২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইথিওপিয়ার টাইগ্রে যুদ্ধ ও রেনেসাঁ বাঁধ

- ছবি : সংগৃহীত

আফ্রিকার হর্নের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ইথিওপিয়া এখন আত্মহননের এক গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত। দেশটির ইরিত্রীয় সীমান্তবর্তী টাইগ্রে অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের ফেডারেল বাহিনী এক দখল অভিযান পরিচালনার পর এখন পাল্টা আঘাতে খোদ রাজধানী আদ্দিস আবাবার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শঙ্কিত। টাইগ্রে বাহিনী রাজধানীর অদূরের দু’টি শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। আবি আহমেদ সেনাবাহিনীর সক্ষমতার ওপর আস্থা হারিয়ে জনগণকে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

আদ্দিস আবাবার কর্তৃপক্ষ ইথিওপিয়ানদের টাইগ্রে ডিফেন্স ফোর্সের (টিডিএফ) বিরুদ্ধে তাদের আশপাশের এলাকা রক্ষার জন্য অস্ত্র তুলে নিতে বলার কয়েক দিন পর সরকার ছয় মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ১১ অক্টোবর শুরু হওয়া একটি বড় আক্রমণ টিডিএফ-এর অগ্রগতি ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পর ইএনডিএফ টাইগ্রের আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে।

আফ্রিকার দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ জনবহুল এই দেশটির সম্ভাব্য পতনের আশঙ্কা বাড়ার প্রেক্ষিতে ক‚টনীতিক ও আঞ্চলিক নেতারা প্রতিদ্ব›দ্বী বিভিন্ন পক্ষকে টেবিলে আনার চেষ্টা করছেন। লড়াই শুরু হওয়ার এক বছর পর, বিদ্রোহী বাহিনী এখন দেশের রাজধানীতে অগ্রসর হচ্ছে। এর আগে, দেশটির নয়টি সরকারবিরোধী দল আবি আহমেদের সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব ইথিওপিয়ান ফেডারেলিস্ট অ্যান্ড কনফেডারেলিস্ট ফোর্সেস নামে একটি জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। এই জোটের মধ্যে টিপিএলএফ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেটি নভেম্বর ২০২০ সাল থেকে ইথিওপিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। জাতিসঙ্ঘের মতে এই সঙ্ঘাতে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।

আফ্রিকার হর্নে গৃহযুদ্ধ
সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা দেশটির বৃহত্তম রাজ্য ওমরোর অধিবাসী আবি আহমেদ নিজেই এক সময় টিপিএলএফ-প্রধান সরকারের অংশ ছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের নামে ইথিওপিয়ায় প্রভাবশালী এই গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা বাহিনীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বিদায় করার কাজ শুরু করেন। এটি টাইগ্রিয়ান নেতৃত্বকে ক্ষুব্ধ করে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে, টাইগ্রিয়ানরা আবি আহমেদের আঞ্চলিক সংসদীয় নির্বাচনের বিরোধিতা করে। এর কয়েক সপ্তাহ পরে, ইথিওপিয়ার আইন প্রণেতারা টাইগ্রে অঞ্চলের জন্য অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেন। এর ফলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এর জের ধরে গত বছর নভেম্বরে টিপিএলএফ বাহিনী টাইগ্রেতে ফেডারেল সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। গোষ্ঠীটি বলে যে, এই আক্রমণের কারণ হলো টাইগ্রেতে হামলার প্রস্তুতি নিতে কয়েক দিন আগে ফেডারেল বাহিনীর প্রতিবেশী অঞ্চলে অবতরণ। সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পরে প্রধানমন্ত্রী আবি টাইগ্রিয়ান নেতৃত্ব এবং এর নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণের নির্দেশ দেন।

আবি টাইগ্রের দক্ষিণে আমহারা থেকে মিলিশিয়া যোদ্ধাদের নিয়ে তার বাহিনী শক্তিশালী করেন। তারা বেসামরিক লোকদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে পশ্চিম টাইগ্রেতে প্রবেশ করে। তারপর ইথিওপিয়ার এক সময়ের বৈরী প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সৈন্যরা আবির বাহিনীর সাথে লড়াই করার জন্য উত্তর থেকে টাইগ্রেতে প্রবেশ করে। ফেডারেল বাহিনী এবং তাদের মিত্ররা দ্রুত টাইগ্রের আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলে এবং অন্যান্য শহরের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। কিন্তু টিপিএলএফ ও এর সশস্ত্র সমর্থকরা গ্রামীণ এবং পার্বত্য এলাকায় পালিয়ে গিয়ে একপর্যায়ে পাল্টা আঘাত হানে। জুন মাসে ইথিওপিয়ান সামরিক বাহিনী বড় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। তখন টাইগ্রে থেকে ফেডারেল বাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং এর কয়েক হাজার সৈন্য বন্দী হয়।

টাইগ্রিয়ানদের অগ্রযাত্রার সময় অন্য একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওরোমো লিবারেশন আর্মি তাদের বাহিনীতে যোগ দিলে তাদের সম্মিলিত শক্তির সামনে ইথিওপিয়ান সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি ইউনিট পিছু হটে।

চলমান এই গৃহযুদ্ধে টাইগ্রে ডিফেন্স ফোর্সেস (টিডিএফ), ইথিওপিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (ইএনডিএফ), ইথিওপিয়ান ফেডারেল পুলিশ, আঞ্চলিক পুলিশ এবং প্রতিবেশী আমহারা এবং আফার অঞ্চলের জেন্ডারমেরি বাহিনীর সাথে ইরিত্রিয়ান ডিফেন্স ফোর্সেস (ইডিএফ)-এর সাথে লড়াই হচ্ছে।

২০১৯ সালে, জাতিগত ফেডারেলিজম এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে দেশকে দূরে রাখতে, প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ইথিওপিয়ান পিপলস রেভল্যুশনারি ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইপিআরডিএফ) জোটের জাতিগত ও অঞ্চলভিত্তিক দলসহ কয়েকটি বিরোধী দলকে তার নতুন প্রসপারিটি পার্টিতে একীভূত করেন। টাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) নতুন দলে যোগ দিতে অস্বীকার করে। টিপিএলএফ উল্লেখ করে যে চলমান কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২৯ আগস্ট ২০২০-এর জন্য নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনগুলো ২০২১-এ স্থগিত করে আবি আহমেদ একজন অবৈধ শাসক হয়ে পড়েন। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ফেডারেল নির্বাচন বিরোধীরা বয়কট করে। এর মাধ্যমে নবায়ন করা আবি সরকারের নির্বাচনকে টিপিএলএফ জোট অবৈধ ঘোষণা করে।

এর আগে ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর টাইগ্রে বাহিনী এবং ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া-আমহারার মধ্যে লড়াই শুরু হয়। ফেডারেল মিত্র বাহিনী ২৮ নভেম্বর টাইগ্রে অঞ্চলের রাজধানী মেকেলে দখল করার পরে প্রধানমন্ত্রী আবি টাইগ্রে অপারেশন ‘সমাপ্ত’ ঘোষণা করেন। টাইগ্রে সরকার নভেম্বরের শেষের দিকে বলে যে ‘হানাদারদের’ বের না হওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। ২৮ জুন ২০২১ তারিখে টাইগ্রে প্রতিরক্ষা বাহিনী মেকেলে পুনরুদ্ধার করে এবং জুলাই মাসে আমহারা এবং আফার অঞ্চলে অগ্রসর হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরের শুরুতে, টিডিএফ ওরোমো লিবারেশন আর্মি (ওএলএ) এর সাথে একত্রে টাইগ্রে অঞ্চল থেকে আদ্দিস আবাবার দিকে দক্ষিণে হাইওয়েতে বেশ কয়েকটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। টিপিএলএফ এখন আদ্দিস আবাবার দিকে এগোবে। সাতটি ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে ঐক্যবদ্ধ টিপিএলএফ ও ওএলএ জোট ঘোষণা করে যে তাদের লক্ষ্য হলো, শক্তি প্রয়োগে বা আলোচনার মাধ্যমে আবির সরকারের পতন ঘটানো এবং তারপর একটি ক্রান্তিকালীন কর্তৃপক্ষ গঠন করা।

টিপিএলএফ ও টাইগ্রিয়ান কারা?
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইথিওপিয়ার মার্কসবাদী সামরিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রান্তিক হওয়া গোষ্ঠী টাইগ্রিয়ানদের একটি ছোট মিলিশিয়া হিসেবে টিপিএলএফ জন্ম নেয়। দেশটির দু’টি বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী, ওরোমো এবং আমহারা মিলিতভাবে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি আর তৃতীয় বৃহত্তম টাইগ্রায়ানরা ৭ শতাংশের মতো। এর পরও টিপিএলএফ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী বাহিনী হয়ে ওঠে, অবশেষে একটি জোটের নেতৃত্ব দেয়, যা ১৯৯১ সালে সরকারের পতন ঘটায়।

টিপিএলএফ-এর সাথে ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহী জোট ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন জোটে পরিণত হয়। টিপিএলএফ-এর নেতৃত্বদানকারী মেলেস জেনাভি, ১৯৯১ থেকে ২০১২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইথিওপিয়াকে নেতৃত্ব দেন। এ সময়কালে অশান্ত অঞ্চলে ইথিওপিয়া একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় দেশটিতে। কিন্তু ২০১৬ সালে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আবি আহমদের ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। তার সরকার টাইগ্রায়ান কর্মকর্তাদের ওপর শুদ্ধি অভিযান শুরু করে এবং টাইগ্রিয়ান নেতৃত্বকে এটি ক্ষুব্ধ করে।

ইথিওপীয় সরকারি বাহিনীর সাথে রয়েছে ইএনডিএফ, আমহারা, আফার, বোনিসাংগুই- গুমুজ, দিরে দাওয়া, গামবেলা, হারারি, অরোমিয়া, সিডামা, সোমালি রিজিয়ন ও এসএনএনপিআর। টাইগ্রিয়ানদের দাবি অনুসারে ইরিত্রিয়া, জিবুতি সোমালিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সহায়তা করছে।

অন্য দিকে বিদ্রোহী ফ্রন্টের সাথে রয়েছে, টাইগ্রের টিডিএফ, অরোমো লিবারেশন আর্মি-ওএলএ, আর্ডোফ আগাউ লিবারেশন ফ্রন্ট, সিদামা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, বেশিংগুল পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট, সোমালি স্টেট রেসিসটেন্স, কিমান্ট ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও গামবেলা পিপলস লিবারেশন আর্মি। ইরিত্রিয়ার বিরোধী দল তাদের সমর্থন করে বলে ইথিওপীয় সরকার দাবি করে। উইকিপিডিয়ার তথ্যে, ইথিওপীয় সরকারি পক্ষে এক লাখ ৮৩ হাজার এবং বিদ্রোহী জোটের পক্ষে এক থেকে আড়াই লাখ যোদ্ধা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

উভয়পক্ষের শক্তিমত্তা দেখলে মনে হয় কোনো পক্ষই দুর্বল নয়। তবে এটি যতটা না জাতিগোষ্ঠীকেন্দ্রিক লড়াই, তার চেয়ে বেশি কর্তৃত্ব দখলের লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। একসময় টাইগ্রে অঞ্চলকে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা লড়াইয়ের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হতো। এখন বিদ্রোহী পক্ষের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আবি সরকারের পতন ঘটানো। আফ্রিকান হর্নে যে ক’টি রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জটিল সমীকরণ রয়েছে তার একটি হলো আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ইথিওপীয়া। আবি আহমদের পিতা ছিলেন মুসলিম আর মা ছিলেন খ্রিষ্টান। তিনি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে পিতৃধর্মের পরিবর্তে মাতৃধর্ম অনুসারে নিজেকে খ্রিষ্টান হিসাবে পরিচয় দেন।

নীল নদের রেনেসাঁ বাঁধ সংযোগ
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকে গৃহবিরোধ নিরসনের জন্য ২০১৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। এখন নীল নদের পানি নিয়ন্ত্রণে রেনেসাঁ বাঁধ চালু করে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রক শক্তি হওয়ার স্বপ্ন তাকে পরে এমন এক দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে যেখানে তিনি সম্ভবত হতে যাচ্ছেন ইথিওপিয়ার সবচেয়ে রক্ত ঝরানো সরকার প্রধান। বলা হয়ে থাকে, ইসরাইল ও তার কিছু মিত্র শক্তি নীল নদে বাঁধ দিয়ে বৃহত্তম পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সেচ ব্যবস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রলুব্ধ করেছিল ইথিওপিয়াকে। এই নীল নদই হলো মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম জনসংখ্যাবহুল আরব দেশ মিসরের মিষ্টি পানির একক উৎস। মিসরের কৃষিব্যবস্থা গড়ে উঠেছে মূলত নীল নদকে ঘিরে। নীলের প্রবাহ বন্ধ হওয়ার অর্থ হলো মিসরীয় অর্থনীতির বিপর্যয়ের মুখে পড়া। নীল নদের পানির ওপর প্রায় একই রকম নির্ভরতা রয়েছে সুদানের। ইথিওপিয়ার পানি প্রত্যাহারে সুদানের অর্থনীতিও চাপে। দুই দেশই বাঁধের জলাধার ভরা শুরু করার আগে সমঝোতা চুক্তির জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। ইস্যুটি তারা আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। কিন্তু ইথিওপিয়ার আবি আহমেদের সরকার এসবের তোয়াক্কা না করে বাঁধের জলাধার ভরার কাজ শুরু করে। আর এতে সুদান ও মিসরে নীল নদের প্রবাহে গুরুতরভাবে টান পড়তে শুরু করে। বিষয়টি মিসরের জন্য রীতিমতো বাঁচা মরার প্রশ্ন। তাই কোনো রকম সমঝোতা চুক্তি ছাড়া বাঁধের জলাধার পূরণ বা বাঁধ চালু করা হলে বিমান আক্রমণের পর্যন্ত হুমকি দেয় কায়রো। কিন্তু অনমনীয় থেকে আবি আহমেদ ইথিওপিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতি নজর দিয়েছেন। সে সাথে গৃহ বিরোধগুলোতে সমঝোতার রাস্তা ছেড়ে সামরিক জবরদস্তির পথ গ্রহণ করেন।

এই সঙ্ঘাত ও জবরদস্তির পথ একসময় ইরিত্রিয়াকে ইথিওপিয়া থেকে আলাদা করেছিল। আর সেই পথটি টাইগ্রে ও আরো কয়েকটি অঞ্চলকে ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ইথিওপিয়া হলো আফ্রিকার মুখখ্যাত অঞ্চলের এমন একটি দরিদ্র দেশ যার বিকাশের অনেক সম্ভাবনা গোত্রীয় বিরোধ ও গৃহ সঙ্ঘাতের কারণে বাস্তবতার মুখ দেখেনি। দেশটির ১০ কোটি জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি খ্রিষ্টান যার অধিকাংশ হলো ইথিওপীয় অর্থোডক্স ধারার। ৩৪ শতাংশের মতো অধিবাসী মুসলিম, যাদের প্রায় সবাই সুন্নি। ১ শতাংশের কম জনসংখ্যা ইহুদি, যাদের একটি অংশ ইহুদিদের হারানো গোত্রের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে ইসরাইলের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। তবে ইথিওপিয়ার এখন যে রাজনৈতিক সঙ্ঘাত তাতে ধর্মের বিষয় কোনো ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানে জাতিগত স্বার্থ ও বিরোধই মুখ্য। এর সাথে নীল নদের বাঁধসহ যার যার স্বার্থের কারণে বিভিন্ন আঞ্চলিক পরাশক্তি যুক্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষভাবে ইসরাইল ও তার মুসলিম মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ বাঁধে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এই বাঁধটি দিয়ে মিসর-সুদানসহ ইসরাইলের প্রতিবেশী আরব দেশের ওপর নিয়ন্ত্রক প্রভাব বিস্তার করতে চায় তারা। অন্য দিকে বাঁধের ব্যাপারে সমঝোতায় না আসায় মিসর ও সুদান পরোক্ষভাবে বিদ্রোহী শক্তিকে ইন্ধন দিচ্ছে বলে মনে হয়।

মিসর প্রকাশ্যে ইসরাইলের সাথে যতই সম্পর্ক রক্ষা করে চলুক না কেন দুু’টি ইস্যুকে তার অস্তিত্বের ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে। এর একটি হলো নীল নদের ওপর ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ বাঁধ নির্মাণ আর অন্যটি হলো তার দখলকৃত ভ‚খণ্ডের মধ্য দিয়ে সুয়েজ খালের বিকল্প খাল তৈরির ইসরাইলের পরিকল্পনা। এই দু’টি উদ্যোগের সাথে যুক্ত ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মিসর ইসরাইলের কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের একক আশ্রয় থেকে সরে এসে রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক তৈরি করছে। তুরস্কের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগের সাথেও কৌশলগত সমীকরণের একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয়।

নীল নদের পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন পর্যন্ত একটি অহিংস কিন্তু সম্ভাব্য বৃহত্তর সংঘর্ষের পরিস্থিতি চলছে। নির্মাণের ১০ বছর পর, ইথিওপিয়া রেনেসাঁ বাঁধের জলাধার ভরাট শুরু করেছে। ইথিওপিয়া দাবি করে যে প্রকল্পটি দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয়। অন্য দিকে ডাউন রিভার দেশ সুদান এবং মিসর সতর্ক করেছে যে নীল নদের প্রবাহে বিঘ্ন ঘটলে তা ধ্বংসাত্মক হবে। খার্তুম এবং কায়রো দাবি করেছে যে ইথিওপিয়াকে তথ্য শেয়ার করতে হবে এবং তাদের সাথে বাঁধের ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রণ সমন্বয় করবে। তবে এটিকে ইথিওপিয়া তার নিজস্ব সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে খারিজ করেছে। আবি এ ব্যাপারে অপ্রতিরোধ্য রয়ে গেছে এবং টাইগ্রে সঙ্কট রেনেসাঁ বাঁধ নিয়ে আলোচনা বা আপস প্রত্যাখ্যান করার জন্য তার সংকল্পকে কেবল শক্ত করেছে বলে মনে হচ্ছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে, সুদান এবং মিসর এই বিরোধ সমাধানের জন্য রাজনৈতিক ও আইনি উপায় অনুসরণ করেছে, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের কাছে আবেদন করেছে হস্তক্ষেপ করতে। তবে, উভয় দেশ ইঙ্গিত দিয়েছে যে, শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে সামরিক পদক্ষেপ টেবিলে থাকতে পারে। এই বছরের শুরুর দিকে, সুদান এবং মিসর যৌথ সামরিক মহড়ারও আয়োজন করেছিল, এই মহড়াকে ‘নীল নদের অভিভাবক’ নাম দিয়েছিল। এই দু’দেশ আনুষ্ঠানিক সামরিক পদক্ষেপের আগে প্রক্সি লড়াইয়েও যুক্ত হতে পারে। ইথিওপিয়ার বর্তমান সঙ্ঘাতে তাদের গোপন সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়।

এখন কী হবে?
ইথিওপিয়ার সরকার জুন মাসে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল। এখন টাইগ্রিয়ান বাহিনী আঞ্চলিক রাজধানী মেকেলে পুনরুদ্ধার করে যুদ্ধটি টাইগ্রের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আমহারা এবং আফার অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইথিওপিয়ার মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল ওরোমিয়ার বিদ্রোহী দল ওরোমো লিবারেশন আর্মির সাথে জোট করার পর টিপিএলএফ-এর অনুগত যোদ্ধা টাইগ্রে ডিফেন্স ফোর্সেস সামনের লাইনটিকে আরো দক্ষিণে ঠেলে দিয়েছে।

বিদ্রোহী যোদ্ধারা আদ্দিস আবাবার রাস্তার দু’টি প্রধান শহর ডেসি এবং কমবোলচা দখল করেছে, ইথিওপিয়ার নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, রাজধানীর পতন হতে পারে।

বিদ্রোহী জোটের মুখপাত্র বলেন, রাজধানী শহরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ফেডারেল সরকারের সাথে আলোচনায় ফলাফল কী হয় তার ওপর ভিত্তি করে। গ্রুপটি অত্যন্ত ঘন জনবহুল শহরে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়াতে চায় বলে উল্লেখ করেছে। অবশ্য আবি আহমেদের সর্বশেষ ঘোষণা এবং টাইগ্রের ওপর বিমান হামলা জোরদার করাতে তিনি সঙ্ঘাতের পথ বেছে নেবেন বলে মনে হচ্ছে। এখন দু’পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের পথ বন্ধ করা আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের সক্রিয় উদ্যোগের ওপর নির্ভর করবে। বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে জটিল স্বার্থের টানাপড়েনের কারণে নিরাপত্তা পরিষদের শক্তি প্রয়োগে শান্তি স্থাপনের দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেই বললেই চলে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে মারামারি, মাঠ ছেড়ে উঠে গেল সাদা-কালোরা কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সকল