২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এক হাজার কোটি ডোজ টিকাদানের মাইলফলক

-

করোনাভাইরাসের কাছে হার মানলেন সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী হিসেবে পরিচিত ভারতের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি রোববার তার মৃত্যু হয়। প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বের এমন অনেক গুণী মানুষই হারিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন। করোনা মহামারী আরো কত মানুষের যে মৃত্যু ঘটাবে সেটিই দেখার বিষয়।

লতা মঙ্গেশকর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাতেও তার অসংখ্য হিট গান রয়েছে। ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ খ্যাত এই শিল্পী তার অর্ধশত বছরের ক্যারিয়ারে ৩৬টি ভাষায় ৩০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এক হাজার কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগের খবরটি বিশ্বে আশা জাগিয়েছিল। আশার কারণ করোনার টিকা হয়তো মৃত্যুর মিছিল আটকে দেবে। কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের করোনার মৃত্যু ওই আশাকে বিষাদে ঢেকে দিলো। এমন গুণী শিল্পী হয়তো আমরা আর পাবো না।

ওমিক্রনে কি মহামারী শেষ হবে?
করোনাভাইরাসের বিশেষ ধরন ওমিক্রনের মাধ্যমে মহামারী শেষ হতে যাচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি উল্লেখ করেছিলেন। তাদের এ বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি ছিল যে এ ধরনটি বিশ্বে অতিমাত্রায় ছড়াচ্ছে এবং সংক্রমণ বেশি হলেও ডেল্টা ধরনের চেয়ে এটি মারাত্মক নয়। ব্যাপক ছড়ানোর মাধ্যমেই মহামারীর সমাপ্তি ঘটবে। তবে তাদের এ ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে একদল গবেষক সতর্ক করেছেন যে, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকেও যেতে পারে। ‘ওমিক্রন কি মহামারীর সমাপ্তি ঘটাবে’ শিরোনামে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওমিক্রনই কারোনাভাইরাসের শেষ ধরন নয়।

গবেষণাগারে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেন, করোনাভাইরাসের পরবর্তী ধরনটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই আত্মপ্রকাশ করবে। করোনা মহামারীর পুরোপুরি অবসান হবে না। অদূরভবিষ্যতে এটি ‘এনডেমিক ডিজিজ’ বা স্থানীয় রোগ হিসেবেই থেকে যাবে। তবে বিশ্লেষকরা টিকার বিপুল ব্যবহার, নতুন নতুন ওষুধ চলে আসা এবং করোনাভাইরাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণাকে খুবই ইতিবাচক উল্লেখ করে বলেছেন, করোনা মহামারী নিয়ে এখন আর ভীতির কারণ নেই। যদিও বিশ্বের ২২৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারী প্রায় ৩০ কোটি জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করেছে এবং সাড়ে ৫৭ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে করোনার মৃত্যু ৯ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, ব্রাজিলে সাড়ে ছয় লাখ, ভারতে মৃত্যু ছাড়িয়েছে পাঁচ লাখ।

আশার কথা হচ্ছে এক বছরের কিছুটা বেশি সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী এক হাজার কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে টিকা গ্রহণের ফলে কোভিড-১৯ রোগের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি কমে এসেছে। কোনো রোগের ক্ষেত্রে এত বিপুল পরিমাণ টিকাদানের নজির নেই।

টিকায় নতুন ইতিহাস
নেচার পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এক বছরের কিছুটা বেশি সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এটি ইতিহাসের বৃহত্তম টিকাদান কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

অনেক দেশে ২০২০ সালের শেষ কিংবা ২০২১ সালের প্রথম দিকে টিকাদান শুরু হয়। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি বা প্রায় ৪৮০ কোটি মানুষকে অনুমোদিত টিকার অন্তত এক ডোজ দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ সব মিলিয়ে ২০টির মতো টিকা অনুমোদন করেছে।

আনন্দের খবর হলো টিকাদান শুরুর পর প্রথম চার মাসে ১০০ কোটি ডোজ দেয়া হয়। এরপর বাকি ৯ মাসে দেয়া হয়েছে ৯০০ কোটি ডোজ। ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যামান্ডা গ্লাসম্যান বলেন, বিশ্ব এর আগে এই মাত্রার জীবনরক্ষাকারী প্রযুক্তির ব্যবহার আর দেখেনি। টিকার চলমান প্রচেষ্টা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।

কিন্তু গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, টিকা প্রাপ্তিতে ধনী ও নিম্নআয়ের দেশগুলোর মধ্যে প্রকট বৈষম্য রয়েছে। কিছু বিজ্ঞানী সতর্ক করেছেন যে এই অব্যাহত বৈষম্যের ফলে টিকা না পাওয়া জনসংখ্যা থেকে করোনার নতুন ধরনের উদ্ভবের ঝুঁকি থেকেই যাবে।

লাইবেরিয়ার রিফিউজ প্লেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা মোসোকা ফালা বলেছেন, ১০ বিলিয়ন টিকার মাইলফলকের তথ্য একজন আফ্রিকান হিসাবে তার কাছে বৈষম্যের বার্তাবাহক। বিশে^র উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে টিকা বিতরণে বিদ্যমান চরম বৈষম্যকেই তুলে ধরছে এটি। যতক্ষণ না আমরা এই বৈষম্য দূর করব, বিশ্ব করোনার নতুন রূপ দেখতেই থাকবে।

বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশের মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ করোনার টিকা একটি ডোজ পেয়েছে। ধনী দেশগুলো টিকার পেটেন্ট তুলে নিলে নিম্নআয়ের অনেক দেশ নিজেরাই টিকা তৈরি করতে সক্ষম হবে। জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন বলেছেন, এ বৈষম্য সত্ত্বেও ১০ বিলিয়ন ডোজের মাইলফলকে পৌঁছানো একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত। এটি একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব যে একটি নতুন রোগ শনাক্ত করার পর দুই বছরের মধ্যেই তার ১০ বিলিয়ন ডোজ টিকা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।

টিকায় কমে দীর্ঘ-কোভিডের ঝুঁকি
করোনাভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তিদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, টিকা গ্রহণ এ রোগের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। ইসরাইলের গবেষকরা জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমিত কিন্তু টিকার সম্পূূর্ণ ডোজ নেয়া ব্যক্তিদের টিকা না নেয়া লোকদের চেয়ে সাধারণ দীর্ঘ কোভিডের উপসর্গ থাকার সম্ভাবনা অনেক কম। ইসরাইলের সাফেদের বার-ইলান ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজিস্ট মাইকেল এডেলস্টেইন বলেছেন, ‘আপনার প্রয়োজনেই টিকা নিন।’

অনেকে করোনা সংক্রমণের কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর পরেও দীর্ঘ কোভিডের লক্ষণ যেমন ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও মনোযোগ সমস্যায় ভুগতে থাকেন। ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সংক্রমিত ব্যক্তির মধ্যে করোনার স্থায়ী লক্ষণ দেখা যায়। তবে টিকা দীর্ঘ কোভিডের লক্ষণ হ্রাস করে।

মহামারীর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পরীক্ষা করার জন্য গত বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এডেলস্টেইন এবং তার সহকর্মীরা তিন হাজারের বেশি লোককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তারা দীর্ঘ কোভিডের সাধারণ লক্ষণগুলো অনুভব করছেন কি না। তাদের সবারই করোনা হয়েছিল।

গবেষকরা দেখেছেন, টিকা না নেয়া ব্যক্তিদের চেয়ে সম্পূর্ণ ডোজ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মাথাব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা ৫৪ শতাংশ কম, ক্লান্তি বোধ করার সম্ভাবনা ৬৪ শতাংশ কম এবং পেশি ব্যথার সম্ভাবনা কম ৬৮ শতাংশ।

এডেলস্টেইন বলেছেন, তার দলের গবেষণাটি এখন পর্যন্ত টিকা এবং দীর্ঘ কোভিডের সম্পর্কের ওপর সবচেয়ে বিস্তৃত ও সুনির্দিষ্ট। তাদের প্রাপ্ত ফলাফল গত সেপ্টেম্বর থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গবেষণার ফলাফলেরই প্রতিধ্বনি। যুক্তরাজ্যের ওই গবেষণায়ও বলা হয়, দীর্ঘ কোভিডের ঝুঁকিকে অর্ধেক করে দেয় টিকা।

কিংস কলেজ লন্ডনের বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ক্লেয়ার স্টিভস যুক্তরাজ্যের ওই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইসরাইলি গবেষণার তথ্য আগের সব ফলাফলকে সমর্থন করে। এটি আনন্দের ব্যাপার।

বাংলাদেশে টিকা
বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক মানুষ এখনো টিকা পায়নি। ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি খবরে জানা গেছে দেশে গত এক বছরে ৯ কোটি ৯১ লাখ মানুষ টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন। দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ছয় কোটি ৯১ লাখ মানুষ। বুস্টার ডোজ দেয়া হয়েছে ২০ লাখ ৩৮ হাজার জনকে। দেশে এ পর্যন্ত টিকা এসেছে ২৭ কোটি ৬৭ লাখ। সরকারের কাছে মজুদ আছে ১১ কোটি চার লাখ। টিকাদানের সার্বিক পরিকল্পনায় ত্রুটির কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আশা করেন টিকাদান দ্রুত করা সম্ভব হলে বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হওয়ার মাধ্যমে করোনা মহামারীর ঝুঁকি কমে আসবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব,
e-mail: abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement