২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অন্যায় অনিয়ম অশুভের বিরুদ্ধে লাল কার্ড!

অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা সব সময়ই সোচ্চার। - ছবি : সংগৃহীত

অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা সব সময়ই সোচ্চার। ছাত্রদের সম্মিলিত প্রতিবাদ আমাদের বড় বড় অর্জন এনে দিয়েছে। বায়ান্নার ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের প্রতিবাদ এবং আত্মদানের কারণেই আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনেও ছাত্রদের অনন্য ভূমিকা ছিল। তেমনি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন, নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দোলনে ছাত্ররা অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আজ আমরা সড়কে প্রতিবাদ করতে দেখছি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে তারা সড়কে বিক্ষোভ ও মিছিল নিয়ে এসেছে।

বেশ কয়েক দিন ধরেই ছাত্রদের সড়কে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। শনিবার তাদের যে কর্মসূচি ছিল তা সবার দৃষ্টি কেড়েছে। তারা সড়কে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছে। রাজধানীর রামপুরা ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা ‘লাল কার্ড’ উঁচিয়ে ধরে বলেছে, সড়ক নিরাপদ করতে হবে। অনিরাপদ সড়ক আমরা দেখতে চাই না। সড়কে হত্যা বন্ধ করতে হবে। লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো যাবে না, সড়ক দুর্ঘটনাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, সেতু বা সড়ক নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা যাবে না, সড়কে আমরা ভাইবোনের আর লাশ দেখতে চাই না, যানবাহনে বোনেরা নিগৃহীত হোক আমরা দেখতে চাই না, বাসে হাফ ভাড়া শিক্ষার্থীদের অধিকার, এটি নিশ্চিত করতে হবে। ‘লাল কার্ড’ কর্মসূচির বর্ণনা দিয়ে আন্দোলনরত ছাত্ররা বলেছে, আপনারা জানেন ফুটবল মাঠে খেলোয়াড়রা ভুল বা অন্যায় করলে, অখেলোয়াড় সুলভ আচরণে রেফারি সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়কে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন। আমাদের আজ বাধ্য হয়ে সে ভূমিকায় নামতে হয়েছে। কারণ সড়ক নিরাপদ নয়। সড়কে নিয়মকানুন মানা হয় না। সড়ক হয়ে পড়েছে মৃত্যুর ঠিকানা। ছাত্ররা তাদের কর্মসূচির ব্যাপারে একজন মন্ত্রীর অভিযোগেরও প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলেছে, মন্ত্রী মহোদয় বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে আমাদের সংশ্লিষ্ট করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিন্দনীয়। আমরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছি। দাবি বাস্তবায়িত হলে আমরা রাস্তায় আসব না। প্রকৃত তথ্য না জেনে মন্ত্রীদের মন্তব্য না করারও অনুরোধ জানায় ছাত্ররা। রোববার ছাত্ররা রামপুরা ব্রিজে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনী এবং শাহবাগে প্রতীকী লাশ নিয়ে মিছিল করে। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ছাত্ররা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদী গান ও মোমবাতি প্রজ্বলনের কর্মসূচি দেয়।

ছাত্রদের এ আন্দোলন ন্যায্যই শুধু নয়, যথার্থও। সড়কে অরাজকতা এতটাই বেড়েছে যে, মানুষ আজ অসহায়বোধ করছেন। সড়ক দুর্ঘটনা মহামারী আকার ধারণ করেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর মাসেই মারা গেছে ৫৪ শিক্ষার্থী। ছাত্রদের আন্দোলন চলাকালে গত শুক্রবার রাতেও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাহাদী হাসান। তিনি গ্রীন ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিমানবন্দরের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে গত ২৪ নভেম্বর গাড়ি চাপায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাস চাপায় মারা যায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম।

ছাত্রদের আন্দোলনের সূত্রপাত একজন ছাত্রীর প্রতি বাসের হেলপারের অশোভন উক্তির প্রতিবাদ থেকে। বাসে যাতায়াতকালে ওই ছাত্রী হাফ ভাড়া দিতে চাইলে হেলপার তাকে ধর্ষণের হুমকি দেয়। ওই ছাত্রী বিষয়টি কলেজে সহপাঠীদের জানালে তারা সড়ক অবরোধ করে এর প্রতিবাদ জানায়। একই সাথে তারা ‘হাফ ভাড়া’ চালুর দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তাদের আন্দোলনের মুখে হাফ ভাড়া সরকার মেনে নিলেও সরকারি প্রজ্ঞাপন এখনো জারি হয়নি। ছাত্ররা বলেছে, হাফ ভাড়ার বিষয়ে শর্তহীন প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। এ নিয়ে সংসদেও আলোচনা হয়।

আগেই বলেছি ছাত্রদের এ আন্দোলন ন্যায্য। অন্যায় অনিয়ম ও অশুভের বিরুদ্ধেই তারা আন্দোলন রচনা করেছে। হাফ ভাড়া নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার আগে যেমন ছিল, তেমনি স্বাধীনতার পরও বাসে ছাত্রছাত্রীরা হাফ ভাড়ায় যাতায়াত করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতি কার্ড দেখালেই বাসে হাফ ভাড়া নেয়া হতো। এমনকি আগে হেলপার-কন্ডাক্টররা ছাত্রছাত্রীদের বাসে দেখলে জিজ্ঞাসাও করত না, হাফ ভাড়া নিয়ে নিত। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ট্রেনে টিকিট ফ্রি থাকত। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি হাফ ভাড়া কিংবা উৎসবের দিনে বিনা পয়সায় শিক্ষার্থীদের ট্রেনে ভ্রমণ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তাই ছাত্রছাত্রীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তাদের এ অধিকার আবার ফিরিয়ে দিতে হবে। এটি দোষের কিছু নয়। হাফ ভাড়ার দাবিতে ছাত্রদের যাতে আর সড়কে নামতে না হয় সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের যে দাবি ছাত্ররা তুলেছে তার সাথে সারা দেশের মানুষ একাত্ম; কারণ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার ভুক্তভোগী। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, যানবাহনের বেপরোয়া চলাচলে অনেক প্রাণ প্রতিদিন সড়কে ঝরে পড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং অদক্ষ চালক। সড়কে ছাত্ররা বাস-মিনিবাসের ফিটনেস এবং লাইসেন্স পরীক্ষা করে হাতেনাতে প্রমাণ দেখিয়ে দিয়েছে যে সড়কে অরাজকতা দীর্ঘ দিন ধরে চলছে। সড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশও ছাত্রদের সাথে একমত হচ্ছে; কারণ ছাত্ররা যানবাহনের কাগজপত্রের অনিয়ম বের করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। তাই সড়কে আর যাতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালকের রাজত্ব না থাকে তা বিআরটিএ এবং পুলিশসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।

সড়ক ও সেতু নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ তুলেছে ছাত্ররা। এটিও সঠিক অভিযোগ। চোখের সামনে আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি কিভাবে রাষ্ট্রের টাকা লোপাট হচ্ছে। সড়ক মেরামতের নামে একের পর এক প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে এবং শত শত কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার এমন এলাকা নেই যেখানে একটি সড়ক বছরে দু-তিনবার কাটতে না হয়। ভালো সড়কও কেটে ফেলতে দেখা যায়। আবার মাসের পর মাস সড়ক কাটা অবস্থায় পড়ে থাকে। সাধারণ চলাচলকারীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কিন্তু কেউ যেন দেখার নেই। প্রকল্প বানিয়ে তা পাশ করিয়ে টাকা হস্তগত করেই শেষ। সড়ক থাকে সড়কের জায়গায়। পুরান ঢাকায় বর্তমানে বিভিন্ন সরু গলিতে এ ধরনের খোঁড়াখুঁড়ি, কাটাকাটি দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে। ফলে যানজট, জলজট ও মানুষের ভোগান্তি চরমে। তাই এ অন্যায়, অনিয়ম ও অশুভ চর্চার বিরুদ্ধে ছাত্রদের ‘লাল কার্ড’ যথার্থ প্রতিবাদ।

অশুভ করোনা মহামারী ও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট
পৃথিবীর জন্য অশুভ ও অভিশাপের নাম অতি ক্ষুদ্র অদৃশ্য করোনাভাইরাস। দুই বছর ধরে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর দাপট চলছে। এক অঞ্চলে সংক্রমণ কমছে তো অন্য অঞ্চলে বাড়ছে। করোনাভাইরাসের নিত্যনতুন রূপ নতুন নতুন আতঙ্কের সৃষ্টি করছে। এ পর্যন্ত ভাইরাসটির যে ক’টি ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট ভয়ঙ্কর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে তার মধ্যে ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শীর্ষ বিজ্ঞানী ড. সোয়ামীনাথন বলেছেন, সারা বিশ্বে বর্তমানে যেসব সংক্রমণ ঘটছে তার ৯৯ শতাংশের জন্য দায়ী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। আর গত এক সপ্তাহের খবর হচ্ছে ডেল্টার চেয়েও খারাপ ও মারাত্মক ধরন হচ্ছে ‘ওমিক্রন’। করোনাভাইরাসের নতুন রূপ পাওয়া এ ধরনটি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হয়। দেশটির বিজ্ঞানীরা এর পরই ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপারে বিশ্বকে সতর্ক করে দেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শীর্ষ বিজ্ঞানী ড. সোয়ামীনাথন দক্ষিণ আফ্রিকার তথ্য তুলে ধরে গত শুক্রবার বলেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ‘অতি সংক্রমণশীল’। এটি সারা বিশ্বেই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে। এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এ ভ্যারিয়েন্ট অনেক বেশি পরিবর্তিত এবং আগেরগুলোর চেয়ে বেশি সংক্রমণশীল। তবে এটি কোভিড-১৯ টিকাকে ফাঁকি দিতে পারে কি না- এসব বিষয় এখনো পরিষ্কার হওয়া যায়নি। প্রাথমিক বিশ্লেষণ তুলে ধরে ড. সোয়ামীনাথন বলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে মানবদেহের যে ক্ষমতা, নতুন এই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট তাকে হয়তো অকার্যকর করে দিতে পারে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এটি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতিটি দেশ যদি তাদের নাগরিকদের রক্ষার ব্যাপারে সতর্ক থাকে, প্রত্যেক ব্যক্তি যদি নিজেকে রক্ষার জন্য সতর্ক থাকে, মাস্ক ব্যবহার করে তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ এখন আমরা এক বছর আগের চেয়ে ভিন্ন অবস্থানে আছি। মহামারীর হাত থেকে রক্ষার জন্য যেসব কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে সেগুলো আমাদের জানা, এর বিরুদ্ধে এখন বেশ কয়েকটি টিকা আছে, ওষুধ আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কার্যক্রমের পরিচালক মাইক রায়ান বলেন, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বর্তমানে যেসব টিকা রয়েছে, সেগুলো ‘অত্যন্ত কার্যকর’ এবং এখন আমাদের সারা বিশ্বে আরো বিস্তৃতভাবে টিকা সরবরাহ করার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা লোকদের টিকাদান সম্পন্ন করতে হবে।

ফাইজার-বায়োএনটেকের কোভিড টিকার অন্যতম আবিষ্কারক বায়োএনটেকের সিইও বিজ্ঞানী ড. উগর শাহিন বলেন, চাহিদানুযায়ী নতুন ধরনের উপযোগী টিকাও তুলনামূলকভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসা সম্ভব। তিনি বলেন, এ নিয়ে তারা জোরালোভাবেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ এখনো ‘ওমিক্রমন’-এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। তবে আতঙ্কের কারণ হচ্ছে প্রতিবেশী ভারতে এরই মধ্যে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত ভারতে তিনজনের মধ্যে ওমিক্রনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তদের কেউ কেউ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছেন বলে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগতদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখার নিয়মাবলি ঘোষণা করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে এ ব্যাপারে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত করোনা মহামারীতে সাড়ে ৫২ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মানুষের সচেতনতা ও বিজ্ঞান অবশ্যই এ মহামারীকে লাল কার্ড দেখাবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement