২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারতীয় বংশোদ্ভূত আরবি লেখক

- ছবি : সংগৃহীত

ভারতের প্রখ্যাত আরবি লেখক, আরবি অভিধান রচয়িতা, দারুল ‘উলুম দেওবন্দের সাবেক সহকারী প্রধান পরিচালক ও শিক্ষা বিভাগীয় প্রধান আল্লামা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভি রহ: এক বহুল পরিচিত নাম। কেবল নাম বললে যথার্থ হবে না বরং তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, প্রবাদতুল্য ব্যক্তিত্ব। শিক্ষার্থীদের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক, আরবি সংবাদপত্র সম্পাদনা, আরবি-উর্দু এবং উর্দু-আরবি অভিধান রচনায় তিনি সবিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। প্রতিটি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, প্রতিশব্দ, বাকরীতি ও পরিভাষার ব্যবহার হচ্ছে তার অভিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। উপমহাদেশের আরবি শিক্ষার্থীদের কাছে তার অভিধানগুলো ব্যাপকভাবে সমাদৃত। আরবি সাংবাদিকতায় তার খ্যাতি উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আরববিশে^ ছড়িয়ে পড়ে।

সৃষ্টিধর্মী মনন ও মেধার অধিকারী মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভি রচনা ও বক্তৃৃতায় ছিলেন সমান পারদর্শী। তার আরবি ও উর্দু বক্তৃতার ওজস্বিতায় শ্রোতৃমণ্ডলী আপ্লুত ও তন্ময় হয়ে পড়তেন। মাওলানা কিরানভির ভাষাদক্ষতা, শব্দগঠন, রচনাশৈলী, অনুপ্রাসের ব্যবহার এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষার অভিনবত্ব রীতিমতো বিস্ময়কর। প্রতিশব্দের ব্যবহার তার ভাষায় প্রাঞ্জলতার জন্ম দেয়। সঠিক স্থানে সঠিক শব্দ প্রয়োগে তাকে বেগ পেতে হতো না। তিনি আরবির রঙ্গে এমনভাবে নিজেকে রাঙিয়ে তোলেন যে, আরবি ভাষা ও মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভি যেন একে অপরের পরিপূরক, সম্পূরক। ক্লাসে, সেমিনারে, বক্তৃৃতায়, টেবিলটকে প্রবহমান ফল্গুধারার ন্যায় তার কথামালার ফুলঝুরি শ্রোতাদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিত। দারুল উলুম দেওবন্দের আরবি সাহিত্যের উস্তাদ ও আরবি মাসিক ‘আদ-দাঈ’-এর সম্পাদক মাওলানা নূর আলম খলিল আমিনি বলেন, ‘১৯৯৩ সালে আমার আমন্ত্রণক্রমে ভারতে নিযুক্ত কুয়েত দূতাবাসের চিফ ইনফরমেশন অফিসার জনাব বাসিম লুঘানী দারুল উলুম দেওবন্দ পরিদর্শনে আসেন। সম্মানিত মেহমান কিছু সময়ের জন্য মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভির সাথে সাক্ষাৎ করেন তার বাসায়। কুয়েতি মেহমান তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি আরবি কোথায় শিখলেন? মার্জিত আরবিতে তিনি যে জবাব দেন এতে আগন্তুক বিস্ময়ে হতবাক। প্রত্যাবর্তনের পথে গাড়িতে তিনি আমাকে বলেন, শায়খ ওয়াহিদুজ্জামানের কথায় বেশ প্রভাবিত হয়েছি। তিনি আরবদের চাইতেও উন্নত আরবি বলতে সক্ষম। তার সাথে আমার দেখা না হলে দেওবন্দ পরিদর্শন আমার অসম্পূর্ণ থাকত। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, আপনি অনুগ্রহ করে তার সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছেন।’ মাওলানা খলিল আমিনি বলেন, ‘১৯৯২ সালে মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভির সাথে আমি কুয়েত সফর করি। ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে তিনি আলোচনা করছিলেন। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে সচিব মাওলানার উন্নত আরবি কথোপকথনে বিস্মিত হয়ে বারবার সুবহানাল্লাহ বলে উল্লসিত হন এবং তার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকেন।’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরবি ভাষা জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালে তিনি দেওবন্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দারুল ফিকর’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তিনি নিয়মিত এতে ক্লাস নিতেন। এতে আরবির পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। এ প্রতিষ্ঠান হতে বিভিন্ন বিষয়ের ছোট ছোট বহু পুস্তিকা প্রকাশিত হয় (মাওলানা খুরশিদ হাসান কাসেমী, দারুল ‘উলুম দেওবন্দ কি তারিখি শাখছিয়াত, দেওবন্দ, ভারত ১৪২৬ হি, ৩য় সংস্করণ, পৃ. ৩৩-৩৪)।

