২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তুরস্কের অর্থনৈতিক সঙ্কট, বাংলাদেশে শঙ্কা

-

বিশ্বের আলোচিত দেশ তুরস্ক এক নজিরবিহীন আর্থিক সঙ্কটকাল পার করছে। এক দিনেই দেশটির মুদ্রা লিরা মূল্য হারিয়েছে ১৫ শতাংশ। এক বছরে লিরার দাম কমেছে ডলারের বিপরীতে ৫৫ শতাংশের বেশি। লিরার নজিরবিহীন এই দরপতন অর্থনীতির অন্যান্য দিকে চাপ সৃষ্টি করছে; শুধু তাই নয়, একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বেড়েছে। বিরোধী দলগুলো সমস্বরে অগ্রিম নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। তারা বলছেন, এরদোগানের একগুঁয়েমির কারণে বিপর্যয়কর এই অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। অন্য দিকে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান এটিকে ‘অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, তিনি কী করছেন, কোথায় যেতে চান, এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এবং এর চূড়ান্ত ফলাফল জাতি কতটা কী পাবে, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন রয়েছেন।

এদিকে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ বিষয় হলো, লিরা নিয়ে এখন যে সঙ্কট তুরস্কে সৃষ্টি হয়েছে, একই ধরনের পটভূমি বাংলাদেশেও বিরাজ করছে। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বলতা বা ভঙ্গুরতা আরো বেশি। ফলে বাংলাদেশও একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ার ব্যাপারে উদ্বেগ রয়েছে। সরকারের নীতি প্রণয়ন পর্যায়েও এ শঙ্কা কাজ করছে বলে জানা যাচ্ছে যদিও সংশোধনমূলক কোনো পদক্ষেপ এখনো সেভাবে দেখা যায় না।

তুরস্ক ও এর অর্থনীতি
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সংজ্ঞা অনুযায়ী, তুরস্কের অর্থনীতি উদীয়মান বাজার অর্থনীতি। তুরস্ককে বিশ্বের নতুন শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০২১ সালের হিসাবে ৮ কোটি ৩৪ লাখ জনসংখ্যার তুরস্ক বিনিময় হার অনুসারে বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম জিডিপির অর্থনীতি আর ক্রয়ক্ষমতার সমানুপাত বা পিপিপি বিবেচনায় ১১তম বৃহত্তম অর্থনীতি। দেশটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কৃষিপণ্য, টেক্সটাইল, মোটরযান, পরিবহন সরঞ্জাম, নির্মাণসামগ্রী, ভোক্তা ইলেকট্রনিকস এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস উৎপাদনকারীদের মধ্যে একটি।

গত ২০ বছরে, তুরস্কের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলোতে বড় ধরনের উন্নয়ন হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধির এই গতি সৃষ্টি হয়। অবশ্য বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ফলে তুরস্ক সম্প্রতি তার অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মন্থর হয়েছে। দেশটি যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তুরস্কের অর্থনৈতিক সংস্কারে নিম্নগতি।

লিরার অব্যাহত দর পতনের কারণে বড় একটি সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে তুরস্কের অর্থনীতি। মুদ্রার দাম কমার সাথে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। ‘সরবরাহ শৃঙ্খল’ সমস্যা এবং কোভিড মহামারী থেকে উদ্ভূত শ্রমের ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান খাদ্য ও জ্বালানির দামের মিলিত প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬.২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৪.২ শতাংশ, ব্রাজিলে ১০.৭ শতাংশ এবং ভারতে ৪.৫ শতাংশ পর্যন্ত জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয় সুদহার বাড়িয়ে অথবা অদূরভবিষ্যতে বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুরস্কের বিষয়টি হয়েছে এর উল্টো। দেশটি সুদহার বাড়ানোর পরিবর্তে আরো কমিয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে, তুরস্ক সুদহার ধাপে ধাপে ১৯ শতাংশ থেকে চার শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

সেপ্টেম্বরের শুরুতে ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরা ছিল ৮.২৮ যা গত ২৩ নভেম্বর ১৩.৪ লিরায় এসে দাঁড়ায়। পরে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়ে এখন প্রতি ডলার ১২.১ লিরায় লেনদেন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা কোভিড-১৯ সম্পর্কে নতুন ভয়ের প্রতিক্রিয়ায় দুর্বল মুদ্রা থেকে অর্থ সরিয়ে নিয়েছে বলে লিরার এই দরপতন ঘটার কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, কেন তুরস্কের সরকার সুদের হারের বিষয়ে এমন একটি নীতি গ্রহণ করছে?

এরদোগান কী বলছেন?
লিরার মূল্য কমার বিপর্যয়কর চাপের মধ্যেও তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগান তার নীতিতে অটল থেকে বলেছেন, আমরা উচ্চ সুদের হারে জনগণকে পিষ্ট হতে দেব না। তিনি ২৬ নভেম্বর ইজমিরের এক অনুষ্ঠানে কম সুদের হারের প্রতি প্রতিশ্রæতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, তুরস্ক তার নতুন অর্থনৈতিক নীতি অব্যাহত রাখবে যা উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং চলতি হিসাবের উদ্বৃত্তকে অগ্রাধিকার দেয়।

তুর্কি নেতা টেলিভিশন মন্তব্যে বলেছেন, লিরায় এই সপ্তাহের পতনের কোনো অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই এবং এটি একটি আর্থিক অন্তর্ঘাতের ফল। ‘রাজনীতি ও অর্থের বৈশ্বিক ব্যারন’ এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সমর্থকরা তুরস্কে সুদের হার উচ্চ রাখতে চায়। তারাই এই অন্তর্ঘাতের কারিগর।

তুরস্কের উপ-অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সুদের হার কমানোর নীতি বাস্তবায়ন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ সঙ্কল্প পুনর্ব্যক্ত করেছে। উপ-ট্রেজারি ও অর্থমন্ত্রী নুরেদ্দিন নেবাতি টুইটারে বলেছেন, ‘২০১৩ সাল থেকে, যতবারই আমরা স্বল্প সুদের হার নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি, আমাদের প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়। এবার আমরা এটি চালিয়ে যেতে দৃঢপ্রতিজ্ঞ। তুর্কি লিরার ওপর ‘কারচুপিমূলক আক্রমণ’ দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষার পথ থেকে আমাদের নিবৃত্ত করা যাবে না।’

তুরস্কে গত তিন বছরেরও কম সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হয়েছেন চারজন। সরকারের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার সাথে গভর্নরের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধানের কারণেই এটি হয়েছে বলে মনে হয়। সরকার চেয়েছে সুদের হার কমাতে; কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা আরো বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গত মার্চ মাসে সর্বশেষ অ্যাপয়েন্টমেন্টটি ছিল শাহাপ কাভসিওলুর। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সুদের হার আর বাড়েনি।

বছরের শুরু থেকে লিরা এ পর্যন্ত ৪০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। এটি যেকোনো অর্থনীতির জন্য একটি বড় দুর্বলতা। লিরার এই পতনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে যা ইতোমধ্যেই ২০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। বিদ্যমান ধারণা অনুসারে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরার ১০ শতাংশ অবমূল্যায়নের ফলে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তুরস্কের আমদানির প্রায় ৭০ শতাংশ কাঁচামাল এবং পণ্য উৎপাদনে তা ব্যবহার করা হয়। লিরার অবমূল্যায়নের প্রভাব এখানে পড়বে। একই সাথে তা জীবনযাত্রার ব্যয়কে বাড়াবে। তুরস্কের আরেকটি অসুবিধা হলো, দেশটির প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ জ্বালানি আমদানি করতে হয়। এ কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি লিরার দাম কমার প্রভাব পড়বে মুদ্রাস্ফীতিতে।

তুরস্কের আরেকটি সমস্যা হলো, ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে বিদেশী মুদ্রা মার্কিন ডলার ও ইউরোতে। দুর্বল লিরা এই ঋণের পরিষেবা দেয়াকে কঠিন করে তুলবে। তুরস্ককে আগামী ১২ মাসে তার বিদেশী ঋণের জন্য ১৬৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটি তুরস্কের সমস্যা অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে।

Chate

নীতিনির্ধারকরা কী করতে পারেন?
মুদ্রার অস্থিরতার মুখে নীতিনির্ধারকদের কাছে গতানুগতিক তিনটি করণীয় রয়েছে বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, সুদের হার বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিক্রি করা এবং মূলধনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ। (অর্থাৎ বিদেশী মুদ্রাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধা দেয়া)। তিনটিরই লক্ষ্য হতে পারে দেশীয় মুদ্রায় চাপ কমানো। সুদের হার বাড়ানো দেশীয় মুদ্রাকে বিনিয়োগকারীদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। কারণ এখান থেকে তাদের আয় বৃদ্ধি পেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিক্রি করার অর্থ হলো দেশীয় মুদ্রার বেশি কেনা, আর অতিরিক্ত চাহিদার কারণে এর মূল্য শক্তিশালী হয়। অন্য দিকে, মূলধন নিয়ন্ত্রণ দেশীয় ও বিদেশী মুদ্রার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণকে ধীর করে দেয়।

তুরস্কের সরকার সুদের হার বাড়ানোর বিষয়ে উৎসাহী নয়। তা ছাড়া সরকার বৈদেশিক রিজার্ভ বিক্রি করতে পারবে না। কারণ এটি এক ধরনের আতঙ্ক ছড়ায়। আর সরকার মূলধন প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করলে তা এই বার্তা দেবে যে, তুরস্ক আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে চাচ্ছে। পুঁজি নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের দেশগুলোতেও কঠিন এবং ব্যয়বহুল হয়।

তুরস্কের সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কী করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সম্ভবত সরকার গতানুগতিক পথ না নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়ানোর বিকল্প পথ নেবে। সরকার ক‚টনৈতিক অংশীদারদের সাথে বিরোধ মিটিয়ে নতুন সম্পর্ক তৈরি করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে আরব আমিরাতের ডিফেক্টো শাসক মুহাম্মদ বিন জায়েদ আঙ্কারা সফর করেছেন এবং তার সফরকালে দু’দেশের মধ্যে বিনিয়োগের অনেক চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। বিন জায়েদ তুরস্কে বিনিয়োগের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলার তহবিল সংরক্ষণের কথা জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্স রাশিয়া গ্রিস মিসর সৌদি আরব ইরান ইসরাইলসহ সব দেশের সাথে দূরত্ব মিটিয়ে ফেলার প্রতি নজর দিচ্ছে এরদোগান সরকার। এর পাশাপাশি ‘তুর্কি রাষ্ট্র সংস্থার’ মতো বিভিন্ন বলয় ও বাজার সৃষ্টির ব্যাপারে বিশেষ নজর দিয়েছে তুর্কি সরকার।

এরদোগানের সামনে নীতি পরিবর্তনের পরিবর্তে তুর্কি অর্থনীতিকে নিয়ে বাইরের শক্তির ঝুঁকি সৃষ্টির যে টুলস রয়েছে সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার এজেন্ডাই রয়েছে বলে মনে হয়। যে সব দেশ ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান ১৯-২০ শতাংশ সুদ রাখার ব্যাপারে চাপ দিচ্ছে, সে সবের কোনো দেশেই এত উচ্চ হারের সুদ নেই। সুদের এই উচ্চ হারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে যেমন উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হন, তেমনিভাবে ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণ নিয়ে কোনো উদ্যোগ সফল করতে পারেন না। এর প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে। এবার এরদোগান সম্ভবত সুদের হারের এই বিষয়টি কঠিনভাবে সমাধান করতে চাইছেন। ফলে লিরার এত বড় দরপতনের পরও নীতিপ্রণেতাদের খুব বেশি উৎকণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি। তারা ঠাণ্ডা মাথায় নীতি রূপান্তরের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন বলে মনে হয়, যার অংশ হিসেবে লিরার অধঃপতন নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।

তবে এই ইস্যু নিয়ে প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি, গুড পার্টি এবং এক সময়ের একেপি নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমদ দেভোতুগ্লর ফিউচার পার্টি ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আলি বাবাকান ও তার দলের সমালোচনামূলক অবস্থান নিয়েও খুব একটি বাড়তি প্রতিক্রিয়া সরকারের নেই। শাসক দল একে পার্টি ও প্রেসিডেন্টের অনুমোদন হার এখন যে ৪০ শতাংশের কোটায় নেমে এসেছে তা নিয়েও খুব একটি উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না। তাদের ধারণা, ২০২৩ সাল নাগাদ এমন অনেক পরিবর্তন তুরস্কে আসবে যা এসব রাজনৈতিক ঝুঁকি কাটাতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির শঙ্কা
তুরস্কের অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির মিল ও ব্যবধান দুটোই রয়েছে। তুরস্কের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। তবে তুর্কি অর্থনীতির যে গভীরতা রয়েছে ততটা শক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতির নেই। তুরস্কের রফতানি বাজার প্রধানত ইউরোপ-আমেরিকা কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের অবস্থাও একই। বাংলাদেশের পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে চীন ও ভারত নির্ভরতা যে রকম রয়েছে তুরস্কের অবস্থাও প্রায় কাছাকাছি। দুই দেশের জ্বালানি আমদানির প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য।

ভ‚কৌশলগত অবস্থা বিবেচনায় তুরস্ক বিশ্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। বাংলাদেশের গুরুত্ব সেই তুলনায় কম হলেও চীন ভারতের নিকটবর্তী দেশ হিসেবে ঢাকার গুরুত্ব বাড়ছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের অস্থিরতা বাদ দেয়া হলে এর আগের এক দশকের বেশি সময় তুরস্কে বিনিময় হারে স্থিতি বজায় ছিল। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হলেও গত এক দশকে ভারত পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল ছিল বিনিময় হার।

অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর আঘাতের মাত্রা বিবেচনা করা হলে দু’দেশের পরিস্থিতি প্রায় কাছাকাছি যদিও করোনাকালে বাংলাদেশে শিল্পোৎপাদন খাত যেভাবে লম্বা সময়ের জন্য বন্ধ ছিল তুরস্কে সে রকম ছিল না। তুরস্কে কোভিড মোকাবেলার স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। তবে প্রাক-কোভিড ও কোভিডোত্তর সময়ে শিল্প বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে গতি আনার ব্যাপারে তুরস্ক ও বাংলাদেশের সুদহার নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় কাছাকাছি।

অর্থনৈতিক বিকাশ, কর্মসংস্থান ও দীর্ঘমেয়াদি শিল্প প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এরদোগানের ভাবনার মতোই বিবেচনা রয়েছে বাংলাদেশের। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল দায়িত্ব গ্রহণের পর সুদহার কমানোর ব্যাপারে বিশেষ জোর দিয়ে আসছেন। তিনি বলেছেন, ১৫-১৬ শতাংশ সুদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। এমনকি ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করাও এত উচ্চ হারের সুদে কঠিন। এ কারণে বাংলাদেশের শিল্প ও বণিক সমিতিগুলোর সুদহার কমানোর দাবিতে অর্থমন্ত্রী অনেকটা সক্রিয়ভাবে একমত হয়েছেন। কয়েকটি ব্যতিক্রমী খাত বাদ দিয়ে ব্যাংক সুদের হার তিনি এক অঙ্কে নামিয়ে এনেছেন। অর্থনীতিতে যেখানে অব্যাহতভাবে ৬-৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি চলে এসেছে, সেখানে এক অঙ্কে ঋণ সুদহার নামাতে গিয়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর ফলে আমদানিকারকদের জমাকৃত অর্থ প্রকৃত অর্থে মূল্য হারাচ্ছে।

এ নিয়ে নানা সমালোচনার পরও সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশে এখনো সুদহার এক অঙ্ক বা ৯ শতাংশের কোটায় রেখেছে। করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে আরো কম সুদে প্রণোদনা ঋণ এবং ৯ শতাংশ সুদে সাধারণ ঋণ দেয়ার পরও ব্যাংক-বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে আশানুরূপ গতি সৃষ্টি হয়নি। বেকারত্ব ও আধা বেকারত্বের হার সরকারিভাবে দেখানো হারের কয়েক গুণ বেশি বলে ধারণা করা হয় সাধারণভাবে।

এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্য আর একই সাথে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্ক সুদহার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার যে প্রভাব লিরার ওপর পড়ছে তেমন কিছু ৯ শতাংশ সুদহারের বাংলাদেশে আগে না পড়লেও ভবিষ্যতে পড়বে কিনা। দুটি দেশই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে কাছাকাছি মাত্রায় সমন্বিত ও নির্ভরশীল। তুরস্কের মতো রাতারাতি স্থানীয় মুদ্রার ১৫ শতাংশ মূল্য না কমলেও গত এক বছরে ১ শতাংশের মতো দাম কমেছে টাকার।

তুরস্কের অর্থনীতি বহুলভাবে ইউরোপ আমেরিকা নির্ভরশীল। দেশটির এসব অংশীদার বা প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক পুঁজির মালিকরা এরদোগানের সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে লিরাকে বিপর্যস্ত করেছে বলে মনে হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা লিরার বিপর্যয়কে ‘বিদেশের চাপিয়ে দেয়া ষড়যন্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করে তা থেকে মুক্ত হওয়ার ডাক দিয়েছেন। বাণিজ্য অংশীদারদের সাথে ঠিকঠাকভাবে সমঝোতায় না যেতে পারলে অথবা বড় কোনো অবরোধ চাপিয়ে দেয়া হলে ব্যবসা বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান আর প্রবৃদ্ধিতে গতি আনতে সুদের হার হ্রাসের টুলসকে কতটা কার্যকরভাবে এরদোগান প্রয়োগ করতে পারবেন তাতে সন্দেহ রয়েছে। এ জন্য অবশ্য এরদোগান তার আরব ও বৈশ্বিক অংশীদারদের সাথে দূরত্ব কমানোর নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তুরস্কের।

বাংলাদেশ অর্থনীতির একটি কঠিন বাস্তবতা হলো, এখানকার দ্বিমুখী-নির্ভরতা। রফতানি বাজার ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য মোটা দাগে ঢাকার নির্ভরতা রয়েছে ইউরোপ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ওপর। অন্য দিকে উন্নয়নসহায়তার জন্য চীনের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। আর বর্তমানে যে বৈশ্বিক পরিস্থিতি তাতে চীন রাশিয়ার সাথে ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্ঘাতের এক অবস্থা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ চীনের সাথে বর্তমান সম্পর্ক বজায় রাখলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নানা অবয়বে বয়কটের মতো টুলস ব্যবহার করতে পারে। তার প্রভাব বিশ্বব্যাংক গ্রæপ বা জাপানের মতো দেশের অর্থনৈতিক সহায়তার ওপরই পড়বে। একই সাথে এই প্রভাব রফতানি পণ্যের বাজারেও পড়তে পারে।

কোয়াড প্লাসে থাকা না থাকা নিয়ে এখনো যে দ্বিমুখী সঙ্কট বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে সরকারের সামনে অস্বস্তিকর এক অবস্থা তৈরি হয়েছে। ইন্দো-আমেরিকার দিকে ঝুঁকলে চীনের উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ হতে বা কমে যেতে পারে। একই সাথে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বজায় রাখার চাপ বাড়বে। অন্যদিকে চীনমুখী হলে আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে। এর মধ্যে, বাংলাদেশের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কিছু ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।

তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যকার একটি বিশেষ মিল হলো, দু’দেশেই ২০২৩ সালে নির্বাচন। এই নির্বাচনের আগেই ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস চলছে। দুই দেশেই ক্ষমতার এই পরিবর্তনের আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে শাসন পরিবর্তনে প্রভাব বিস্তারের যে প্রধান টুলস রয়েছে, সেটি হলো বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রভাব। সেই টুলসটি এখন তুরস্কে কাজে লাগানো হচ্ছে। বাংলাদেশেও এটিকে সক্রিয় করা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তুরস্কের দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি, কূটনৈতিক অংশীদারিত্বের ব্যাপকতার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে।

বাংলাদেশ সে অবস্থা কাটাতে কতটা কী করতে পারবে সেটিই হলো বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্বল্প ব্যবধানে ৮০ টাকা থেকে ৮৬ টাকায় উন্নীত হয়েছে। রিজার্ভ নভেম্বরের তিন সপ্তাহে ২ বিলিয়ন ডলার কমে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আমদানি বিল বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণে এটি আরো নেমে যেতে পারে। এত দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনে ও বিক্রি করে বিনিময় হারকে স্থির রেখেছে। এখন যেভাবে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে তাতে এই প্রক্রিয়া সফল হবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের বিপজ্জনক ঊর্ধ্বগতি চলছে। নানা ধরনের শিথিলতার পরও খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা পেরিয়ে গেছে। কোনো ধরনের কিস্তি পরিশোধ ছাড়া ঋণ নবায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ হলে খেলাপি ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারে। এর উপরে নামে বেনামে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের তহবিল বের করে নেয়ার গুজব রয়েছে। এতে সত্যতা থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে বাইরের যেকোনো চাপ মোকাবেলা কঠিন হবে।

বাংলাদেশ পররাষ্ট্র কৌশলে ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। সে প্রচেষ্টায় বিপত্তি সৃষ্টিতে তুরস্কের এরদোগানের সামনে এখন যে ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে ঝুঁকির মাত্রা কম হলেও তা কতটা এড়াতে পারবে বাংলাদেশের সরকার সেটি এ সময়ে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement