২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

শতবর্ষে ‘বিদ্রোহী’র দাউ দাউ আগুন

-

আজ থেকে ঠিক এক শ’ বছর আগে পৃথিবীর তিনটি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনটি ওলটপালট করে দেয়া ঘটনা ঘটেছিল। ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে ঘটে যাওয়া ওই তিনটি ঘটনার মধ্যে একটি অভিন্ন যোগসূত্র এখন খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তিনটি ঘটনাই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সেই সময়ের সাংস্কৃতিক অচলায়তনে সুনামির মতো ভয়াবহ আঘাত হেনেছিল। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল প্রচলিত মননচর্চার দুর্ভেদ্য দুর্গপ্রাকার।

প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯২১ সালের ১০ মে ইতালির রাজধানী রোমের বিখ্যাত নাট্যশালা তিয়েত্রি ভ্যালেতে। সে রাতে সেখানে নাট্যকার লুইজি পিরানদেল্লোর নতুন নাটক ‘সিক্স ক্যারেকটারস ইন সার্চ অব অ্যান অথর’-এর প্রথম প্রদর্শনী হয়। এটি ছিল তার প্রথম অ্যাবসার্ড নাটক যা আগের নাট্যকলার সব প্রচলিত প্রথা ও রীতি, ছক ভেঙে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক নাট্যধারার জন্ম দেয়। সেই অভিনবত্ব রোমের অভিজাত নাট্যামোদীরা নিতে পারেনি। উদ্ভট ও অভাবিত সেই নাটক দেখে দর্শক এমনই হকচকিত, বিহ্বল এবং উত্তেজিত হয়েছিল যে, মঞ্চায়ন শেষ হওয়ার আগেই তারা রাস্তায় গিয়ে নাট্যকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন নাট্যকারকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য। এর আগে নাটক মঞ্চায়নের সময় হইচই চিৎকার, সিটি বাজিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ এসব তো চলছিলই। বাংলাদেশের স্টাইলে কেউ কাঁচা ডিম ছুড়ে মেরেছিল এমন তথ্য অবশ্য পাওয়া যায় না। তবে বিপদ বুঝে পিরানদেল্লো রঙ্গালয়ের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নোংরা আবর্জনাময় গলিপথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাতেও রেহাই পাননি। তাকে চরমভাবে অপদস্থ হতে হয় ক্ষুব্ধ দর্শকদের হাতে। বহু বছর তিনি আর কোনো নাটক লেখেননি। কিন্তু এই নাটকটি কেবল ইতালির নয়, গোটা বিশ্বের নাটকের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল। এটি ছিল বিশ্ব সংস্কৃতির জগতে এক সত্যিকারের বিপ্লব।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ইংল্যান্ডে, যখন টমাস স্টার্ন এলিয়টের (TS Eliot-1888-1965) ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ (পোড়োভূমি) কাব্য প্রকাশ পায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হলেও এর বেশির ভাগ কবিতা লেখা হয়েছিল ১৯২১ সালে। প্রকাশের সাথে সাথে কাব্যটি এলিয়টের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং তিনি আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ হয়ে ওঠেন। কারণ, এটি গোটা ইংরেজি কবিতার ধারা বদলে দেয়। বলা হয়, বিশ শতকে যদি কোনো একটি কাব্য বিশ্বসাহিত্যে কবিতার মোড় ফিরিয়ে থাকে তবে তা নিঃসন্দেহে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। খোদ রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হয়েছিলেন এই ইংরেজ কবির কবিতায়। আর রবীন্দ্রকাব্যের বিশাল কাব্যবলয় ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য উদগ্রীব গত শতাব্দীর ত্রিশ-এর দশকের কবিরা, যাদের আমরা বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃৎ বলতে শ্লাঘা বোধ করি, সেই বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ এরা প্রত্যেকে এই এলিয়টের প্রভাবে আপাদমস্তক নিমজ্জিত ছিলেন। যদি বলা হয়, এদের সাহিত্যকর্মের বড় অংশই ছিল এলিয়টের রচনার অনুবর্তনমাত্র, তাহলেও খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয় না।

তৃতীয় যে বিপ্লবাত্মক ঘটনাটি ১৯২১ সালে ঘটেছিল সেটি এই বাংলায়, অর্থাৎ তৎকালীন বঙ্গে। ওই বছরের শেষ মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক শেষ রাতে কলকাতার এক উদীয়মান কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে ফেলেছিলেন ‘বিদ্রোহী’ নামে একটি কালজয়ী কবিতা। হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এই কবিতাটি লেখার পর যে ঝড় উঠেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরলতম। আমাদের আজকের এই আলোচনার মূল বিষয়, শতবর্ষে বিদ্রোহী কবিতা। আমরা একটু ফিরে দেখার চেষ্টা করব বিদ্রোহী কবিতা বাংলায় কতটা সাড়া জাগিয়েছিল বা কতটা সমগ্র জাতিকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

বিদ্রোহী অনন্য
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের মতো অত সুদীর্ঘ নয়; আবার খুব ছোটও নয়। এতে আছে ছোট-বড় ১৪টি স্তবক। পঙ্ক্তি আছে ১৪১টি। কবিতার প্রথম অংশের দিকে আছে ‘বল বীর/বল উন্নত মমশির!’ অংশটি পাঁচবার। আরো আছে- ‘আমি’। ‘আমি’ সর্বনামের ব্যবহার আছে ১৪৫ বার।

রাতভর লিখে সকালে তার রুমমেট কমরেড মোজাফফর আহমদকে শুনিয়েছিলেন। এরপর ওই সকালেই এর দুটি কপি করে দু’জন সম্পাদককে দিলেন কবি। দিলেন সম্পাদকদের পীড়াপীড়ির কারণে। দু’জন সম্পাদক কে আগে ছাপাবেন- সেই প্রতিযোগিতায় প্রকাশের আগেই কবিতাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। একটি কবিতা লেখা হওয়ার পরেই সেটি ছাপার জন্য প্রতিযোগিতা হচ্ছে দু’জন খ্যাতনামা সম্পাদকের মধ্যে এমন ঘটনা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। এ ঘটনায় প্রমাণিত, দু’জন সম্পাদকই কবিতাটি শুনে শুধু মুগ্ধ হননি এর যথাযথ গুরুত্ব উপলব্ধিও করেছিলেন। এই দুই সম্পাদক হলেন সাপ্তাহিক মোসলেম ভারত পত্রিকার আফজালুল হক এবং সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। অবশ্য কবিতাটি প্রথম প্রকাশ পায় অবিনাশের বিজলীতে, বাংলা ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ পৌষ, ইংরেজি ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি। ১০০ বছর আগের ওই শীতের দিনটিতে কলকাতায় অকাল বর্ষণ হচ্ছিল। সেই বৃষ্টির মধ্যেও শুধু ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার কারণে বিজলী পত্রিকার চাহিদা এতটা বেশি হয়েছিল যে সেই সপ্তাহে দু-বার প্রকাশ করতে হয়েছিল বিজলী। বিদ্রোহী যেন বিজলীর বেগেই বাংলার পাঠকসমাজকে চমকিত করে তুলল। সম্পাদক-পাঠক একই সাথে এমন ধাক্কা খেল যে বাংলা কবিতার ইতিহাস ও ভূগোল একই সাথে পাল্টে গেল।

‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে একবাক্যে স্বীকৃত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ইংরেজ শাসকের রোষানল ধেয়ে আসে তার দিকে। কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়নি ঘোষণা দিয়ে, তবে যেখানেই পাওয়া যাচ্ছিল পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছিল বিদ্রোহী কবিতা মুদ্রিত পত্রিকার সব কপি। আবার অন্য বাংলা পত্রিকাগুলোও এগিয়ে আসে কবিতার পক্ষে। শুরু হয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতার পুনর্মুদ্রণ। বলা দরকার, যেসব পত্রিকা পরে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশ করল, সেসব পত্রিকার প্রায় সবই প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা। যেমন- প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯), ধূমকেতু (২২ আগস্ট ১৯২২)। এ ছাড়া আরো অনেক অনামিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। বিজলীর পর অসংখ্য নামী-অনামী পত্রিকায় বিদ্রোহীর বিদ্রোহ বাংলা তথা ভারতের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে দিলো।

বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, “মনে হ’লো এমন কখনো পড়িনি- দেশব্যাপী উদ্দীপনার এ-ই যেন বাণী।’ প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখলেন- ‘হঠাৎ একটা তীব্র প্রবল তুফানের ঝাপটা কাব্যের রূপ নিয়ে তরুণ মনকে উদ্বেল করে তুলেছিল।’ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখলেন, ‘এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠল।’ মতামত দিলেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। আশীর্বাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক দিকে স্বদেশপ্রেমিকদের সাহস জোগাল, অন্য দিকে বন্ধুদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাল। এই অসামান্য বৈপরীত্য- ‘বিদ্রোহী’ ছাড়া আর কোনো কবিতার ক্ষেত্রে অদৃষ্টপূর্ব।

বাংলার জনমানসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ঘিরে জমে ওঠে প্রতর্ক ও প্রতিক্রিয়ার পুষ্পবাণ, যা এর আগে কোনো কবিতাকে ঘিরে হয়নি। মাত্র একুশ বছরের একজন নবীন ও তরুণ কবির পক্ষে-বিপক্ষে বিচিত্র পাঠ-প্রতিক্রিয়া আর কোনো কবির জীবনে ঘটেনি। পরাধীন ভারতবর্ষের সমকালের সাহিত্যাঙ্গনে এত ব্যাপক আলোড়ন কোনো কবিতা নিয়ে হয়নি। শুধু ব্যতিক্রম বলে নয়, ‘বিদ্রোহী’ অভিনব বলেই। ‘বিদ্রোহী’ একক এবং অদ্বিতীয়। ‘বিদ্রোহী’র চিরবিদ্রোহ আজো অব্যাহত। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এক দিকে যেমন স্বদেশী-বিপ্লবীদের বুকে শক্তি ও সাহস জোগায়; অন্য দিকে প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিদ্রুপবর্ষণে অনুপ্রাণিত করে। শেষ পর্যন্ত ‘বিদ্রোহী’ দ্বিমুখী বাণ থেকে ত্রিমুখী ফলায় পরিণত হয়।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে বলা হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল মানচিত্র। যেখানে বেদ-পুরাণ-উপনিষদ-গীতা-মহাকাব্য থেকে শুরু করে ইসলামী অনুষঙ্গও অসামান্য দক্ষতায় চিত্রিত হয়েছে। শুধু হিন্দু-মুসলিম মিথ নয়, এতে গ্রিক পুরাণেরও মহাসমন্বয় ঘটেছে। যেন বেদ-পুরাণ-কুরআন-বাইবেলের সহাবস্থানে উদার সুফিবাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। শুধু পুরাণ কিংবা মিথ নয়, দেশী-বিদেশী শব্দমালার সংমিশ্রণ এটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। গ্রিক পুরাণের হোমারের ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’, প্রাচীন ভারতের ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, বেদ-উপনিষদ-ভাগবত গীতা ছাড়া ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে মিথের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। সমন্বয়ের মিথ ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, সামাজিক বৈষম্য, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, ভণ্ডামি ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সমকালীন সাম্রাজ্যবাদ এবং স্বাধীনতার স্বদেশপ্রেমকে জাগরণের মন্ত্রে এই সম্প্রীতির মিথ প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল।

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বিদ্রোহী প্রসঙ্গে বলছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো, রবীন্দ্র ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাতে আরো সময় লেগে যেত। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা হলো।’ তিনি বলছেন, বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলা সমাজজীবনে, বাংলা রাজনৈতিক জীবনে, বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে।

নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রসঙ্গে উনিশ শতকের আমেরিকার কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের (১৮১৯-৯২), ‘সং অফ মাইসেল্ফ’ কবিতাটির উল্লেখ করা হয়। এখানেও ‘আমি’র প্রাচুর্য আছে। ‘আমি’ প্রসঙ্গে সাদৃশ্য আছে। তবে ‘সং অফ মাইসেল্ফ’ কবিতাটি প্রধানত আত্মঘোষণামূলক, আর ‘বিদ্রোহী’ কবিচিত্তের উল্লাস প্রকাশমূলক কবিতা। আমাদের কোনো কোনো প্রধান দৈনিকে বিদ্রোহীর শতবর্ষ পূর্তির বিশেষ আয়োজনে এই প্রসঙ্গ ধরে কবিকে কিছুটা যেন হেয় করারই প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কিন্তু এই প্রভাবের বিষয়টি যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে বলে রাখি, আধুনিক বাংলা কবিতার মহীরুহ বলে পূজিত বিগত ত্রিশের দশকের এলিয়ট প্রভাবিত কবিকুল এক ফুঁৎকারে উড়ে যাবেন। আর যে এলিয়টকে প্রণাম জানিয়ে আমাদের বাংলা কবিতা আধুনিকতার পথে পায়ে পায়ে অনুগমন করে সেই এলিয়টেরও দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড রচনার পেছনে অনুপ্রেরণা বা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে অতীতের কোন্ কোন্ বিশিষ্ট সাহিত্যকর্ম সেই খোঁজ আমরা নিশ্চয়ই রাখি।

বিদ্রোহী কবিতা বাংলায় প্রচলিত রবীন্দ্র কাব্যবলয় ভাঙার প্রথম দৃষ্টান্ত হলেও সমসাময়িক ভাষা ও সাহিত্যের পুরোহিতরা যে এই ধারা অনুসরণ করেননি তার কারণ আছে। সে বিষয়ে আরেক সময় লিখব। তবে এটাও ঠিক নজরুল প্রভাবিত করেছিলেন অনেক কবিকে। এমনকি জীবনানন্দকেও। আর রবীন্দ্রবলয় ভাঙার কাজটি শুরু করেছিলেন।

নজরুলকে আধুনিক কবিতার আলোচনায় সামনে আনা তো দূরের কথা পেছনের কাতারে রাখতেও যাদের অনীহা তাদের প্রতি সব শেষে বলা যেতে পারে, নজরুলই হয়তো অনাগত দিনে হয়তো এই নজরুলই টিকে থাকবেন। অন্য কেউ নন। কেন? এই বিদ্রোহীর জন্য।

‘মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না -
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না -
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।’

এই যে উচ্চারণ, এটি শাশ্বত, এটি চিরন্তন। এই অন্যায়-অবিচারে দীর্ণ, যুদ্ধ-সঙ্ঘাতময়, ক্ষমতার দাপটে অস্থির বিশ্বে উৎপীড়কের হাত ক্রমেই আরো হিংস্র হয়ে উঠছে এবং আগামী হাজার বছরেও এর অবসান হবে তেমন লক্ষণ আমাদের অনুভবে ধরা পড়ে না। সে জন্যই ধারণা করি, উৎপীড়িতের কান্নার ধ্বনিতে এই পৃথিবীর বাতাস সব সময়ই ভারী হয়ে থাকবে। আর যত দিন এই কান্নার রোল বাতাসে থাকবে তত দিন নজরুল শান্ত হবেন না। তিনি বেঁচে থাকবেন মহাকালের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে। কারণ তাঁর কাব্য, তাঁর অগ্নিবীণা থাকবে ভবিষ্যতের মানুষের হাতে। ‘আজি হতে শত বর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার কবিতাখানি’ এমন কাতর আর্তি নজরুলের নেই। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নজরুলই পঠিত হবেন দূরতম ভবিষ্যতেও। বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষকে শোনাবেন তার কাব্যের আশ্বাসবাণী, যা বিদ্রোহের অবিশ্বাস্য শক্তিমত্তায় উচ্চকিত। বজ্রমুষ্টি উঁচিয়ে সুতীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদের, অন্তত নিজের অধিকারের আওয়াজটা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়ার এই কাজটি তো কোনো বিপ্লবী বঙ্গীয় কবিই এভাবে আর করতে পারেননি!

(এই কলাম লিখতে মুখ্যত পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গবেষক, প্রাবন্ধিক সুরঞ্জন মিদ্দে-এর প্রাসঙ্গিক রচনার সহায়তা নিয়েছি)
mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement