২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের আশা

- ছবি : নয়া দিগন্ত

ন্যায়বিচার পাওয়া মানুষের সহজাত অধিকার। জন্ম যেমন সত্য, তেমনি সত্য ন্যায়বিচার। অন্যায়, অসত্য, অনাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিটি মানবিক আইন ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের আদেশ দেয়। বাংলাদেশের স্বাধিকারের ঘোষণা এবং সংবিধান ন্যায় নিশ্চিতকরণের কথা বলে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় চার প্রকারে ন্যায় নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।
এই ন্যায়বিচারের প্রকারগুলো হলো-
১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা;
২. আইনসভা প্রণীত আইন পর্যালোচনা করার ক্ষমতা;
৩. নির্বাহী আদেশ পর্যালোচনা করার ক্ষমতা এবং ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ। এর মধ্যে শেষোক্ত বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেপারেশন অব পাওয়ারস বা ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে- টাইরানি বা স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রক্ষাব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন এমনভাবে করা যাতে একটি অপরটির ওপর উদ্দেশ্যমূলক কর্তৃত্ব বা প্রভুত্ব করতে না পারে।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মনীষী মন্টেস্কু বিষয়টিকে কার্যকরভাবে উপস্থাপন করেন। প্রয়োগিক দিকনির্দেশনা দেন। তার রচিত সবচেয়ে মূল্যবান গ্রন্থ ‘স্পিরিট অব ল’স’-এ তিনি এ বিষয় বিধৃত করেন। তিনি স্বৈরতন্ত্রকে ভীতির রাজত্ব মনে করেন। আর প্রজাতন্ত্রকে পুণ্যময় বলে মনে করেন। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বৈরতন্ত্রের অবসানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তিনি ব্যালেন্স অব পাওয়ার বা ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেন। এটি নাগরিকদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের একটি প্রকৃষ্ট পন্থা।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ন্যায় নিশ্চিত নয়, বরং ন্যায়বিচার নির্বাসনে গেছে বলেই নাগরিকদের ধারণা। সামগ্রীকভাবে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে নিম্ন আদালতে চরম দলীয়করণের কথা বলা হয়েছে। বিচারব্যবস্থায় উচ্চ পাদপীঠ সম্পর্কেও হতাশা কম নয়। ২০০৮-০৯ সালের সামরিক সমর্থিত সরকার বিচার বিভাগকে শাসনব্যবস্থা থেকে পৃথকীকরণের চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা ওলট-পালট হয়ে গেছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে সর্বোচ্চ বিচারক এবং সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের দ্বন্ধের কথা আর গোপন কিছু নয়। সে দ্বন্ধের প্রধান বিচারপতিকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। কোনোভাবেই এটি আর বিচার বিভাগের জন্য সুখকর ঘটনা নয়- বলেছেন স্বয়ং আইনমন্ত্রী।

এরকম হতাশা ও কষ্টের মধ্যে সদ্য নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর বক্তব্য নাগরিক মনে হঠাৎ আশার ঝলকানি সৃষ্টি করেছে। গত রোববার নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রদত্ত সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের সব বিভাগ ও ব্যক্তিতে অবশ্যই বারবার স্মরণ করতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ গণতান্ত্রিক সভ্যতা পরাজিত হবে।’ ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের অগ্রনায়ক মনীষী মন্টেস্কুর সাথে সুর মিলিয়ে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি অঙ্গ যদি দুর্বল বা সমস্যাগ্রস্ত হয়, তাহলে রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হতে পারে না। সে কারণে আমি বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের অপর দু’টি বিভাগ তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিচার বিভাগের সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান ও কার্যকর ভ‚মিকা রাখবে।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণে আমি উদার চিত্তে বিচার বিভাগে আইনের কাঠামোর মধ্যে যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। আপনারা যারা বিচার বিভাগের আলোচক ও সমালোচক বন্ধু রয়েছেন, তারা বিচার বিভাগের সমস্যা উপলব্ধি করবেন, নিঃসঙ্কোচে আলোচনা বা সমালোচনা করবেন রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তম কল্যাণকামিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে।’ প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘মামলাজট নিরসন তথা বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও গতি আনতে আট বিভাগর জন্য একজন করে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিতে প্রধান করে একটি করে মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। প্রতি মাসে আমি তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রতিবেদন গ্রহণ করব। পুরনো মামলাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে নিষ্পত্তির বিষয়ে সুপারভাইজ ও মনিটরিং করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র এক হাজার নয় শ’ জন বিচারকের কাঁধে যে বিপুল পরিমাণ মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে, তা বিচার বিভাগের জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়। সব স্তরের বিচারকদের আহ্বান জানাব, আসুন কঠোর পরিশ্রম, আন্তরিকতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে অধিক পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সচেষ্ট হই। এটা হবে বিচার বিভাগের জন্য মামলাজট থেকে মুক্তির যুদ্ধ।’ সংবর্ধনা সভায় আবেগায়িত হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামীণসমাজের একজন সাধারণ মানুষ। মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আবেগ-অনুভ‚তি ও আনন্দ-বিরহ মনের গভীর থেকে আমি উপলব্ধি করতে পারি। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার কোনো অশুভ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা কখনোই মেনে নেয়া হবে না। বিচার কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমার অভিপ্রায় জানাতে চাই যে, বিচার বিভাগে দুষ্টক্ষতকে আমরা ন্যূনতম প্রশ্রয় দেবো না। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের শাখাগুলোর অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, অলসতা ও অযোগ্যতাকে নির্মূল করতে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে আমি সবাইকে পাশে পাবো- এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যারা নিয়ামক শক্তি রয়েছেন, তারা সবাই আমাদের প্রতি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন- এটা আমার একান্ত আবেদন। ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয় এমন সব কারণ চিহ্নিত করে তা দূর করার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর।’

প্রধান বিচারপতি তার বক্তৃতার উপসংহারে বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, ন্যায়বিচার জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া জনগণের প্রতি আমাদের দয়া নয়; বরং এটি জনগণের সহজাত অধিকার। আমি এই অধিকারকে কেবল সাংবিধানিক অধিকার বলে সাব্যস্ত করতে রাজি নই। ন্যায়বিচারের সৌকর্য এবং আইনের রাজকীয় প্রকৃতপক্ষে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। সে কারণে দেশের সব বিচারককে নিরপেক্ষতার সাথে নির্মোহ হয়ে, নির্ভয়ে ও স্বাধীনভাবে জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার সহজাত অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সবার। এই কার্যক্রমে আমি আপনাদের পাশে আছি।’ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ‘দুর্নীতি একটি ক্যান্সার। কোনো আঙুলে যদি ক্যান্সার হয়, সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে আঙুলটি কেটে ফেলা। দুর্নীতির ব্যাপারে আমি কোনো কম্প্রোমাইজ করব না। চিহ্নিত হলে সাথে সাথে স্টাফ বা অফিসার যেই হোক না কেন, সাসপেন্ড করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’

দেশের বিচারব্যবস্থায় যখন ঘনঘোর অমানিশা তখন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির এই আলোকিত বক্তব্য সবার মনে আশা জাগাবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য গোটা বিচারব্যবস্থার জন্য একটি গাইডলাইন বা নির্দেশিকা। তার বক্তৃতায় যেমন নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে, তেমনি আছে কর্মসূচি ও সতর্কতা। তার এই নির্দেশনা যদি মেনে চলা হয়, তাহলে আশা করা যায়, বিচারব্যবস্থার সর্বস্তরে একটি পরিবর্তন সূচিত হবে। প্রধান বিচারপতি সবার প্রতি যে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে সাড়া দেয়া নাগরিক সাধারণের অবশ্য কর্তব্য। বিশেষ করে দেশের আইনের সেবায় নিয়োজিত আইনজীবীরা যদি সুবিধাবাদ ও দলীয় মনোভাব পরিত্যাগ করে তার পেছনে একাট্টা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়া কঠিন হবে না। আমাদের বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হচ্ছে আইনের দলীয় প্রয়োগ, বিচারকের দলীয় মনোভাব ও আইনজীবীদের দলীয় মনোভাব। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আইন পেশা সম্মান ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।

প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় আইন বিভাগ দেশের নীতিনির্ধারণ ও নেতৃত্ব সংশোধনে বিরাট ভ‚মিকা পালন করছে। এ দেশেও উদাহরণ আছে। প্রধান বিচারপতি রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছেন। সামরিক অধিকারীকে শপথবাক্য পাঠ করাননি। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে আইনজীবীরা এক হয়েছিলেন বলেই স্বৈরাচারের দ্রুত পতন ঘটেছে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় জনগণ যখন ভীতিকর জীবন যাপন করছে তখন আন্দোলন সংগ্রামে পথ দেখাতে তথা ন্যায় নিশ্চিত করতে আইনজীবী সমাজকে তথা আইন বিভাগকে আলোর পথ দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ একটি আবশ্যিক কাজ। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ- আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগকে বিচার বিভাগ নিজ নিজ সীমারেখায় আবদ্ধ রাখতে পারে, তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়া সহজতর হবে। সে জন্য যেমন জনগণের অঙ্গীকার করা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তিত্বের সাহস, দৃঢ়তা ও নেতৃত্ব।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement