১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কূটনৈতিক দেউলিয়াত্ব, ওআইসিকে বলে সাম্প্রদায়িক!

-

ইংরেজি কমিউনাইজ শব্দটি খুবই ইতিবাচক এক শব্দ। যার রুট শব্দ কমিউন। ল্যাটিন অরিজিন কমিউনিস (communis), সেখান থেকে সম্ভবত ফ্রেঞ্চ comuner (মানে ভাগাভাগি শেয়ার করা), হয়ে কমিউনাল খুবই ইতিবাচক শব্দ যার অর্থ কমিউনিটিতে স্বেচ্ছাশ্রম দেয়, আর কষ্ট-আরামসহ সবই যে শেয়ার করে; এক সম্প্রদায় হিসেবে মিলেমিশে থাকে। অনেক সময় প্রকৃতির সাথে স্পিরিচুয়ালি সম্পর্কিত করে দেখা অর্থে কমিউনাইজ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

অথচ জমিদার-হিন্দুরা এর বাংলা সম্প্রদায় শব্দটাকে করেছে ‘সাম্প্রদায়িক’ যা খুবই নেতিবাচক অর্থ। তাই ভারতীয় ছাড়া কোনো ইংরেজি ডিকশনারিতে কমিউনাল শব্দ পাওয়া যাবে না। কমিউন বা কমিউনিটি পাওয়া যাবে। তবে সেগুলো অবশ্যই ইতিবাচক শব্দ।

এখন জমিদার হিন্দুর দেয়া এই কমিউনাল শব্দের অর্থ কী? তারা কী বোঝাতে চান?

প্রথমত বলতে চান, জমিদার হিন্দুর রাজনৈতিক সামাজিক কালচারাল আধিপত্য সবাইকেই মানতেই হবে। অ-হিন্দুরা তা মানতে না চাইলে অথবা পাল্টা তাদেরকে ভিন্ন কোনো ধর্মীয় সামাজিক চিহ্ন দেখানোর চেষ্টা করলে তাকে সাম্প্রদায়িক ডাকা হবে। তাদের আধিপত্যের সমাজে থাকতে গেলে তাদের সংজ্ঞায়িত করা ধারণা মানতে হবে। অ-হিন্দু বা মূলত মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া তাদের কথিত সব শিষ্টাচার ও কোড ফলো করলেই কেবল তারা স্কুল-কলেজ বা চাকরিতে তাদের সমাজে প্রবেশাধিকার দেবে, পাশে বসতেও দিতে পারে। আর যে তাদের কোড মানে না, ডমিনেন্স মানে না তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলা হবে।

খুঁচিয়ে ঘা করা ভারতের স্কুল-কলেজে হিজাব ইস্যুতে মুসলমানবিদ্বেষ-ঘৃণায় বৈষম্যমূলক আচরণে সমাজ তোলপাড় করা চলছে এখন। এতে আমেরিকা, ইউরোপ আর এদিকে পাকিস্তান বা ওআইসির নিন্দা করাতে ভারত কূটনৈতিক সঙ্কটে পড়ে যায়। আপনি আপনার দেশের সব চিহ্ন-পরিচয় নির্বিশেষের নাগরিকের প্রতি অ-বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক সাম্যের চোখে দেখতে বাধ্য থাকবেন ও দেখবেন এটি আন্তর্জাতিক পলিটিক্যাল অর্ডার আশা করে। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই ভারতের নিন্দা করা হয়েছে। এতে কূটনৈতিক ভাষা ও ভাষ্য হারিয়ে বেহাল দেউলিয়া অবস্থায় পড়ে সে ওআইসিকেই ওই সাম্প্রদায়িক বলে গালি দিয়েছে যেন সারা দুনিয়াটা জমিদার-হিন্দুর রাজত্ব!

মুসলমান কোপাতে হবে, ইসলামবিদ্বেষ একমাত্র ভরসা মোদির

প্রায় তিন সপ্তাহ আগের এক লেখায় পরিষ্কার করে লিখেছিলাম যে, একালের ভারতে বিজেপি-আরএসএস বা মোদি একেবারে চ্যালেঞ্জ হয়ে যাওয়া মানে হিন্দুত্ববাদ প্রথমবারের মতো উৎখাত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পড়েছিল ২০২১ সালে। গত মধ্য মার্চে ভারতে নেমে এসেছিল করোনাভাইরাস আক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় আক্রমণের ঝড়! সারা ভারত তাতে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। অক্সিজেন, বেড আর সৎকার, এসব পাওয়ার পুরোপুরি অনিশ্চয়তা - এটিই হয়ে উঠেছিল ভারতের মুখ্য পরিচয় আর মোদি যার প্রতীকী এবং এক অসহায় প্রধানমন্ত্রীর রূপ। সৌদি আরব অক্সিজেন ভরা ট্যাংকার পাঠিয়েছে কার্গো প্লেনে করে কিন্তু তা দেখাতে গিয়েও মোদির ইজ্জত যায় অবস্থা! যেন মুসলমান সৌদি আরব তো ‘নিচা’; তার সাহায্য মোদি নিয়েছে এটি কেমন দেখায়? আর তা দেখেই দ্যা-হিন্দুর সুহাসিনী হায়দার প্রথম নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, ভারত আসলে নিশ্চয় কোনো পরাশক্তি নয়! নইলে সৌদি সাহায্য নেবে কেন?

আরো বলেছিলাম, “মুসলমান কোপাতে হবে, ইসলামবিদ্বেষ - এটিই হবে মোদির একমাত্র ভরসা। হিন্দুত্ববাদের দিকে ভোটার ফেরানোর একমাত্র উপায়। এ কারণেই ব্যাপারটি এখন দাঁড়িয়েছে এমন যে, বাইডেন যতই মোদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনে অবরোধের ভয় দেখান না কেন, মোদিকে আরো বেশি করে এখন মুসলমান কোপাতেই হবে - তা কাশ্মিরে বা সারা ভারতে। এটিই তার রাজনৈতিক আয়ু লুপ্ত হওয়া ঠেকানোর একমাত্র উপায় যার সোজা মানে, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাইডেনের সাথে মোদি ভারতের সম্পর্ক আর ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, বরং আরো সঙ্ঘাতেরই সম্পর্ক হবে। অন্তত ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত!”

নির্বাচন শুরু হয়েছে, খবর ভালো না

শিডিউল মোতাবেক গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ভারতের কিছু রাজ্য বা বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। আর এর সাথে পরিকল্পিতভাবে দুটো চরম ঘৃণা ছড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করে নেয়া হয়েছে। প্রথমটি ঘটানো হয়েছে, গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ১৭-১৯ লাগাতার এই তিন দিন। দুই কথিত ‘সাধু’ নরসিংহ আনন্দ ও প্রবোধানন্দ গিরি, তারা এর আয়োজক ও বক্তা। এরা আবার বিজেপি-আরএসএসের বিভিন্ন নামের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের প্রধান নেতা। তারা বলেছেন, “প্রত্যেক হিন্দুকে ‘সাফাই অভিযান’ পরিচালনার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই।” আর প্রথমজন বলেছেন, ‘সারা দুনিয়ায় যদি মানুষকে টিকে থাকতে হয় তবে আমাদেরকে জিহাদিদের ওপর সাফাই অভিযান চালাতে হবে।’ এর পরও কারো বুঝতে অস্পষ্টতা যাতে না থাকে তাই বলে দেই, এখানে এই সাফাই অভিযান মানে হলো জাতিগতভাবে (মুসলমানদের) সবাইকে নির্মূল করা বোঝাতে ইংরেজিতে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বলে বোঝায়। এটিই অ্যাকাডেমিক বইপত্রে ও আইন-আদালতের ভাষাও বটে।

এর পরে প্রায় এক মাস ধরে চলে এদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না দেয়ার-নেয়ার পুলিশি প্রচেষ্টা; এ ছাড়া কোনো বাদি-অভিযোগকারী পাওয়া যাচ্ছে না, এ অজুহাতও খাড়া করা হয়েছিল। এরপরে ১৫ জানুয়ারি কেবল নরসিংহ আনন্দকে গ্রেফতার করা হয়। তবুও এমন সব আইনে গ্রেফতার যাতে জামিন পেতে পারে। অথচ ‘জনশৃঙ্খলা ভঙ্গ’ বা ‘জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি’ - শুধু এ অভিযোগে কাশ্মির বা নর্থ-ইস্টে অনবরত প্রয়োগ ও গ্রেফতার করে কয়েক বছরের জন্য ফেলে রাখা হচ্ছে; এমন অন্তত চারটি আইন আছে। এসব প্রয়োগ করে তারা, জঙ্গি বা সশস্ত্র সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে। এমনকি এর একটির ক্ষেত্রে বলা আছে, এ অভিযোগে মামলা হলে আদালতেও আসামিকে পেশ করারও বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ নরসিংহ আনন্দ ইতোমধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে গেছেন।

এখন এমন গণহত্যার হুমকির ঘটনার পর এক মাস কেন বিভিন্ন অজুহাতে কোনো গ্রেফতার বা মামলা না করে অপেক্ষা করা হলো? মূল কারণ এ বছরের পাঁচ রাজ্য নির্বাচন শুরু হয়েছে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় এক মাস ধরে কয়েক পর্বে। তাই ১৭-১৯ ডিসেম্বরে ওই এথনিক ক্লিনজিং আর চরম মুসলমানবিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর বক্তব্য দেয়ার পরও কোনো পুলিশ অ্যাকশন না ঘটানোতে, হিন্দু ভোটারদের মনে উসকানির ঝড় তুলতে মানসিকভাবে তাদের প্রভাবিত করার সুযোগ নেয়া হয়। এভাবে এক মাস কাটিয়ে দেয়ার পরে নরসিংহ আনন্দ- এরপরে গ্রেফতার হয়েছে কি না বা জামিন হয়েছে কি না তা এসব ক্ষুদ্র আমজনতা হয়তো ব্যাপারটা জানবে না; বেশির ভাগই মনে রাখবে না। কিন্তু এ দিকে হিন্দু ভোটারদের উসকানি দিয়ে তাদের মোদির ভোটের বাক্স পর্যন্ত আনার লক্ষ্যে তাদের মনের ওপর ছাপ ফেলার ঘটনাটা ঘটিয়ে দেয়া হলো। এই হলো পরিকল্পনা। যেমন এর মধ্যে যে নরসিংহ আনন্দের জামিন হয়ে গেছে তা আর পত্রিকার কোনো খবরই নয়।

এবার দ্বিতীয় ঘটনা - স্কুল-কলেজে হিজাব

নির্বাচন শুরু হয়ে গেলে সেসব রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যায়। তাদের যেকোনো নির্দেশনা মান্য করা বাহিনীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। সে কারণে হিজাবের ইস্যুটা তোলা হয়েছে এমন এক বিজেপিশাসিত রাজ্যে যেখানে এ বছর নির্বাচন নেই। ফলে নির্বাচন কমিশনের কিছু বলার নেই। কিন্তু আবার ইস্যুটা হাজির করা হয়েছে এমনভাবে যার এফেক্ট ভারতব্যাপী বিস্তৃত হয়। এটিই স্কুল-কলেজে হিজাব নিষিদ্ধকরণ ইস্যু যে কারণে এটি কেবল কর্নাটক রাজ্যের ঘটনা। এর ওপর আবার এটি এক-দু’টি স্কুল-কলেজের পরিচালনা কমিটির নেয়া সিদ্ধান্ত। সারা কর্নাটক রাজ্যে বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও নয়। একটি জেলার দু-একটি স্কুল-কলেজে। কিন্তু পাশের আরো দুটো জেলায় জবরদস্তিতে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালু করার প্রচেষ্টাই শুরু করে দেয়া, আন্দোলন, এসব শুরু করা হয়েছে মোদির ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে; অথচ স্কুল পরিচালনা কমিটি নিশ্চুপ।

অথচ কার্যত হিজাদ নিষিদ্ধ ইস্যুটা সারা কর্নাটক তো বটেই, সারা ভারতের সব রাজ্য ছাপিয়ে ভারতের বাইরে আমেরিকার নিন্দা প্রস্তাব, ওআইসি নিন্দা প্রস্তাব ঘটিয়ে এটি এখন ভারতের জন্য এক গেøাবাল কূটনীতিক ইস্যু হয়ে গেছে; অর্থাৎ বলাবাহুল্য এর এফেক্ট নির্বাচন চলছে এমন পাঁচ রাজ্যের ওপরই পরিপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলেছে। আর এবার তা সেখানকার প্রতিটি ব্যালট বাক্সে গিয়ে আছড়ে পড়বে, বিজেপির ভোটের বাক্সগুলো এখন নিশ্চয় উপচে পড়বে আর মোদি-বিজেপি এরই অপেক্ষায়! এ হলো পরিকল্পনা!

কথিত নিরপেক্ষ হিন্দুত্বের আদালত

এ ছাড়া এবার ঘটনাকে আরো পোক্ত করতে কোনো উপায়ই ছাঁটা হয়নি। তাই আদালতও। আদালত মানেই ভীষণ বিজ্ঞ, জ্ঞানী মানুষে তা ভরপুর থাকে। তাদের সামাজিক সম্মানও অনেক উঁচুতে। সুপ্রিম কোর্ট থেকেও এ ইস্যুতে বলা হলো, তারা এখন হস্তক্ষেপ করবে না; কখন করবে তা তারাই ঠিক করবে বলে দেয়া হয়েছে। আর এ সুযোগে স্থানীয় রাজ্য হাইকোর্ট বিরাট নিরপেক্ষতার ভান নিয়ে হাজির। তারা এক সাময়িক রায় দিয়ে দিয়েছে। সেটি হলো, ‘স্টাটাস কো’ যার আইনি মানে হলো বিবদমান পক্ষগুলো বিবাদ শুরুর আগে যে যেখানে ছিল, সেখানে ফিরে গিয়ে স্থিতাবস্থায় থাকবে, যত দিন আদালত ইস্যুটা নিয়ে বিচার বিবেচনা করে কোনো ফাইনাল রায় না দেয়। এটিই ইউজুয়াল প্র্যাকটিস হয়ে থাকে।

কিন্তু এখানে একটি টুইস্ট করে দেয়া হয়েছে। বলছে ‘স্ট্যাটাস কো’; কিন্তু সাথে ব্যাখ্যা দিচ্ছে যে, এর মানে হলো, এই অন্তর্বর্তী বা সাময়িক সময়ে কেউ কোনো ধর্মীয় পোশাকে স্কুল-কলেজে যেতে পারবে না। এ বলাটাই বেআইনি। এটিই এক বিরাট বৈষম্য - একেবারে এক সূক্ষ্ম কারচুপি করা যাকে বলে।

কারণ হিজাব ইস্যু হওয়ার আগে যে যেমন খুশি হিজাব, পাগড়ি, ঘোমটা প্রভৃতি পরে স্কুল-কলেজে যেতে পারত ও আসতও। কাজেই ‘পূর্বাবস্থা’ বলতে এটিকেই বোঝায়। কিন্তু ব্যাখ্যায় তা না বলে উল্টো ধর্মীয় পোশাক পড়া যাবে না এ কথা বলে আসলে কথিত এই সাময়িক সময়ের রায়ের কথা বলে যারা হিজাববিরোধী মোদি-বিজেপির লোক এদের দাবিকেই মেনে নেয়া ও এদের পক্ষেই রায় দিয়ে দেয়া হয়ে গেছে। অথচ এই সাময়িক রায়েও কোনো শুনানিই করা হয়নি, আদালত যেন খুবই একটি নিরপেক্ষ সাময়িক সিদ্ধান্ত দিয়েছে এই ভাব করে তাদের হিন্দুত্বের খেয়াল চাপিয়ে দিয়েছে।

এখন পরে কী ফাইনাল রায় হবে তা আগেই বলে দেয়া যায়। এ বছরের নির্বাচন কেবল এই পাঁচ রাজ্যে আর তা কেবল ১০ মার্চ পর্যন্ত। এর মানে হলো ১০ মার্চের পরে আদালত ফাইনাল রায় দিলে আর সেখানে আবার হিজাব পরে স্কুল-কলেজে আসার পক্ষেও যদি আদালত রায় দেয় তো বিজেপির আপত্তি হবে না; কারণ পরের বছরের আগে আর নির্বাচন নেই। অর্থাৎ এখনকার এই সাময়িক নিষেধাজ্ঞা বিজেপির পক্ষে কাজ করে দিয়ে আদালত বিজেপির হিন্দুত্ব ও ভোট জোগাড়কে সাহায্য করল। আবার ফাইনাল রায় হিজাবের পক্ষে না দিয়ে বিচারক বিরাট উদার বিচারক সাজবার পথ পরিষ্কার রেখে দিতে পারবেন।

উচ্চ আদালতগুলোর ভেঙে পড়ার ইতিহাস

এমনিতে ভারতের উচ্চ আদালতগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশের চোখে আমাদের দেশের অনেকে ভূয়সী প্রশংসা করতে দেখা যায়। কিন্তু বটম অব দ্য ফ্যাক্টস হলো, ভারতের আদালতগুলো স্বেচ্ছায় রাজনীতি বা সরকারের কাছে নিজেদের সব ক্ষমতা সমর্পণ করার পেশাগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী কারচুপির জাজমেন্টের পর থেকে যেখানে ইন্দিরার ওপর ক্ষমতা ত্যাগ ও শাস্তি গ্রহণ করার রায় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইন্দিরা তা গ্রহণ না করে রায় উপেক্ষা করে ক্ষমতায় থেকেই উল্টো দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। এভাবে তিনি শাস্তি গ্রহণ এড়িয়ে গিয়েছিলেন।

আর সেই থেকে আইন পেশার সব লোক, রাজনীতিবিদ মিলে মূল্যায়নে গিয়েছিলেন যে, জাজদের ওমোন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সাথে সঙ্ঘাতে যাওয়াতে ভারত-রাষ্ট্রই দুর্বল হয়ে গেছে। তাই তাদের আপস করা উচিত ছিল।’ এমন সঙ্ঘাতের এই নাকি মহিমা। অতএব মন্দের ভালো হিসেবে ক্ষমতার সাথে আপস করাই ভালো। কেন?

কারণ না হলে জরুরি অবস্থা দিলে তো তা রাষ্ট্রই না থাকার সমান, এই ক্ষতি হয়। ফলাফলে জরুরি অবস্থা পাওয়ার চেয়ে নির্বাহী ক্ষমতার সাথে আপস করা অথবা এড়িয়ে চলা হলো, সর্বোত্তম পন্থা। যদিও এর কোনো লিখিত প্রস্তাব পাওয়া যাবে না, এটি তাদের অলিখিত চর্চা ও বুদ্ধিজীবিতা! আর এ সুযোগে দেখা যাচ্ছে এখন যেটা হয়েছে, একদল বিচারক হয়েছেন যারা এ সুযোগে প্রধান নির্বাহীর কাছ থেকে নানা পার্সোনাল সুবিধা আদায় করে নেয়ার সূক্ষ্ম তৎপরতা চালিয়ে, কে কত বুদ্ধিমানের মতো মোদির সাথে সঙ্ঘাত এড়িয়েছেন সেই ক্রেডিটের গর্ব ও এর প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছেন। ভারতের পরপর দুই প্রধান বিচারকের দোষ আছে তা তারা আমাদের দেখিয়েছেন।

এতে প্রায়ই ভারত-রাষ্ট্রের বড় বড় দুর্বলতা বা ‘ফুটাফাটা’ এসবের কারণে, এটি ভেঙে পড়ার দিকে এগোচ্ছে বলা হয় - সে পথের সবচেয়ে বড় এক গর্ত হলো, এই নির্বাহী ক্ষমতার সাথে আপস, এড়িয়ে যাওয়া তথা হবু জরুরি অবস্থা এড়ানোর বিরাট বুদ্ধি প্রয়োগ-কথা!

মুসলমান কোপানো, ঘৃণা ছড়ানোর সাথে ভোটের সম্পর্ক

অনেকের মনে হতে পারে মোদির মুসলমান কোপানো, ঘৃণা ছড়ানোর নীতি-পদক্ষেপের সাথে ভোটের সম্পর্ক কী? আমরা বোধহয় বাড়িয়ে দেখছি ব্যাপারটাকে। ভারতে এখন রাজ্য নির্বাচন চলছে পাঁচ রাজ্যে যেখানে সবচেয়ে বড় উত্তরপ্রদেশ রাজ্যও আছে। কত বড়? ভারতে কেন্দ্র সরকার গড়তে মোট ন্যূনতম ২৭২ আসনে জিততে হয়। এই ২৭২টার ৮০ আসন সংগ্রহ করা সম্ভব একা এই উত্তরপ্রদেশ থেকেই, যা প্রায় তিনের এক ভাগ আসন পেয়ে যাওয়া। এ কারণে বলা হয়, কেউ কেন্দ্রে সরকার গড়তে চাইলে উত্তরপ্রদেশে জেতা গুরুত্বপূর্ণ, যদিও এখন যা চলছে তা কেন্দ্রের নির্বাচন না; রাজ্য নির্বাচন। কিন্তু এখন রাজ্য নির্বাচনে জিতলে তবেই না ২০২৪ সালে কেন্দ্র নির্বাচনে জেতা সম্ভব! এ কারণে এবারের উত্তরপ্রদেশে মোদি যেকোনোভাবে জিততে মরিয়া!

ঘটনার কেন্দ্র কৃষি আইনবিরোধী আন্দোলন

এই প্রথম এটি রেকর্ড যে, একটি কৃষক আন্দোলন ১৫ মাস ধরে লাগাতার হাইওয়ে রাস্তায় বসে থেকে প্রতিবাদ করে গেছে। দিল্লি-উত্তরপ্রদেশের সংযোগ হাইওয়ে সড়কের মুখ্য শহর গাজিপুর। এটিই হলো সেই আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি। হিন্দু জাতিবাদী আনন্দবাজার পত্রিকাও একে ‘ধাত্রীভূমি’ বলে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছে। এ অঞ্চলকে ‘পশ্চিম উত্তরপ্রদেশও’ বলা হয়। এটিই মোদির জন্য কাঁটা বিছানো ভূমি। এখানে মোদি হাঁটলে পায়ে কাঁটা বিঁধবে খালি। অথচ বিরোধও অন্যদের বেলায় হবে উল্টোটা। দিল্লিসহ এ অঞ্চলের আবহাওয়া হলো - গ্রীষ্মে যত তপ্ত গরম, শীতকালে ততই শীত। অথচ এখানেই ১৫ মাস ধরে অনেকেই বউ সাথে নিয়ে রাস্তায় বসে-শুয়ে কষ্ট করে গেছেন। শেষে মোদি তাদের সবার কাছে হার স্বীকার করে মাফ চেয়েছেন, চালু করা তার তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার বা বাতিল করেছেন। কেন?

এ অঞ্চলটা আশপাশের হরিয়ানা, পাঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশের যারা বাণিজিক কৃষি করে থাকেন, তাদের সবার চেয়েও সমৃদ্ধ এবং আসলে অগ্রগামী স্বার্থের বড় কৃষক লোকেদের বসবাসের স্থল। এদের জাট বা জাঠ, ইংরেজিতে জাঠল্যান্ডার বলা হয়; এমন এদের বৈশিষ্ট্য হলো মিনিমাম পাঁচ একর ও উর্বর জমিকে ঘিরে এদের কারবার এবং পাইকারি কৃষিপণ্যের বাজারের বড় সাপ্লায়ার এমন কৃষক এরা। পাকিস্তানের করাচিতে বা কাশ্মিরেও এমন জাঠদের দেখা মিলবে। যত আরবাইনাইজেশন বা শহুরেকরণ ঘটবে, ততই জাঠ কালচার বড় হবে। এরাই ছিল ওই কৃষক আন্দোলনের মূল আপসহীন অংশ। কিন্তু এমন জাঠ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান জাঠের টেনশন প্রায়ই ঘটে থাকে, হয়েছেও স্থানীয় ভাষায় যা আবার জাঠ ও মুসলমান দ্বন্দ্ব।

মোদির ২০১৪ সালের প্রথম কেন্দ্রে সরকার গঠনে নির্বাচনের আগের এক বছর অমিত শাহ, ‘দা মাস্টারমাইন্ড অব দাঙ্গা’ - তিনি এসে এই উত্তরপ্রদেশে কাটিয়েছেন। তারই পদক্ষেপে মুজাফফরনগরে তিনি পরিকল্পিত দাঙ্গা ঘটিয়েছিলেন, যার পরিণতি হলো জাঠ-মুসলমান শত্রুতাকে চরমে তোলা, আর এর সেটিরই ব্যালট ফলাফল হলো, ২০১৪ নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের মোট ৮০ আসনের ৭২ আসন মোদির ব্যাগে। এমনকি এই ‘শত্রুতা’ বিক্রি করেই বিজেপি পরে ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ বা ইউপি রাজ্য নির্বাচনে বিজয় এবং পরে ২০১৯ সালে মোদির দ্বিতীয়বার সরকারের আসার জয় সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু এবার আর নয়। কেন?

এরই মধ্যে এবার এই জাঠ ও মুসলমান একযোগে মোদির বিরুদ্ধে রাস্তায় কৃষি আন্দোলন করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন। আর এতেই মোদি মাফ চেয়েও যে এই বিরোধী ঐক্যের পাথর সরাতে পারবেন না, তা জেনেও যতটা যা করা যায় মনে করে মাফ চেয়েছেন। আর তার একমাত্র করণীয় করেছেন প্রবলতরভাবে। মুসলমান কোপানো আর বিদ্বেষ-ঘৃণা ছড়ানো তুঙ্গে তোলা, এখান থেকেই বাড়তি হিজাব বিতর্ক। স্কুলের ছোট বা টিন-এজ মেয়েগুলোকে মানুষের মর্যাদা হারিয়ে অপমানের অভিজ্ঞতায় অবলীলায় ডুবিয়ে দেয়ার এই নিষ্ঠুরতা।

ইউপি নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫৮ ও ৫৫ আসনের এলাকায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেছে; বিশেষ করে প্রথম ৫৮ আসন - এই-ই সেই জাঠ অঞ্চল। মোদির ভাগ্য এখানেই নির্ধারিত হবে। তবে এর ফলাফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী ১০ মার্চ। যদিও এরই মধ্যে আগাম মিডিয়া পূর্বাভাস মোদির বিরুদ্ধে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
আরো দুই সদস্য বাড়িয়ে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন রাবির নতুন জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে অপরাধ না করেও আসামি হওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে : মির্জা ফখরুল লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানোৎসবে নেমে শিশুর মৃত্যু ধূমপান করতে নিষেধ করায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা বড় বোনের বৌভাতের গিয়ে দুর্ঘটনায় স্কুলছাত্র নিহত কোটালীপাড়ায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত চুয়াডাঙ্গা দর্শনায় রেললাইনের পাশ থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবার রহমানের কবর জিয়ারত করলেন জামায়াত আমির আরব আমিরাতে ভারী বৃষ্টিপাত, বন্যায় ওমানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৮ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠস্বর

সকল