২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রাচ্যতত্ত্ব ও ইসলাম : মোস্তফা সিবাঈর বোঝাপড়া

-

(প্রথম কিস্তি)
প্রাচ্য কিংবা এর কোনো অংশবিশেষ সম্পর্কে পশ্চিমা অধ্যয়নকে আমরা ওরিয়েন্টালিজম বলে জানি, সে অধ্যয়ন প্রাচ্যের কোনো বিদ্যা বা ডিসিপ্লিন নিয়েও হতে পারে। ওরিয়েন্টালিজমের বিশেষ ও প্রখর মনোযোগ ইসলামের প্রতি। প্রাচ্যবাদী মন ইসলামকে পাঠ ও বিচার করতে চেয়েছে কর্তৃত্বের জায়গা থেকে। যেন সে কর্তৃপক্ষ কিংবা এমন ডাক্তার, যার সামনে রোগী হয়ে বসে আছে ইসলাম। বেশির ভাগ প্রাচ্যতাত্তি¡ক এই মানসিকতা থেকে ইসলামকে দেখেছেন, সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন কোথায় খুঁত পাওয়া যায়, তার তালাশে। যখন বলার মতো কিছু মিলছে না, তখনো কিছু একটা বের করার চেষ্টা বাদ দিতে পারেননি। মুসলিমদের সভ্যতাকে ‘অপর’ ও ‘বর্বর’ এবং নিজেদের সভ্যতাকে ‘মহান ও আলোকিত’ ভাবার অসুখ থেকে তারা ইসলামের প্রায় সব কিছুতেই তালাশ করেছেন অন্ধকার। ফলে অলীক ও ভিত্তিহীন অভিযোগের স্ত‚প সাজিয়েছেন ইসলামের বিরুদ্ধে।

ঔপনিবেশিকতার প্রশ্রয়ে মুসলিম জাহানে প্রাচ্যবাদ বিচারক ও শিক্ষক হিসেবে জ্ঞানের পরিমণ্ডলে স্থান করে নিতে চাইল। যেন সে ইসলাম সম্পর্কে ভালো-মন্দের রায় দেবে। বলে দেবে, ইসলামের কী কী জারি রাখার আর কী কী বাতিল করার! এ মানসিকতার গোড়ায় ছিল সেই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও বর্ণবাদী অহম, যা ইউরোপকে ঔপনিবেশিক বর্বরতা ও মানুষকে ধরে এনে দাস বানানোর হীনতায় লিপ্ত করেছিল। বর্ণবাদের পাশাপাশি ধর্মকেন্দ্রিক সেই আক্রোশও এতে নিহিত ছিল, যার ফলে মুসলিম সভ্যতার বিরুদ্ধে ইউরোপ শুরু করেছিল ক্রুসেড!

প্রাচ্যবাদের এ প্রভুত্বকামিতা ইসলাম মেনে নেবে না, তা ছিল স্পষ্ট এবং ইসলামের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী প্রাচ্যতাত্তি¡ক প্রেসক্রিপশনের আলোকে কুরআন-সুন্নাহকে বুঝতে ও বোঝাতে রাজি হবেন না, এটিই ছিল অবধারিত। কিন্তু যে সমস্যা দেখা গেল, তা হলো- প্রাচ্যতাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞরা ছিলেন উন্নত বুদ্ধিবৃত্তি, নানামাত্রিক প্রস্তুতি এবং কর্তৃত্বের অধিকারী। ফলে তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাল্টা ডিসকোর্স হাজির করার ভাষিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তৃত্বসম্পন্ন আলেমদের উপস্থিতি ছিল বিরল। যারা জ্ঞানদক্ষ উপস্থাপন ও চিন্তানৈতিক পরিশীলনে প্রাচ্যবাদী ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দেবেন দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো। যদিও সে চেষ্টা নানা হাত দিয়ে হচ্ছিল, কিন্তু তাতে ছিল না সেই প্রাবল্য, যা কর্তৃত্ববাদী বয়ানের ভিত্তি ধরে টান দেবে।

অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো মিসর-সিরিয়া এই সঙ্কট অনুভব করছিল গভীরভাবে। সে ফরাসি ও অন্যান্য সূত্রে প্রাচ্যতত্তে¡র শিকারে পরিণত হয়ে আসছিল বহুকাল ধরে। এখানকার মুসলিম জ্ঞানকলা নানাভাবে চেষ্টা করছিল মোকাবেলার। কিন্তু বিচিত্র পথ ধরে, বিচিত্র প্রকরণে, বিচিত্র মাত্রায় প্রাচ্যবাদী বয়ান মুসলিম বিশ্বাস ও মানসলোককে চ্যালেঞ্জ করছিল। এ প্রেক্ষাপটে আল আজহারের সিরীয় বংশজাত এক সন্তান চ্যালেঞ্জের বিপরীতে এগিয়ে এলেন। তিনি মোস্তাফা আস সিবাঈ। সিরিয়ার হোমসে জ্ঞানগত আভিজাত্য ও নেতৃত্বদক্ষতার ঐতিহ্যসম্পন্ন একটি পরিবারে তার জন্ম। সময়টা ১৯১৫ সাল। তার পিতা হাসানী আস সিবায়ী ছিলেন বিদগ্ধ আলেম। ১৯৩৩ সালে মিসরে যান সিবাঈ, লক্ষ্য জামে আল আজহারে পাঠগ্রহণ। আল আজহার তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের তুফানে কাঁপছে। উপনিবেশের শেষ দেখে নিতে চায় ছাত্র-তরুণরা। মোস্তাফা সিবাঈও সেই সংগ্রামে শামিল হলেন। সরকারের রোষের শিকার হলেন এবং গ্রেফতার করে তাকে পাঠানো হলো কারাগারে। মিসরে থাকাকালে পরিচয় হয় ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নার সাথে। তার চেতনাবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি গড়ে তোলেন মুসলিম ব্রাদারহুড ইন সিরিয়া। রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন ক্রমেই। ১৯৪৯ সালে তিনি দামেস্কের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৯ সদস্যবিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যও ছিলেন। শিক্ষা ও জ্ঞানপ্রয়াসে ছিলেন সমান সক্রিয়। ১৯৫০ সালে সিরিয়া ইউনিভার্সিটির অধিকার অনুষদের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে দামেস্ক ইউনিভার্সিটির শরিয়াহ অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডিন মনোনীত হন।

কিন্তু সিস্টেমের সাথে তার সঙ্ঘাত বাধছিল এবং তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫৬ সালে। সুয়েজ খালের কর্তৃত্ব নিয়ে তখন আরব-ইহুদি যুদ্ধ বাধে, সিবাঈ সিরিয়ার সরকারকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তীব্র চাপ প্রয়োগ করেন ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জোরালো প্রচারণা শুরু করেন। সিরীয় সরকার এই কঠোর অবস্থান সহ্য করল না। সিরিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় সিবাঈকে, নির্বাসিত করা হয় লেবাননে।

সিবাঈ সেখানেও ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তায় অগ্রগণ্য। বস্তুত রাজনীতি, জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিজীবীতাকে একত্রে ধারণের প্রখর নমুনা হয়ে ওঠেন সিবাঈ। জীবনের পরিণত ধাপে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিণতিটাই তাকে অধিকতর উজ্জ্বল করেছে। যেখানে প্রাচ্যবাদের সাথে তার লড়াই ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক দিক। প্রাচ্যবাদী কাজগুলোর সাথে তার মোলাকাত হয় ছাত্রজীবনেই। সেসবের জবাবী প্রচেষ্টাও শুরু করেন বিকাশের প্রথম প্রহর থেকে। কিন্তু কোনো প্রাচ্যবিদের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৫৬ সালে। ইতোমধ্যে প্রাচ্যতাত্তি¡ক আপত্তি ও তার সাথে তর্কপদ্ধতি তিনি অধ্যয়ন করেছেন নিবিড়ভাবে। ফলে লন্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এন্ডারসনের সাথে প্রথম সেই সাক্ষাতে সিবাঈ অপ্রস্তুত ছিলেন না বরং পরাক্রম নিয়েই হাজির হয়েছিলেন, যেমনটি হন আপন রচনায়। মিসরের কায়রো-আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে আরবি শিখেছিলেন এন্ডারসন। ইসলামের বিরুদ্ধে তার ছিল কঠোর অবস্থান। যা জ্ঞানগত সততা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মোহতা থেকে ছিল অনেক দূরে।

সিবাঈর সাথে সাক্ষাতে যা গোপন করেননি তিনি। এন্ডারসন স্বীকার করেন, আল আজহারের কিছু ছাত্র ইসলামী আইন নিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করতে চেয়েছিল। এন্ডারসন তাদের ফিরিয়ে দেন। কারণ, তারা বলেছিল- ইসলাম নারীদের পূর্ণাঙ্গ অধিকার সাব্যস্ত করেছে।’ বৈঠকে এন্ডারসন ড. সিবাঈয়ের কাছে বহুবিয়ের প্রসঙ্গ তোলেন। ইসলামে যা আদেশ নয়, অনুমোদন। মানুষের জীবনবাস্তবতায় এর প্রয়োজন পড়তেই পারে। স্বভাবধর্ম হিসেবে ইসলাম তাই একে অনুমোদন দিয়েছে ইনসাফ রক্ষার শর্তসাপেক্ষে এবং এর সীমা বেঁধে দিয়েছে সর্বোচ্চ চার। এন্ডারসনের বিচারে ইসলামের এই অনুমোদন অমানবিক, অপ্রয়োজনীয়। সিবাঈ দেখান, এর প্রয়োজনীয়তা ও মানবিকতার দিক। এন্ডারসনের সামনে তিনি পেশ করেন বিশেষ এক পরিস্থিতি। ‘ধরুন এক ব্যক্তির একজন স্ত্রী রয়েছে। সেই স্ত্রী এমন সংক্রামক বা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হলেন, যার নিরাময়ের কোনো আশা নেই। অথচ পুরুষটি তাজা তরুণ, যুবক। সে তখন কী করবে? হয়তো সে প্রথমাকে তালাক দিয়ে পুনরায় নতুন কোনো নারীকে বিয়ে করবে, অথবা তাকে বহাল রেখেই অন্য বিয়ে করবে, অথবা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে অন্য কোনো নারীর সাথে গোপনে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এই তিন পন্থা ছাড়া তার সামনে কি আর কোনো বিকল্প পথ খোলা আছে?’
এন্ডারসন বললেন, ‘চতুর্থ একটি বিকল্পও তো আছে। সে ধৈর্য ধারণ করবে এবং অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকবে।’ সিবাঈ জানতে চাইলেন, ‘সবাই কি তা পারে?’ এন্ডারসন বললেন, ‘আমরা, খ্রিষ্টানরা ঈশ্বরে বিশ্বাসের বলে এটা করতে পারি।’ সিবাঈ জবাব শুনে হাসলেন এবং বললেন, ‘পশ্চিমা একজন হয়ে আপনি এ দাবি করলেন কোন বাস্তবতার আলোকে? কোনো মুসলমান বা প্রাচ্যদেশীয় খ্রিষ্টান এমন দাবি করলে অন্তত বোধগম্য হতো। সে অবৈধ যৌনতা থেকে আত্মসংযম করলেও করতে পারে। কেননা, তার পরিবেশ তাকে যখন যেখানে খুশি, নারীর সংসর্গ লাভের সুযোগ দেয় না। তা ছাড়া তার ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধ তার কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার দেশে ও সমাজে তার ধর্মের প্রভাবও অপরিসীম। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ার উন্মুক্ত সংস্কৃতিতে আপনি যখন ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা নারীসঙ্গ পেতে পারছেন, সম্মতি হলেই এখানে দৈহিক সম্পর্কও স্বাভাবিক। আপনারা ঘর থেকে বাইরে গিয়ে ফিরে আসার সময়টুকুও নারীসঙ্গ ছাড়া স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। আপনাদের সমাজে নাইট ক্লাব, মদের আসর ও যৌনতাপূর্ণ নাচের আসরগুলো মুখর থাকে। রাস্তাঘাটে থাকে অবৈধ সন্তানদের ভিড়। এমন সমাজে থেকে আপনি কীভাবে দাবি করেন, আপনাদের সংযম আপনাদেরকে রুগ্ণ স্ত্রীর সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করতে দেয় না? অথচ পত্র-পত্রিকায় অহরহ খবর বেরুচ্ছে, যুবতী সুন্দরী সুস্থ স্ত্রী ঘরে থাকা সত্তে¡ও আপনাদের পুরুষরা অন্য নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলছে এবং তা নিয়ে হরহামেশা মামলা-মোকদ্দমা ও ঝগড়া ফ্যাসাদ হচ্ছে। এ সব কি মিথ্যা?’

এন্ডারসন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘আমি আপনাকে শুধু আমার নিজের কথা বলছি। আমি ধৈর্যধারণ ও আত্মসংযম করতে পারি।’ সিবাঈ বললেন, ‘বেশ ভালো কথা। আমি জানতে চাই, খ্রিষ্টীয় পাশ্চাত্যে আপনার মতো সংযমী শতকরা কতজন? অসংযমীদের হার শতকরা হিসেবে কত হবে?’ এন্ডারসন বললেন, ‘অস্বীকার করি না যে, সংযমীরা সংখ্যায় খুবই কম’। সিবাঈ প্রশ্ন করলেন, ‘তাহলে, হাতেগোনা কয়েকজন লোকের জন্য আইন প্রণীত হয়, না সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার জন্য? যে আইন নগণ্য সংখ্যক কয়েকজনই মানতে পারে, গরিষ্ঠরা মেনে চলতে পারে না, সে আইন দিয়ে সমাজ কী করবে?’ এন্ডারসন নিরুত্তর হয়ে গেলেন। আলাপের সমাপ্তিও ঘটল এখানেই।

সিবাঈর বক্তৃতাও ছিল অসাধারণ। তথ্য ও তত্তে¡র নিগূঢ় সমাহার এবং চিন্তা ও কর্মের সুস্পষ্ট বার্তা থাকত তার বক্তৃতায়। থাকত বিচার ও বিশ্লেষণ। তার বক্তৃতার মূল্যবান একটি সঙ্কলন ইসলাম ও নারী প্রসঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর আলোকসম্পাত করে। প্রাচ্যবাদী প্রপাগান্ডা ইসলামের নারীকে অপমানিত ও উপেক্ষিত একজন হিসেবে উপস্থাপন করে। বহুবিয়ে, তালাক, নারীর সামাজিক অধিকারসহ বহু বিষয়ে ইসলামকে আসামি বানাতে চায়। প্রতিটি দিক নিয়ে ড. সিবাঈ শক্তিশালী আলোকপাত করেন এবং প্রাচ্যবাদী ভাবধারার গলতি দেখিয়ে দেন।

এ প্রসঙ্গে লিখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মারয়াতু বাইনাল ফিকহি ওয়াল কানুন’ (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, আকরাম ফারুক অনূদিত, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা)। গ্রন্থটি রচিত হয় ১৯৬১-৬২ সালে দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে প্রদত্ত বক্তব্যকে ভিত্তি করে। সিবাঈর দুই ঘণ্টার বক্তব্যকে বিশ্ববিদ্যালয় সে বছরের সাংস্কৃতিক বক্তৃতামালা সিরিজের অন্তর্ভুক্ত করে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। সে উপলক্ষে সিবাঈ তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য অধিকতর যুক্তি ও প্রমাণাদি দিয়ে সজ্জিত করেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে বিস্তারিত ও স্পষ্ট করে লিখে দেন। তা যখন গ্রন্থরূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়, আরব দুনিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপেও তৈরি হয় এর প্রতি মনোযোগ।

সিবাঈর আলোচনা ছিল নারীর প্রতি না শত্রুতা ও না পক্ষপাতের জায়গা থেকে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন একটি চরিত্রবান ও অটুট নীতির অনুসারী মুসলিম সমাজে নারীর সঠিক স্থান ও ভ‚মিকা কী হবে! তিনি দেখান ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বিভিন্ন সভ্যতায় নারীর অবস্থান কেমন ছিল, গ্রিক, রোমান, হামুরাবি আইন, হিন্দু সংস্কৃতি ইহুদি ও খ্রিষ্টীয় সমাজ নারীকে অতীতে কীভাবে দেখে এসেছে! তিনি হাজির করেন নারী সম্পর্কে ইসলামের নীতিমালা। যেসব নীতি মনুষত্বের ক্ষেত্রে নারীর পরিপূর্ণ সাম্য, জন্মপাপ ও আদিপাপের সাথে তার সম্পর্কহীনতা ও পবিত্রতা, সদাচার ও নৈতিকতায় পুরুষের মতোই সমান পুরস্কার ও ন্যায়োচিত সম্মান, নারীশিক্ষায় ইসলামের উদ্দীপনা, মা-স্ত্রী, বোন ও মেয়ে হিসেবে তার অধিকার ইত্যাদিকে ন্যায্যতার সাথে নিশ্চিত করে। ইসলামে নারীর উত্তরাধিকার, পারিবারিক জীবন, বহুবিয়ে, তালাক, নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নে ১২টি মূলনীতি উপস্থাপন করেন সিবাঈ। তিনি দেখান এমন সব দিক, যাতে পুরুষ ও নারীতে ভিন্নতা রেখেছে ইসলাম। সিবাঈ এর ন্যায্যতার যুক্তিগুলো উপস্থাপন করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে মুসলিম নারীদের অবস্থা, পতনকালের চিত্র, নারী সমাজ উন্নয়নে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ বইটিকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। প্রাচ্যবাদী বয়ানের বিপরীতে সিবাঈ প্রবলভাবে লড়েন বহুবিয়ে ও নারীর সামাজিক অধিকার এবং অবস্থানের প্রশ্নে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার পশ্চিমা প্রবণতা যেসব বিপদ ডেকে আনছে, তার প্রতি সঙ্গত কারণেই ছিল সিবাঈয়ের দৃষ্টি। তার মূলকথা হলো- নারীকে আমাদের সমাজে যথার্থ সম্মান ও শক্তির জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তার আইনসম্মত অধিকার বহাল করতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবার, সমাজ ও সভ্যতায় তার সৃষ্টিশীল ও কল্যাণউৎপাদক যথাস্থান নিশ্চিত করতে হবে। দেখতে হবে, তার নারীত্ব যেন শোষণের শিকার হয়ে নিপীড়ন ও অবমাননার কবলে না পড়ে। তাকে ভোগের দৃষ্টিতে দেখা এবং পণ্যে পরিণত করা তার প্রতি অবমাননা উৎপাদন করে। যেখানে পুরুষ ও পরিবেশের চোখে নারী হয়ে ওঠে একদলা মাংস! পশ্চিমা সমাজে আজকাল নারীর যে শোচনীয় দুর্গতি হচ্ছে, যে দুর্গতি দেখে তাদের বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীন বিবেকের অধিকারী মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন, আমাদের নারীদের সেই পরিণতি থেকে সবার আগে রক্ষা করতে হবে। হ

লেখক : কবি, গবেষক
ইমেল: 71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement