২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

অশান্ত পৃথিবীর অধিকারহীন যত জনপদ

-

এ কোন পৃথিবীতে বাস করছি আমরা? চার দিকে শুধু নির্যাতন-নিপীড়ন, মানুষের অধিকার হরণ, বিচারহীনতা, মানবতার পদদলন আর অসহায় জাতিগোষ্ঠীকে জীবনের ন্যূনতম চাহিদা থেকে বঞ্চিত করার নোংরা খেলা। কত নজির দেবো? প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো জাতিসত্তা ফিলিস্তিনিরা। অথচ এ জাতির প্রতিটি সদস্যের জীবন এখন কাটছে চরম নিরাপত্তাহীনতা আর আগ্রাসনের মধ্যে। প্রতিনিয়ত তাদের কারো না কারো মাথার ওপরের ছাদখানি সরিয়ে ঠেলে দেয়া হচ্ছে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ খোলা আকাশের নিচে। সেই ৭৩ বছর আগে ১৯৪৮ সালে বিশ্ব পরাশক্তির মদদে এক অতর্কিত হামলায় ইহুদিরা প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি দখল করে নেয়। এক সাগর রক্তের বন্যা বইয়ে তারা আজো বেআইনি দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। চালাচ্ছে এক অসহনীয় নিপীড়নমূলক শাসনের স্টিম রোলার। মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পর্যন্ত সেখানে নেই, অথচ বিশ্ববিবেকের কোনো নজর নেই। হরহামেশা এমন জঘন্য ঘটনা পৃথিবীর এখানে-ওখানে ঘটেই চলেছে।

কাতালোনিয়াবাসীর দোষ কী? একটু স্বাধীনতা চেয়েছে, এই তো? গণভোট করে জানিয়ে দিয়েছিল, তারা স্বাধীন জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ব্যস, তাতেই হয়ে গেল। কথিত গণতান্ত্রিক স্পেনের কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাতালোনিয়ার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, স্পিকার, মন্ত্রী পরিষদ সদস্যসহ সব নেতাকে আটক করা হলো। কাতালোনিয়াবাসী যে বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদার স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছিল সেটুকুও কেড়ে নেয়া হলো। কেন? স্বাধীনতা চাওয়া কি অপরাধ? এর চেয়েও ছোট ভূখণ্ডের পূর্ব তিমুরকে কি ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা দেয়নি? দক্ষিণ সুদান কি সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায়নি?

ইরাকের অপরাধটা কী ছিল? সাদ্দাম হোসেনের অপশাসন? সেটি তার দেশের জনগণই তো দেখবে। বাইরের কেউ কেন? হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতায় সমৃদ্ধ জাতিটি ভালো হউক, খারাপ হোক, নিজেদের মতোই চলছিল। অথচ পারমাণবিক অস্ত্রমজুদ আছে অসমর্থিত এমন এক অজুহাতে ২০০১ সালে বিশ্বমোড়ল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ আর তার লেজুড়বৃত্তি করা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার নারকীয় এক তাণ্ডব চালিয়ে পুরো দেশটিকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেন। আধুনিক বিশ্বে স্বাধীন দেশের ভেতরে অন্য দেশের সেনাবাহিনী ঢুকে অবৈধ দখলদারিত্ব ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এটি কোন অধিকারে পড়ে? অথচ পরে প্রমাণিত হলো, যে অজুহাতে ইরাকে এ অভিযান চালানো হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ জন্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী দোষ স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছিলেন। কী হবে ক্ষমা প্রার্থনায়? ইরাকের যা ক্ষতি হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। সচ্ছল-সমৃদ্ধ জাতিটির যে ক্ষতি হয়েছে তা কি তারা ৫০০ বছরেও পূরণ করতে পারবে? কেউ এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না, দেবেও না। কী অযৌক্তিক দুনিয়ায় বসবাস করছি আমরা।

আট হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিসর। আমার স্মৃতিভাণ্ডার যদি প্রতারণা না করে থাকে তবে বলতে পারি এই আট হাজার বছরের ইতিহাসে মিসরে একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মদ মুরসি। ২০১২ সালে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এ অতিভদ্র-নম্র অর্থনীতির অধ্যাপক। নিয়তির কী বিধান। একটি বছরও ক্ষমতায় থাকতে পারলেন না তিনি। সেনাঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা কেড়ে নিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি। কারান্তরালে নিক্ষিপ্ত হলেন নির্বাচিত ড. মুরসি এবং তার ব্রাদারহুড দলের হাজার হাজার নেতা-সমর্থক। আর এ কারান্তরালেই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করলেন মুরসি। পৃথিবীতে নাকি একটি জাতিসঙ্ঘ আছে, আছে আরব লিগ, আর ওআইসি। কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তাই আজো এ অবৈধ সামরিকজান্তা মিসর শাসন করছে। যিনিই সিসির বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন তাকেই মামলা দিয়ে জেলে পুরে দিচ্ছেন, আর তিনি নাকি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন? কী অদ্ভুত গণতন্ত্রের নমুনা!

দেখুন না, বেচারা নাভালনি, তিনি নাকি রাশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধীদলীয় নেতা মানে ছায়ামন্ত্রী সভার প্রধান। অথচ রাশিয়ায় তিনি রীতিমতো এক অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। নির্বাচনে দাঁড়ালেই ‘অযোগ্য’ ঘোষিত হচ্ছেন। কারণ পুতিনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো যোগ্যতা তিনি রাখেন না। পুতিন সরকার তার সাথে যে আচরণ করে একটি সভ্য সমাজে সম্ভবত একজন ক্রিমিনালের সাথেও এমন আচরণ করা যায় না। যখন তখন জেলে, না হয় বাইরে থাকলে হয় বিষ প্রয়োগের বা পুলিশের লাঠির আঘাতের শিকার হচ্ছেন। এই মুহূর্তেও তিনি কারান্তরালে। শুধু কি তিনি? তার স্ত্রীও জেলে। অপরাধ? তিনি যে নাভালনির স্ত্রী! কী অবিচার, কী জঘন্য আচরণ! শুধু নাভালনি নন, পুতিন চেচনিয়ার মতো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশকে গায়ের জোরে সৈন্য ঢুকিয়ে দখল করে নিলেন। বছরের পর বছর ধরে দখলেই আছে অথচ কোনো প্রতিকার নেই। পৃথিবীতে নাকি জাতিসঙ্ঘ আছে, কেউ বিশ্বাস করবে?

মানুষ কত প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারে তার একেবারে সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো বেলারুশের জবরদখলকারী প্রেসিডেন্ট ডেভিড লুকাশেঙ্কা। প্রায় তিন দশক ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেও সাধ মেটেনি। গত নির্বাচনে পুরো জালিয়াতি করে ভোটের বাক্স ভরে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন। এর প্রতিবাদে দেশ শুদ্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে এলেও তার লাজ-শরম নেই। জোর করে ক্ষমতা আঁকড়েই আছেন। মানুষের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছেন। তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিরোধী নেতাসহ হাজার হাজার নাগরিক নির্যাতন এড়াতে বিদেশে নির্বাসনে। এর মধ্যে একজন ২৬ বছর বয়সী তরুণ সাংবাদিক রোমানও তার সমালোচনা করে চিহ্নিত হয়ে পালিয়ে ইটালিতে নির্বাসনে ছিলেন। কী প্রয়োজনে যেন তিনি লাটভিয়া যাচ্ছিলেন বিমানে। খবর ছিল লুকাশেঙ্কার কাছে। বিমানটি বেলারুশের আকাশসীমা অতিক্রম করার সময় তাতে বোমা আছে এমন এক মিথ্যা বানোয়াট অজুহাত তুলে যুদ্ধ বিমান পাঠিয়ে এটিকে বেলারুশের মাটিতে নামিয়ে আনলেন। রোমানকে আটক করা হলো। কী অপরাধ রোমানের? কিছুই না, তিনি শুধু লুকাশেঙ্কার কর্তৃত্ববাদের, মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সমালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। এতেই হয়ে গেল। কী জঘন্য প্রতিহিংসাপরায়ণতা; কল্পনা করা যায়? এ হলো আমাদের বসবাসের পৃথিবী।

নজিরের শেষ নেই। পৃথিবীর এমন আর একটি দীর্ঘ নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী হলো চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের ‘উইঘুর’। গণমাধ্যমের বদান্যতায় এ নামটি আজ সারা পৃথিবীর ঘরে ঘরে পরিচিত। এ ছাড়া তাদের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আমেরিকা প্রবাসী রাবিয়া কাদেরীর প্রচারণাও বিশ্বব্যাপী জাতিগোষ্ঠীটিকে বেশ পরিচিত করে তুলেছে।

চীনের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশের সমৃদ্ধ এ অঞ্চলে স্থানীয় হান জাতি ও তুরস্ক-শ্যাম-উজবেকিস্তানসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা প্রত্যাবাসিত জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে এ উইঘুর সম্প্রদায়। তাদের উন্মেষ ঘটে ইসলামের প্রায় সমসাময়িক সময়ে। ইসলাম ধর্মের একেবারে সূচনালগ্নে মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের অমানুষিক অত্যাচারের সময় রাসূলে করিম সা: হজরত উসমানের রা: নেতৃত্বে প্রায় সাড়ে তিন শ’ মুসলমানকে আবিসিনিয়ায় (ইথিওপিয়া) রাজনৈতিক আশ্রয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকেই একদল মুসলমানকে সাথে নিয়ে রসূল সা:-এর এক মামা হজরত সাদ ইবনে আবু আক্কাস ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য নৌপথে বেরিয়ে পড়েন। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি কলম্বো, ভারতের কেরালা হয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে প্রবেশ এবং চীনের ক্যান্টন বন্দরে নোঙর করেন। দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করে তিনি জিনজিয়াং প্রদেশের তথা বর্তমান উইঘুর অঞ্চলের বিরাট জনগোষ্ঠীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। অঞ্চলটিতে প্রচুর মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণসহ তাদের আচার-আচরণ-সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহমুখী করে তোলেন। হজরত আবু আক্কাস রা: জীবনের শেষ দিনগুলো চীনে কাটিয়ে সেখানেই সমাহিত হন। তারই প্রভাবে উইঘুরের মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চেতনাবোধ অত্যন্ত দৃঢ় হয়। বিভিন্ন সময়ে তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে চীনা কিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে এমনকি, ১০০ বছর পর্যন্ত স্বাধীনভাবে নিজেদের দেশ শাসন করেন। কিন্তু ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনা। তাদের সব ধর্ম কর্মের ওপর আরোপিত হয় কঠোর বিধিনিষেধ। বহু মসজিদ হয় ভেঙে দেয়া হয়েছে নয়তো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাথায় টুপি দেয়া, হিজাব পরা, নামাজ আদায়, রোজা রাখা এ সবই নাকি সন্ত্রাসবাদিতা! মুসলিম নাম রাখা পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়। তাই এসব মানুষের দুটি করে নাম - সরকারি নথিতে একটি চীনা নাম এবং ঘরে নিজেদের মুসলিম নাম। নামাজ নিষিদ্ধ থাকায় এবং মসজিদ বন্ধ থাকায় কোনো কোনো এলাকায় মুসলমানেরা রোজার সময় এলাকাভিত্তিক কয়েকটি করে পরিবার একটি বাড়িতে একত্র হয়ে তারাবির জামাতের ব্যবস্থা করে। এসব খবর পেয়ে সে অঞ্চলের স্থানীয় প্রশাসন মুসলমানদের ওপর নজরদারির জন্য বিভিন্ন এলাকায় পাঁচজন করে লাল ফৌজের সদস্যকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোতায়েন করে। শুধু তা-ই নয়, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় স্থানীয় মুসলিম পরিবারদের। অত্যন্ত শক্ত ঈমানের অধিকারী এসব মুসলমানকে এতসব করেও দমানো যায় না দেখে কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষ এক নজিরবিহীন ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করে।

জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, এসব ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য দশ লাখ মতান্তরে বিশ লাখ উইঘুর মুসলিমকে concentration camp-এ বন্দী করে রাখা হয়। এভাবে ইবাদত বন্দেগি থেকে যেমনি দূরে রাখা হয় তেমনি চরম নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের সার্বক্ষণিক কমিউনিজমের নীতি ও বিধি বিধান সম্বলিত লাল বইগুলো পড়তে বাধ্য করা হয়। মুসলিম জনসংখ্যা যাতে বৃদ্ধি না পায় এ জন্য এসব ক্যাম্পে স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা রাখা হয়। এতসবের পরেও অনেক বন্দী উইঘুর মুসলমানকে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি খামার ও কলকারখানায় বাধ্যতামূলক কাজে নিয়োগের জন্য স্থানান্তর করা হয়। আর অন্যান্য অঞ্চল থেকে অমুসলিম চীনাদের উইঘুরে এনে পুনর্বাসন করা হয়। ফল দাঁড়িয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলে এক সময়ে যেখানে অমুসলিম ছিল শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম, তা এখন বেড়ে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। শুধু ধর্ম পালনের অপরাধে কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর এমন দুঃসহ নির্যাতন পৃথিবীর আর কোনো দেশে কোনো যুগে হয়েছে কিনা জানা নেই। কেন? কেউ যদি আগুন, পানি, বায়ু বা সূর্য অথবা এমনকি বিষধর প্রাণী বা হিংস্র পশুর উপাসনা করতে পারে, তাহলে মুসলমান নামে এ প্রাণীগুলো কেন মহান স্রষ্টার, নিরাকার মহাশক্তির রাব্বুল আলামিন-এর ইবাদত করতে পারবে না? অবাক ব্যাপার হলো, এমন অমানবিক নির্যাতনের পরও এর বিরুদ্ধে কোনো মহল থেকেই কোনো জোরালো প্রতিবাদ নেই। এমন কি মুসলিম বিশ^ পর্যন্ত নির্বিকার। কারণ একটিই- তা হলো চীনের আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কী অদ্ভুত! যাদের আত্মসম্মানবোধ নেই, বিধাতার ক্ষমতার প্রতি আস্থা নেই এবং সামান্য অর্থ লোভে এমন জঘন্য অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের ব্যাপারে কিছু না বলাই ভালো; শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস।

শেষ করব ইতিহাসে মানুষের অধিকার হরণের নিকৃষ্টতম ও ঘৃণ্য উদাহরণ দিয়ে। সেটি হলো কাশ্মির-বিধাতার অমোঘ সৃষ্টি; দৃষ্টি-নন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। তার চেয়েও চমৎকার অপরূপ এ অঞ্চলের সুন্দর মুখের মানুষগুলো। কী হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল জীবন কাটাচ্ছিলেন তারা ১৯৪৭ সালের আগে। এখানকার অপরূপ মোহনীয় রমণীদের পায়ের নূপুরের শব্দ আর উচ্ছল হাসির সুমধুর ধ্বনি যেন বয়ে যাওয়া ঝর্ণাগুলোর কলতানের সাথে এক হয়ে অনুরণিত হতো। অথচ আজ এসব হারিয়ে গেছে। নেই কোনো মুখরতা, নেই মন কাড়া হাসির উচ্ছলতা। আজ পুরো উপত্যকাজুড়ে শুধু বুটের আওয়াজ, বারুদের গন্ধ আর বিষাদময় গোঙানির শব্দ। কেন এমন হলো? এমন তো কথা ছিল না! কথা ছিল, ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পুরো উপমহাদেশের বাকি সব রাজ্য-ভূখণ্ড নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে। হয় স্বাধীন থাকবে, নয়তো জনগণ ইচ্ছা করলে ভারত বা পাকিস্তানের সাথে একীভূত হতে পারবে। তাহলে শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মির রাজ্যটির জনগণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করলেও কেন হিন্দু ডোগরা রাজা জনগণের ইচ্ছাকে ভূলুণ্ঠিত করে ভারতের সাথে একীভূত হওয়ার ঘোষণা দিলেন? আর এ ঘোষণার সাথে সাথেই ১৯৪৭ সনের আগস্টে ভারতীয় বাহিনীর সাথে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। আর সে সঙ্ঘাত আজো চলছে ৭৫ বছর ধরে-হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ সংহার আর রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে। কেন? ১৯৪৮ সালেইতো জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব গ্রহণ করল, গণভোটের মাধ্যমেই কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। সেটি ভারতও মেনে নিলো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু কাশ্মিরের প্রকাশ্য জনসভাগুলোতে ঘোষণা দিলেন, গণভোটের মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত হবে। এমনকি এক মাসের মধ্যে গণভোট আয়োজনের প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতিও ঘোষণা করলেন তিনি। কিন্তু, না, সময় গড়ায়, মাস যায়, বছরও শেষ হয়। গণভোট আয়োজনের কোনো লক্ষণই নেই। আস্তে আস্তে দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। নতুন মোড়কে ট্যাবলেটের পরিবর্তে খোলসে ঢুকিয়ে ক্যাপসুল দেয়া হলো। হঠাৎ কাশ্মিরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ সংযোজিত হলো।

বলা হলো, কাশ্মির তো প্রায় স্বাধীনই। এখানে নির্বাচিত সরকার প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী, অন্য রাজ্যের মতো মুখ্যমন্ত্রী নন। নিজেদের শাসন নিজেরাই করবে, শুধু পররাষ্ট্র আর অর্থ-বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটু ভারত সরকার দেখাশোনা করবে-তাও সাময়িকভাবে। কী চমৎকার ‘ললিপপ’। কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল এ সবই আসলে কৌশল। জনগণ ফুঁসে উঠল, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুরু করল। শত-সহস্র প্রাণের বিনিময়ে সেটি আজো চলছে। ভাগ্যে জুটছে বিশেষ মর্যাদা নয়, বক্ষবিদীর্ণ করা গুলি আর কণ্ঠরোধ করা ফাঁস। তারপর অবশেষে বেরিয়ে এল থলের বিড়াল নয়, একেবারে খাঁচা ভেঙে হিংস্র বাঘ। কাশ্মিরি জনগণকে ৭৫ বছর আগে দেয়া সেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ নামক কাগুজে মর্যাদাটুকুও ভারত সরকার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। কিসের মর্যাদা, এরা তো ‘সন্ত্রাসী’। ৭৫ বছর আগেই এরা সীমান্তের ওপার থেকে এসে এখানে শান্তি নষ্ট করছে। সুতরাং সব নির্মূল কর। কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। ঘরে থেকেও এরা সন্ত্রাস করতে পারে। তাই এদের যাবতীয় ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ। শুধু কি তাই? একসময়ে যারা কাগুজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সেই ফারুক আব্দুল্লাহ, মেহবুবা মুফতি সবাই উঁচু দেয়ালের লাল ঘরে বন্দী। এত নিপীড়ন-নির্যাতনের পরও কাশ্মিরি জনগণের একটিই চাওয়া। সেই ১৯৪৮ সালের জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবের বাস্তবায়ন, তাদের লালিত স্বপ্নের স্বাধীনতা। এর চেয়ে এতটুকুও কম নয়, আবার একটু বেশিও প্রয়োজন নেই।

অধিকার হরণ আর মানুষের কণ্ঠরোধের এমন বহু নজির পৃথিবীর দেশে দেশে নানা জনপদে। এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোতে হয়তো একটু বেশি। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইয়েমেন, লিবিয়া, সিরিয়া, লেবানন, ইথিওপিয়া, সুদান-কোথায় নেই বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা আর মানুষের অধিকার হরণের হোলিখেলা! মানুষ যাবে কোথায়? এসব দেখে বলতে ইচ্ছে করে, হে মানুষ, একটু কি থমকে দাঁড়াবে? ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখবে তোমরা যে, মানুষের অধিকার নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করছ তোমার অধিকারের দৌড় কতদূর? যে পৃথিবী নিয়ে এত ছেঁড়াছেঁড়ি করছ, সে পৃথিবীর মালিকানা কি তোমাদের? এর স্থায়িত্ব কতটুকু? এ পৃথিবীতে তোমার আগে অনেকের মতো মহাপরাক্রমশালী নমরুদ-ফেরাউনরাও অল্প ক’দিনে অনেক রঙ্গ-তামাশা করেছিল। মোহ কাটার আগেই দেখল, সব তামাশার শেষ ঠিকানা ঘোর অমানিশা। সুতরাং সাবধান। হে ‘সাধু’ সাবধান।

লেখক : প্রফেসর, রসায়ন এবং প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড


আরো সংবাদ



premium cement