২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণমুখী প্রশাসন বনাম প্রশাসনমুখী জনগণ

-

ল্যাটিন শব্দ Ad+Ministrate থেকে Administration শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ ‘প্রশাসন’। সাধারণ অর্থে ‘প্রশাসন’ সরকারি কর্মচারীদের এমন একটি সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্ঠী যা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগকৃত, যাদের দায়িত্ব জনস্বার্থমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত থাকা। Administrator-এর শব্দার্থ হচ্ছে ‘ব্যবস্থাপনা’, পরিচালনা ও সেবা প্রদান।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১(২)-তে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। অথচ জনগণ কি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে? জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে তারতম্য এই যে, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে প্রজাতন্ত্রে নিযুক্ত ব্যক্তিরা বেতনভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। অন্য দিকে জনগণ প্রশাসন দ্বারা শাসিত হচ্ছে। সাংবিধানিক অর্থে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক এবং প্রশাসন জনগণের বেতনভুক কর্মচারী। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোই প্রশাসনের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন কি ঘটানো হচ্ছে? বাংলাদেশের পূর্বাপর ইতিহাস অনেক কণ্টকময়। এ দেশের জনগণের সাথে ১৯০৫, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৮০ প্রভৃতি সালসহ অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক ঘটনা অঘটনের পরও জনগণের ভাগ্যের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয়নি, বরং কোথাও কোথাও জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাজা, রাজত্ব, সাম্রাজ্য, রাষ্ট্র প্রভৃতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রশাসনের সৃষ্টি। কারণ শাসকগোষ্ঠী জনগণকে শায়েস্তা ও আজ্ঞাবহ রাখার জন্য প্রশাসন নামান্তরে লাঠিয়াল বাহিনী বা রাজকর্মচারীদের ব্যবহার করত। রাজত্ব চলত জনগণ থেকে আদায়কৃত খাজনা থেকে। ‘খাজনা’ই ছিল রাষ্ট্রের বা রাজত্বের বা সাম্রাজ্যের আয়ের একমাত্র উৎস যা প্রকারান্তরে হালে ট্যাক্স বা ‘কর’ নামে রূপান্তরিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক প্রতি জেলায় রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। প্রকৃতপক্ষে জেলা প্রশাসকের আদি পদবি ‘কালেক্টর’। ‘কালেক্টর’ বাংলার শব্দার্থ হচ্ছে ‘সংগ্রহকারী ব্যক্তি’ বা ‘সংগ্রাহক’। জেলা প্রশাসকদের মূল কাজ ছিল এবং বর্তমানেও হচ্ছে ভ‚মিকর বা খাজনা আদায়। পরবর্তীতে প্রশাসনিক দফতর, অধিদফতর, পরিদফতর, করপোরেশনের সৃষ্টি করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য। রাষ্ট্রীয় কার্যে নিয়োজিতদের বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন পদে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রকারান্তে তারা আমলা, কামলা, গোমস্তা প্রভৃতি নামকরণেও ভ‚ষিত হয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়দের শাসন-শোষণের মাধ্যমে রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রশাসনিক অবকাঠামো সৃষ্টি করা হয়, যা এখনো সেই আদলেই চলছে। জনতার চাহিদার প্রয়োজনে দেশ দু’বার দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু আমলাতন্ত্রের মানসিকতা ও ধরন পরিবর্তন হয়নি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদ শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু করে। ২ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নতুন শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর করেন, যা ২৩ মার্চ বলবৎ হয়ে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন হয়ে ‘পূর্ব বাংলা’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখার হয়। অতঃপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।

মুখভরা বুলি নিয়ে বলা হয়, জনগণের কল্যাণের জন্য প্রশাসন যা অ্যাডমিনিস্ট্র্রেটিভ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। এ ক্যাডার বাহিনী ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে মাথায় রেখে পাক-ভারত উপমহাদেশকে কিভাবে শাসন-শোষণ করা যায় সে আদলে ও মানসিকতায় শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে। ব্রিটিশ আমাদের শাসন-শোষণ করত তাদের প্রশাসনিক ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এবং এ বাহিনীই সেবার পরিবর্তে ঘুষ প্রথা ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে চালু করেছে, যা পরবর্তীতে আবশ্যক রেওয়াজে পরিণত হয়। আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা বইতে (পৃষ্ঠা-২৯) লেখক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান লিখেছেন, ‘উৎকোচ নামক দুর্নীতি এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে আমদানি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছরে ৬০ লাখ পাউন্ড আত্মসাৎ করেছিল (সূত্র : Fourth Parliamentay Report 1773, Page-535, সুপ্রকাশ রায় প্রণীত ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ থেকে সংগৃহীত)।

বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনে ইংরেজরা একা ছিল না। তাদের পাশে ছিল তাদের এদেশীয় দালাল, গোমস্তা ও বেনিয়াগোষ্ঠী তথা প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত এ উপমহাদেশের সন্তানরা। তাদের শোষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে ব্রিটিশ কট্টর সাম্রাজ্যবাদী লর্ড মেকলে স্বয়ং মন্তব্য করেছেন, ‘কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের প্রভু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, নিজেদের জন্য প্রায় সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশী লোকদেরকে তারা অত্যন্ত কম দামে উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি করতে এবং অন্য দিকে খুবই চড়া দামে বিলাতি পণ্য কিনতে বাধ্য করত। কোম্পানি তাদের অধীনে একদল দেশী কর্মচারী নিয়োগ করত। এই দেশীয় কর্মচারীরা যে এলাকায় যেত, সে এলাকায় ছারখার করে দিত। সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করত। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার উচ্চপদস্থ (ইংরেজ) মনিবের শক্তিতে বলীয়ান। আর এই মনিবদের প্রত্যেকের শক্তির উৎস ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। (তাদের ব্যাপক লুণ্ঠন ও শোষণের ফলে) শিগগিরই কলকাতায় বিপুল ধনসম্পদ স্ত‚পীকৃত হলো। সেই সাথে তিন কোটি মানুষ দুর্দশার শেষ ধাপে এসে দাঁড়াল। বাংলার মানুষ শোষণ ও উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যস্ত এ কথা ঠিক, কিন্তু এ ধরনের (ভয়ঙ্কর) শোষণ ও উৎপীড়ন তারাও কোনো দিন দেখেনি’ (সূত্র : Macaulay: Essays on Lord Clive, P-63)।

দেশ ও জাতির কল্যাণ যদি প্রশাসনের একমাত্র দায়িত্ব হয়ে থাকে তবে জনগণের প্রতিটি পদে পদে এত ভোগান্তি হয় কেন? প্রশাসন প্রদত্ত সেবায় কি এ দেশের সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ঘুষের যে প্রথা চালু করেছিল, পরপর দু’বার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কি স্বাধীনতার সত্তা নিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গণমুখী হয়েছে? এখনো সাধারণ জনগণের সাথে আমলাতন্ত্রের যে ব্যবহার ও আচরণ তাতে কি তাদেরকে গণমুখী প্রশাসন বলে মনে হয়? বৈষয়িক উন্নয়ন ও মানুষের সাংবিধানিক অধিকার পাওয়া কি এক কথা? উন্নয়নের ক্রমধারা দেশের আপামর জনগণ যদি একই ধারাবাহিকতায় ভোগ করতে পারে তাকেই বলা যেতে পারে সার্বিক উন্নয়ন।

যদি প্রশ্ন করা হয়, দেশের কোন শ্রেণীর মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে? উত্তর নিশ্চয় গণমানুষের পক্ষে আসবে না। চুলচেরা বিচার করলে অবশ্যই দেখা যাবে, আমলারা রয়েছে সুখে-শান্তিতে, জনগণ রয়েছে ভোগান্তিতে যাদের ওপর সরকারি দলের ছায়া নেই। যারা সরকারি দলের ছত্রছায়ায় রয়েছে তারাই পাচ্ছে রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে যে প্রশাসনকে জনগণের অর্থে রাষ্ট্র লালন পালন করে, রাজনীতিবিদরা তো বটেই, কার্যতভাবে প্রশাসন তথা আমলারা দেশকে পরিষ্কারভাবে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। যথা - ১. ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও অন্য দিকে ২. ক্ষমতাবহির্ভূত গোষ্ঠী যারা ক্ষমতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত। হালে বাংলাদেশে একই আইন দুটি ধারায় প্রয়োগ হয়। ক্ষমতাসীনরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং যত আইন কার্যকর হয় শুধু ক্ষমতাহীনদের বেলায় যাদের খুঁটির জোর নেই বা পরিচয় দেয়ার মতো ক্ষমতাসীন কোনো ‘মামা’ না থাকে।

প্রশাসনকে গণমুখী করা বা ‘গণমুখী প্রশাসন’ সৃষ্টি করার প্রথম ও প্রধান শর্ত হচ্ছে নিরপেক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন প্রশাসন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমলাদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কথা থাকলেও তারা ‘এক চোখে তেল, অন্য চোখে লবণ বিক্রি’ করে। চাহিদা মোতাবেক অর্থ ঘুষ বা কমিশন এবং ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ থাকতেই তাদের সব প্রাপ্তি, সব আমলা একই চরিত্রের তা বলা যায় না, তবে যারা ব্যতিক্রম তারা চোখে পড়ার মতো নন।

একটি গণমুখী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কোনো কারণেই জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যথাযথ সম্মান পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না, কিন্তু হালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা প্রশাসন দ্বারা নিরীহ, নিপীড়িত, শোষিত, অসহায় জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশে যে ঘুষ প্রথা ও তাঁবেদারি অর্থাৎ তেলমর্দন শিক্ষা দিয়েছে প্রশাসনকে গণমুখী করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই জনগণ কাঙ্ক্ষিত সেবা ও সম্মান পাওয়া থেকে বঞ্চিত। স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য একটি ‘গণমুখী প্রশাসনের’ বিকল্প নেই। স্বাধীনতার চেতনা উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ‘প্রশাসনমুখী জনগণ’ সংস্কৃতির বিলুপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement