২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমরা আমাদের শালীন ও ভদ্র জীবনধারা ফিরে পেতে চাই

-

চারিত্রিক দোষত্রুটির জন্য বাঙালিদের দীর্ঘকাল দুঃখ-কষ্ট ও অবমাননাকর অবস্থা সহ্য করতে হয়েছে। এদের মধ্যে যারা শিক্ষিত তাদের বেশির ভাগ হচ্ছে লোভী এবং আত্মকেন্দ্রিক। আমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের সাথে সহজেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। আমাদের ‘ব্লাডি কাওয়ার্ডস’ বলে গালিও দেয়া হয়।

নিজেদের ভালো করার নামে সবচেয়ে ক্ষতি করার জন্য আমাদের সমালোচনা করা হচ্ছে। বলা হয়, আমরা প্রতারক, আমাদের সকলকে বিশ্বাস করা যায় না। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য আমাদের যখন মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছিল তখনো জনগণের কিছু অংশ জনগণের সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকতায় একটা বিরাট ভ‚মিকা রেখেছিল। ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পাক-ভারত যুদ্ধে পরিণত হয়ে যায় এবং আমরা আমাদের নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলি।

এসব বিষয় আমাদের রক্তে ও চৈতন্যে বহমান, যার কিছুই আমাদের অজ্ঞাত নয়। আমাদের রক্তে মিশে থাকা এই বিষাক্ত দুর্বলতার কথা বলতে আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক মহান ব্যক্তি সৎ সাহসের অভাব দেখাননি। তারা আমাদের সাহসী ও সৎ চরিত্রের অধিকারী হতে তাগিদ দিয়েছেন। আমাদেরকে মর্যাদাসচেতন হতে বলেছেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের ওপর নির্ভর করে ভারতে একাধিক সশস্ত্র গ্রæপ গড়ে উঠেছিল এবং তাদেরকে ভারতই অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এ নিয়ে ভারতে গঠিত প্রবাসী সরকারও বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। সুতরাং এ সশস্ত্র গ্রুপগুলোর ওপর প্রবাসী সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। জনগণের প্রতিনিধিত্ব দাবি করারও সুযোগ তাদের ছিল না। তারা রাতারাতি বিপ্লবী হয়ে গেলেন। নির্বাচনও তাদের কাছে অচল হয়ে গেছে। তারা প্রবাসী সরকারকে মানতে চায়নি।

শেষ পর্যন্ত পাক-ভারত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে। আমাদের মুক্তিবাহিনী ভারতকে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল। তাদের পাশে থেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কিন্তু তাদেরকে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করেনি। শেষপর্যায়ে তাদেরকে বিব্রত করেছে।

ভারত থেকে ফেরত আসা মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের এমন একটা রূপ-চরিত্র দাঁড় করালেন যা আমাদের কাছে আজব ও অপরিচিত মনে হয়েছে। এক দিকে তাদের আচরণ ছিল যুদ্ধবিজয়ী বীরের মতো, অন্য দিকে তারা জনগণের গণতান্ত্রিক লক্ষ্যের পূরণকারী হননি।

এদের কয়েকটি গ্রুপ বিশেষ করে বামপন্থী, ক্ষমতা দখল করার জন্য দেশের অভ্যন্তরেই যুদ্ধ শুরু করলেন। তাদের তৎপরতা জনগণের মধ্যে নতুন করে ভয়-ভীতির সঞ্চার করে। কেউ কেউ আমাদের জনগণকে পরাজিত শক্তি বিবেচনা করে তাদেরকে পরাজিত শত্রু হিসেবে দেখার দুঃসাহসও দেখিয়েছেন।

দেশ যেন কিছু অবাঞ্ছিত লোকের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। ভুলে গেলেন সে দিনের কথা, যখন তারা সামরিক আক্রমণের মুখে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ৯ মাস ভারতে অবস্থান করার কারণে তাদের অংশবিশেষের মধ্যে চিন্তাভাবনায় বিরাট পরিবর্তন প্রকাশ হতে থাকে। আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে তারা বিরাট যোদ্ধা হয়ে দাঁড়ালেন।

দেশে থাকা আমাদের জনগণ তাদের প্রিয় বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ হিসেবে রাখতে এক সাগর রক্ত দিলো এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করল কিন্তু ভারত থেকে প্রত্যাগত কিছু ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ নির্লজ্জের মতো সেই সত্যকে অবজ্ঞা করতে থাকেন। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা নয়, ভারতের সাথে মৈত্রীবন্ধন তাদের গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। জনগণ নয়, ভারত তাদের পেছনে আছে, এটাই তাদের নিকট ‘বড় শক্তি’।

আমাদের অপরিকল্পিত বাস্তবতায় ভারতে আমাদের প্রবাসী সরকার ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ভারতে না যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর পরিষ্কার নির্দেশনা ছিল। তিনি নিজে পাকিস্তান চলে যান। আমাদের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের বিভ্রান্তি এভাবেই ঘটে।
ওই স্বঘোষিত বীরদের দ্বারা আমাদের নেতৃত্বও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়। প্রত্যেকটি গ্রæপ ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে; কিন্তু তাদের কারও ওপর না ছিল জনগণের আস্থা, না ছিল নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেদের বিচার-বিবেচনা।

তাদের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল ভারত মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য। তারা তা ব্যবহার করে দেশে হিংসা-বিদ্বেষের প্রসার ঘটাতে এবং জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির কাজে। এটা আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য কতটা বিব্রতকর যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। পুলিশ দিয়ে নির্বাচন ডাকাতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা করা হলো। কেবল তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ পুলিশ বাহিনী র‌্যাবসহ অন্য আরো কিছু রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অনভিজ্ঞ সরকার দৃশ্যত আমলাতান্ত্রিক সরকারের নির্দেশেই আইনের শাসন বা মানবাধিকারে অর্থই বুঝতে চায়নি। অফিসারদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়াটাই গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন সময় কত লোককে অসহায়ভাবে জীবন দিতে হয়েছে তার হিসাবও একদিন প্রকাশ পাবে।

ইতোমধ্যে আমরা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কে অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে বদনাম অর্জন করেছি। এ জন্য লজ্জার কোনো বালাই নাই। কারণ সরকারি ব্যবস্থাপনার এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে অসত্য নেই। আজকের দিনে গোপন তথ্য হিসেবে কিছুই গোপন থাকে না। সবাই সবার খবর রাখেন। দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এখন আন্তর্জাতিকভাবে শাস্তিযোগ্য।

‘দেশ’ বলতে একখণ্ড মাটিকে বোঝায় না। একটি নতুন পতাকাকেও বোঝায় না। ‘দেশ’ বলতে বোঝায় তার জনগণকে। জনগণের জন্যই দেশ। সরকারের সাফল্যের মাপকাঠি হচ্ছে জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন এবং জনগণের সুখ শান্তি। অথচ জনগণের সরকার গঠনের অধিকারই আমাদের হরণ করা হয়েছে। অসহায় জনগণ তাদের ট্যাক্সের ওপর নির্ভরশীল কর্মচারীদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত জীবন যাপন করছে। ক্রসফায়ারে মৃত্যু বা গুম করা স্বাভাবিক নিয়ম হয়েছে। জেল-জুলুম সহ্য করে এসব অপরাধের মধ্যে প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। একজনের অপরাধের জন্য তার স্ত্রী-সন্তানদেরকে নির্যাতনের শিকার হতেও দেখা গেছে।

উন্নয়নের কর্মকাণ্ড হিসেবে সরকার চলমান মেগা প্রজেক্টগুলোর কথা চার পাশের লোকদের শোনাচ্ছে। বাস্তবে দুর্নীতিপরায়ণদের স্বার্থ রক্ষা করে জনগণের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন আদায় করা হচ্ছে।

কোর্ট-আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি নির্মম হত্যার জন্য ২০ জন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া সহজ ব্যাপার নয়। এটা একধরনের প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। আতঙ্ক সৃষ্টির রাজনীতিতে পেশিশক্তি হিসেবে ছাত্রদের ব্যবহার করার জন্য সরকারকে কোনো দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না। দলীয় লোকদের দ্বারা প্রতিনিয়তই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। সরকারের মধ্যে এ জন্য কোনো অপরাধবোধ দৃশ্যমান নয়। অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে অন্যদের জীবনের নিরাপত্তা ব্যাহত হবেই। ক্ষমতার অপব্যবহার স্বাভাবিক ব্যাপার হয়েছে। পুলিশ একটি অপরাধে শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। কোথায় মানবাধিকার রক্ষার সচেতনতা!

সংগঠিত অপরাধের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নতুন ভাবমূর্তি অর্জন করেছে সেখানে যে কারও পক্ষে শালীন ভিন্নমত প্রকাশ একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যুক্তি নয়, ক্ষমতার দাপটই যেন সবকিছু। সহনশীলতার বিপর্যয় ঘটেছে। কিছু বলতে গেলে প্রথমেই ভাবতে হয় নিজের নিরাপত্তার কথা। পরিবার-পরিজনের হয়রানির কথা। সভ্য ও নিরাপদ সৎ জীবনযাপনও কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি না করে নিরাপদে ভালো থাকা প্রায় অসম্ভব। এখানে তরুণরা সুন্দরতর ভবিষ্যতের দৃষ্টান্ত দেখছে না।

একটা সুন্দর দেশে এ রকম আত্মঘাতী তৎপরতা চলতে পারে না। অবশ্যই আমাদের বিদ্যমান অপরাধপ্রবণ, বর্বরোচিত ভাবমূর্তি বদলাতে প্রতিটি নাগরিককে ভ‚মিকা রাখতে হবে। আমাদের সভ্যতা ও শালীনতার ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা আর ভাবমূর্তির অবক্ষয় দেখতে চাই না। আমাদের গণতন্ত্রমনা জনগণকে আমরা আর অগণতান্ত্রিক ও সভ্যতাবিমুখ করে অসহায় রাখতে পারি না। শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের সুযোগ সম্ভব করতে হবে। বন্দুকের শাসন নয়, মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

‘কর্তৃত্ববাদের উত্থানের মুখে স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা করাই এ যুগের চ্যালেঞ্জ।’ এই সংজ্ঞার আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তি দেখিয়েছেন এবং উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বকে গণতন্ত্র রক্ষায় অবশ্যই অস্ত্র তালাবদ্ধ করতে হবে। অস্ত্রের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের ফলে দেশে সন্ত্রাসবাদীর শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। অস্ত্রব্যবসা তালাবদ্ধ করতে হবে।

একনায়কদের নিরস্ত্র করতে হবে এবং এই সদিচ্ছাকে শুধু ভাষার মধ্যে আবদ্ধ রাখলে হবে না। স্বেচ্ছাচারী শাসকরা জনগণকে এবং বিশ্বকে অমানবিক করে তুলবে যদি আমাদের প্রতিবাদী সাহসের অভাবের কারণে তাদের সাহস বাড়তে থাকে।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় শক্তি জোগাতে হবে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক দাবি।

আমেরিকাকে দেখতে চাই মানবাধিকার রক্ষার প্রতিযোগিতায় যে ক্ষেত্রে তার বিজয় নিশ্চিত। অস্ত্রের প্রতিযোগী ও সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রগুলোর অমানবিক ব্যবস্থা রক্ষায় অস্ত্রশক্তি অপরিহার্য। মানবাধিকার রক্ষার কথা ভাবলে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হবে।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ
সুপ্রীম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement