২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইভিএমে ভোট! ঘুঘুদের ফাঁদের চেয়েও ভয়ঙ্কর!

ইভিএম মেশিন - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের ভোট-ব্যবস্থায় যখন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন অর্থাৎ ইভিএম সংযুক্ত করার কথাবার্তা হচ্ছিল তখন অনেক ইতিবাচক চিন্তাচেতনার মানুষ এতে সায় দিয়েছিলেন। নির্বাচনে সহিংসতা-বালট বাক্স ছিনতাই, জাল ভোট এবং ফলাফল জালিয়াতি নিয়ে যারা আতঙ্কিত ছিলেন তাদের অনেকেই জানতেন না যে, ইভিএমের মাধ্যমে ভোটের ফলাফলে কর্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু গত কয়েক বছর বাংলাদেশের ভোট-ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার, নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের ক্ষমতায় থাকার অভিলাষের রসায়ন এত শক্তিমত্তা নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আঘাত হেনেছে, যার কারণে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক বোধ-বুদ্ধি-বিশ্বাস-আস্থা ইত্যাদি সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

বাংলাদেশে যারা ইভিএম চালুর পক্ষে কথা বলেন তাদের অনেকেই এই পদ্ধতিটিকে ভোট প্রদানের আধুনিক এবং কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করতে চান; কিন্তু তারা এ কথা বলেন না কিংবা এ কথা জানেন না যে, উন্নত বিশ্বে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সাহায্যকারী উপকরণ হিসেবে। মার্কিন মুলুকে ভোটের ফলাফল ত্রিমাত্রিক পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই করে তারপর ঘোষণা করা হয়। সে দেশে ইভিএমে যে ভোট প্রদান করা হয় সেটি যেমন ভোটিং মেশিনে সংরক্ষিত হয় তেমনি ইভিএম মেশিনের সাথে একটি প্রিন্টার থাকে, যেখানে ভোটারের প্রদেয় ভোটের ফলাফল সাথে সাথে প্রিন্ট আকারে বের হয়ে যায়। এরপর ভোটাররা সাধারণ ব্যালট পেপারে সনাতন পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে তা ব্যালট বাক্সে পুরে দেন।

ভোট গণনার সময় ইভিএম মেশিনের ফলাফল, ইভিএম মেশিনের সাথে সংযুক্ত প্রিন্টারের ফলাফল এবং ব্যালট বাক্সে সংরক্ষিত ফলাফল- তিনটি গ্রুপ আলাদাভাবে কাউন্ট করে চতুর্থ গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই চতুর্থ গ্রুপটি যদি দেখে যে, তিনটি ফলাফল যদি একই রকমের হয় তবে তারা ধরে নেন যে, ভোট সুষ্ঠু হয়েছে এবং সে মতে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করে। কিন্তু যদি দেখা যায়, ফলাফলে গরমিল দেখা দিয়েছে তবে ব্যালট পেপার গণনার ফলাফলকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হয়। যদি ফলাফলের মধ্যে মারাত্মক গরমিল থাকে তবে সেই কেন্দ্রে পুনরায় ভোটের আয়োজন করা হয় এবং এসব কর্ম সুচারুরূপে করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল পেতে ভোটারদের বহু দিন অপেক্ষা করতে হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ভোটিং পদ্ধতি এবং ফলাফল ঘোষণার বিড়ম্বনা নিয়ে আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে যখন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন তখন তিনি যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয় নিয়ে খোশ দিলে বলেছিলেন যে, সব ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিক্ষা নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমাদের থেকেও যুক্তরাষ্ট্র অনেক ব্যাপারে শিক্ষা নিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বাংলাদেশের ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ এবং ভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিস্ময়করভাবে ফলাফল ঘোষণার উদাহরণ টেনে বলেন, কিভাবে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে হয় তা যদি শিখতে হয় তাহলে মার্কিনিরা বাংলাদেশে এসে শিখে যেতে পারে।

সিইসি নুরুল হুদার উল্লিখিত বক্তব্যের পর সারা দেশে রীতিমতো রঙ্গ-তামাশার রোল পড়ে গিয়েছিল। মানুষ সিইসি হুদা সম্পর্কে কী ভাবেন অথবা নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মানুষের কেমনতর আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে এবং সর্বোপরি নুরুল হুদার নিয়োগকর্তাদের দল ও ক্ষমতায় থাকা নিয়ে মানুষের অভিমত কী, তা নিয়ে হুদা সাহেবদের কোনো মাথাব্যথা না থাকার দরুন অনায়াসে বিগত দিনগুলোতে যা ইচ্ছে তা বলতে পেরেছেন এবং যা ইচ্ছে তা-ই করতে পেরেছেন। অন্য দিকে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী শাসন, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন-গুম-হত্যা-জেল-জুলুমের বিরুদ্ধে আশ্রয় নেয়ার মতো রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের নির্ভরতা, আস্থা ও বিশ্বাস শূন্যের কোঠায় থাকায় বেশির ভাগ মানুষ স্বেচ্ছায় জবানে তালা লাগিয়ে রেখেছে এবং কানের মধ্যে ভারী তুলো ঢুকিয়ে শ্রবণশক্তিকে ভোঁতা বানিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া দৃষ্টিশক্তির ওপরও একধরনের সেন্সর বসিয়ে দেয়ার কারণে জনগণ জানতে পারেনি যে, জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে মোট কত হাজার কোটি টাকা খরচ করে কতগুলো ইভিএম কেনা হয়েছে!

ইভিএম কেনার পর এই মেশিনের সাহায্যে কোথায় কিভাবে ভোট হয়েছে এবং মেশিনের ফলাফলে কী বিজয়ী হয়েছে ওসব নিয়ে জনগণের সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। কারণ বেশির ভাগ নির্বাচন হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, ক্ষেত্রবিশেষে যেসব স্থানে প্রতিযোগিতা হয়েছে সেখানেও নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ বনাম তাদের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে দু-একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বাদ দিলে যেসব অভিযোগ বাজারে চাউর হয়েছে সেগুলো হলো, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আওয়ামী মনোনয়ন লাভের জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীকে কেবল দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ১০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে বলে সরকার সমর্থক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

মনোনয়ন হাসিলের পর প্রার্থীরা ২০১৮ সালের রাতের ভোট কিংবা ২০১৪ সালের অটো পাসের তথাকথিত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন স্তরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলেছে; কিন্তু তারপরও অনেকের ভাগ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা নির্বাচনী সহিংসতা, দুর্ভোগ-দুর্দশা অনিবার্য হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সাম্প্রতিক চার ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে পরিমাণ লোক মারা গেছে তার নজির বাংলাদেশের শত বছরের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। ফলে নির্বাচনকেন্দ্রিক একদলীয় তৎপরতা এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সহিংসতার কারণে দেশের মানুষ ইভিএম কিংবা প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার কথাবার্তা নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। এ অবস্থায় সাম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার এবং ফলাফল নিয়ে সর্বপ্রথম জাতীয়ভাবে বিতর্ক পয়দা হয়, যখন সেই নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পরাজিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার অভিযোগ করেন যে, ইভিএম জালিয়াতির কারণে তিনি পরাজিত হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ‘অনাগত দিনে কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত হবে না ইভিএম পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা।’

তৈমূর আলম খন্দকারের অভিযোগ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করলে নিবন্ধের পরিধি অনেক বড় হয়ে যাবে বিধায় ওদিকে না গিয়ে শুধু এ কথাই বলব যে, ডা: সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো জনপ্রিয় এবং যোগ্য প্রার্থীর ওপর কেন শাসকদল ভরসা করতে পারল না, সেটি কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না। নির্বাচনকালীন পুলিশের আচরণ এবং শাসকদলের বড় বড় নেতার নারায়ণগঞ্জ গমনের মাধ্যমে ভোটের মাঠে যে উত্তেজনা ছড়ানো হয়েছিল তার ফলে প্রথমত স্বতন্ত্র প্রার্থী জনাব খন্দকারের লোকজনের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের এক সপ্তাহ আগের সময়কালে পুলিশ প্রশাসন-নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দেশে একযোগে একই কায়দায় যে কাণ্ডকারখানা করেছিল- ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। ফলে তৈমূর আলম খন্দকার এবং তার সহযোগীদের অবস্থা হয়েছিল- ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি এবং সেই অবস্থায় ইভিএম-ফিভিএম নিয়ে তার চিন্তাভাবনা করার সময় ছিল না।

নির্বাচনের আগে জনাব খন্দকারের মাথায় কেবল একটা চিন্তাই হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছিল আর সেটি হলোÑ ঘুঘু কোথায়? ঘুঘুর ফাঁদ কোথায়? অথবা ঘুঘু কে এবং ঘুঘুর ফাঁদ কেমন? কারণ আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক যখন নারায়ণগঞ্জ গিয়ে প্রকাশ্যে তৈমূর আলম খন্দকারের উদ্দেশে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে, আপনি ঘুঘু দেখেছেন; কিন্তু ঘুঘুর ফাঁদ দেখেননি; ফলে জনাব খন্দকার এ ধরনের হুমকি শোনার পর প্রচলিত নির্বাচনে-যেসব বাধাবিপত্তি থাকে সেগুলোর মধ্যে ঘুঘু এবং ঘুঘুর ফাঁদ খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তিনি জীবনে প্রথমবারের মতো অদ্ভুত এক নির্বাচনী ঘুঘুর ফাঁদ দেখতে পেয়েছিলেন।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষপর্যায়ে চলে এসেছি। এখন বাংলাদেশী ইভিএম এবং আমেরিকার ইভিএম নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। আমেরিকাতে যে প্রক্রিয়ায় ইভিএম ব্যবহার করা হয় ঠিক সেভাবে বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহৃত হয় না। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার ইভিএমের সাথে যেভাবে প্রিন্টার সংযুক্ত থাকে বাংলাদেশের ইভিএমে সেই অপশনটিই নেই। এর পরের বিষয়টি হলো উদ্দেশ্য। সেখানে ব্যালটের গরমিল ঠেকানো এবং পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভোটের ফলাফল নির্ধারণে ত্রিমাত্রিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ইভিএম ব্যবহার করা হয়। অথচ বাংলাদেশে কী উদ্দেশ্যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে বা আগামীতে ব্যবহার করা হবে- এ কথা যদি নীতিনির্ধারকরা কোনো পবিত্র গ্রন্থ স্পর্শ করে শপথ করে বলে অথবা নিজেদের স্ত্রী-পুত্র-স্বামী-কন্যার মাথায় হাত রেখে কসম কাটে তবুও হয়তো পাবলিক তাদের বিশ্বাস করবে না।

মার্কিন ইভিএম এবং বাংলাদেশের ইভিএম সম্পর্কে আমার সর্বশেষ বক্তব্য হলো- কোনো মেশিনই ভালো ফলাফল দিতে পারে না, যতক্ষণ সেটি যে মানুষটি পরিচালনা করে সে মানুষটি যদি ভালো না হয়। এ জন্যই যেকোনো মেশিন সম্পর্কে সার্টিফিকেট দেয়ার আগে ‘ম্যান বিহাইন্ড মেশিন’ সূত্রটি পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়া অথবা ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-জার্মানিতে যারা ইভিএম তৈরি করে, যারা ব্যবহার করে এবং যে কাজে সেটি ব্যবহৃত হয় তার সবকিছুর মধ্যেই সততা-দক্ষতা-ন্যায়পরায়ণতা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ইত্যাদি থাকে। ফলে ওসব দেশের ভোটাররা ইভিএমের মধ্যে ঘুঘুর ফাঁদ খোঁজে না অথবা ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে ঘুঘুর ফাঁদে পড়ে না। অন্য দিকে বাংলাদেশের ইভিএমে কী হচ্ছে বা কী হবে সেটির চেয়েও যখন মেশিনটির মধ্যে ঘুঘুর ফাঁদের গুজব ছড়িয়ে পড়ে তখন কোনো মানুষ সচেতনভাবে কেন সেই ফাঁদে পা দিতে যাবে?

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement