২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দেশের আড়াই কোটি লোক জলবায়ু উদ্বাস্তু হতে পারে

- ছবি : সংগৃহীত

[গতকালের পর]

বাংলাদেশ কপ-২৬ সম্মেলনেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ সম্পর্কিত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছে। সেখানে কৃষিমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন- জলবায়ুজনিত কারণে যে ক্ষতি আমাদের হবে, তা আমরা নিজস্ব অর্থায়নে করবো; কৌশলগত দিক থেকে কৃষিমন্ত্রীর এমন কথা বলা ঠিক হয়নি, যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি করছেন; সেখানে যদি বলা হয় আমরা নিজেরাই অর্থের ব্যবস্থা করবোÑ বিষয়টি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয় কি? আর ৭০০ কোটি টাকার তহবিল ক্ষতির নিরীখে কি যথেষ্ট? এটা কি সহজ ব্যাপার, যেখানে আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ুর জন্য উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে চলেছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কত শত কোটি টাকা লাগবে তার হিসাব কি করা হয়েছে?

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে, দেশের উন্নয়নের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কার্যকর পথগুলো গবেষকরা সম্মুখে রেখেছেন। সেই সেন্টার অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। দেশে লাখ লাখ মানুষ নানা সময়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ¡াস, দাবদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অনেক অংশ ডুবে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে কিছু কিছু অঞ্চলের আবহাওয়া ইতোমধ্যে সঙ্কটজনক অবস্থাকে আরো শোচনীয় করে তুলছে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ মোটামুটি ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে আরো বেশি হুমকির মুখে ফেলবে। তা ছাড়া এটা স্পষ্ট যে, ঝুঁকিপূর্ণ জলবায়ু সৃষ্টির পেছনে সব বড় কারণগুলোর সাথে দারিদ্র্য অন্যতম। তাই সরকারের দারিদ্র্য কমাতে সাধারণ নীতিমালা তৈরি করা জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন জলবায়ুজনিত সঙ্কটের সমাধানের একটি হচ্ছে ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণ। উপকূলীয় অঞ্চলের ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করা একান্ত জরুরি। সেটি পরিবেশকে কার্বনমুক্ত করার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ হিসেবে কাজ করবে। ম্যানগ্রোভ ক্রমবর্ধমান জীববৈচিত্র্য, মাছের আবাসস্থল ও ইকোট্যুরিজম সুবিধাসহ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে কিন্তু এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, কারণ এ ব্যবস্থায় প্রতি বছর প্রায় ৪০ কিলোমিটার উপকূল রেখায় ম্যানগ্রোভ রোপণ করতে হবে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণে পরবর্তী ৩০ বছরের প্রয়োজন হবে এবং দশ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লাগবে। সব মিলিয়ে, জলবায়ু সুরক্ষা ও পর্যটনের উন্নয়নের পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ এবং পুনঃবনায়নের পিছনে ব্যয়িত প্রতি টাকায় ২ দশমিক ৮ টাকার কল্যাণ সাধিত হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হলো আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে সেখানে মানুষ যাতে আশ্রয় নিতে পারে। অনেকে বর্তমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ব্যবহার করে না, কারণ সেখানে তারা তাদের গবাদিপশু, ও অন্যান্য মূল্যবান প্রাণিসম্পদ রাখার ব্যবস্থা করতে পারে না, তাই প্রস্তাবিত কাঠামোতে মানুষ এবং গবাদিপশু উভয়ের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫৩০টি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন। কিন্তু প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় বিবেচনায় নিলে এগুলো বেশ ব্যয়বহুল হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানে সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলো কালেভদ্রে ঘটে। প্রতিটি বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্রের পেছনে খরচ হবে প্রায় আট দশমিক পাঁচ কোটি টাকা। তবে ব্যয়িত প্রতি টাকা এক দশমিক ৮ টাকার কল্যাণ সাধন করবে।

তৃতীয় সম্ভাব্য সমাধানটি হলো, নিচু জমির চার পাশে বাঁধ দেয়া, যা বন্যা থেকে কৃষিজমি, বাড়িঘর ও নানা স্থাপনা অবকাঠামোকে রক্ষা করবে। তবে নানা দিক থেকে বিবেচনা করে দেখা গেছে, এই প্রস্তাব অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এগুলো করতে বাংলাদেশের খরচ হবে ৩৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। তবে সর্বজনীন একটি সমাধান দরকার যাতে এদেশের অধিবাসীরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারে, এবং সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ নিশ্চিত করা যেতে পারে। অর্থনীতিবিদ আলেক্সজান্ডার গোলবু ও অ্যালেনা স্ট্রুকোভ গোলবু দু’টি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ওপর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। সাধারণত সেগুলোর লক্ষ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার করা, অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করা ও মানুষের সাধ্য বৃদ্ধি করে পুঁজি গঠন করা।

জলবায়ুর পরিবর্তন অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ পেশ করে কিন্তু এগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু আশাব্যঞ্জক কৌশল আছে। অপ্রতুল সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ এখন কিভাবে শুরু করতে চায়, এসব সমাধানের মধ্যে কোনটি বেছে নেয়া হবে বা নজর দেয়া হবে, যঃঃঢ়ং://পড়ঢ়বহযধমবহ, ভনধঢ়ঢ়.রড়/পষরসধঃবঢ়ৎরঃরবং-এর থেকে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ কিভাবে ব্যয়িত প্রতি টাকায় সর্বোচ্চ কল্যাণ পেতে পারে, আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত। ড. বিয়র্ন লোমবাগ কোপেনহেগেন কনসেনসাস স্টোরের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।

এখানে যে তথ্য পেশ করা হলো তাতে আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে ব্যয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার সাথে মন্ত্রীর অর্থ ব্যয়ের হিসাব আকাশ পাতাল ব্যবধান। মন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং একজন কৃষিবিদ তাই তার বক্তব্য নিয়ে আমরা খটকায় পড়ে গেছি। তাছাড়া অন্য আরো কিছু বিষয় রয়েছে তা আমরা বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে তুলে ধরবো। এখন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে সমধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য বিশেষজ্ঞ শ্রেণী, যোগ্য দক্ষ ব্যক্তিকে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে দায়িত্ব দিতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের, অর্থনীতি, জীবনশৈলী নতুন করে বিন্যাস করতে হবে। তার মডেল তৈরি করা নিয়ে ভাবতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্য করার জন্য একটি পরামর্শক পরিষদ থাকা জরুরি বলে মনে করি।

নিকট অতীতে এই কলামে এক নিবন্ধে বলেছিলাম, উন্নয়নের জন্য গবেষণাকে সঙ্গী করতে অপরিহার্য। সে বক্তব্যে অটল থেকে এখন যোগ করতে চাই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে সঙ্কট তাতে কালবিলম্ব করা উচিত নয়। এ জন্য গবেষণাকে সর্বক্ষণের সাথী করতে হবে। সে জন্য দেশে যে সমস্ত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেখানকার পানিসম্পদ বিভাগগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন, এর প্রতিকার, মানুষের জীবন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা নিয়ে গবেষণা শুরু করতে কৃষি বনবিষয়ক উচ্চতর প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণাকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে বিন্যস্ত করতে হবে। বস্তুত আমরা বলতে চাই জলবায়ু নিয়ে যে বিপদ এখন দেশের ওপর, তাকে মোকাবেলার যথাযথ টেকসই পরিকল্পনা নিতে বিলম্ব হলে সেটা আত্মঘাতী হবে। উপক‚লের নিকটবর্তী আমাদের ২৮টি ছোট বড় দ্বীপ রয়েছে, যেগুলো রক্ষা করতে অকারণে সময় নেয়া যাবে না।

পদ্মা মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের বয়ে আনা পলিতে যোগ হয়েছে প্রায় একশত বর্গকিলোমিটার নতুন ভ‚মি। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার নতুন ভ‚মি যুক্ত হচ্ছে মূল ভ‚খণ্ডের সাথে। এসব নতুন ভ‚মিকে রক্ষা করতে হবে। বিরূপ জলবায়ুর কবল থেকে নিস্তার পাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে সেখানে মানুষ বসবাস করতে সক্ষম হলে দেশের নতুন দিগন্তের সোনালি সুবর্ণ রেখা উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে। সেখানে যদি মানুষের বসবাস শুরু করানো যায়, তবে দেশের মূল ভ‚খণ্ডে মানুষের চাপ অনেকখানি হ্রাস পাবে। বন সৃষ্টি করতে পারলে সে ভূমি ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করবে।

যাই হোক আমরা জলবায়ু সংক্রান্ত আসন্ন বিপদ মোকাবেলা নিয়ে যে উচ্চ আশার কথা বলেছি তা পুরো গবেষণানির্ভরশীল। সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। আমাদের প্রকৌশল, কৃষি ও বনবিষয়ক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা জোরদার করা বাঞ্ছনীয় কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানে যাতে উচ্চমান নিয়ে নির্বিঘেœ সচ্ছলতার মধ্যে নিরাপদে কাজ করতে পারে, সেটা দেখার ষোলোআনা দায়িত্ব সরকারের। আর অনুরোধ করব প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ও রাজনৈতিক দলগুলোকে; দয়া করে আপনারা ক‚ট-রাজনীতিকে ঢুকতে দেবেন না সেখানে যাতে শিক্ষা ও গবেষণার কাজ ক‚ট-রাজনীতি ধ্বংস করতে না পারে। দেশের মানুষের প্রত্যাশা আমাদের যেন আর বুয়েটে মেধাবী ছাত্র আবরার ও কুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেনের মতো জাতির ভবিষ্যৎ সম্পদ আর হারাতে না হয়।

আমাদের দেশের মানুষ গভীরভাবে রাজনৈতিকমনস্ক; তাই এই নিবন্ধে রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা বলে লেখা শেষ করব। প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটাই স্বতঃসিদ্ধ যে, রাজনীতিকদেরই ওপর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব থাকে। অবশ্য প্রকৃত গণতন্ত্রের যদি চর্চা হয় তবেই সেখানে সৎ যোগ্য বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক নেতাদের বেছে নেয়ার অধিকার ষোলো আনা থাকে দেশের জনগণের। তবে হালে এ দেশে জনগণের পক্ষে নেতৃত্বকে বেছে নেয়ার সুযোগ, অধিকার কতটুকু আছে? তা সবারই জানা বোঝা দেখার বহু মওকা তো হয়েছে। তাই এ সম্পর্কে কিছু বলা বাতুলতা মাত্র। দেশের অধিকাংশ রাজনীতিকের প্রিয় বিষয় হচ্ছে ক্ষমতা প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্ব করার সুযোগ লাভ করা। ক্ষমতা পাওয়ার জন্য ভোটব্যবস্থা, নীতিনৈতিকতা, আইন-কানুন বিধি-বিধান কিছুকেই তারা গ্রাহ্য করেন না। এ দিকে দেশ সমস্যায় আকণ্ঠ ডুবে যাক তাতে ‘কুছ পরোয়া নেই’। শুধু প্রধানমন্ত্রী দেশের ভালাই নিয়ে চিন্তায় নিমগ্ন, কিন্তু তার একার পক্ষে সব কিছু করা, দেখা তো সম্ভব নয়, তিনি আইডিয়া বা ধারণা দেবেন তার আলোকে তার সহযোগীরা নিষ্ঠার সাথে কাজ করবেন। এ ক্ষেত্রে কিন্তু ঘাটতি লক্ষণীয়। দেশে আবহাওয়াজানিত যে দুর্যোগ, রাজনীতিতে তা এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল। সে গুরুত্ব কি এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে? রাজনীতি পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক আলোচনা সমালোচনাকে স্বাগত জানাতে চাই তা যদি দেশের স্বার্থকে নিয়ে হয়। বিতর্কের মধ্য দিয়েই সঠিক পথ পন্থা বেরিয়ে আসতে পারে। নিছক তর্কের তর্ক নয়। এটা সত্য, তেমনি সমালোচনা যদি ঠিক পথে থাকে। তবে বিপক্ষের কথায় ধৈর্য হারালে চলবে না। জলবায়ুজনিত কারণে দেশ কী ভয়ঙ্কর বিপদে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশটা সবার, তাই এর ভালো সবাইকে দেখতে হবে। তাতে যেন কোনো বাধা না আসে, তা সর্বাগ্রে ভাবতে হবে।
ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement