২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গরম, আগুন আর কাঁচাবাজার

- ছবি : সংগৃহীত

শীত চলে গেছে। তবে গ্রীষ্মকাল এখনো আসেনি। তার আগেই গরম আমাদের রোদের তাওয়ায় যেন ভেজে তুলছে। তাতে এমন কোনো ক্ষতি নেই সাধারণ মানুষের। তারা তো জন্মেছেই গরমের দেশে। এর জন্য অখুশি নয় তারা। কিন্তু মাছ-গোশত-শাকসবজির দেশ বলে আমরা যে ভেজিটারিয়ানই থাকব আজীবন, এমন তো নয়। আমরা মাংসাশী ও সবজিভুক দুটোতেই এখন সমান সমান।

কিন্তু সেই সমান কি আর থাকতে পারছি? না মোটেই নয়। অতীতে কচুঘেচু খাওয়া মানুষ আজ আর কচু খেতে পেলেও ঘেচু ক’জনের খাবার ভাগ্য হয়েছে বলা মুশকিল। তবে তার চেয়েও বড় মুশকিল হলো আজকের শাক আর সবজির বাজারের দাম নিয়ে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে একটি লাউ (ডাক নাম তার কদু) এর দাম মিনিমাম এক শ’ টাকা। চার সদস্যের একটি পরিবারের জন্য ওই একটি লাউ একবেলার জন্য ঠিক আছে। কিন্তু একটি লাউ দিয়ে তো আর পরিবারের খাদ্য গ্রহণ সম্ভব নয়। আরো অনেক কিছু লাগে। আর মধ্যে প্রধান হলো কাঁচামরিচ। দিন পনেরো/কুড়ি আগেও কাঁচামরিচের কেজি ছিল ১২০ টাকার মতো। এখন অবশ্য কমেছে। এ বছর ফুলকপির দাম ৪০-৫০-৬০ টাকার নিচে নামেনি। বাঁধাকপির দাম অবশ্য কমই ছিল বলতে হবে। কিন্তু চারডাঁটার এক মুঠি লাউশাকের দাম শীতের দিনে ছিল ২০-২৫-৩০ টাকা। এখন চৈতা লাউ আর শাকের চাহিদা যেমন বেশি তেমনি দামও কমেছে। এতে স্বস্তি কমলে কী হবে, সেই স্বস্তিকে চড়া দামে কিনে নিয়েছে আমাদের আমদানিকারক ও ভোজ্যতেল উৎপাদক-পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা। সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা বলছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় তারাও বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ১০০ টাকা বাড়লে বাংলাদেশে সেই হিসাবে ১০ টাকার বেশি বাড়তে পারে না; কিন্তু সেটি তো হয় না। এখানে দাম বাড়ানোর কোনো হিসাব থাকে না।

এগুলোই হচ্ছে কাঁচাবাজারের প্রতিদিনকার পাকা সমস্যা। পঞ্চাশ বছর ধরে আমি ঢাকায় বাস করছি। বাজারে দাম বাড়ানোর নিত্যদিনের হুমকি ছিল না এমন দিন খুঁজে বের করা কঠিন।

কাঁচাবাজারের গরম আর আগুন এগুলোই। সংসারে লাগে এমন হাজারটা পণ্যের দাম তিল তিল করে মেটাতে গেলে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। কত মানুষ যে এই কাঁচাবাজারের রাজনৈতিক চাপে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে এবং মরার মিছিলে আছে, সেই হিসাব কিন্তু আমরা করি না। কারণ আমাদের মতো সাধারণ ও সুবিধাবাদীদের কাছে গণমানুষের নিত্যদিনের চাহিদার কোনো মূল্য নেই। সেই সঙ্কট সমাধানের প্রয়াসও নেই তাদের। তাই নিত্যই যারা মরছে, তাদের নাম উঠছে গিয়ে অন্য কোনো রোগের খাতায়। খাদ্যের জোগান দেয়া ও খাদ্যের মূল্য কেনার সামর্থ্যরে মধ্যে রাখার চেষ্টাকে আমরা ইতিবাচক ভাবি; কিন্তু সেই ইতি যে বাচক স্তরে ওঠে না, সেটি আমরা দেখি না। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে বগল বাজানো সরকার প্রতিবারই পাঁচ-চয়-সাত লাখ টন চাল আমদানি করে। খাদ্যের অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি যে কোন পর্যায়ে আছে সেটি তারা কখনো বলে না। খাদ্যের অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে মাছ, গোশত, ডিম ও দুধ। আমিষ ও নিরামিষের সব উপাদান-উপকরণ যখন পরিপূর্ণভাবে আমরা উৎপাদন করতে পারব দেশের জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজনের সাথে মিল রেখে, তখনই কেবল বলা যাবে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তার আগে নয়; কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরের সব সরকারই দাবি করেছে তাদের ঘাটতি নেই কোনো খাদ্যশস্যে। এই যে আত্মপ্রবঞ্চনা, এটা এক দিনে হয়নি। এই প্রবঞ্চনার মূলে আছে রাজনীতিকদের মিথ্যাচার আর এই মিথ্যাচারের জন্ম হয়েছে রাজনৈতিক ব্যর্থতার দরুন। রাষ্ট্রপরিচালনায় দক্ষতার অভাব এবং একটি পতিত প্রশাসনধারা তাদের ব্যর্থতাকে নানা অপকৌশলে ঢেকে রাখার কুমন্ত্রণা দিয়ে ও শিখিয়ে আজকে তাকে পাহাড়সম করে ফেলেছে। এ কারণেই বাণিজ্যমন্ত্রী বলতে পারেন আমাদের কিছু করার নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও অপরাপর মন্ত্রণালয় যদি না-ই পারে তাদের দায়িত্ব পালন করতে, তাহলে তাদের অধীনে থাকা মন্ত্রণালয়গুলোকে ব্যর্থ বলে চিহ্ন দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতেই তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। বরং সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। তাহলে কী করা যেতে পারে? আমরা অনেকেই মনে করি, সেই ব্যর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদত্যাগ করলেই বোধকরি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে তা ঠিক নয়। মন্ত্রী তো আর একা কাজ করেন না। মন্ত্রীর আধিকারকগণ কাজ করেন বাজার নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য বিষয়ে। তাদের দক্ষতা ও কাজ করার আগ্রহ থাকতে হবে। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের একটি সামাজিক গুণ হচ্ছে গদাইলস্করি ভাব। যেন তিনি সবকিছুর মালিক। তিনি যে জনগণের সেবাদাতা কর্মচারীমাত্র, তার জন্য যে তিনি বেতনভাতা ইত্যাদি পান, সেটি তারা ভুলে যান। আর ঘুষের গুণ তো তাদের চিরদিনের শোভার মতো লেগে থাকে।

এই মানসিকতা নিয়ে আর যাই হোক কাঁচাবাজারের নিত্যপণ্যের দাম সহনশীল স্তরে রাখা সম্ভব নয়। ধরুন, যেসব পণ্য আমদানি করতে হয় না, সেগুলো মফস্বল থেকে ঢাকায় নিয়ে আসতে কেন ট্রাকের ভাড়া বাড়বে? কেন মাঝপথে শ্রমিক নেতাদের এজেন্ট ও পুলিশের এজেন্টরা চাঁদা তুলবে? কেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র, যুব ও আওয়ামী চাঁদাবাজরা সড়কে/মহাসড়কে চাঁদা তুলবে? এই চাঁদা তোলা বন্ধ করলেই তো শাকসবজির দাম অনেক কমে আসতে পারে। উৎপাদক স্তরে ও খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে দামের হেরফের তিন থেকে ১০ টাকার বেশি হবে না কিংবা যতটাই ফারাক হোক না কেন তাতে ক্রেতার কেনার সামর্থ্যরে মধ্যেই থাকবে।

ক্ষমতাবানদের বলছি, দয়া করে সড়কে/মহাসড়কের সবরকম চাঁদাবাজি বন্ধ করুন। না করলে গণমানুষ এটাই মনে করে যে ওই চাঁদাবাজি আপনারাই করছেন। এই বদনাম থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হলে এ ক্ষেত্রে জোর দিন। না হলে একদিন এ কারণেই নানা অঘটনের শিকার হতে হবে, যা হয়তো কারোরই আকাঙ্ক্ষিত নয়।

কাঁচাবাজারের গরম ও আগুন কিন্তু জ্বলছে দেশজুড়ে প্রতিটি ঘরে। সেই ঘর যেমন মহানগরের তেমনি সেই ঘর গ্রামেরও। মহানগরের ক্ষুব্ধ মানুষ কথা বলতে পারে, কারণ নানাভাবে সংগঠিত, কিন্তু গ্রামের মানুষ তেমনভাবে সংগঠিত নয়। কৃষকসমাজ যদি সংগঠিত হতে পারে, তখন কিন্তু সেই প্লাবন থেকে নিজেদের রক্ষা করা যাবে না।


আরো সংবাদ



premium cement