১৯৩০ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি উত্তর প্রদেশের মুযাফ্ফরনগর জিলার কিরানা নামক কসবায় জন্ম গ্রহণ করেন। এমন এক খান্দানে তার জন্ম যেখানে বংশ পরম্পরায় ইলমেদ্বীনচর্চার ঐতিহ্য বিদ্যমান। তার পিতার নাম মাওলানা মসিহউল্লাহ ও মাতার নাম আমাতুল মুগনী। তার মাতা মিশকাতুল মাসাবিহের ভাষ্যগ্রন্থ ‘মাযাহিরে হক’ এক লেখক মাওলানা নওয়াব কুতুবউদ্দীনের দৌহিত্রী। তার বংশধারা ৩৫ প্রজন্মে বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু আইয়ুব আনসারি রা:-এর সাথে মিলিত হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পড়া লেখা তিনি কিরানার মাদরাসা আরাবিয়াহ জামেয়া মসজিদে সম্পন্ন করেন। হিফযুল কুরআন শেষ করে এক বছর তিনি হায়দারাবাদের এক মসজিদে সাত ভাষার বিশেষজ্ঞ, সিরিয়ার আল্লামা আল-মামুন দিমাশকির নিকট আধুনিক আরবি ভাষা শেখেন। আল্লামা আল-মামুন দিমাশকি উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও অল ইন্ডিয়া রেডিও, হায়দারাবাদ কেন্দ্রে অনুবাদ ও বিভিন্ন প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন।

১৯৪৮ সালে আল্লামা কিরানভি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং পাঁচ বছর উচ্চতর পর্যায়ে অধ্যয়নের পর দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি লাভ করেন। দারুল উলুমে অধ্যয়নকালে তিনি ছাত্র সংসদের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানি রহ:, মাওলানা ইব্রাহিম বলিয়াভি রহ: এবং শায়খুল আদব মাওলানা ইজায আলী আমরুহি রহ:-এর কীর্তিমান ছাত্র। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। আরবি সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি দীর্ঘকাল হাদিস বিভাগে তাহাভি ও নাসাঈ-এর দরস দেন। দারুল উলুমের পরিমণ্ডলে আরবি সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন এবং আধুনিক আরবি ভাষার চর্চা ও বিকাশে আল্লামা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভির নিরলস প্রয়াস ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। দিবা-রাত্র পরিশ্রম করে তিনি ছাত্রদের এমন এক জামাত তৈরি করেন যারা পরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আরবি ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন অব্যাহত গতিতে। তার সংস্পর্শে বহু ছাত্র স্বর্ণসন্তানে রূপান্তরিত হন। অনেক সময় রাত ২টা পর্যন্ত ছাত্রদের সাথে ইলমি আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন। দারুল উলুম দেওবন্দের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান ও আরবি সাময়িকী মাসিক ‘আদ-দাঈ’ এর সম্পাদক মাওলানা নূর আলম খলিল আমিনি রহ: তার হাতে গড়া ছাত্র।

দারুল উলুমের মুহতামিম আল্লামা কারি মুহাম্মদ তৈয়ব রহ: ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তাকে শিক্ষাবিষয়ক পরিচালক এবং ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সহকারী মুহতামিম পদে নিযুক্ত করেন। ১৯৯০ সালে সৌদি আরবের হজ ও ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণক্রমে তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করেন। আরব বিশ্বের প্রায় রাষ্ট্রে সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে তার অংশগ্র্রহণের সুযোগ ঘটে। ১৯৯২ সালে কুয়েতের তথ্য ও স¤প্রচার মন্ত্রণালয়ের আহŸানে আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেন। এ ছাড়াও তিনি দাওয়াতি কাজে কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, মরিশাস, যুক্তরাজ্য, মিসর ও প্যারিস সফর করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষার্থীদেরকে আরবি ভাষায় লেখার হাত সৃষ্টি, অনুবাদ, বক্তব্য উপস্থাপনা ও কথোপকথনে পারঙ্গমতা তৈরি করার উদ্দেশ্যে তিনি ‘আন-নাদি আল-আরবি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এ সংস্থার সদস্য হওয়ার জন্য আরবি ভাষা ও সাহিত্যামোদী শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়তে থাকে। যুগ যুগ ধরে এ সংস্থা ছাত্রদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে এবং আরবি সাহিত্যচর্চায় কার্যকর ভ‚মিকা পালন করে। দেশ-বিদেশের বহু শিক্ষার্থী মাওলানার প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে ভারতীয় উপমহাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মাদরাসায় আরবি চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রাখতে সক্ষম হন। এভাবে আরবি ভাষা ও সাহিত্যচর্চা আহলে ইলমের নিকট ব্যাপকতা লাভ করে। তিনি ছাত্রদের উপদেশ দিয়ে বলতেন, ‘আরবি ভাষায় লিখিত একটি সাধারণ বাক্যও ভাষাগত উৎকর্ষের দিক দিয়ে উর্দু ও অন্যান্য ভাষায় লিখিত অসাধারণ বাক্যের তুলনায় উত্তম। পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে ও কিতাবে যেখানে পাও আরবি ভাষায় লিখিত কথামালার কদর করো’ (মাওলানা নূর আলম খলিল আমিনি, ওয়হ কুহে কান কি বাত, দেওবন্দ, ভারত, ২০০০ খ্রি: তৃতীয় সংস্করণ,পৃ. ৮০-৮৭, ১০২)।

তিনি বেশ কয়েকটি উন্নতমানের আরবি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘দাওয়াতুল হক’, পাক্ষিক আরবি সাময়িকী ‘আদ-দাঈ’ ও ‘আল ইয়াকদা’ এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আরবি মুখপত্র ‘আল কিফাহ’ এর সম্পাদক হিসেবে তিনি দেশ বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন। তার ক্ষুরধার লেখনী পাঠকের চেতনাকে সহজে শাণিত করত। বিশ্বজুড়ে ছিল এসব জার্নালের গ্রাহক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী। বহু আরবও তার সম্পাদিত আরবি সাময়িকী পড়ার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তার রচিত আরবি অভিধানসমূহ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যে আরবিচর্চাকারী বিশেষত : ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার অভিধানসমূহ উপমহাদেশের বিভিন্ন মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। নিম্নোক্ত অভিধান ও রচনাবলি তার কৃতিত্ব ও জীবন সাধনার স্বাক্ষরস্বরূপ ইতিহাসে জীবন্ত হয়ে থাকবে :
১. আল কামুস আল জাদিদ (আরবি-উর্দু),
২. আল কামুস আল জাদিদ (উর্দু-আরবি),
৩. আল কামুস আল ইসতিলাহি (আরবি-উর্দু),
৪. আল কামুস আল মুহিত (১৯৫০ পৃষ্ঠা, দু’খণ্ড),
৫. আল কির’আতুল ওয়াদিহা,
৬. নাফহাতুল আদব,
৭. আচ্ছি বিবি,
৮. আচ্ছা খাওন্দ,
৯. জাওহার আল মা‘আরিফ,
১০. তাকসিমুল হিন্দ ওয়াল মুসলিমুন ফিল জামহুরিয়াতিল হিন্দিয়া,
১১. মাজমু’আ মিশকাত,
১২. তরজমা কুরআন,
১৩. আখিরাত কা সফরনামা,
১৪. শরঈ নামায,
১৫. ইনসানিয়াত কা পয়গাম,

১৯৫৯-১৯৫২ সালের মধ্যে মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভি ‘আল কামুস আল জাদিদ’ (আরবি-উর্দু), ‘আল কামুস আল জাদিদ’ (উর্র্দু-আরবি) নামক দু’টি অভিধান রচনা করেন। বর্তমানে আরবি সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে প্রচলিত আধুনিক শব্দাবলি এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ‘আল কামুস আল জাদিদ’-এর মতো সংশ্লিষ্ট ভাষায় এত জনপ্রিয় কোনো অভিধান ভারতীয় উপমহাদেশে আর কেউ লিখতে পারেননি, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। এমন কোনো মাদরাসার ছাত্র ও উস্তাদ নেই, যার ব্যক্তিগত সংগ্রহে এ দু’টি অভিধান নেই। অর্ধ শতাব্দীর ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত অভিধানদ্বয়ের অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি ‘আল-কামুসুল ইসতিলাহি’ নামক পরিভাষাগত আরেকটি অভিধান রচনা করেন, সেটাও ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৬-১৯৭০ সালের মধ্যে তার হাতে রচিত হয় ‘আল কির‘আতুল ওয়াদিহা’ নামক ছাত্রদের উপযোগী আরবি সাহিত্যগ্রন্থ। এর গাইড বুকও তার হাতে সম্পন্ন হয়। আরবির পাঠদান, শিক্ষার্থীদের ভাষা ও সংস্কৃতির মানকে বিবেচনায় রেখে এ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়কে বিন্যস্ত করা হয়। আলোচ্য গ্রন্থে তিনি প্রাথমিক অবস্থায় নাহু-সারাফের বোঝা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেননি। কারণ তিনি মনে করতেন, পৃথিবীর কোনো ভাষা ব্যাকরণকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি, বরং ভাষার ক্রমবিবর্তনে ব্যাকরণ তৈরি হয়। মাওলানার এ গ্রন্থটি কেবল মাদরাসায় নয়, অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যভুক্ত হয়েছে। খোদ দারুল উলুম দেওবন্দেও এ গ্রন্থের পাঠদান চলে আসছে আগ্রহভরে।

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমারের কওমি মাদরাসায় ‘নাফহাতুল ইয়ামান’ নামক আরবি সাহিত্যের যে গ্রন্থটি পড়ানো হয়, তা বিষয় ও ভাবগত দিক দিয়ে বহু ক্ষেত্রে যৌন সুড়সুড়িমূলক ও নৈতিকতা পরিপন্থী বিবেচিত হয়ে আসছে। দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ ‘নাফহাতুল ইয়ামান’-এর বিকল্প শিক্ষাবান্ধব ও নৈতিকতানির্ভর একটি সাহিত্যগ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আসছিলেন। অবশেষে মাওলানা কিরানভির হাতে এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে। দারুল উলুমের মজলিসে শূরার সিদ্ধান্তক্রমে তিনি ‘নাফহাতুল আদব’ নামক এমন এক সাহিত্যগ্রন্থ রচনা করেন, যা ভাষাগত উৎকর্ষ ও নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। দারুল উলুম দেওবন্দসহ ভারতের কমবেশি সব মাদরাসায় এ গ্রন্থ পাঠ্যভুক্ত। ‘জাওহার আল মা’আরিফ’ গ্রন্থটি মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ: লিখিত ‘মাআরিফ আল কুরআন’-এ বর্ণিত ঐতিহাসিক ও তাত্তি¡ক বিষয়াবলির সুসম্পাদিত ও সংক্ষেপিত রূপ। ‘তাকসিমুল হিন্দ ওয়াল মুসলিমুন ফিল জামহুরিয়াতিল হিন্দিয়া’ গ্রন্থটি মূলত ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য মুহাম্মদ আহমদ কাসেমী রচিত উর্দু গ্রন্থের আরবি ভাষ্য। খতিব তাবরেযি বিরচিত ‘মিশকাতুল মাসাবিহ’-এ উল্লিখিত আখলাক, আদাব ও সামাজিক শিষ্টাচার সম্পর্কিত হাদিসসমূহের সঙ্কলিত রূপ হলো ‘মাজমু‘আ মিশকাত’। ‘তরজমা কুরআন’ হলো উর্দু ভাষায় পবিত্র কুরআনের সরল অনুবাদ কিন্তু হায়াতের অভাবে তিনি এটা সম্পন্ন করতে পারেননি। দারুল উলুম থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৮৮ সালে দারুল মুয়াল্লিফিন নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কুতুবখানায়ে হোসাইনিয়া নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন। এ প্রতিষ্ঠানদ্বয় হতে এই পর্যন্ত ত্রিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় (মুফতি মুহাম্মদ সালমান মানসূরপুরী, যিকরে রাফতাগাঁ, মুরাদাবাদ, ভারত, ২০০৫ খ্রি. পৃ.১৮৩, ১৮৫)।

আল্লামা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সহজ, সরল ও দরবেশ প্রকৃতির। রুটিন মাফিক জীবন পরিচালনায় তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। নিয়মানুবর্তিতার সাথে জীবন পরিচালনার জন্য তিনি ছাত্রদের সব সময় উদ্বুদ্ধ করতেন। আইন ও নিয়মবহির্ভ‚ত যেকোনো কর্মকাণ্ড ছিল তার অপছন্দ। দীর্ঘদিন যাবৎ অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে তার শরীর ভেঙে পড়ে এবং নানা জটিল ব্যাধির সৃষ্টি হয়। একসময় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ইন্তেকালের সময় তার বয়স ছিল ৬৫। মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানভি রহ:-এর মতো মনীষী সবসময় জন্ম নেন না, যাদের কথা, লেখা, ভাষা ও শব্দমালা ব্যতিক্রমধর্মী। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement