২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজনীতির ঊর্ধ্বে মানবিকতা

-

‘ডিম আগে না মুরগি আগে’- এটি একটি বিতর্কের বিষয় হতে পারে, কিন্তু রাজনীতি আগে না মানবিকতা আগে- এটি নিয়ে বিতর্ক চলে না। তার কারণ ‘মানুষ মানুষের জন্য’। রাজনীতি প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ যাই হোক না কেন, সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানুষ। মানুষের ভালো ও মন্দ দু’টিই করতে পারে মানুষ। যারা সমাজে অপরাধী তারা মানুষের অকল্যাণ-খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি করে বেড়ায়। যারা ভালো মানুষ, তারা মানুষের কল্যাণ করে বেড়ায়। এর মধ্যে রাজনীতিবিদরা দাবি করেন- মানবকল্যাণের সব দায়দায়িত্ব তাদের। এক কথায়, মানবিকতার সোল এজেন্সি বা একচেটিয়া ব্যবসায় তারাই নিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ দেখে অবশেষে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, ‘রাজনীতি হচ্ছে বদমায়েশদের শেষ আশ্রয়স্থল’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার চরম অসুস্থতা নিয়ে মানবিকতা বনাম রাজনীতির বিতর্ক বেশ সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রাসঙ্গিক বক্তব্যেও মানবিকতা ও অমানবিকতার বিষয়টি নিয়ে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার পরিবার, দল ও ব্যক্তিগতভাবে তার প্রতি বেগম খালেদা জিয়া তথা বিএনপি ও তার পূর্বসূরিদের সমালোচনা করে বলেন, ‘আপনাকে যদি কেউ হত্যার চেষ্টা করত, আপনি কি তাকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেন? আপনার পরিবারকে যদি কেউ হত্যা করত, আর সেই হত্যাকারীকে যদি কেউ বিচার না করে পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিত, তাদের আপনি কী করতেন?’ খালেদা জিয়ার জন্য এত দয়া দেখাতে বলার জন্য লজ্জা হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বাপ-মা, আমার ছোটভাই রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করিয়েছে। তারপরও আমরা অমানুষ না। অমানুষ না দেখেই তাকে আমরা অন্তত তার বাসায় থাকার, চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় যথার্থভাবেই মানবিকতার বিষয়টি এসেছে। বস্তুত মানবিকতা যে রাজনীতির ঊর্ধ্বে তা জননেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে।

রাজনীতি এবং মানবিকতার বিষয়টি কেতাবি ভাষায় আলোচনা করা যাক। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব পলিটিকস অনুযায়ী ‘রাজনীতি হচ্ছে শাসনব্যবস্থা করায়ত্ত করতে একটি শিল্পকলা অথবা বিজ্ঞান।’ সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনীতির প্রাধান্য মেনে নিলেও এর সামাজিক দিককে অস্বীকার করছেন না। তারা জোর দিয়ে বলছেন, এই রাজনীতি ও সমাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে মানবিকতা। তাদের ভাষায় এখানে ব্যক্তি বা মানুষ এককটি গুরুত্বপূর্ণ। তারা উদাহরণ দিয়ে বলছেন, স্বামী-স্ত্রী, পরিবার ও গ্রাম বা শহরে সব কর্মকাণ্ড আবর্তিত-বিবর্তিত হয় মানবিকতা দিয়ে। তারা মনে করেন, মানবিকতা অর্জনে বা মানবিক লক্ষ্যে পৌঁছতে রাজনীতি একটি বাহন মাত্র। আবার এটি শুধু শাসনব্যবস্থাকেন্দ্রিক। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বীতার ফলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে বটে, তবে নীতিগতভাবে মানবিকতা বিসর্জিত হয় না কখনো। বার্নার্ড ক্রিকস তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইন ডিফেন্স অব পলিটিকসে’ দেখান যে, রাজনৈতিক কার্যক্রম সময় ও সুযোগে সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানবিকতা কোনো সীমারেখা দিয়ে আবদ্ধ নয়। তিনি আরো স্পষ্ট করেন, মানুষের জীবনের এমন সব বিষয় আছে যেমন- পরিবার, ক্রীড়া, শিক্ষা এসব ক্ষেত্রে রাজনীতির কিছু করণীয় নেই। আজকাল সব কিছুকে রাজনীতি দিয়ে পরিমাপের যে প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় তাকে তিনি কৃত্রিম এবং অস্থায়ী বলে বর্ণনা করেন। সরকারি কার্যক্রমকে শিল্পকলা অথবা বিজ্ঞান বলার সাথে সাথে তিনি এ কথাও বলেন যে, এসব বিষয়ও রাজনীতির সীমারেখা ও আওতা নির্দেশ করা সুকঠিন। ক্র্যাকস দুটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেন। মানুষ ব্যতীত সৃষ্টির কোনো ক্ষেত্রে কি রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে? তার দ্বিতীয় প্রশ্ন, মানবিকতা ছাড়া কখনো কোথাও রাজনীতি সম্ভব হয়েছে কি? তিনি বলেন, আদিম সমাজে প্রচলিত অর্থের রাজনীতি উপস্থিত ছিল না। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় বা রাজনৈতিক কার্যক্রমে মানুষ বা মানবিকতার অনুশীলন, অনুকরণ এবং আত্তীকরণ চলছে। তার ভাষায় রাজনীতি তখনই ঘটে, যখন মানুষ সম্পদের যথোচিত বণ্টন থেকে বঞ্চিত হয়। তিনি আরো বলেন, বিরোধ যেখানে রাজনীতি সেখানে। অথচ হবস, লক, রুশো বর্ণিত সেই প্রকৃতির রাজ্যে এসব জটিলতা ছিল না। সেই সমাজব্যবস্থায় এবং আজকের সমাজব্যবস্থায় একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ব্যক্তি যখন বিবেকশূন্য হয়ে পড়ে বা মানবিকতা বিসর্জিত হয়, তখনই রাজনীতির ঘনঘটা অনুভ‚ত হয়। বলা বাহুল্য এই যে, রাজনৈতিক প্রাধান্যের কোনো বাছ-বিচার নেই।

মানবিকতা বলতে আমরা কী বুঝি? যেকোনো দর্শন বা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের কল্যাণার্থে যা কিছু করা হয়, তাই মানবিকতা বলে গণ্য করা যায়। মনে করা হয়, মানুষ নির্বিশেষে সবাই যৌক্তিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। বিভিন্ন রকমের পার্থক্য থাকার পরও তারা সমান সুযোগ-সুবিধার দাবিদার। বিষয়টি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নৃ-পার্থক্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদ উতরিয়ে সামগ্রিক ন্যায্যতার দাবি রাখে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে রেডিক্যালপন্থী সমালোচক জ্যাঁ পল সাত্রে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে নামেন। তার তাৎক্ষণিক ক্ষোভ ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদী, কঠোর গোষ্ঠীতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে মানবিকতাকে মানুষের আদি এবং অকৃত্রিম ইতিহাসের সাথে সমান করে দেখেন ফুকো। অপর ভাষায় মানুষ হিসেবে জন্মলাভের পর সে যে মৌলিক অধিকারগুলো অর্জন করে তার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। এসব অধিকার হরণের যেকোনো প্রয়াস বা বিধি-ব্যবস্থাকে তিনি রাজনীতির কলাকৌশল বলে বর্ণনা করেন। সাম্প্রতিককালে ‘মানবিক রাজনীতি’র যথেষ্ট অবক্ষয় ঘটেছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন।

এ ক্ষেত্রে ২০১১ সালে সেইজ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে মার্কওয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রায়ান পেট্রিক হেনলি সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড হিউমের ‘পলিটিকস অব হিউমিনিটি’ বিষয়ের পুনর্মূল্যায়ন করেন। তিনি তার বিশ্লেষণে আধুনিক রাজনীতিতে ডেভিড হিউমের মানবিকতার ভিত্তিমূল খোঁজার চেষ্টা করেন। প্রথমত, তিনি ডেভিড হিউমের মানবিক রাজনীতির ব্যবহারিক এবং নন্দনতাত্তি¡ক বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তিনি প্রমাণ করে দেখান, মানবিকতাই হচ্ছে মানুষের নৈতিক ভিত্তির উৎস। মানবিকতার ওপর নির্ভর করেই যেকোনো সমাজব্যবস্থা বা প্রথা-পদ্ধতির বিকাশ ঘটে।

দ্বিতীয়ত, তিনি হিউমের মানবিক সংজ্ঞার সাথে সহজাত সহানুভ‚তি এবং কল্যাণ ধারণাকে সম্পৃক্ত করেন। রাজনীতি, মানবিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও নৈতিকতাকে তিনি সমান্তরালে স্থাপন করেন। তিনি মনে করেন, এসব প্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের মানবিকতার স্বীকৃতি অর্জিত হচ্ছে। রায়ান হেনলি অবশ্য চলমান সমাজের পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে স্বীকার করেন। রাজনীতি যে মানবিকতাবিবর্জিত হচ্ছে আবার মানবিকতা দিয়ে রাজনীতির নতুন যে ধারণা উপস্থাপিত হচ্ছে, তাও তিনি স্বীকার করেন। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, ‘রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে মানবিক রাজনীতিতে মানবজাতির উত্থান ঘটবে’। বিশ্বব্যাপী মানবিক রাজনীতির উত্থানে আরো চিন্তা ও গবেষণা লক্ষ করা যাচ্ছে। এরকম আরেকটি গবেষণা নিবন্ধ হচ্ছে- ‘পলিটিকস, হিউমিনিটি, পাওয়ার অ্যান্ড জাস্টিস’। এখানে বুদ্ধিজীবী এবং সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বব্যাপী স্থান, কাল, পাত্রভেদে মানবিক রাজনীতির বিভিন্নতা এবং বিচ্ছিন্নতা লক্ষ করা গেলেও মোটাদাগে মানবিকতাই পৃথিবীব্যাপী অর্জন করছে সফলতা। ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের লভ্যতা, স্থায়িত্ব এবং মৌলিক চাহিদা বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা চলছে সর্বত্র। এসব মৌলিক চাহিদা হচ্ছে- খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি এবং বসবাসের পরিবেশ। এসব চেষ্টার মাধ্যমে রাজনৈতিক অধিকারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা এবং প্রবৃদ্ধির জন্য কাজ এগিয়ে চলেছে। সঙ্গতভাবেই মানবিক রাজনীতি মানবিক ন্যায়বিচারের দাবি রাখে। যেখানে পৃথিবীর সব মানুষ সমানভাবে সম্মান, সমতা, স্বাধীনতা ও স¤প্রীতি নিয়ে বসবাস করতে পারবে। মানবজাতির বিভেদ নিরসনে আলোচনা, সংলাপ ও সম্মেলন প্রয়োজনীয়। কখনো কখনো ত্যক্ত-বিরক্ত নাগরিকরা বলেন, ‘রাজনীতির বাইরে থাকুন’। আসলে পানিতে যেমন মাছ থাকে; তেমনি মানুষ থাকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। মানুষের উপার্জন, যাপিত জীবন ও অবকাশ-অবসর যদি রাজনীতি হয়, তাহলে সমগ্র জীবনই রাজনীতিসর্বস্ব। হয়তো বা এ জন্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল মানুষকে ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এ কথা তো সত্য যে, রাজনীতির অনেক আগেই মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। অন্যের মঙ্গল সাধন, সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিতকরণ ও অন্যায় ব্যবস্থা উচ্ছেদই মানবিক রাজনীতির লক্ষ্য। একজন মানুষ রাজনৈতিক দলের সদস্য নাও হতে পারেন। কিন্তু তিনি সমাজে বসবাস করেন, জীবন ধারণ করেন এবং শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত থাকেন।

রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার বাইরেও অনেক মানুষ আছেন, যারা সমাজের প্রতি তাদের দায় অনুভব করেন। প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়ান। তারা রাজনীতিবিদ নন। তারা মানবিক। অবশ্যই মানবিকতাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। জনগণের বা ব্যক্তির অধিকারের বিনিময়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হতে দেয়া যায় না। সম্ভবত এটাই তা যা সক্রেটিস বলে গেছেন- ‘জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই পুণ্য’। মানুষ এবং মানবিকতা ছাড়া জ্ঞান বা পুণ্য কোনোটিই অর্জিত হতে পারে না।
এসব আলোচনা ও বিদ্বান ব্যক্তিদের বিশ্লেষণ থেকে আশা করি, রাজনীতি ও মানবিকতার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। আর এরই ভিত্তিতে মীমাংসিত হওয়া উচিত- বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সরকার মানবিক ব্যবহার করবে অথবা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেবে। সব রাজনৈতিক স্বার্থপরতা ও ভেদ-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবিকতা তা ফের ধ্বনিত হয়েছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথায়। তিনি আবেগের সাথে বিবেকের কথা বলেছেন- ‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়টি বিবেচনা করুন’।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement