ষ্য নয়। কেবল ওই তিন দফাই তার যুদ্ধ বন্ধের মূল শর্ত। তাই ‘ক্ষমতায় থাকছেন’ এ কথা শোনার পরে জেলেনস্কি জান হাতে ফিরে পেয়ে রাশিয়ার সাথে আপসে রাজি হয়েছেন।

আর পুতিনের শর্ত তিনটা হলো :
১. ‘ইউক্রেন নিরেপেক্ষ হয়ে যাবে’। এ জন্য তার কনস্টিটিউশন সংশোধন করে এ কথাগুলো সেখানে ঢুকাবে। অন্য ভাষায় রাশিয়ার নিরাপত্তাবোধে অভাব সৃষ্টি করবে না, ন্যাটোর সদস্য হতেও আর চেষ্টা করবে না।
২। রাশিয়া ইউক্রেনকে অসামরিকীকরণের কাজ শেষ করবে।
৩। বিচ্ছিন্ন দুই প্রদেশ যার বাসিন্দারা এথনিক রাশিয়ান, সে দুই আবাসভূমিকে স্বাধীন দেশ বলে মানবে, ক্রাইমিয়ার বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়াকেও মেনে নেবে।

এক কথায় তাহলে, এবিসির সাক্ষাৎকারটা হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন কী কী ব্যাপারে আপস করবে এরই আগাম প্রতিশ্রুতি বিনিময়ের সাক্ষাৎকার। এসব বক্তব্যের ভিত্তিতে এখন রাশিয়া-ইউক্রেন বসে ফাইনাল খুঁটিনাটি চুক্তিপত্র ঠিক করে নেবে। অতএব কেস ফরফিট এবং যুদ্ধ থামার পথে।


তাহলে কী বাইডেনের অবরোধ এখন উঠে যাবে?

সরাসরি বললে, বাইডেন আশা করে আছেন এটিই সেই জায়গা। কিন্তু তাতে এখন ইউক্রেন রাশিয়ার সাথে কি আরো খারাপ কোনো চুক্তি করে রাশিয়ার ভিতর ঢুকে গেল কিনা সেদিকে বাইডেনের কোনো আগ্রহ নেই। তিনি চেয়েছিলেন রাশিয়ার ওপর অবরোধ জারি করতে - এখন তাই তিনি সেখানেই মনোযোগ দিতে চান। কিন্তু অন্তত এখানে কি বাইডেনের আশা পূরণ হবে?

সকালকে দেখলেই বোঝা যায় যে, দিনের বেলায় বাকি সময়ে আর কী হবে। এই তত্ত্ব-অনুসারে এবার ইউরোপ একেবারে পিছটান দিয়েছে। তারা বাইডেনের হাত ছেড়ে দিয়েছে এরই মধ্যে। কিভাবে?

ইইউর প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক ধরা হয় ফ্রান্স ও জার্মানিকে। মানে এদের প্রভাবকে। এরই মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস ছাড়া তারা চলতে পারবে না। জার্মান ডয়েচে ভেলের বরাতে ঢাকার এক বাংলা পত্রিকা রিপোর্টের শিরোনাম, ‘রাশিয়ার তেল-গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা চায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের অসম্মতি’। রাশিয়ান তেল-গ্যাসে এমনিতেই জার্মানির নির্ভরশীলতা প্রায় ৪৫ ভাগ। অন্য সবাইও কমবেশি নির্ভরশীল। এ দিকে ডাচ ও ফরাসি সরকারপ্রধানদ্বয় যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার করে বলে দিলেন, রাশিয়ার জ্বালানি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য তা ‘আনসাসটেইনেবল’, মানে টেকা অসম্ভব।

সোজা ভাষায়, রাশিয়ান জ্বালানি ইস্যুতে আমেরিকা-ইইউ আলাদা আলাদা রাস্তা ধরে ফেলেছে এরই মধ্যে; অর্থাৎ পুতিনের হুমকিটাই যেন কার্যকর যে, তিনি বলেছিলেন, আমাদের তেল না নিলে ‘ব্যারেল তিন শ ডলারে কিনতে প্রস্তুত হও’।

বাইডেন কি পোলাপান?
বাইডেন ধরে নিয়েছিলেন রাশিয়া তেল বেচতে না পারলে আর ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ আটকে থেকে গেলে রাশিয়ার কিছুই করার থাকবে না - সব স্তব্ধ হয়ে যাবে!! অথচ আমেরিকার একজন প্রেসিডেন্ট এসব মনগড়া অনুমানে কি চলতে পারেন? বাইডেনের অনুমান অবশ্য সত্য, সন্দেহ নেই। কিন্তু এটি ঘটনার একটি সাইড; যার অন্য সাইডের খবর নেয়া হয়নি। দুনিয়ার সব বেচাবিক্রি মানেই তা একপক্ষীয়ভাবে দেখা। কারণ যেটা বেচা সেটিই আরেক দিক থেকে কেনা। কাজেই রাশিয়া বেচতে না পারলে যেমন বিপদ প্রায় তেমনিই বিপদ জ্বালানি ক্রেতারও। বাইডেন এ দিকটা দেখতেই চাননি। ফলে বাস্তবতা হলো, ক্রেতা ইইউর সব সদস্যের জন্যই এটি রাশিয়ার মতোই সমান সঙ্কটের। কথা আরো আছে। যদি ইউরোপ রাশিয়ান তেল-গ্যাস না কিনে কাতার বা অন্য কোথাও থেকে কিনতে চায় তা হলে সেই বিকল্প জ্বালানি যদি পাওয়াও যায় তবু সেটি বিপদেরই হবে। কারণ অবকাঠামো কোথায়? এটি তো পাড়ার বাজার ফেলে কাওরানবাজারে বাজার করতে যাওয়া নয়। গ্যাস-তেলের জন্য এখন নতুন করে বিকল্প পাইপলাইন বসাতেও তো কমপক্ষে তিন বছর লাগবে। এ ছাড়া বিনিয়োগের খরচ তোলার ব্যাপার আছে। যে তেলের দাম এত দিন আশি ডলারে আটকে রাখার কসরত চলছিল এর মাঝেই এই যুদ্ধ এটিকে এরই মধ্যে ১১২ ডলারে নিয়ে গেছে। আর অনুমান হলো এটি এমন চলতে থাকলে ১৫০ ডলার পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। বাইডেনের খায়েশ পূরণ করতে চাইলে তেলের দাম পুরনো ৮০ ডলারে ফিরে যাওয়া দূরে থাক এটি কি সত্যিই ৩০০ ডলারের দিকে যাত্রা শুরু করবে? করোনার ধাক্কা সামলাতে যেখানে সারা দুনিয়া মন্দা আর মুদ্রাস্ফীতির কবলে, সেখানে এই নতুন তেলের দামের বোঝা কয়টা দেশ সামলাতে পারবে? বাছবিচারহীন বাইডেনের এমন পদক্ষেপকেই সম্ভবত আক্কেলের অভাব বলে!
তাহলে এখন একা কে? পুতিন না বাইডেন?

আনপপুলার সিটিং প্রেসিডেন্টের উদাহরণ হবেন বাইডেন!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement