১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মন্ত্রী বলেন, ‘সারা জীবনের রাজনীতি বরবাদ’

- ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া এখন স্বাভাবিক ঘটনা। যখন তখন যেকোনো অবস্থাতেই দাম বাড়তে পারে। চড়া রোদ উঠলেও, ঝিরঝির বৃষ্টি নামলেও। সরবরাহ কমলেও, প্রচুর সরবরাহ থাকলেও। গত সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। বিক্রেতারা বলল, বৃষ্টির কারণে বেড়েছে। অথচ খেতের পেঁয়াজ উঠে গেছে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে। কোনো খাদ্যপণ্যের ভরা মৌসুমেও দাম বাড়ার প্রবণতায় ভাটা পড়ে না। সরকারও দাম বাড়ায়, বিক্রেতাও বাড়ায়, মধ্যস্বত্বভোগীও বাড়ায়। এমনকি দাম বাড়ায় বিত্তবান সেসব ক্রেতাও, যারা যাচাই না করেই বিক্রেতার হাঁকানো দরে বিনাবাক্য ব্যয়ে পণ্য কিনে নেন। তার এই কাজটিও পণ্যমূল্য বাড়াতে ভূমিকা রাখে। দাম বাড়াতে পারেন না শুধু সাধারণ মানুষ, যারা বিত্তহীন ক্রেতা।

সম্প্রতি বাজারে তেল, মুরগি, পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। বেড়েছে চালের দামও। প্রতিটি পণ্যই মানুষের প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদার মতো। না কিনে উপায় নেই। বাঁচতে হলে চাল কিনতেই হবে। কিন্তু সেই চালের বাজার গত প্রায় এক মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী। কেন দাম বাড়ছে, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

চলতি বছর আউশ, বোরো ও আমনের রেকর্ড ফলন হয়েছে। বাজারে সরবরাহ যথেষ্ট। সরকারি গুদামে মজুদও নাকি সর্বকালের সর্বোচ্চ। অর্থাৎ সব গুদাম ভরা। অথচ ভরা আমন মৌসুমেও চালের দাম বাড়তে বাড়তে নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ভোক্তাদের তিন বেলার খাবার জোগাতেই নাভিশ্বাস উঠছে। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালের দাম ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। আগামী এক মাসে চালের দাম আরো বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে।

সরকারের কৃষি বিপণন অধিদফতর বলেছে, এই মুহূর্তে বাজারে চালের যৌক্তিক মূল্য যা হওয়া উচিত, তার চেয়ে কেজিপ্রতি এক থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে বিক্রেতারা। বাজারে এখন এক কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। ২০১৭ সালের পর এটাই চালের সর্বোচ্চ দর। এ ছাড়া মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা এবং চিকন বা সরু চাল ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শুধু এখন নয়, করোনার মধ্যে সারা বছরই চাল চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। সরকার গত বোরো মৌসুমে উৎপাদন খরচ ও মুনাফা যুক্ত করার পর সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চালের দাম নির্ধারণ করেছিল ৩৬ টাকা। আমনে তা কেজিপ্রতি ৩৭ টাকা ধরা হয়। অবশ্য গত বোরো মৌসুম শেষে বছরজুড়েই মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৫ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। বাজারে চালের চড়া দামের ফলে উচ্চহারে মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, সরকারি মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ, তার পরও চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। চালের চাহিদার অনুপাতে দ্রæত উৎপাদন বাড়াতে রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হচ্ছে।’ এই রোডম্যাপ কী কাজে লাগবে সেই প্রশ্ন তাকে কেউ করেনি। দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর রোডম্যাপ চালের দাম কমাতে কীভাবে ভূমিকা রাখবে তা বোধগম্য নয়। যেখানে চালের কোনো ঘাটতি নেই সেখানে দাম কমানোর জন্য উৎপাদন আরো বাড়ালেই দাম কমে যাবে এমন তত্ত্ব অভাবিত। তবে এ বক্তব্য থেকে একটি বিষয় সামনে আসে। সেটি হলো, সমস্যার মূলে হাত দেয়ার সদিচ্ছা, ক্ষমতা ও তাকিদ সরকারের কোনো পর্যায়েই সম্ভবত নেই।

সবাই জানে, দেশে চালের বাজারের মূল নিয়ন্ত্রক মিলার বা চালকল মালিকরা। তাদের মধ্যে আবার হাতেগোনা কয়েকজন মূল হোতা। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় মিলারদের ওপর নজরদারি বাড়ানো দরকার। সরকার সে দিকে যাচ্ছে না। চালের দাম বাড়ানোর পেছনে কারসাজি করে মিল মালিক ছাড়াও মজুদদার ও আড়তদার সিন্ডিকেট। এই তিন চক্রের ওপর নজরদারি জোরদার করা বা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ আয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে নেই।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সম্প্রতি রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবৈধ মজুদদারি রোধে করণীয় ও বাজার তদারকি-সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা করেছেন। তাতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী বলেন, গতবার ধান সংগ্রহ ভালো হয়নি। মজুদ ছিল চার লাখ টন। সেই সময়ও চালের দাম বাড়তে দিইনি। এবার বোরোতে যেমন বাম্পার ফলন হয়েছে, আমনেও বাম্পার ফলন। জাতীয় মজুদ সর্বকালের সেরা। এ সময় চালের দাম বাড়ছে। এটা হাস্যকর। এখন চালের দাম বাড়াটা ভালো ঠেকছে না।’

‘ভালো ঠেকছে না’ বলতে মন্ত্রী কী বোঝাচ্ছেন তা বিস্তারিত বলেননি। কিন্তু তার বক্তব্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। চালকল মালিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ‘আপনারাই বলেছেন, উৎপাদন প্রচুর হয়েছে। ঘাটতি নেই। মজুদ আছে। ধান আপনারাই কেনেন। আপনারাই ভাঙান।... আপনারাই বলছেন, অবৈধ মজুদ আছে। আপনারাই সেখান থেকে কিনছেন। আপনারাই জানেন, কার কাছে মজুদ আছে। দয়া করে তথ্যটা আমাদের দিন। সহযোগিতা করুন।’

চাল আমদানির ক্ষেত্রেও মিলাররা বাধা। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, মিলাররা যদি সব চাল বাজারে বিক্রি করে দেন এবং তারপরও ঘাটতি পড়ে তাহলে সরকার আমদানির পথে যাবে। মন্ত্রী বলছেন, ‘আপনারা সব (চাল) বিক্রি করে দেন। তারপর যদি ঘাটতি হয়, আমরা আমদানির রাস্তা পাবো। সেই রাস্তাও আপনারা খোলাসা করছেন না। আপনারা ধীরে ধীরে রক্তচোষার মতো করে চুষবেন, তা তো হতে পারে না।’

চালের দাম নিয়ে কারা মানুষের রক্ত চুষছে, মন্ত্রী জানেন। কিন্তু ব্যবস্থা নেন না। রক্তচোষাদের উদ্দেশ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের আমি অনুরোধ করব, কোথায় কোথায় ধান মজুদ আছে, সেই তথ্যগুলো আমার জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে দিন। সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে, কার কাছে ধান মজুদ আছে। দয়া করে তথ্যটা দিন। আমরা কিন্তু আপনাদের চালকলে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করিনি। চাল জব্দ করিনি। ব্যবসা করছেন, লাভ হচ্ছে কি লোকসান হচ্ছে, সেটা আপনারাই বুঝবেন। আমি এগুলো বুঝতে চাই না। আমি পত্র-পত্রিকায় সপ্তাহে দুই-তিনবার করে চালের দাম বাড়তি দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আপনারা দয়া করে আমাদের সহযোগিতা করুন।’

মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে বুঝতে কী বাকি থাকে, চাল নিয়ে কারা কারসাজি করছে? কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা তার নেই। সেটা বোঝা যায় তার কাতর মিনতি থেকে। তিনি তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমরা কিন্তু আপনাদের চালকলে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করিনি। চাল জব্দ করিনি।’

মন্ত্রী দায়িত্বে আছেন, সারা দেশের সব মানুষের কল্যাণের জন্য। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষকে যুক্তিযুক্ত দামে চাল সরবরাহ করা তার দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব তিনি পালন করছেন না। চালকল মালিকদের অবৈধ কাজে সাহায্য করছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা না করে, মজুদদারদের সরকারিভাবে চিহ্নিত না করে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে। এর পেছনে রহস্য কী? তার এই অবস্থান কি গণমানুষের পক্ষে যে গণমানুষের জন্য তারা রাজনীতি করেন বলে আজীবন চিৎকার করেন!

দেশে কেউ আইনকানুন ভঙ্গ করলে তাদের ধরার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। আইন-আদালত আছে। সরকারের হাজারটা উপায়-উপকরণ আছে দোষীদের ধরার। কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী সে পথে না গিয়ে যারা অপরাধী তাদেরই হাতে-পায়ে ধরছেন। এটি অবিশ্বাস্য। চালের দাম বাড়ানোর জন্য যারা দায়ী তাদের সঙ্গে মন্ত্রীর কিসের সমঝোতার সম্পর্ক, আমরা জানি না। কিন্তু অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করে সব আলামত মন্ত্রীর হাতে তুলে দেবে এমন সরল বিশ্বাস দিয়ে মন্ত্রণালয় তথা রাষ্ট্র পরিচালনা তো দূরের কথা, পাড়ার মসজিদ-মন্দির কমিটিও চালানো যায় না।

চালের বাজার যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের বিরুদ্ধে নজরদারি বা আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারার পেছনে তাদের দলীয় পরিচয় সম্ভবত একটি বড় ফ্যাক্টর। সে কারণেই হয়তো মন্ত্রীকে কাকুতি-মিনতি করতে হয়। এদিকে চাল কিনতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। মহামারীর ধাক্কায় আর্থিকভাবে যাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে সেই নিম্নবিত্ত মানুষেরা দু’মুঠো খাবার পাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের দামে আগুন। তাই ন্যায্যমূল্যে পণ্য পেতে রাজধানীতে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের ভিড় বাড়ছে। শুধু নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্তদেরও দেখা যাচ্ছে সেখানে। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে ট্রাকের পেছনে মানুষের সারি। টিসিবি এখন চাল বিক্রি করে না। চাল বিক্রি করা হলে এই সারি আরো বাড়বে।

এমনকি গ্রামের প্রান্তিক মানুষও ভালো নেই। ভিজিডির চালও লোপাট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বগুড়ার ধুনটে আওয়ামী লীগের এক নেতা ও তার কাজের লোকের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ভিজিডির সরকারি চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। এমন আরো অনেক ঘটনা সবার অগোচরে ঘটছে যেগুলো মিডিয়ায় আসছে না। কারণ মিডিয়াকর্মীরা সেসব খবর বোধগম্য কারণেই চেপে রাখেন বা নিউজ করা থেকে বিরত থাকেন।

খাদ্যমন্ত্রীর যে মিটিংয়ের বক্তব্য আমরা উপরে তুলে ধরেছি তাতে তিনি আরো কিছু কথা বলেছিলেন। সেটিও মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে। মন্ত্রী চালকল মালিকদের কাছে আক্ষেপ করে বলেছেন, তার মন্ত্রিত্বের তিনটি বছরে সারা জীবনের রাজনীতির শিক্ষা নস্যাৎ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘হয়তো বা এই তিন বছর পরে আপনাদের কাছে আমার নতুন করে শিক্ষা নিতে হবে। আমার এই তিন বছর বরবাদ গেল। আমার সারা জীবনের রাজনীতিই বরবাদ গেল।’

সারা জীবনের রাজনীতি বরবাদ করে দিয়ে তাকে কেন মন্ত্রীর চেয়ারে বসে থাকতেই হবে, সেই প্রশ্ন তোলা জরুরি মনে করছি না। কারণ তিনি অভিজ্ঞ মানুষ, অভিজ্ঞ রাজনীতিকও। মন্ত্রীর চেয়ারে বসে দেশের মানুষের স্বার্থে ন্যূনতম ভূমিকা রাখতে না পারলে কী করণীয়, সেটি তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। তবে সেই পদক্ষেপ নেবার মতো সাহস, মনোবল হয়তো সবার থাকে না। হয়তো থাকে না পরিবেশ-পরিস্থিতিও। তবে মন্ত্রীর আফসোস করার তেমন কিছু নেই। কারণ, তার দল ক্ষমতায় আছে গত এক যুগ। এই সময়ে পুরো দলেরই পৌনে ১০০ বছরের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও গণমুখী রাজনীতির ধারা কতটা উজ্জ্বল হয়েছে বা বরবাদীর খাতায় গেছে সে বিবেচনার সময় আসবে।

এই মুহূর্তে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে অসাধু মিলার, মজুদদার ও আড়তদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তথা পুলিশিব্যবস্থা নেয়া দরকার। দরকার সম্ভবত চালের আমদানিও। কারণ সরকারের পরিসংখ্যান যে সঠিক চিত্র দেয় না, সেটি গত ১২ বছরে সবারই জানা হয়েছে। সীমিত আয়ের মানুষ এবং কোভিড মহামারীতে নতুন করে গরিব হয়ে পড়া মানুষদের কষ্ট লাঘবে এই কাজটুকু মন্ত্রী করতে পারেন কি না সেটাই দেখার অপেক্ষা।
mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement