২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সংস্কৃতির সাথে ধর্মের মেলবন্ধন

সংস্কৃতির সাথে ধর্মের মেলবন্ধন - ছবি সংগৃহীত

ধর্মের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক নিবিড় এবং ধর্ম ছাড়া কোনো সংস্কৃতিই পরিপূর্ণতা অর্জন করেনি। ধর্ম মানুষকে পরিশ্রুত করে, আদর্শবান বানায় এবং নিজের পার্থিব কর্মযজ্ঞের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহি করার মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে। একজন সত্যিকারের ধার্মিক ব্যক্তি তার আবেগ, কলুষ আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন এবং সর্বদা তার নিজের চিত্তকে ভালো, মাধুর্য ও মর্যাদার দিকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিমার্জিত আকারে তাদের কার্যকলাপের ওপর প্রভাব ফেলে। ধর্মীয় পরিবেশ সমাজের জন্য একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং জনগণকে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আদর্শের বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে।

সংস্কৃতি হলো মন ও আত্মার চাষ। ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মানুশীলন ছাড়া ভেতরে-বাইরে মাধুর্য ও আলো অর্জন করা যায় না। অতীন্দ্রিয় সত্তার প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং সৃষ্টির অসীমতার ধ্যানে মন ও আত্মার চাষ ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি তার নিজের তুচ্ছতা উপলব্ধি করে নম্র, মধুর ও আলোকিত হয়ে ওঠে, যা সংস্কৃতির অপরিহার্য পূর্বশর্ত। ধর্ম ছাড়া সংস্কৃতি তার অর্থ পূরণ করতে পারে না। পরকালের প্রতি বিশ্বাস ছাড়া বিশুদ্ধভাবে একটি ইহজাগতিক জীবনবোধ তার সঠিক চাষের জন্য মনকে জাগ্রত করতে পারে না। একমাত্র ধর্মই মনকে অসীম স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির সাথে সংযুক্ত করে। যে ব্যক্তি তার স্রষ্টা ও তার সামনে জবাবদিহি থেকে সরে যায় সে তার আত্মাকে গড়ে তুলতে পারে না। সে দৈহিক ও ইন্দ্রিয় সুখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই তার কাছে সংস্কৃতি হলো নিছক নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য, স্বেচ্ছাচারী সঙ্গীত এবং শারীরিক সৌন্দর্য প্রদর্শন। এ ধরনের নৃত্য ও দেহ প্রদর্শন দৈহিক আকাক্সক্ষাকে উত্তেজিত করে এবং জীবনের মাধুর্য বাদ দিয়ে দেয় এবং আত্মার আলো ম্লান করে দেয়। এ ধরনের অশ্লীলতা দ্বারা পশুত্ব চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আত্মা জীবনের মূল। মানুষকে সুন্দরতম আকারে সাজানো হয়েছে। মানব চরিত্রে ধর্মীয় বিশ্বাস নিহিত। তিনি প্রকৃতির দ্বারা অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিক্রিয়াপ্রবণ, তাই ধর্মীয় আদর্শের আনুগত্য ও ঐশ্বরিক আদেশ পালন করা শারীরিক অস্তিত্বের মতোই তার প্রকৃতির অংশ। সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুতি আধ্যাত্মিক বিপর্যয় এবং সেই সাথে এই জাগতিক জীবনে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত তাকে পরকালে অনন্ত শাস্তির দিকে ঠেলে দেয়।

একজন ব্যক্তিজীবনের মূল্যবোধ নির্মাণে একেশ্বরবাদী হতে পারে বা প্রকৃতিতে নাস্তিক হতে পারে। তাদের সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং জীবনের সাধনায় এটি প্রতিফলিত হয়। একজন ধার্মিক ব্যক্তির সামনে উচ্চ আদর্শ থাকে এবং তিনি তা অর্জন করেন তার অস্তিত্বের পরমানন্দ আর কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্তির মাধ্যমে। অন্য দিকে একজন নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী মানুষ হিসেবে তার জীবনকে অনুসরণ করে, তার কিন্তু কোনো আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব নেই। অন্য কথায় তিনি কর্মের জন্য অন্য কোনো সত্তার কাছে দায়বদ্ধতায় বিশ্বাস করেন না। যেমন তার পার্থিব জীবনের মধ্য দিয়ে জাগতিকতার একটি বায়ু প্রবাহিত হয়। তিনি তার অভ্যন্তরীণ ইচ্ছার মাধ্যমে জীবন ও অস্তিত্বের প্রতি এমন মনোভাব গড়ে তোলেন। যদি পরিস্থিতি ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক প্রকৃতির হয় তবে তার অস্তিত্বের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবেশ, বংশগতি, মূল্যবোধের প্রবর্তন এবং নতুন ধারণার আবির্ভাব তার জীবনে গভীর আলোড়ন তৈরি করে। এটি সংস্কৃতির আকারে নিজেকে প্রতিফলিত করে যেমন জীবনযাত্রার ধরন, ভাষা, রীতিনীতি, শিল্পকর্ম, আচার-অনুষ্ঠান এমনকি পোশাক ও সামাজিক যোগাযোগের মধ্যেও। অন্য দিকে একজন ধার্মিক মানুষ তার অভ্যন্তরীণ ইচ্ছা থেকে ধর্মীয় বিশ্বাসে আচ্ছন্ন হতে পারেন। তিনি ধর্মগ্রন্থ, হিতোপদেশ ও ধর্মীয় পরিবেশের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে আলোকিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও বংশগতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা তার জন্য একটি সম্পদ হয়ে দাঁড়ায় এবং তার সামাজিক, ধর্মীয় ও জাতিগত পটভূমি থেকে অর্জিত ঐতিহ্য অনুযায়ী তার গঠনকাঠামো তৈরি করে।

ধর্ম মানব প্রকৃতির অংশ। সংস্কৃতি ধর্মীয় সত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, যার এমন প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে যে, তিনি সমাজে অভিনব প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন এবং লোকেরা তার কর্মকে অনুসরণ করে। ধর্মের প্রতি অনুগত একজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে আলোর বাতিঘর। তিনি সত্য ও সুন্দরের উজ্জ্বল পথ দেখাতে পারেন। অবশ্যই তাকে তার অটল বিশ্বাস ও দৃঢ় সঙ্কল্পের মাধ্যমে অনেক কষ্ট ও মোহ অতিক্রম করতে হবে। তার জীবন প্রকৃতপক্ষে সব প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সমাজ যত জটিল হবে এই জাগতিক জগতে তার অবস্থান ততই কঠিন হয়ে উঠবে। ধর্মের আদি সৌন্দর্য ও জীবনের পবিত্রতা রক্ষার জন্য তাকে ‘ক্রুসেড’ চালাতে হবে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত জীবনের চিরন্তন বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য তাকে অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। জীবন তার জন্য একটি ‘লিটমাস টেস্ট’ হিসেবে কাজ করে। একজন প্রকৃত মুমিন বা ধার্মিক মানুষ শেষ পর্যন্ত ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে বিজয়ী হন। সত্যিকার অর্থে ধর্মীয়নীতিতে আবদ্ধ একজন ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে মর্যাদাবান যিনি তার পবিত্র অস্তিত্ব এবং জীবনের সম্ভাবনার জোরে অন্য লোকদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারেন। ধর্ম তার জীবনের একটি সারাংশ হিসেবে কাজ করে।

পরকালের প্রতি বিশ্বাস ও ঐশ্বরিক ব্যবস্থা মানুষের অস্তিত্বকে উন্নত করে এবং তার পার্থিব পরীক্ষা ও ক্লেশ সত্ত্বেও তাকে শান্তি ও প্রশান্তি দেয়। তিনি দুর্দশার মুখোমুখি হন এবং বহিরাগত দৃঢ়তার সাথে তা সহ্য করেন। একজন ধার্মিক মানুষ রতœতুল্য, যিনি সমাজের অন্যান্য মানুষকে উন্নত ও দামি বানান। সুতরাং ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনধারা এবং সমগ্র অস্তিত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একজন ধার্মিক ব্যক্তির একটি মহিমান্বিত চরিত্র ও একটি মহৎ উদ্দেশ্য থাকে। তার জীবন লক্ষ্যহীন নয় এবং এভাবে তিনি একটি অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করেন এবং পরমসত্তা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য তার জীবনকে পবিত্র করে তোলেন।

এ আলোচনার মাধ্যমে আমরা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, সংস্কৃতির আবির্ভাব ও বিকাশ মূলত ধর্মের ওপর নির্ভর করে। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আধুনিক চিন্তাবিদদের একজন, নোবেল বিজয়ী ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের চিন্তা-উদ্রেককারী এ কথায় এটা ফুটে উঠেছে, “Yet there is an aspect in which we can see a religion as the whole way of life of a people, from birth to the grave, from morning to night and even in sleep, and that way of life is also its culture” (T. S. Eliot, Notes towards the Definition of Culture, p.15. )
‘আমরা একটি ধর্মকে একটি মানুষের সমগ্র জীবনধারা হিসেবে দেখতে পারি, জন্ম থেকে কবর পর্যন্ত, সকাল থেকে রাত এমনকি ঘুমের মধ্যেও এবং সেই জীবনধারাটি তার সংস্কৃতি।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ধর্ম পার্থিব ও পরকাল উভয় জীবনকে পরিবেষ্টন করে। কিন্তু কোনো সমাজ যদি এখানকার জীবনকে অবহেলা করে এবং পরকালের মুক্তির জন্য নিজের শক্তিকে একচেটিয়াভাবে নিবেদন করে তা হলে তা এখানে জীবনের বাধ্যবাধকতা থেকে বিচ্যুত হয়। এর ফলে এটি বস্তুগত সাধনার সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়ে। দরিদ্রতা, সঙ্কীর্ণ পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক দুর্দশা তার অপরাপর সব ধরনের সমস্যার সাথে জীবনকে গ্রাস করে। অন্য দিকে যদি কোনো সমাজ পার্থিব জীবন নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ইহজাগতিক আনন্দে লিপ্ত হয় তবে সেই সমাজে ধীরে ধীরে কিন্তু অনিবার্যভাবে অবক্ষয় শুরু হয়। জীবন ইহকাল ও পরকালের সূক্ষ্ম ভারসাম্যের বিষয়। সামান্য ভারসাম্যহীনতার ফলে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।

সংস্কৃতি শব্দের অর্থে বিভিন্ন দেশ, সম্প্রদায়, মুশরিক, ত্রিত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও নাস্তিকদের জীবনধারাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইসলাম এই জীবনধারার কোনোটিই অনুমোদন করে না যেহেতু তাদের কেউই মন ও আত্মার চাষাবাদ ব্যতিরেকে সংস্কৃতি শব্দের মাধুর্য হিসেবে প্রকৃত অর্থ পূরণ করে না। বহু ঈশ্বরবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নাস্তিকতার ধারণা ও আদর্শের সাথে যুক্ত একটি মন ও আত্মা জীবনে প্রকৃত মাধুর্য ও আলোর জন্ম দেয় না। এটি শুধু কামুক লালসা ও বিকৃত শারীরিক আকাক্সক্ষা তৈরি করে, যা তাদের নৃত্যকলা, নাটক, কল্পকাহিনী, ক্রীড়া, কৌতুক, শিল্পকলা ও ভাস্কর্যে প্রকাশ পায়।

এসব থেকে আলাদা, ইসলাম মন ও আত্মার চাষাবাদকে সমর্থন করে এবং আল্লাহর একত্ববাদ ও হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নবুওয়তের সাথে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বজায় রাখে। এ সম্পর্কের দ্বারা ব্যক্তি ও সম্প্রদায় অস্থায়ী জীবনের আসল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে এবং এই উপলব্ধির দ্বারা ব্যক্তি ও সমাজ সব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও শয়তানি কর্মযজ্ঞকে বর্জন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ, পোশাক ও জীবনধারা ধর্মীয় আদর্শ ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু মুসলমানরা বাঙালি সংস্কৃতি ঢালাওভাবে গ্রহণ করলে আপত্তি উঠতে পারে; কারণ তা ইসলামী সর্বজনীনতা ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের পরিপন্থী।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, সংস্কৃতির ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষ্য হচ্ছে বৃহত্তরভাবে মানবতার বিকাশ এবং ঐশ্বরিক নির্দেশ থেকে উদ্ভূত উচ্চ আদর্শ দ্বারা পরিচালিত আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সর্বোচ্চ নীতি ও নৈতিক আইনের ভিত্তিতে মুসলমানদের সামাজিক জীবন এবং তাদের সংহতি দৃঢ়ভাবে গঠিত হয়। এটি সমৃদ্ধির সাথে সুখ নিশ্চিত করার জন্য, ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজের জন্য এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ইসলামী সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ভাষা বা শ্রেণীর অন্যান্য ভিত্তিকে স্বীকৃতি দেয় না। ইসলামী সমাজ স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক, যা ভৌগোলিক বাধা, জাতিগত অহঙ্কার ও বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব অতিক্রম করে যায়। মুসলমানদের সংস্কৃতি তাদের সমাজের সাথে অবিচ্ছেদ্য। এটি কুসংস্কার ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সমাজের সদস্যদের সক্ষম করে তোলে। পূর্ব বা পশ্চিম গোলার্ধ যাই হোক না কেন, মুসলমানরা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।

একজন মুমিন অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রথম পিতা হজরত আদম আ: ও প্রথম মাতা হজরত হাওয়া আ: দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সর্বজনীন পরিবারের সদস্য। এই অভিন্ন উৎসের আলোকে মানবজাতির ঐক্যের ধারণা করা হয়, যা মানুষকে তাদের সামাজিক আচরণে ঐক্যবদ্ধ করে। মানুষ সমাজের অনিবার্য ভিত্তি; তার বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণ ও সমাজের বিবর্তন সম্পূর্ণভাবে তার ওপর নির্ভর করে। মানুষের ধারণা ও আদর্শ, কর্ম ও সংস্কৃতি ছাড়া কোনো সমাজের অস্তিত্ব, বিকাশ ঘটে না কিংবা মার্জিত হতে পারে না। সমাজ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে এর প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন উপায়ে অস্তিত্ব লাভ করে। সমাজ ও সংস্কৃতির পুরো কাঠামো গঠন করে, এমন অনেক উপাদান রয়েছে। ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যা তার সাথে এবং তার আশপাশের পরিবেশের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য মানুষের সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক কথায় ইসলামে ধর্ম ও সমাজব্যবস্থার মধ্যে নিবিড় সমন্বয় রয়েছে। ধর্মভিত্তিক সমাজের একজন সদস্য তার সত্তা, ভাগ্য এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও তাওহিদ থেকে উদ্ভূত জীবন উপলব্ধি করে। আল্লাহর একত্ব, তাঁর সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর সৃষ্টির সাথে সরাসরি যোগাযোগ হলো সামাজিক সাম্যের ভিত্তি যার ওপর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত।

আল্লাহর পরম সন্তুষ্টি অর্জনই মানবজীবনের সাফল্য। তাঁর কাছ থেকে মানুষ আসে, তাঁর জন্যই তারা বেঁচে থাকে এবং তাঁর কাছেই তারা সবাই ফিরে আসে। ইসলামের সামাজিক জীবনে এটিই চূড়ান্ত লক্ষ্য। শান্তি স্থাপন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা করা এবং সমাজের সাধারণ কল্যাণে অবদান রাখায় ব্যক্তির ভূমিকা অগ্রগণ্য। এ দায়িত্বটি পারস্পরিক ও সমাজের জন্য পরিপূরক। ব্যক্তি শুধু সমাজের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে না, আল্লাহর কাছেও তার কর্ম ও দায়িত্বের জন্য নিজেকে সমর্পণ করে। সমাজ দ্বারা ব্যক্তিকে শোষণ করার বা ব্যক্তি দ্বারা সমাজকে কলুষিত করার সুযোগ নেই; কারণ কর্তব্য, অধিকার ও দায়িত্ব পারস্পরিকভাবে ন্যস্ত এবং এটি সম্প্রীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সামাজিক জীবনে ব্যক্তিকে ভালো ও ধার্মিকতার দাওয়াতি কর্মধারায় কার্যকর ভূমিকা পালন এবং বিদ্যমান আইনের অধীনে মন্দ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইসলামে। একজন মুসলমান তার সমাজের প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না; তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে; তাকে নৈতিকতার অধঃপতন, বিবেকের দংশন ও ঐশ্বরিক নির্দেশভিত্তিক বিশ্বাসের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। ইসলাম একটি যৌক্তিক ধর্ম, যার মধ্যে জীবনের সমগ্র ধারা রয়েছে। এটি ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ ও সিন্ডিকালিজমের বিকল্প হিসেবে একটি সম্পূর্ণ আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নির্দেশনা দেয়। ইসলামের সংস্কৃতি আল্লাহর সর্বজনীন সার্বভৌমত্ব এবং হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নবুওয়তের পরিপূর্ণতার সাথে একেবারে আবদ্ধ। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা সমাজসেবার ক্ষেত্রে সর্বদা ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান।
ইসলামে সংস্কৃতির লক্ষ্য কেবল বস্তুগত উপাদানের গৌরব এবং ইহজাগতিক পরিপূর্ণতা নয়, বরং মানবজীবনকে সার্থক, মর্যাদাপূর্ণ ও উন্নত করাই এর চূড়ান্ত লক্ষ্য। ইসলামের আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা আদর্শে উচ্চতর, গঠনে অনন্য ও কার্যকারিতায় সুনিপুণ। ইসলামে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের কাঠামো অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ ও দূরপ্রসারী।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement