২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইউক্রেন সঙ্কট, এখন যুদ্ধক্ষেত্র

ড. মাহবুব হাসান - ছবি : লেখক

আমরা তখনই নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালাতেই পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস এলাকায় (লুনেৎস্ক ও দোনেৎস্ক) শান্তিরক্ষার নামে তার সেনাবাহিনী ঢুকিয়ে দেবে এবং পর্যায়ক্রমে কিয়েভের দিকে ভারী অস্ত্রের মুখ ঘুরে যাবে। এটা মনে করার কারণ, ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া দখল করে নেয়ার পর পুতিনের লক্ষ্য ছিল কিয়েভ। আমরা সেটা বুঝিনি। বোঝেনি পশ্চিমা শক্তিগুলোও। তাই তারা সীমিত নিষেধাজ্ঞা দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছিল। এখন চলছে দখলের সেই দ্বিতীয় পর্ব।

পুতিন বিশ্বাস করেন, ইউক্রেন রাশিয়ার আদিভূমি। তার এই বিশ্বাসের পেছনে সত্য ইতিহাস আছে, তবে বিবর্তনের বিষয়টি যদি আমরা মাথায় রাখি, তাহলে ইউক্রেন নানা সময়ে অনেক দখলদারের অধীনেই ছিল। অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে ইউক্রেনিয়ান ও রাশিয়ানদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সে দিক বিবেচনায় রাখলে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের বিরোধ না থাকারই কথা। কিন্তু ইতিহাস বলছে, বারে বারে পরাধীনতার বেদনায় জারিত কিয়েভিয়ানরা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। দানা বেঁধেছে তাদের মনে ও মানসিকতায় জাতিচেতনার বহুবর্ণিল অভিঘাত। জাতীয়তার সেই দিনগুলো তারা অর্জন করেছে লড়াই চালাতে চালাতে।

কেউ কেউ মনে করেন ইউক্রেনীয় জনগোষ্ঠীর আদি মানুষ ছিলেন রুশ। তাদেরকে ডাকা হতো কিয়েভিয়ান রুশ হিসেবে। কারো কারো মতে, তাদের রয়েছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রক্ত ও সাংস্কৃতিক ধারা। কেউ কেউ বলেন, রুমানিয়ানদের সাথেও তাদের রয়েছে যোগসূত্র। তবে, আসল হলো তারা আসলেই রাশিয়ান রক্তের উত্তরাধিকার বহন করছে। ভ্লাদিমির পুতিন আর ভ্লাদিমির জেলেনক্সির নামে ও ধর্মে, চেহারা ও অন্যান্য বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐক্য বিদ্যমান। কিন্তু রাজনৈতিক চেতনায় তারা ভিন্ন। এই ভিন্নতার কারণ রয়েছে। ৭০ বছর ধরে সোভিয়েত শাসনের সময় তারা কি নিগৃহীত হয়েছেন? লেনিন থেকে শুরু করে নিকিতা ক্রুশ্চেভ পর্যন্ত সোভিয়েত নেতারা ক্রাইমিয়াসহ আরো কিছু এলাকা ইউক্রেনের সীমানায় জুড়ে দেন। সেগুলো উদ্ধারের চিন্তা তো পুতিন করতেই পারেন? আদি রাশিয়ান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রও ছিল এককালে কিয়েভ। এসব মিলিয়েই ভ্লাদিমির পুতিনের নিজের মতো করে রাশিয়ার সীমানা গড়ে নেয়ার আয়োজনের নামই এখন ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সূচনার আগেই পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন কোনো জাতিরাষ্ট্র নয়। ওই রাষ্ট্র কোনো জাতিকে চিহ্নিত ও চিত্রিত করে না। এখন, তিনটি ধারা চালু আছে যারা ইউক্রেনের সত্তার মধ্যে বসবাস করছে। এক. ইউক্রেনপন্থী; দুই. রুশপন্থী; তৃতীয়পন্থীরা এই দুই পক্ষেরই বিরুদ্ধে। সুদূর অতীতেও ইউক্রেনের মানুষের বোধ ও বিশ্বাসে এমন ত্রিধারা ছিল। পুতিন মনে করেন, ১৯৯১ সালে যখন মিখাইল গর্বাচেভ ক্ষমতায় ছিলেন, তার সরকার ছিল খুব দুর্বল এবং তিনি একটি ঘোরের মধ্যে পেরেস্ত্রৈকার জালে জড়িয়েছিলেন। তিনি সে সময়ই ক্রাইমিয়াসহ অন্য এলাকাগুলো ফিরিয়ে আনতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। সেই ভুল থেকেই আজকের এই বিরোধ।

এ লেখা যখন লিখছি, তখন কিয়েভের দিকে ছুটে যাচ্ছে রাশিয়ার অস্ত্রশস্ত্রের গোলা। আমরা জানি না সেগুলো জনবসতির কোন কোন এলাকার কত মানুষ হননে ব্যস্ত। আমরা জানি না, এর মধ্যেই কত মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে। মানুষের কান্নার হাহাকার ও চিৎকার, বাঁচার আকুতি কতটা এলাকাজুড়ে চলছে। আগামী দিনগুলোতে আর কত মানুষ হত্যার শিকার হবে, তা কেবল আল্লাহই জানেন।

২.
রাজনীতিতে এবং সামরিক নীতিতে মানবতা শব্দটি একেবারেই গুরুত্বহীন। বিশেষ করে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা রক্ষার রাজনীতি কতটা হৃদয়হীন সেটা কারো অজানা নয়। সেটা রাজনীতিকরা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের নামে চালাচ্ছেন। আমরা যতটা জেনেছি, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছিলেন। তার সেই প্রস্তুতি কতটা ফল দেবে, মানে বৃহৎশক্তি রাশিয়ান বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ কতটা ঠেকাতে পারবে, তা আমাদের ধারণায় নেই। এমনকি আমরা এটাও বলতে পারছি না যে, ইউক্রেনের পশ্চিমা বিশ্বের বন্ধুরা, মানে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেবে কি না। আমাদের যতটা মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যুদ্ধে যেতে চায় না। কেন তারা কূটনৈতিক স্তরেই বিষয়টির সমাধান চেয়েছিলেন, তারও পেছনে ছিল যুক্তি। যুদ্ধে সমাধান নেই- এই সত্য বৃহৎশক্তিগুলোর মনে থাকলেও পুতিনের মতো শক্তিমদমত্ত মানুষের ক্ষেত্রে তা খাটে না।

এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যদি ইউক্রেনের সাহায্যে প্রচলিত অস্ত্র নিয়েই এগিয়ে আসে, তাহলেও এর ব্যাপ্তি ঘটবে এবং বিস্তার লাভ করবে গোটা দুনিয়াজুড়ে। এ কারণেই কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, দু’টি মহাসমরের পর এটিই হবে আরেকটি মহাসমর। আমরা প্রথম মহাযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির প্রত্যক্ষ কোনো বিষয় দেখিনি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা আমাদের সেই বীভৎস নির্মমতা দেখিয়েছে, যা পারমাণবিক পৃথিবীর নৃশংসতাই কেবল দেখায়নি, আমাদের মানবতার ছাতা তুলে ধরতেও মদদ দিয়েছে। আমরা বলেছি, এমন হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর মানুষ চায় না। কিন্তু মানুষ হচ্ছে সেই প্রাণী, যার ভেতরে মানবতাটুক না থাকলে তা হিটলারের চেয়েও সহস্র্রগুণ নৃশংসতায় হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে।

বোধ করি এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে টেকনিক্যালি রাশিয়াকে স্থবির করতে উৎসাহী। কিন্তু সেখানেও রয়েছে নানামুখী সমস্যা ও সঙ্কট।

৩.
ক্রাইমিয়া দখল করে নেয়ার পর যুক্তরাজ্য রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংক ও ধনকুবেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা বলতে গেলে তেমন কোনো কাজেই লাগেনি। রাশিয়া তারও আগে থেকে তার অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করে এবং রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ একটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বাঁধ তৈরি করেছে। এখন আর কেবল সোনা আর ডলারের মজুদের ওপরই নির্ভরশীল নয় রাশিয়া, সে চীনা টাকায়ও তার রিজার্ভ রেখেছে। ডলারে তার রিজার্ভের ১৬ শতাংশ রাখা হয়েছে। আর চীনা মুদ্রায় (রেনমিনবি) রাখা হয়েছে ১৩ শতাংশ মুদ্রা। বর্তমানে রাশিয়ার রিজার্ভের পরিমাণ ৬৩ হাজার কোটি ডলার, যা পৃথিবীর চতুর্থ রিজার্ভ। এই টাকা দিয়ে রাশিয়া খুব ভালোভাবেই তার সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারবে বলে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউই যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপও করে তাহলেও তাকে সহজে কাবু করা যাবে না।

এ ছাড়াও রাশিয়া তার বিনিয়োগ ও ঋণের বিষয়টি বৈদেশিক ঋণের ওপর থেকে সরিয়ে এনেছে অনেকটাই। অবশ্যই এই নতুন ব্যবস্থার প্রধান সাহায্যকারী হবে চীন। নতুন অর্থব্যবস্থার চেষ্টাও রাশিয়ার রয়েছে, যার কারণে তাদেরকে নিষেধাজ্ঞার জালে সহজে আটকাতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র।

এটা হলো হিসাবের বিষয়। কিন্তু উল্টোদিকে রাশিয়ার হাতে আছে গ্যাস ও তেল অস্ত্র। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রাশিয়ান তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪০ শতাংশ জ্বালানির সরবরাহ পেয়ে থাকে রাশিয়া থেকে। আর ব্রিটেন ৩ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।

যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক ও খাদ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে রাশিয়া প্রাকৃতিক জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। ফলে উভয় পক্ষই যে সঙ্কটের মধ্যে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই হিসাব নিশ্চয়ই পুতিন করেও নতুন একটি টেক্কার সন্ধান পেয়েছেন, তার নাম চীন।

৪.
ইউক্রেন রাশিয়ার আদি ভূমিই হোক বা এদেশ ইউক্রেনীয় জাতির নিজস্বই হোক, এর শৈলচূড়ার নিচে কী আছে লুকিয়ে তা আমাদের জানার কোনো অভিপ্রায় নেই। আমরা শুধু বলব মানুষ হত্যার এই যজ্ঞ কোনো যুক্তিতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আগে মনে করা হয়েছিল, অস্ত্র ব্যবসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার এই টেনশন বিল্ডআপ খেলা। কিন্তু এখন বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক অভিলাষের পেছনে রয়েছে আরো কিছু।

সেই আরো কিছু দেখার অপেক্ষায় আমরা।


আরো সংবাদ



premium cement