২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আফগানিস্তান : ভারত ও পাকিস্তানের উদ্যোগ

-

সবার আগের প্রসঙ্গ
আফগানিস্তানে দুর্ভিক্ষ আসন্ন আর সেইসাথে সেখানকার পাহাড়ি-শীত জেঁকে বসল বলে। এর চেয়েও বড় কথা আফগান অর্থনৈতিক অবস্থা ডুবন্ত। এমনিতেই আফগানিস্তানে ২০ বছরের দখলি শাসন অবসানের পরে একটি নিজ রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়। এর ওপর তাতে কার্যকর একটা অর্থনৈতিক সিস্টেম আবার খাড়া ও চালু রাখা খুবই কঠিন কাজ। বিশেষত যখন ওই দেশে ফাংশনাল বৈদেশিক মুদ্রাব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে আছে। বলা যায় আফগানিস্তান এখনো ‘গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার’ সাথে একই বোঝাবুঝিতে নেই, ন্যূনতম কার্যকর রাজনৈতিক সহমত তৈরি নেই বা হচ্ছে না। ফলে বাস্তবত আফগানিস্তান গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেম ও গ্লোবাল মুদ্রাব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত নয়, বিচ্ছিন্ন। ফলে আফগান অর্থনৈতিক কাঠামোটাই নড়বড়ে, নিজে নিজে কোনো মতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। দুর্ভিক্ষাবস্থার মূল সঙ্কট এখানেই।

এদিকে পাকিস্তানের ‘ডন’ একটি খুবই খারাপ খবর ছেপেছে। জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেলের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হকের বরাতে পত্রিকাটি লিখেছে, তা অনুবাদ করে লিখছি : ফারহান বলছেন, ‘মানবিক সাহায্য বিতরণ নিয়ে কাজ করা আমাদের সহকর্মীরা সতর্ক করে জানাচ্ছে যে, আফগানিস্তানের প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ লোক যারা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি (৫৫ শতাংশ), তারা অতি জরুরি পর্যায়ের খাদ্যসঙ্কট ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে। বিশেষ করে চলতি নভেম্বর ২০২১ থেকে মার্চ ২০২২ এই সময়কালটায়।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে, ১৯৭৪ সালের দিকে যাদের বয়স তখনই ১০ বছর বা এর বেশি ছিল তাদের স্মৃতিতে আবছা বা স্পষ্ট থাকার কথা যে, দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পরে খাদ্যসঙ্কট, দুর্ভিক্ষ আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অকার্যকর হয়ে পড়া বা থাকা ওদেশের মানুষের জন্য কেমন অসহায় অবস্থায় এক চরম সঙ্কট-বিপর্যয় তৈরি করে! আজ বাংলাদেশে নিজেরা জীবনমানের দিক থেকে যে উঁচু জায়গাতেই থাকি পুরনো সেই স্মৃতি আমাদের জানান দেয় আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এখন কী অমানবিক দুর্দশায়! চার দিকে খাদ্যের জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা - মিডিয়ায় শুধু পুরুষ লাইন না, নারীদের লাইনও বলে দেয় তাদের অসহায় অবস্থার কথা!

এদিকে আমেরিকান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মূলত মানবাধিকার ইস্যুতে কাজ করে। গত ১১ নভেম্বর তার রিপোর্টের শিরোনাম ‘আফগানিস্তান দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি’। মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ফেলা ও রাখা চেয়ে বড় মানবাধিকার ও মর্যাদার সঙ্কট আর কি-ই-বা হতে পারে? তাদের রিপোর্টের সারাংশ করে লিখেছে, ‘জাতিসঙ্ঘ, বিশ্বব্যাংক, আমেরিকার উচিত যা কিছু বাধানিষেধ বা অর্থনীতিক অবরোধ বা পলিসি তারা আফগানিস্তানে আরোপ করতে চায়, তা অবশ্যই যেন বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে শিথিল করে নেয়।’

পরের প্রথম বাক্যেই লিখছে, ‘দাতা দেশ, জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানগুলোকে আফগানিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঠেকাতে জরুরিভিত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তা গড়িয়ে সর্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ অবস্থা না তৈরি করে - আজ (১১ নভেম্বর) হিউম্যান রাইট ওয়াচ এ কথা বলেছে।’

আফগানিস্তান নিয়ে দুটো গ্লোবাল উদ্যোগ
এ সপ্তাহে আফগানিস্তান নিয়ে দুটো উদ্যোগ থেকে মিটিং ডাকা হয়েছে। একটির আয়োজক ভারত, অন্যটির পাকিস্তান। ভারতেরটা নিয়ে পাঠক কৌত‚হলী হতে পারেন ঠিক ভারতই বোঝাতে চেয়েছি কি না; কারণ আমরা জানতাম আমেরিকার বসানো পুতুল - গনি সরকারকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া ভারত অন্য কোনো কিছুতে আস্থা রাখে না, এমন ভারতকেই আমরা চিনতাম। হ্যাঁ, তা বটে। কিন্তু ইদানীং তাতে ছোট্ট কিছু মোচড় দেখছি আমরা। তা হলো ভারত হঠাৎ করে জানাল তারা (নাকি আফগানিস্তানকেই দাওয়াত না করে তবে) আফগানিস্তান ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে এক সভা করতে চায়। এমন ইচ্ছা করাটাই অবশ্য ভারতের ‘গনি সরকার’ ছেড়ে অন্য কিছুর তালাশ করা। তাই ভারতের দিক থেকে এটি বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া যে, ‘গনি সরকারকে’ ফিরিয়ে আনতে আবদার এটি বাস্তবের মাটিতে পা রেখে দাঁড়ানো কোনো পক্ষের জন্য কোনো অপশনই নয়। তাই বলা যায়, ভারত যে আফগান ইস্যুতে এক দিকভ্রান্ত মুসাফির হয়ে গেছে; যে আবার দিশা খুঁজতে এবার পথে নেমে পড়েছে তা আর লুকানো থাকল না।

শুধু কি তাই? ভারত কি মনে করে সে এবার পথে পেয়ে যাবে? এক কথায় উত্তর, একেবারেই না। কিভাবে তা জানা গেল? ভারতের মিডিয়ারই ভারতের এ উদ্যোগ থেকে কোনো ফলাফল আসা নিয়ে আস্থায় নেই। যেমন ধরা যাক, এক সহযোগী দৈনিকের নয়াদিল্লি প্রতিনিধি লিখছেন এভাবে : ‘পাকিস্তান বেঁকে বসেছে। মুখ ফিরিয়েছে চীনও। এখন আফগানিস্তান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারতের উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ জেগেছে। তবু ভারত চেষ্টা ছাড়তে রাজি নয়।’ অর্থাৎ স্পষ্ট করেই প্রতিনিধি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ভারতীয় উদ্যোগের ওপর তার কোনো আস্থাই নেই।

ভারতের এ উদ্যোগে দাওয়াত পেয়েছিল ইরান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান। আসলে ভারতসহ সাত রাষ্ট্রকে দেখা গেলেও এতে মূল গুরুত্ব ইরান ও রাশিয়ার। এ দুটোর মধ্যে আবার মূল ওজনটা একমাত্র রাশিয়ার; যদিও ভারত এই সম্মেলনের শিরোনাম দিয়েছে এভাবে : ‘দ্যা দিল্লি রিজিওনাল সিকিউরিটি ডায়লগ অন আফগানিস্তান...’।

কিছু কথা এখানে খুলে বলাই ভালো, বুঝতে সুবিধা হবে তাতে। গত আগস্ট থেকে আফগানিস্তান ইস্যু ভারতের কেন ‘ঘুম হারাম’ হয়েছে সে কথা কাউকে সে খুলে বলতে পারছে না। প্রধানত ঘুম হারাম ঘটনাটা হলো কাশ্মির; অর্থাৎ কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ বা তা হাত ছাড়া হয়ে যায় কি না! কেন?

কারণ মোদি-অমিত খুবই ভীত এ জন্য যে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তারা একেবারেই গায়ের জোরে কাশ্মির (পুরোটাই, পাকিস্তান ও চীনের দখলে থাকা অংশসহ) ভারতের স্বাভাবিক অঙ্গ-ভূখণ্ড বলে সংসদে ঘোষণা করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এখানে ‘গায়ের জোরে’ বললাম অনেক কারণে। প্রথমত, নেহরু জানতেন কাশ্মির ভারতের নয়; তাই তো জাতিসঙ্ঘের কাছে তিনি চিঠি লিখে মতামত চাইলে জাতিসঙ্ঘ গণভোট আয়োজন করে সিদ্ধান্ত নিতে ফয়সালা দিয়েছিল। কিন্তু ভারত তা কখনোই অনুসরণ করেনি। একেবারেই এমন কোনো পদক্ষেপ না নেয়াটা সরাসরি জাতিসঙ্ঘ অমান্য করা হয় - সম্ভবত এমন অনুমানে তিনি কিছু ‘বিশেষ শর্তে’ (যেমন কাশ্মিরে ভারতের মূল ভ‚খণ্ডের কেউ জমি কিনতে পারবে না ইত্যাদি) তা ভারতভুক্ত করে নেন। সেটিই হলো ভারতের কনস্টিটিউশনের ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ। আর গত ২০১৮ সালেও ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিজেপি সমর্থক এক ব্যক্তি মামলা করেছিলেন ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিতে; তা এই যুক্তিতে যে ‘ভারতের মূল কনস্টিটিউশন প্রণয়ন কমিটি’ ৩৭০ ধারা যুক্ত করেছিলেন একে ‘অস্থায়ী’ বলে উল্লেখ করে। কিন্তু পরে এ নিয়ে আর কোনো কাজ না করেই ওই প্রণয়ন কমিটি তার আয়ু শেষ, তাই ‘বিলীন’ (ডিসল্ভ) বলে ঘোষণা করে দেয়া হয়। অতএব কোর্ট এখন ৩৭০ ধারাকে বাতিল ঘোষণা করুক - এই ছিল আর্জি। কিন্তু কোর্ট রায় দেন, এমন করা যাবে না। কারণ এটি করা হলে আইনিভাবে কাশ্মির আর ভারতের অংশ থাকবে না। তাই আদালত ওই রিট আবেদন বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন।

এর অর্থ ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট অমিত শাহের ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণা এক অবৈধ কাজ। কিন্তু যেহেতু কেউ এখনো এ ব্যাপারটা আদালতের দৃষ্টিতে আনেনি, তাই এটি বৈধ হয়ে আছে।

আবার সুপ্রিম কোর্টের ওই রিট মামলার রায়ে দেখা যাচ্ছে সেখানে পরোক্ষে ধরে নিয়ে রায় দেয়া হয়েছে যে, কাশ্মির ভারতের মূল ভ‚খণ্ড নয়। তা হলে অমিত শাহের ৩৭০ ধারা বাতিল ঘোষণা এবং কাশ্মিরকে সরাসরি ভারতের ভ‚মি বলে দখল করে নেয়া - এটিও অবৈধ। কিন্তু এটিও আদালতের দৃষ্টিতে কেউ আনেনি, তাই এটিও এখন বৈধ হয়ে আছে। এ ছাড়া মোদির জমানায় আদালতের ট্রেন্ড হলো, সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরোধিতা করতে হয় এমন ইস্যু হলে আদালতের এড়িয়ে চলা বা বছরের পর বছর ফেলে রাখা অথবা কোনো একবারের প্রধান বিচারপতি আন্ডারহ্যান্ড ডিলের অভিযোগ মাথায় নিয়েও সরকারের পক্ষে রায় দিয়ে দেয়ার ঘটনা অনেক।

এসব ‘গায়ের জোরের’ মতো হঠকারি কাজের কারণে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে মোদি-অমিত চমকে ওঠেন। কারণ এর প্রভাবে আজকের কাশ্মিরে (যেখানে মানুষের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, এটি এখন রাজ্যের মর্যাদায় নেই, আইনি রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের কোনোই ব্যবস্থা নেই) যদি সশস্ত্র আন্দোলন আবার তুঙ্গে ওঠে আর যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এসে যায়; তবে সারা ভারতের হিন্দুত্ববাদীরাই ফিরে মোদি-অমিতের চরম বিরুদ্ধে চলে যাবে এই বলে যে, ‘গায়ের জোরে কাশ্মির ভারতের বলে দখল, ৩৭০ ধারা বাতিল’ করা থেকেই ওই বিপর্যয়।

কাজেই মোদি-অমিত এখন চান যেই আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসুক সে যেন প্রতিশ্রুতি দেয় যে কাশ্মিরে স্বাধীনতাকামী কাউকে সহযোগিতা দেবে না। মজার কথা মোদি-অমিতের এই ঘোরতর মাথাব্যথার ইস্যু কাশ্মির, এ নিয়ে বাইডেন প্রশাসন অন্তত কোনো সমর্থনের অবস্থানে নেই; বরং উল্টো কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু আমেরিকার অভিযোগের তালিকায় আছে। কিছু কংগ্রেস সদস্যও এ নিয়ে সোচ্চার।
তা হলে এখন মূল মুরুব্বি রাশিয়া - সে কেন ভারতকে এই কোল দিতে গেল যাতে ভারত একটি সম্মেলন ডাকতে পারে?

তালেবানরা এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাশিয়া মূলত খুবই খুশি, তার অনুমান, এবার দিন তার পক্ষে এসেছে আর আমেরিকার বিপক্ষে। কিন্তু একই রাশিয়ারই আবার প্রবল শঙ্কা; কারণ সে আবার সেন্ট্রাল এশিয়ার ছয় রাষ্ট্রকে (এরই চার রাষ্ট্র ভারতের সম্মেলনে যোগ দিয়েছে) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে রেডিক্যাল ইসলাম বা আইএস টাইপের সশস্ত্র আন্দোলন বা আক্রমণ থেকে এদের সুরক্ষিত রাখবে। আর এ কাজে রাশিয়া তালেবানদের ওপর নির্ভর করতে চায়।

এসব কিছু অবশ্যই রাশিয়ার বড় স্বার্থ। কিন্তু এসব ছাড়াও রাশিয়ার আরেক বড় স্বার্থ আছে। যেমন সেটি হলো, রাশিয়ান এস-৪০০ মিসাইলের হবু ক্রেতা ভারত; যার একটির দামই আধা বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ভারত এটি কিনলে আমেরিকা ক্ষেপে গিয়ে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধসহ বহু ধরনের বাধা আরোপ করবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে আগেই জানানো হয়ে আছে। তাই ভারত চেষ্টা করছে কোনো ছাড় পাওয়া যায় কি না। কিন্তু উদাহরণ হলো, একই পথে তুরস্কের বেলায় সে ব্যর্থ হয়ে আছে।

তাই অনুমান করা যায় রাশিয়ার হবু ক্রেতা ও অন্য অনেক সমরাস্ত্রের এরই মধ্যে ভালো ক্রেতা, ভারতের ‘মন রক্ষা’ করতে রাশিয়া সেন্ট্রাল এশিয়ার চার রাষ্ট্র সাথে নিয়ে ভারতের সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। তবে সেন্ট্রাল এশিয়ার চার রাষ্ট্র - এদের দিক থেকে দেখলে তাদের নিজস্ব বড় স্বার্থও এটি যে, তারা তালেবানদের ভরসা করে যেকোনো রেডিক্যাল ইসলাম থেকে সুরক্ষিত থাকতে চায়। এটি তাদের ভাইটাল স্বার্থ!

তা হলে ইরান কেন?
ইরান ভারতের সম্মেলনে কেন - এটি এক বিরাট প্রশ্ন। তবে জবাবটা সহজেই এভাবে বলা যায় যে, সম্প্রতি আফগানিস্তানে শিয়া মসজিদে হামলা পরপর সম্ভবত তিনবার বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। আর প্রতিবারই দেড় শতাধিক লোক মারা গেছে। এটি শুধু শিয়া মসজিদে হামলা না; এরা ছিল মূলত আফগানি হাজারা শিয়া।

ওরা শিয়া এই সেন্টিমেন্টের ওপর ভর করে এ হামলা হয়েছে। কিন্তু এরা মূলত আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম এথনিক জনগোষ্ঠী। আমাদের মতো দেশের ভ‚খণ্ডের সীমানা টেনেছে কলোনিয়াল শক্তিগুলো তাদের নিজের একান্ত স্বার্থে, আর এতে একই এথনিক জনগোষ্ঠী কাটা পড়ে সীমানা দুই দেশে বিভক্ত করার ভিত্তিতে। আমাদের বেলায় একই বাঙালি বা পাঞ্জাবি এথনিক জনগোষ্ঠী যেমন ভারতে থেকে গেছে; যাদের আরেক অংশ বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে। তেমনি আফগান হাজারা জনগোষ্ঠী আরেক বড় অংশ আছে ইরানে। ফলে আফগানিস্তানের অংশ হামলায় বিপদগ্রস্ত হলে ইরানের দুটো সমস্যা। ইরানে সেন্টিমেন্ট তৈরি হয় আফগানদেরকে উদ্ধার ও রক্ষার। আবার আরেক বিপদ হলো, ইরান না চাইলেও তারা রিফুজি হিসেবে ইরানে ভিড় করে, করবেই - এটিই স্বাভাবিক। আর ইরান সেই দায় ঠেলে ফেলেও দিতে পারে না।

কাজেই তালেবানরা যদি হাজারারা শিয়া (ওরা কম মুসলমান বা সহি মুসলমান না ইত্যাদি ধরনের যেসব এথনিক ঘৃণা আফগান পশতুন ডমিনেটেড সমাজে প্রচলিত আছে) এই ধর্মীয়-সামাজিক মনোভাবের আলোকে উপেক্ষায় আইএসের হাতে হামলায় মারা যেতে দেয়, নাগরিক নিরাপত্তা না দিতে পারে তা হলে গত আগস্টে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরান সরকারের যে ইতিবাচক মনোভাব বজায় আছে তা ইরান চাইলেও বজায় রাখতে পারবে না। যেমন আফগানিস্তানের প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহ এখনো ইরান করছে; যেখানে এর অর্থ পরিশোধের কী ব্যবস্থা হবে, সেটি এখনো অনিশ্চিত।

অতএব ইরানের ভারতের সম্মেলনে যোগ দেয়া বলতে গেলে তালেবানদের ওপর অপ্রকাশ্য অসন্তুষ্টির পরোক্ষ প্রকাশ : তুমি আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামিস্টদের যদি আফগানিস্তান থেকে দূরে রাখতে না পারো, তবে ইরানের তোমার বিপরীতে যাওয়া ছাড়া পথ নেই।’

তার মানে কি যারা আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামীদের মুক্ত আফগানিস্তান দেখতে চায়; তাদের সম্মেলন ছিল ভারতেরটা? ভাবটা তাই কিন্তু সত্যিকারভাবে নয়। যেমন আইএস ধরনের রেডিক্যাল ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপ - এই হলো অ্যালার্জি বা অগ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি যদি ধরি, তা হলে কি বলা যাবে এমন গ্রুপের বিরোধীদের সম্মেলন ছিল ভারতেরটা? এটি বলা যাবে না। কেন?

কারণ বাইরে থেকে মনে হতে পারে, হিন্দুত্ববাদী ভারত নিশ্চয় এমন রেডিক্যাল ইসলামী সশস্ত্র গ্রুপদের বিরোধিতা পছন্দ করবে। কিন্তু না, করবে না। প্রমাণ কী?

ইদানীং পাকিস্তানের ইমরান খান দুটো ইসলামী গ্রুপ নিয়ে পেরেশান - টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) আর টিএলপি (তেহরিক-ই-লাব্বায়েক পাকিস্তান)। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে সমন জারি করে ডেকে অসন্তুষ্ট জানিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী অবস্থান জানিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী মনে করে এতে জীবন ও সম্পদ ক্ষয় হবে মাত্রাতিরিক্ত। তাই কৌশল হিসেবে এখনই সামরিক পদক্ষেপ বাতিল করা হয়েছে।

মজার কথা, এ খবর আরো বিস্তারিত ছাপা হয়েছে পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকা। আর যা খুবই কম ঘটে থাকে - আমাদের অবাক করে প্রথম আলো এসব খবর ছেপে দিয়েছে ডন-এর রেফারেন্সে, বিনা দ্বিধায়।

কিন্তু কেন ‘মজার খবর’ বলছি? ডন-এর খবরে লেখা হয়েছে, সশস্ত্র গ্রুপগুলো ভারতের সাথে সম্পর্কিত। প্রথম আলো ডন-এর রিপোর্ট থেকে অনুবাদ করে লিখেছে, ‘পাকিস্তানের মতে আফগানিস্তানভিত্তিক টিটিপির অন্যতম প্রধান সমর্থক ও অর্থদাতা হলো ভারত। পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা চালাতে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীটিকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে দেশটি।’ এ ধরনের পাকিস্তান সরকারের পুরো মনোভাব ও পরিকল্পনাই ওই রিপোর্টে আছে। কিন্তু আমাদের এখানকার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, মোদি-অমিতের কাশ্মির বাঁচাতে তারা পাকিস্তানের অভ্যন্তর অস্থিতিশীল করতে সশস্ত্র ইসলামী গ্রুপের ওপর নির্ভর করতেও রাজি; অর্থাৎ যে অভিযোগ আগে কেবল বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত অথবা একালে উইঘুর সশস্ত্র গোষ্ঠী (ETIM)-এর কথা উঠছে; এখন তা অনেক দূরে বিস্তৃত। এখানে উল্লেখ্য যে, হাজারাদের ওপর আইএসের যে তিন হামলা, তাতে সর্বশেষটাতে হামলাকারী হিসেবে ধৃত ব্যক্তি উইঘুর জনগোষ্ঠীর লোক। কেন? কারণ তালেবানরা এই ETIM গ্রুপকে আফগানে আশ্রয় দেবে না বলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর থেকে এই উইঘুর গ্রুপ আইএসে যোগ দিয়েছে, তাই এ ঘটনা।

পাকিস্তানের আয়োজিত সম্মেলন কী ও কাদের নিয়ে
এক কথায় জবাব, এ সম্মেলনের যদিও পাকিস্তান হলো হোস্ট কিন্তু এটি আসলে ‘ট্রয়কা প্লাস’-এর বৈঠক। কোন ‘ট্রয়কা প্লাস’? গত ১৫ আগস্ট তালেবানরা ক্ষমতা নেয়ার আগে রাশিয়ার উদ্যোগে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনকে নিয়ে তিন দেশীয় গঠন করা হয়েছিল তালেবান-আফগান ইস্যুতে তাদের কমন অবস্থান প্রকাশের জোট, সেটিই ট্রয়কা বা ত্রিদেশীয় জোট। আসলে নিরাপত্তা পরিষদের আফগান ইস্যুতে পাস হওয়া এক সর্বসম্মত প্রস্তাবকে তাদের গঠন ভিত্তি হিসেবে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। পরে পাকিস্তানকে ওই ট্রয়কাতে কোঅপ্ট করে নেয়া হয়; কারণ আফগানিস্তানে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে গেলে পাকিস্তানের মাধ্যমে তা করা অর্থপূর্ণ ও সহজ। অন্তত দুটো কারণে - এক. পাকিস্তান এই প্রথম ২০ বছরের আমেরিকার স্বার্থের যুদ্ধের দায় থেকে মুক্ত হয়েছে। তার পরও এখনো আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা ঘটলে তাতে সবচেয়ে বেশি পুরনো দায় ফিরে আসবে, পাকিস্তান অস্থিতিশীলতায় আক্রান্ত হবে ও সামরিক-অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে পাকিস্তানের। তাই পাকিস্তান না চাইলেও ‘স্থিতিশীল এক আফগান দেখার পক্ষে অবস্থান’ সে নিতে বাধ্য। দুই. আফগানিস্তান কিন্তু এক ল্যান্ডলকড ভ‚খণ্ড। ফলে পাকিস্তানের সাথে ন্যূনতম একটি তাল মিলিয়ে চলতে আফগানিস্তানও বাধ্য।

অতএব পাকিস্তানকে গ্রুপে নেয়ায় এর নাম হয়ে যায় ‘ট্রয়কা প্লাস’। আর ভারতের জন্য এটি ততোধিক বিব্রতকর হয়ে যায়; কারণ এতে ভারতের অভ্যন্তরীণ পাবলিকের কাছে হিন্দুত্ববাদীরা প্রপাগান্ডা চালাত যে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ লালনকারী, তা এখানে উল্টে যায়। পাকিস্তান হলো জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নে সন্ত্রাসবিরোধী সবচেয়ে নির্ভরশীল মিত্র, বিশেষ করে এখনকার সময়ের সবচেয়ে শক্তিধর তিন দেশ ও তাদের জোটের নির্ভরশীল মিত্র।

এবার সবচেয়ে কঠিন সত্যটা আগে বলে রাখি। তা হলো আফগানিস্তানে তালেবানরা ফেল করলে তাদের বিকল্প বা অন্য শক্তিটা হলো মূলত আইএস আর সাথে ওর সমমনা আরো ছোট ছোট নানা, মূলত ‘পড়শিদেশীয়’ গ্রুপ। সবচেয়ে বড় অস্বস্তিকর বাস্তবতা হলো, যেকোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি তো বটেই, এমনকি এশিয়া অমুসলিম কেউই বা অন্য ইসলামী ধারা কেউই আইএসের সাথে পাশাপাশি পরস্পরকে স্বীকার করে টিকতে পারবে, তা আইএস তো বটেই কেউই মনে করে না। ফলে তালেবানরা ফেল করার মানে সবার কাছেই পরিষ্কার।

তাই তালেবানকেন্দ্রিক এখনকার বাস্তবতা হলো, সংশ্লিষ্ট অন্য দেশের এক কমন আকাঙ্ক্ষা যে, তালেবানরা ফেল করা নয় বা আইএস আসা নয়। তাই তালেবানদের ফেল করা যাবে না। কিন্তু জাতিসঙ্ঘকেন্দ্রিক যে গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে, তার ভিত্তিতে তালেবানরা আফগানিস্তান শাসক হিসেবে নিজেদের গড়ে নিক। আর সেই আফগানিস্তান যেন পড়শি যেকোনো দেশে সশস্ত্র হামলাকারী কোনো গোষ্ঠীকে আশ্রয়দানকারী ভূখণ্ড না হয়, এটি নিশ্চিত করতে হবে।

এটি বাস্তবায়নে তা হলে সমস্যাটা কোথায়?
অনেকে মনে করেন, তালেবানরা ভাবছে যেহেতু আফগানিস্তান যেন রেডিক্যাল ইসলাম বা আইএস টাইপের সশস্ত্র আন্দোলন বা আক্রমণকারীদের আশ্রয় ভূমি না হয় এটি নিশ্চিত করা প্রায় সারা দুনিয়ার নানান রাষ্ট্রস্বার্থ, কাজেই তালেবানরা রাজনৈতিকভাবে কেমন শক্তি (আরেকটি আইএস কি না বা রাজতন্ত্র যেমন এক সালতানাত বা আমিরের দেশ কি না) তা দেখাদেখি ট্রয়কাকে বিবেচনা বন্ধ করতে হবে বা ছাড় দিতে হবে।

অথবা আফগানিস্তানেও দুর্ভিক্ষ লেগে যেতে পারে এই ভয়ে ট্রয়কাসহ সবাই তালেবানরা যেমন আছে এভাবেই মেনে নিতে বাধ্য হতে হবে।

তালেবানদের নিজের সম্পর্কে এই অতি-অনুমান যে তারাই হলো দুনিয়াকে স্থিতিশীল রাখার একমাত্র শক্তি - এটিই তালেবানদের সব কিছুকে স্থবির করে রেখেছে।

ট্রয়কা উদ্যোগ ফেল করলে এর প্রথম শিকার হয়ে যাবে আফগানিস্তানের খাদ্যসঙ্কটে থাকা ৫৫ শতাংশ জনগণ।

দ্বিতীয় যেটা সত্য তা হলো, ট্রয়কার তালেবানের সাথে কোনো ছাড় দেয়া যদি ঘটেও সেই তালেবান শক্তির শাসনও ফেল করবেই। ফলাফল হবে আইএস ও সমমনাদের উত্থান। সেই আফগানিস্তান হবে আফ্রিকার সোমালিয়ার চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো ভূখণ্ড। সারা দুনিয়ার জন্য এক হড়মড় এরিয়া!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement