২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পেঁয়াজ প্রসঙ্গ

-

কৌতুকটি লম্বা নয়। স্বামী গিয়েছিলেন পেঁয়াজ কিনতে। ফিরে আসছিলেন না। এক রাত, এক দিন চলে গেল। স্ত্রী গেলেন পুলিশের কাছে। বললেন, আমার স্বামী পেঁয়াজ কেনার কথা বলে বাজারে গিয়েছিলেন। দিন গেল, রাত পেরোল, এখনো তিনি বাসায় ফেরেননি। দয়া করে তার খোঁজ পেতে সাহায্য করুন।

পুলিশ বললেন, এত চিন্তার কারণ নেই। পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি রান্নার অভ্যাস করেন। এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

নিম্নবিত্ত গৃহস্বামী পেঁয়াজের তাপে আসলেই গৃহপলাতক হয়েছিলেন কি না, সেটি তদন্তের নয়; বাস্তব ব্যাপার হলো, পেঁয়াজ প্রতি বছরেই বাজারে আগুন লাগাচ্ছে। বাজারে আগুন লাগলে সংসারে এর তাপ লাগবেই, খাবারেও লাগবে! তেলের দাম আর ঘিয়ের দাম সমান যেখানে, সেখানে জীবনধারণের বিপদ নিয়ে গুরু-শিষ্যের গল্প কম বিখ্যাত নয়। সেই গল্পটি মনে করিয়ে দেয় পেঁয়াজ। এর আগে আমরা দেখেছি, এক কেজি পেঁয়াজের দামে পাওয়া গেছে দুই লিটারের বেশি অকটেন! পেঁয়াজ ছাড়িয়েছে আপেলেরও দাম!

পেঁয়াজকে ছোট করছি, ভাববেন না। ভুলে যাচ্ছি না, সাধারণ মাপের একটি বড় পেঁয়াজে ৮৬.৮ শতাংশ পানি, ১.২ শতাংশ প্রোটিন, ১১.৬ শতাংশ শর্করা জাতীয় পদার্থ, ০.১৮ শতাংশ ক্যালসিয়াম, ০.০৪ শতাংশ ফসফরাস ও ০.৭ শতাংশ লোহা থাকে। পেঁয়াজে আছে ভিটামিন এ, বি ও সি। এটি মানবদেহ সাবলীল রাখতে কাজ করে, হার্টের কার্যক্ষমতা ও কার্ডিওভাসকুলার ফাংশন ঠিক রাখতে সাহায্য করে।

মানবসভ্যতার অজানা অতীত থেকে এর ব্যবহার চলে আসছে। পাকিস্তান, ইরান, পশ্চিম এশিয়া ও মধ্য এশিয়া পেঁয়াজের উৎসভ‚মি হওয়ার দাবি করে। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে চীনে এর ব্যবহারের নমুনা পাওয়া গেছে। প্রাচীন মিসরীয় রাজাদের দেহ মমি করতে চোখের কোটরে ঢোকানো হতো পেঁয়াজের বীচি। রাজা চতুর্থ রামেসিসের মমির দুই চক্ষুকোটরে পেঁয়াজের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। মিসরীয়রা পেঁয়াজ রাখত মৃতদেহের শরীরের নানা অংশে। মৃত স্বজনের বুক ঢেকে দিত পেঁয়াজের ফুল দিয়ে। তাদের বহু পিরামিডে অঙ্কিত চিত্রকর্মে রয়েছে পেঁয়াজের উপস্থিতি। অনেক অঞ্চলে পেঁয়াজকে অনন্ত জীবনের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। পেঁয়াজের গোলাকার আকৃতি ও এর সমকেন্দ্রিক একটির ওপর আরেকটি চক্রাকার রিং থেকে এ ধারণার জন্ম বলে মনে করা হয়।

গ্রিকরা পেঁয়াজে খুঁজতেন শক্তি ও যৌবন। নিজেদের পেশি অধিক বলবান করতে রোমান গ্লাডিয়েটররা দেহে পেঁয়াজ মালিশ করতেন। রোমান খাদ্যরসিক এপিসিয়াসের রচনায় আছে পেঁয়াজের বিবরণ। প্রাচীন রোমে যে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের চাষ হতো, তার প্রমাণ পাওয়া যায় অগ্ন্যুৎপাতে চাপা পড়ে যাওয়া পম্পেই নগরীতে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেখানে পেয়েছেন পেঁয়াজ চাষের প্রমাণ।

মুসা আ:-এর কালে বনি ইসরাঈল জান্নাতের খাবার ‘মান্না-সালওয়ার’ পরিবর্তে যেসব খাদ্যের চাহিদা জানায়, তার মধ্যে ছিল পেঁয়াজ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমরা বলেছিলে, হে মুসা! আমরা এ ধরনের খাদ্যে কখনো ধৈর্যধারণ করব না। সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা করো। তিনি যেন ভ‚মিজাত দ্রব্য শাকসবজি, কাঁকড়, গম, মসুর ও পেঁয়াজ আমাদের জন্য উৎপাদন করেন (সূরা বাকারা, আয়াত : ৬১)।

মানুষের চাষাবাদের ইতিহাসে প্রাচীনতম এক আবিষ্কার এই কন্দমূল, পেঁয়াজ। পেঁয়াজের পাতা হয় গাঢ় সবুজ। সে প্রাকৃতিকভাবে ভেষজগুণের আধার। বাংলার ঘরে ঘরে এটি যেমন রান্নায় ব্যবহার হয়ে থাকে, তেমনি কাঁচাও খাওয়া হয়। পেঁয়াজের সবুজ গাছ ও কলি আমরা রান্না করে খেয়ে থাকি। তবে এই কলি সামান্য লবণ মাখিয়ে চিবিয়ে রস খেয়ে ছিবড়া ফেলে দিলে অনেক বেশি উপকার পাওয়া যায়।

সর্দি-জ্বরে পেঁয়াজের রস উপকারী। নিয়মিত পেঁয়াজের রস পান চোখের জ্যোতি বৃদ্ধিতেও সহায়ক। পেঁয়াজে বিদ্যমান পটাসিয়াম ভাসোডিলেটর হিসেবে কাজ করে; যা আমাদের রক্তনালীগুলো শিথিল করে, আমাদের দেহে রক্ত চলাচল উন্নত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি হ্রাস করে হার্টের সমস্যায় প্রতিদিন খাবারের আগে সালাদ খাওয়া উত্তম অভ্যাস, এই সালাদে একটি বড় উপাদান পেঁয়াজ। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বা ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত ও মাঝারি পরিমাণে পেঁয়াজ খাওয়া খুব উপকারী। পেঁয়াজের এই সুবিধা মূলত এর কম গ্লাইসেমিক সূচক হওয়ার কারণে। পেঁয়াজ খাওয়া রক্তের প্রবাহে ধীরে ধীরে সুগার ছেড়ে দেয় এবং এভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।

অ্যাজমার সমস্যায় নিয়মিত দুবেলা এক চা চামচ করে পেঁয়াজের রস পান উপকারী। নাক দিয়ে রক্ত পড়া রোধ, প্রস্রাবের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদিতে পেঁয়াজরসের ব্যবহার প্রচলিত। আয়ুর্বেদ নিয়মে শিশুদের কানে পুঁজ, অতিগরমে পিপাসা নিবারণ, বিষফোঁড়া ফাটানো, বমি বমি ভাব দূর করা এবং মুখের নানা ইনফেকশন রোধে পেঁয়াজরসের ব্যবহার প্রচলিত।

মানব দেহের দরকার ছয়টি রস। এর তিনটি রয়েছে পেঁয়াজে। কিন্তু পেঁয়াজের অধিক ব্যবহার মুখে আনে গন্ধ। ফলে নিঃশ্বাসে গন্ধ থেকে যায়। সে গন্ধ অন্যের জন্য অপ্রীতিকর এবং মানুষের মধ্যে কথা বলার সময় এ গন্ধ অন্যের জন্য বিরক্তিকর, নিজের জন্য বিব্রতকর। এ গন্ধ তাড়ানোর জন্য পেঁয়াজকে চার ভাগ করে সারা রাত টক দইয়ে ভিজিয়ে রাখলে গন্ধ কমে এবং গুণ যোগ হয়ে উপাদেয় এক খাদ্যদ্রব্যে পরিণত হয়।

কাঁচা পেঁয়াজের ব্যবহারে যে দুর্গন্ধ উৎপাদন হয়, তা নিয়ে হাদিস শরিফে রয়েছে সাবধানবাণী।

জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রসুন বা পেঁয়াজ খায় সে যেন আমাদের থেকে দূরে থাকে অথবা বলেছেন, সে যেন আমাদের মসজিদ থেকে দূরে থাকে আর নিজ ঘরে বসে থাকে’ (বুখারি, হাদিস : ৮৫৫)।

তবে যিনি তরকারি ইত্যাদির সাথে পাকানো পেঁয়াজ খেয়েছেন, মসজিদে আসতে তার কোনো অসুবিধা নেই। ওমর ইবনে খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত এক হাদিসের নির্দেশনা হলো, ‘যে ব্যক্তি তা খায়, সে যেন একে পাকিয়ে গন্ধমুক্ত করে ফেলে’ (নাসায়ি, হাদিস : ৭০৮)।

হিন্দু ধর্মীয় তত্ত্বে দেহ শীতল রাখার স্বার্থে হিন্দু বিধবাদের জন্য পেঁয়াজ, রসুন পরিহারের উপদেশ রয়েছে। কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও স্বাস্থ্যঝুঁকিও কম নয়। পেঁয়াজ কাটার সময় ঝাঁজালো রস বের হয়, বাতাসে ভাসতে থাকে। তা চোখে লাগলে চোখ থেকে যে পানি ঝরে, তাতে থাকে সালফিউরিক এসিড। এই এসিড চোখে জ্বলাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে, মানুষকে অন্ধও করে দিতে পারে।

অতিরিক্ত পেঁয়াজ খেলে ত্বকে হালকা একজিমা বা জ্বালাপোড়া ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্লিনিক্যাল ইমিউনোলজি জার্নাল অনুসারে, অ্যালার্জির অন্যতম একটি উৎস হচ্ছে পেঁয়াজ। যদি আপনার পেঁয়াজের কারণে অ্যালার্জি হয়, মনে রাখা চাই, পেঁয়াজ খেলে ত্বক এবং চোখে লালভাব, ত্বকের চুলকানি, শ্বাস নিতে অসুবিধা, শরীর জ্বলন ইত্যাদির মতো অ্যালার্জির লক্ষণগুলোর জন্ম দিতে পারে।

নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক ওষুধ চলছে। এর মধ্যে পেঁয়াজ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধতে দেরি করাতে পারে।

অনেক বেশি পেঁয়াজ খেলে আমাদের রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে আসতে পারে, রক্তে চিনির মাত্রা কমতে পারে এবং হাইপারটেনশনের জন্ম দিতে পারে। ফলে ক্লান্তি, হালকা মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, হতাশা, ঝাপসা দৃষ্টি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। হতে পারে স্ট্রোকও।

পেঁয়াজকে বলা হয় বায়ুনাশক; কিন্তু রান্না করা পেঁয়াজ বায়ুকারক হয়ে যায়। রান্নায় বেশি পেঁয়াজ দিলে অনেক সময় পেটে গ্যাস জমতে পারে। বারবার ঢেঁকুর ওঠে। এতে অনেকের পেটে ব্যথা হয়, পেট ফুলে যায়। অনেকের পেট গরম হয়ে বারবার পাতলা পায়খানা হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পেঁয়াজ জোলাপের কাজ করে। অতিরিক্ত পরিমাণে পেঁয়াজ খাওয়া লোকদের অম্বল জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অম্বল এমন একটি সমস্যা যার কারণে বুকে জ্বলন্ত সংবেদন এবং চরম ব্যথা অনুভব হয়। এটি প্রধানত ঘটে যখন আমাদের পেটে উপস্থিত এসিড খাদ্যনালীতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহিত হয়। এ কারণে মাঝারিভাবে পেঁয়াজ খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। অতিরিক্ত পেঁয়াজে আসক্ত গর্ভবতী মহিলারা রয়েছেন হৃদরোগের ঝুঁকিতে। তাদের পেঁয়াজ খাওয়া উচিত ডাক্তারের সাথে পরামর্শসাপেক্ষে।

খুব বেশি পেঁয়াজ খেলে রক্তে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার জন্ম নেয়। এটি রক্তের শর্করার মাত্রা বিপজ্জনকভাবে নিম্নস্তরে নামিয়ে আনতে পারে। ফলে অস্পষ্ট দৃষ্টি, দ্রুত হার্টবিট, অনিয়মিত হার্টবিট, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।

বাঙালি খুব বেশি পেঁয়াজ খায়, তা নয়। তবে রান্না আছে আর পেঁয়াজের ব্যবহার নেই, তা হয় না। এটি হয়ে উঠেছে আমাদের আবহমান খাদ্যসংস্কৃতির অংশ। তরকারির স্বাদ থেকে পেঁয়াজকে আলাদা করে ভাবাই এখানে কঠিন। তরকারি আছে, মানে পেঁয়াজ আছে। এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা এক চর্চা, যা বাধ্যতামূলক এক ধারা তৈরি করেছে।

বাঙালি সাধারণত খায় মাছ ও গোশত। এতে পেঁয়াজ যেন না হলেই নয়। এর রন্ধনে হয়তো আদা, রসুন বাদ পড়তে পারে, কিন্তু পেঁয়াজ থাকতেই হবে। ভর্তা, ভাজি এমনকি মুড়ি মাখাতেও পেঁয়াজ লাগে। যে গৃহিণীরা রান্না করেন, তাদের কাছে এটি যেমন জরুরি, যারা খাবেন, তাদের বিচারেও। পেঁয়াজ খাদ্যে আনে বিশেষ স্বাদ এবং ঝোলে আনে বিশেষ মাত্রা। কাঁচা গোশত বা মাছের মধ্যে ঢোকে পেঁয়াজের রস; যা খাদ্যের স্বাদ আরো বাড়িয়ে দেয়। তবে এ করতে গিয়ে আমরা পেঁয়াজের দ্রব্যগুণ প্রায় নষ্ট করে দিই। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের বিচারে রান্নায় উচ্চ তাপমাত্রা ব্যবহারে পেঁয়াজের পুষ্টিগুণ কমতে থাকে। আর বাঙালি রান্নায় তাপমাত্রা ব্যবহারের যে উচ্চ হার, তাতে পেঁয়াজের পুষ্টিগুণ আর থাকার কথা নয়।

পেঁয়াজ বাংলাদেশের একটি অর্থকরী মসলাজাতীয় ফসল। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই পেঁয়াজের চাষ হয়। জলবায়ুর পরিবর্তন, বৈরী আবহাওয়া এবং বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণসহ নানা পারিপার্শ্বিকতার কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজের জাতীয় গড় ফলন (৯.৭৩ টন/হেক্টর)। যা বিশ্বব্যাপী গড় ফলনের (১৭.২৭ টন/হেক্টর) চেয়ে অনেক কম। ২০১৮ সালের হিসাবে দেশে ১.৭৯ লাখ হেক্টর জমিতে ১৭.৩৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। বর্তমানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ১৭ থেকে ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়; যা কি না পেঁয়াজের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ। চাহিদার বাকি ৪০ শতাংশ অথবা ৭ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৬০০-৭০০ কোটি টাকা।

আমদানির ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। বাকি পেঁয়াজ আসে মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক থেকে।

পেঁয়াজ আমদানিতে ভারতের ওপর এই অতি নির্ভরশীলতার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পণ্যটি পচনশীল হওয়ায় কম সময়ের মধ্যে বাজারে ছাড়ার জন্য কাছের দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে পরিবহন খরচও অনেক কম পড়ে। কিন্তু পেঁয়াজের বাজারে প্রায়ই আগুন লাগছে তখন, যখন ভারত পেঁয়াজ আটকে দিচ্ছে। এর সাথে কাজ করছে আরো কিছু কারণ। ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেন, এটি সত্য। চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা আরো বড় সত্য।

এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠা দরকার এবং পেঁয়াজের ওপর আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। উৎপাদন বাড়ানোর কথা যখন আসে, তখন উৎপাদনে লাভালাভের প্রসঙ্গ আসে। বাংলাদেশে কি বিদ্যমান বাস্তবতায় পেঁয়াজ উৎপাদন কৃষকের জন্য লাভজনক? দেখা যাচ্ছে, চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষক যতটা আগ্রহী, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে তেমনটি নয়; কারণ এতে তিনি লাভের মুখ দেখেন কম। সব ধরনের জমিতে পেঁয়াজ ফলানো যায় না। অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমি পেঁয়াজ ফলানোর জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু মিডিয়াম লো ল্যান্ডে পানি জমলে সামান্য বৃষ্টিতে জমিতে পানি উঠে পেঁয়াজ পচে যায়। কৃষকের লস হয় খুব। যেখানে খুব বেশি ঠাণ্ডা বা গরম পড়ে না এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয় না সেসব জায়গায় পেঁয়াজ এবং বীজ খুব ভালো হয়। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাযুক্ত গভীর, ঝুরঝুরে হালকা দোআঁশ বা পলিযুক্ত মাটি দরকার পেঁয়াজ বীজের জন্য। মাটির পিএইচ ৫.৮-৬.৮ থাকলে পেঁয়াজের কন্দ ও বীজের ফলন ভালো হয়। যেসব জমিতে পানি জমে, সেখানে পেঁয়াজ বীজ মোটেও ভালো হয় না। বীজ উৎপাদনের জন্য পুষ্পায়নের সময় প্রয়োজন হয় মোটামুটি ঠাণ্ডা তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রা উৎপাদন মৌসুমে বিশেষ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বিদ্যমান থাকে। পেঁয়াজের বীজ ফলনের সময়কাল দীর্ঘ, ১৫০-১৬৫ দিন। সে জন্য বীজ উৎপাদনে সারের প্রয়োজন অনেক বেশি। পেঁয়াজ সাধারণত পরপরাগায়িত উদ্ভিদ। সে জন্য প্রতিবেশী পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে পরাগায়িত পোকা ও বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়িত হলে এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লোপ পেতে পারে। বীজের বিশুদ্ধতার জন্য দুটি ভিন্ন জাতের পেঁয়াজ বীজের স্বাতন্ত্রীকরণে ১০০ মিটার দূরত্বের দরকার। এর মানে পেঁয়াজ উৎপাদনে রয়েছে নানা জটিলতা।

আবার উৎপাদিত পেঁয়াজও পচনশীল। বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। এ দেশে সাধারণত শীতকালে পেঁয়াজ উৎপাদনের অধিক উপযোগ থাকলেও নতুন জাতের পেঁয়াজ সম্প্রতি গরমকালেও উৎপাদিত হচ্ছে। কিন্তু তা বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। নষ্ট হয়ে যায়। অতএব দরকার প্রচুর স্টোরেজ। কিন্তু পেঁয়াজের উপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজ কতটা আছে আমাদের? যেখানে আর্দ্রতা থাকবে ৬০ শতাংশ, তাপমাত্রা থাকবে ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সমস্যার শেষ এখানেই নয়। স্টোরেজে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হলে তার দাম বেড়ে যায়।

এই যখন বাস্তবতা, তখন আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। আমদানিতে ভারতনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার গুরুত্ব বড় হয়ে দাঁড়ায়। স্বনির্ভরতার জন্য কম সময়ে ফলন বেশি হয়, এমন জাতের পেঁয়াজ উদ্ভাবনের প্রয়াস অধিকতরও জরুরি হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য উপযোগী পেঁয়াজের উচ্চ ফলনশীল বীজ আমদানি করার প্রসঙ্গটাও সামনে আসে। সাথে সাথে আসে বাজার মনিটরিং এবং পেঁয়াজ উৎপাদনে আনুক‚ল্য বাড়ানো। যেহেতু পেঁয়াজ আমাদের খেতেই হচ্ছে! কিন্তু পেঁয়াজ না খেলে চলবে না, বিষয়টি এমন ধ্রূব নয়। পেঁয়াজ খাওয়া কমানো যায়, যদিও বাঙালির রন্ধনশালায় পেঁয়াজের উপস্থিতি কমার সম্ভাবনা খুবই কম।

লেখক : কবি, গবেষক
ইমেইল : 71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement