২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থা

-

যেকোনো দেশের সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে প্রতিদ্ব›দ্বী দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টনের পদ্ধতিকে বলা হয় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থা। এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ব্যবস্থা। এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে। তবে পক্ষের যুক্তি অনেক জোরালো।

যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্রকে বলা হয় আধুনিক গণতন্ত্রের মাতা। যুক্তরাজ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূচনা হয় ১২১৫ সালে যখন ম্যাগনাকার্টা নামক দলিলের মাধ্যমে তৎকালীন রাজা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের প্রতিফলনে রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্র সূদীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছর পথ পাড়ি দেয়ার পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বর্তমানে যে পদ্ধতিতে সরকার গঠিত হচ্ছে তাতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন হচ্ছে কি না?

ব্রিটেনে হাউজ অব কমন্সের সদস্য পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি নির্বাচনী এলাকায় যিনি সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত হন তাকে হাউজ অব কমন্সের সদস্য পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এভাবে সাধারণ নির্বাচনে যে দল হাউজ অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্থাৎ ৩২৬ অথবা এর ঊর্ধ্বে আসন লাভ করে সে দলকে দেশের শাসনতান্ত্রিক প্রধান রাজা বা রানী সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এ যাবৎ অনুসৃত প্রথা অনুযায়ী যখনই দেখা যায় ক্ষমতাসীন দল সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তখন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীর কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেন এবং রাজা বা রানী পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের প্রধানকে সরকার গঠনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেন।

যুক্তরাজ্যে যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের পর যখন স্পষ্টত প্রতিভাত হয় যে, নির্বাচনের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী তিনটি দল যথা, কনজারভেটিভ পার্টি, লেবার পার্টি অথবা লিবারেল ডেমোক্র্যাটস, এর মধ্যে যেকোনো একটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তখন রাজা বা রানী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে কোনোরূপ দ্বিধায় পড়তে হয় না। বিপত্তি দেখা দেয় তখন, যখন মূল প্রতিদ্ব›দ্বী তিনটি দলের কোনোটিই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। যেমনটি হয়েছে ৬ মে, ২০১০ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। এ নির্বাচনে হাউজ অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৬৪৯টি আসনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এত কনজারভেটিভ পার্টি পায় ৩০৬টি, লেবার পার্টি পায় ২৫৮টি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পায় ৫৭টি আসন এবং অন্যান্য দল পায় ২৮টি আসন।

এ নির্বাচনী ফলাফলে সরকার গঠন করতে হলে দুই বা দুইয়ের অধিক দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত বা কোয়ালিশন সরকার গঠনই একমাত্র বিকল্প। যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অতীতে গঠিত সম্মিলিত বা কোয়ালিশন সরকারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে খুব কম ক্ষেত্রেই তারা নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে।

লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি দীর্ঘ দিন যাবৎ নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। এ দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে প্রতিদ্ব›দ্বী দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন। ২০১০ সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৩৬ শতাংশ পেয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি, ২৯ শতাংশ পেয়েছে লেবার পার্টি এবং ২৩ শতাংশ পেয়েছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি। লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির দাবি অনুযায়ী মূল তিনটি প্রতিদ্ব›দ্বী দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা হলে কনজারভেটিভ পার্টির আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৪টি, লেবার পার্টির আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৮টি এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৯টি। নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যদিও লেবার পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্র্যাসটদের মধ্যে প্রদত্ত ভোট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যবধান মাত্র ৬ শতাংশ; কিন্তু আসন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ২টি দলের ব্যবধান ২০১। কনজারভেটিভ পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটসদের মধ্যে ভোট প্রাপ্তির ব্যবধান ১৩ শতাংশ আসন প্রাপ্তির ব্যবধান ২৪৯। ২৩ শতাংশ ভোট পাওয়ার পরও আসন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত ব্যাপক ব্যবধান নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটছে কি না?

যুক্তরাজ্যে যদিও এ পশ্নের উত্তর এখনো ‘না’ কিন্তু ইউরোপের বেশ কিছু রাষ্ট্র যথা, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে প্রভৃতিতে সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন করা হয়। ওই সব রাষ্ট্রে সাধারণ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগেই প্রতিদ্ব›দ্বী দলগুলো নিজ নিজ দেশের সংসদের আসন সংখ্যা অনুযায়ী দলের প্রার্থীদের ধারাবাহিক ক্রম উল্লেখ করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটি দেশের সংসদের আসন সংখ্যা ৩০০টি এবং নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বী তিনটি দলের মধ্যে একটি পেয়েছে প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৩৬ ভাগ এবং অপর দু’টি দল পেয়েছে যথাক্রমে ৩৪ ভাগ ও ৩০ ভাগ। এ অবস্থায় দলগুলোর মধ্যে প্রদত্ত ভোটের ওপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী আসন বণ্টন করা হলে দেখা যাবে ৩৬ শতাংশ অর্জনকারী দলটি পেয়েছে ১০৮টি আসন, ৩৪ শতাংশ অর্জনকারী দলটি পেয়েছে ১০২টি আসন এবং ৩০ শতাংশ অর্জনকারী দলটি পেয়েছে ৯০টি আসন। পূর্বোল্লিখিত ধারাবাহিকক্রম অনুযায়ী, যে দলটি ১০৮টি আসন পেয়েছে সে দলের ৩০০ প্রার্থীর তালিকার ধারাবাহিক ক্রমের প্রথম ১০৮ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মর্মে ঘোষিত হবেন। একইভাবে ৩৪ ও ৩০ শতাংশ ভোটপ্রাপ্ত দল দু’টির মনোনীত ৩০০ প্রার্থীর তালিকায় প্রকাশিত ধারাবাহিকক্রম অনুযায়ী যথাক্রমে প্রথম ১০২ ও ৯০ জন নির্বাচনে বিজয়ী হিসেবে ঘোষিত হবেন। এ ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন হওয়ার কারণে এ ব্যবস্থাটি দিন দিন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনুসারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর অনেক দেশে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আগমনের আধিক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের এ ধরনের অনুপ্রবেশের কারণে প্রকৃত রাজনীতিবিদরা নিজ দলে কোণঠাসা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুদূর অতীতে ব্যবসায়ীরা সরাসরি কখনো রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতেন না যদিও তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সব সম্ভাবনাময় দলকে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দের দলকে সর্বদা অর্থ দ্বারা সহায়তা করতেন। নিকট অতীতে রাজনীতি বিষয়ে ব্যবসায়ীদের চিন্তা ও চেতনায় পরিবর্তন দৃষ্টিগ্রাহ্য। রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য দেশের ও জনগণের উন্নয়ন হলেও এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতর। তারা রাজনীতিকেও ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মূল্যায়ন করে থাকেন। এ মূল্যায়ন থেকে ব্যবসায়ীরা উপলব্ধি করতে থাকল রাজনৈতিক দলকে অর্থ সাহায্য করে ব্যবসায় যতটা না সুবিধা পাওয়া যায় তার চেয়ে অধিক সুবিধা পাওয়া যায় যদি কোনো দল থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়া যায়। আমাদের দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই এ ধরনের ব্যবসায়ী প্রতিটি সংসদ নির্বাচনেই সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এদের কেউ কেউ ভাগ্যগুণে মন্ত্রিত্বও পেয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে প্রতিদ্ব›দ্বী দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন করা হলে আশা করা যায় রাজনীতি প্রকৃত রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে এবং ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থ দিয়ে মনোনয়ন ক্রয়ের সুযোগ অনেকটাই রুদ্ধ হবে।

আমাদের দেশে বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বীর প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা বিজয়ীর চেয়ে একটি কম হলেও তাকে নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করার কোনো অবকাশ নেই। এ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত হওয়ার পরও একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত না হওয়ার কারণে নির্বাচিত ঘোষিত না হওয়ায় তার প্রাপ্ত সব ভোট সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে কোনো অবদান রাখতে পারে না। একটি সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা হলে একটি ভোটও বিফলে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই এবং এ কারণেই এ ব্যবস্থাটির প্রতি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলছে।

এ নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো দলের প্রাপ্ত ভোট প্রদত্ত ভোটের ০.৩৪ শতাংশের নিচে হলে ওই দলের একটি আসন লাভেরও সুযোগ ঘটবে না। এর ফলে নেতাসর্বস্ব দলের অস্তিত্ব বিলোপ হওয়ার কারণে অনেক ব্যবসায়ী যারা এখনো সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন অহেতুক চাঁদা দেওয়ার বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাবেন।

আমাদের বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাদ দিলে চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিত্র পাওয়া যায়। এ নির্বাচনগুলোতে প্রদত্ত ভোটের ওপর ভিত্তি করে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের শতকরা আনুপাতিক হারের মাধ্যমে আসন বণ্টন করা হলে দেখা যেত প্রতিটি নির্বাচনেই আসনপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ ভিন্নতর হতো। বিগত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথমটি তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর জোটভুক্ত দলগুলোর বর্জনের কারণে এটি একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং এ নির্বাচনটিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরূপ নির্বাচন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫(২) এর আলোকে গ্রহণযোগ্য নয়। সর্বশেষ নির্বাচনটিতে মধ্যরাতে অবৈধ পন্থা অবলম্বনে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভাগগুলোকে বশীভ‚ত করে ভোগ গ্রহণ করায় ইতিহাসের বিচারে এটি নজিরবিহীন কলঙ্কজনক নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকবে। উল্লিখিত কারণে এ দু’টি নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির হিসেবের আলোচনা অমূলক।

আমাদের দেশে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সাধারণ নির্বাচনে দেখা গেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শতকরা ৩০.০৮, ৩৭.৪৪, ৪০.১৩ ও ৪৮.০৪ ভাগ ভোটপ্রাপ্ত হয়ে যথাক্রমে ৮৮, ১৪৬, ৬২ ও ২৩০টি আসনপ্রাপ্ত হয়েছিল। উপরোক্ত চারটি নির্বাচনে বিএনপি শতকরা ৩০.৮১, ৩৩.৬০, ৪০.৯৭ ও ৩২.৫০ ভাগ ভোট পেয়ে যথাক্রমে ১৪০, ১১৬, ১৯৩ ও ৩০টি আসন প্রাপ্ত হয়েছিল। উপরোক্ত চারটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ভোটপ্রাপ্তির ব্যবধান ছিল যথাক্রমে ০.৭৩, ৩.৮৪, ০.৮৪ ও ১৫.৫৪ শতাংশ কিন্তু আসনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৭.৩৪, ১০.০০, ৪৩.৬৬ ও ৬৬.৬৭ শতাংশে।

১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শতকরা ভোটপ্রাপ্তির ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা হলে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা হতো যথাক্রমে ৯০, ১১২, ১২০ ও ১৪৪ অপর দিকে বিএনপির আসন সংখ্যা হতো যথাক্রমে ৯২, ১০১, ১২৩ ও ৯৭।

উপরোক্ত চারটি সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আসনপ্রাপ্তির ব্যবধান যথাক্রমে ৫২, ৩০, ১৩১ ও ২০০। শতকরা ভোটপ্রাপ্তির আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা হলে এ চারটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আসনপ্রাপ্তির ব্যবধান গিয়ে দাঁড়াত যথাক্রমে ২, ১১, ৩ ও ৪৭।

১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১১.৯২, ১৬.৪০, ৭.২৫ ও ৭.০৪ শতাংশ ভোটপ্রাপ্ত হয়েছিল। এ চারটি সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল ১২.১৩, ৮.৬১, ৪.২৮ ও ৪.৭০ শতাংশ। এ চারটি সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ভোটপ্রাপ্তির আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা হলে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা দাঁড়াত যথাক্রমে ৩৫, ৪৯, ২২ ও ২১। অপর দিকে জামায়াতের আসন সংখ্যা দাঁড়াত যথাক্রমে ৩৬, ২৬, ১৩ ও ১৪।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ সালে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত যথাক্রমে ৩০০, ২৬৪, ২৭২ ও ১২২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যথাক্রমে ১৪০, ৮৮, ৩৫ ও ১৮টি আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা যায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত যথাক্রমে ৩০০, ৩০০, ২৯৩ ও ৩০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যথাক্রমে ১৪৬, ১১৬, ৩২ ও তিনটি আসন পায়। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা যায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি যথাক্রমে ২৫২, ৩০০, ৩১ ও ২৮১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যথাক্রমে ১৯৩, ৬২, ১৭ ও ১৪টি আসন পায়। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা যায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত যথাক্রমে ২৬৪, ২৬০, ৪৯ ও ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বদন্দ্বী করে যথাক্রমে ২৩০, ৩০, ২৭ ও দু’টি আসন পায়।

দীর্ঘ দিন থেকে যুক্তরাজ্যে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি সাধারণ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো যে শতকরা হারে ভোটপ্রাপ্ত হবে সে শতকরা হারে তাদের আসন সংখ্যা নির্ধারণের যে দাবি উত্থাপন করে আসছে এ দাবির প্রতি লেবার পার্টি পূর্বে অসম্মত থাকলেও বর্তমানে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিবেচনায় আশ্বাস দিয়েও বিফল হয়েছে। অপর দিকে কনজারভেটিভ পার্টির অভিমত, নির্বাচন ব্যবস্থায় এ ধরনের সংস্কার আনতে হলে তা অবশ্যই গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করতে হবে। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির শীর্ষস্থানীয় অনেক রাজনীতিক মনে করেন বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যে পদ্ধতিতে সরকার গঠন করা হচ্ছে তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনের মাধ্যমে সরকার গঠিত না হওয়ায় তা ইতোমধ্যে ভঙ্গুর গণতন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং এ ধরনের ভঙ্গুর গণতন্ত্র যেকোনো দেশে স্থিতিশীলতা দিতে পারে না।

যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্র সূদীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছর পথ পাড়ি দেয়ার পর প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রশ্নে ৫ মে, ২০১১ সালে গণভোটের আয়োজন করা হলে রক্ষণশীল মানসিকতা দ্বারা প্রভাবান্বিত ওই রাষ্ট্রের নাগরিকরা ব্যবস্থাটি অনুমোদন করেনি।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে সমৃদ্ধি অর্জন ও সুন্দরভাবে পথ চলা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনের মাধ্যমে সরকার গঠন। ইউরোপের যেসব দেশে প্রদত্ত ভোটের শতকরা হারের ভিত্তিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী দল দ্বারা সরকার গঠিত হচ্ছে ওই সব দেশের সমৃদ্ধি ও সরকারের স্থিতিশীলতা বিবেচনায় নিলে নিঃসন্দেহে বলা যায় ওই সব দেশ যুক্তরাজ্যের তুলনায় অধিক সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল। সুতরাং দেশের সমৃদ্ধি ও সরকারের স্থিতিশীলতার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যেসব দেশে প্রদত্ত ভোটের শতকরা হারের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয় না সেসব দেশের জন্য ভাববার সময় এসেছে। তারা কি আগের গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করবে নাকি প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা অনুসরণ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী দলকে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ দেবে।

বাংলাদেশ ব্যতীত পৃথিবীর অপর কোনো রাষ্ট্রে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রচলন নেই। বাংলাদেশের বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে থাকায় এবং উভয় দলের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাবের কারণে সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানগণ বিজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেননি।

এ কথাটি নিশ্চয়ই আমাদের বিস্মৃতিতে যায়নি, কী কারণে অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসানের পর সাংবিধানিক সব বিকল্পকে নিঃশেষিত না করে সংবিধান নির্দেশিত পন্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। এরপর সেনা সমর্থিত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল তারও যে কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না এ বিষয়টিও সুপ্রতিষ্ঠিত। এ কথাটি বলার অপেক্ষা রাখে না, যেসব প্রশ্নে অষ্টম জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান পরবর্তী সাংবিধানিক বিধি অনুসরণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যায়নি সে একই প্রশ্নগুলো নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান পূর্ববর্তী উত্থাপিত হয়। তা ছাড়া একটি নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ অবসান-পরবর্তী রাজনৈতিক মতৈক্যের মাধ্যমে সৎ, সাহসী, দক্ষ, দৃঢ়, নীতিবান, ন্যায়পরায়ণ, একনিষ্ঠ এবং সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগে অবিচল ব্যক্তিসমষ্টি সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে কোনোরূপ অন্তরায় সৃষ্টির অবকাশ ক্ষীণ। আর এরূপ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হবে প্রদত্ত ভোটের আনুপাতিক হারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন অর্থাৎ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনী ব্যবস্থা।

এ বিষয়টিকে কার্যকর রূপ দিতে হলে সংবিধানের ৬৫(২) ও (৩) নং অনুচ্ছেদ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এ যৎসামান্য সংশোধনী আনয়ন আবশ্যক। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এ বিষয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ অবসান পূর্ববর্তী ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে সঙ্ঘাতের যবনিকাপাতে সামনে এগিয়ে চলার পথ সবার জন্য প্রশস্ত হবে। তাই আমাদের সবার উচিত হবে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিত প্রয়াস। আর এ ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ভূমিকা হতে হবে অগ্রণী।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু বাকৃবির এক্স রোটারেক্টরর্স ফোরামের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠিত পাবনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু ১ দাগনভুঞায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তির ঘটনায় আ’লীগ নেতাকে শোকজ দখলে থাকা ৪ গ্রাম আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দেবে আর্মেনিয়া স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে স্ত্রীর আত্মহত্যা! কুলাউড়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর মৃত্যু যেসব এলাকায় রোববার ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে

সকল