বিশিষ্ট ব্যক্তি নিরূপণের মাপকাঠি কী?
- ইকতেদার আহমেদ
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২০:২৯
বাংলা ‘বিশেষ’ শব্দটির বিশেষণ ‘বিশিষ্ট’। বিশেষ শব্দটির অর্থ বা সমার্থক শব্দ হলো শ্রেষ্ঠত্ব, পার্থক্য, প্রভেদ, তারতম্য, বৈচিত্র্য, বৈলক্ষণ্য, প্রকার, রকম প্রভৃতি। বিশিষ্ট শব্দটির অর্থ বা সমার্থক শব্দ হলো অসামান্য, অসাধারণ, অনন্য সাধারণ, প্রসিদ্ধ, গুরুত্বপূর্ণ, আলাদা, স্বতন্ত্র প্রভৃতি। যেকোনো শব্দের বিশেষণ দ্বারা শব্দটির গুণ বা দোষ প্রকাশ করা হয়। বিশিষ্ট শব্দটির দ্বারা এর গুণের প্রকাশ ঘটেছে। বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে যখন কোনো ব্যক্তিকে আখ্যায়িত করা হয় তখন ধরে নেয়া হয় তিনি একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে স্বতন্ত্র। ব্যক্তিটির বিশেষ গুণ যেমন- সততা, আন্তরিকতা, নিরপেক্ষতা, বিজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্যতা প্রভৃতি তাকে বিশেষ মর্যাদার আসনে সমাসীন করায় তিনি সমাজের দৃষ্টিতে বিশিষ্ট হিসেবে পরিগণিত। এ ধরনের বিশিষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা একটি দেশ বা সমাজে অত্যন্ত নগণ্য।
আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ একযোগে বা পৃথকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের বিশিষ্টজন হিসেবে পরিচয়ের প্রকাশ ঘটান যদিও দেশের জনমানুষের বড় অংশের কাছে এদের অনেকেই রাজনৈতিক মতাদর্শিতা, পক্ষপাতদুষ্টতা, অসততা, চর হিসেবে ভিন রাষ্ট্রের প্রতি অনুগামিত্ব প্রভৃতি কারণে বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত ও বর্জনীয়। এ ধরনের বিতর্কিত ও বর্জনীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি যখন বিশিষ্টজনের আবরণে বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান করেন তখন এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষেই বিশিষ্টজনের নিষ্কলুষ অবয়ব মলিনতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
অনেকসময় দেখা যায় দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, দফতর, সংস্থা বা সরকার কর্তৃক গঠিত কোনো কমিটি কোনো বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য কিছু ব্যক্তিকে বিশিষ্ট ব্যক্তি উল্লেখে মতবিনিময়ে আহ্বান করেন। এ ধরনের আহ্বানে বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যারা আমন্ত্রিত হয়েছেন তাদের কোন ধরনের যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে মতবিনিময়ে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে এর কোনো ব্যাখ্যা কখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা কমিটি হতে দেয়া হয়নি। বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের একজনের মধ্যেও যদি বিশিষ্টতার ঘাটতি থাকে তবে তা সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং এর পাশাপাশি দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বা সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, দফতর, সংস্থা বা সরকার কর্তৃক গঠিত কমিটির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
পেশাজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বিশিষ্টজন এক নয়। সুনির্দিষ্ট প্রতিটি পেশাজীবীর মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শীর সমারোহ ঘটে। একটি পেশাজীবী সংগঠনের সবাই সৎ, চরিত্রবান, যোগ্য, দক্ষ এমন দাবি যেমন যথার্থ নয় অনুরূপ একটি পেশাজীবী একক সংগঠন হিসেবে একটি একক দলের অনুগত নয়। আমাদের পেশাজীবীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইনজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি। এসব প্রতিটি পেশাজীবীই মতাদর্শের দিক থেকে দ্বিধাবিভক্ত। আমাদের দেশ ও সমাজ পেশাজীবীদের এ বিভক্তিকে মেনে নিয়েছে এবং দ্বিধাবিভক্তভাবেই স্ব স্ব পেশাজীবীরা স্বীয় রাজনৈতিক আনুগত্যের বাতাবরণে আবদ্ধ। এ দিক থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের দেশ ও সমাজের কাছে কখনো কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শী, পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি যা তাকে বিতর্কের আবর্তে ফেলে দেয় এমন ব্যক্তি বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণীয় নয়। সুতরাং পেশাজীবী নামে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তি যদি কখনো কোনো কর্তৃপক্ষ বা কমিটি কর্তৃক আমন্ত্রিত হয় সে ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তির নিরপেক্ষ চরিত্র কলুষিত হয় এবং কর্তৃপক্ষ বা কমিটির নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হয়।
সুশীল সমাজ ও বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। সুশীল সমাজের পরিধি বিস্তৃত। আমাদের দেশে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বিকশিত হতে না পারায় সুশীল সমাজ আজ ডান ও বাম ঘরানায় বিভক্ত। যেকোনো সুশীল সমাজ ডান ও বাম ঘরানায় বিভক্ত হয়ে সরকার বা বিরোধী দলের লেজুড়বৃত্তি করলে তাকে আর সুশীল সমাজ বলা যায় না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের নিরপেক্ষ অবস্থান কাম্য। ডান ও বাম ঘরানার বাইরে আমাদের সুশীল সমাজের মধ্যে মধ্যবর্তী একটি ঘরানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে আমাদের সুশীল সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি নিজ নিরপেক্ষ অবস্থান হারিয়ে ডান বা বামপন্থী হিসেবে সরকারি বা বিরোধী জোটের মতাদর্শের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের সম্পৃক্ততা সুশীল সমাজের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের মোটামুটি নিরপেক্ষ বলা গেলেও বর্তমানে তাদের সংখ্যা নগণ্য এবং ডান ও বাম ঘরানার সুশীল সমাজের প্রভাবে বলতে গেলে তারা অনেকটা কোণঠাসা। বিশিষ্ট ব্যক্তি আপন মহিমায় ও চারিত্রিক মাধুর্যের সমুজ্জ্বলতায় নৈতিকতার উচ্চ শিখরে স্থান পাওয়ায় তার সাথে কোনোভাবেই মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী সুশীল সমাজ তুলনীয় নয়।
দেশের প্রচলিত কোনো আইনে অনুসন্ধান কমিটি বা বাছাই কমিটির মাধ্যমে কোনো সংস্থার শীর্ষ পদগুলোয় নিয়োগের জন্য নাম আহ্বানের উল্লেখ থাকলে অনুসন্ধান কমিটি বা বাছাই কমিটির পক্ষে মতবিনিময়ের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বের করার আবশ্যকতা দেখা দেয়। এমন তিনটি আইনের দু’টি যথা- দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ এ বাছাই কমিটির উল্লেখ রয়েছে; তবে উভয় আইনে বাছাই কমিটি কী পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক বা কাদের সাথে মতবিনিময় করে নামের সুপারিশ প্রস্তুত করবেন সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। অপর দিকে সম্প্রতি প্রণীত অপর আইন যথা- প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২ এ উল্লেখ রয়েছে যে, ‘পদ পূরণের জন্য অনুসন্ধান কমিটি যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করবে এবং এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হতে নাম আহ্বান করতে পারবে।’
সদ্য প্রণীত আইনটিতে নিয়োগে সুপারিশ প্রদানের জন্য অনুসন্ধান কমিটির কথা বলা হয়েছে। অপর দিকে দুর্নীত দমন কমিশন আইন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনে একই উদ্দেশ্যে বাছাই কমিটির কথা বলা হয়েছে। আইনত্রয়ের অনুসন্ধান ও বাছাই কমিটির কাজের পরিধি এক ও অভিন্ন হলেও অনুসন্ধান ও বাছাইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা নিজস্ব বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তার প্রয়োগে অনুসন্ধানের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টায় রত থাকেন। পক্ষান্তরে বাছাই কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন বা ব্যক্তি থেকে প্রাপ্ত নাম বাছাই করে সুপারিশ প্রণয়ন করেন। শেষোক্ত ক্ষেত্রে বিবেক, বুদ্ধি ও চিন্তার প্রয়োগের সুযোগ অবারিত নয়।
তিনটি আইনে উল্লিখিত কমিটির কাজের পরিধি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন- ২০২২-এ নাম আহ্বান বিষয়ে সুস্পষ্টরূপে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের উল্লেখ থাকায় উল্লিখিত দল এবং সংগঠন ব্যতীত বিশিষ্ট ব্যক্তি উল্লেখে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে মতবিনিময়ের মাধ্যমে নাম আহ্বান করা হলে তাতে কমিটিকে আইনের অনুবলে প্রদত্ত ক্ষমতার ব্যত্যয় হয় কি না বিষয়টি বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন এ দু’টিতে পদ পূরণের জন্য নাম আহ্বান বিষয়ে কোনো দল বা সংগঠনের উল্লেখ না থাকায় কমিটি নিজ বিবেচনায় যাদের সাথে মতবিনিময় যথার্থ মনে করেন তাদের সাথে মতবিনিময় করতে পারেন কিন্তু এরূপ মনবিনিময় করতে গিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তির আবরণে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির সাথে মতবিনিময় করা হলে তাতে বিশিষ্ট ব্যক্তি নিরূপণের মাপকাঠির অনুপস্থিতিতে বিতর্কের যে সৃষ্টি হবে না এমন নিশ্চয়তা আছে কি।
উল্লিখিত তিনটি আইনের অনুসন্ধান বা বাছাই কমিটিতে স্থান পাওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই সাংবিধানিক পদধারী। সাংবিধানিক পদধারীরা শপথের অধীন। সংসদ সদস্য ব্যতীত সাংবিধানিক সব পদধারীকে শপথের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে হয় যে, তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং এর পাশাপাশি আরো ব্যক্ত করতে হয় ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবাই প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন অথবা তাদের সরকারি কার্য ও সরকারি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হতে দেবেন না।
বিশিষ্ট ব্যক্তি বা বিশিষ্টজনের কোনো সংজ্ঞা বা নিরূপণের স্বীকৃত কোনো মাপকাঠি না থাকলেও আমাদের দেশ ও সমাজে হাতেগোনা দু-একজন রাজনৈতিক মতাদর্শমুক্ত, প্রাজ্ঞতা, বুদ্ধিমত্তা, ন্যায়পরায়ণতার পরিমাপে অসাধারণ ব্যক্তি যারা জনমানুষের পরম শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে সর্বমহলে সম্মানিত ও সমাদৃত, এদের বিবেচনায় না নিয়ে যদি দলবাজ, ভুঁইফোড়, রাজনৈতিক মতাদর্শী, পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে আমন্ত্রিত হয় সে ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তির নিষ্কলুষ অবস্থান ক্ষুণ্ণ হয়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা