২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মাথার উপর অভিভাবকের হাত

তরিকুল ইসলাম - ফাইল ছবি

দক্ষিণ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন তরিকুল ইসলাম। তার সাথে কবে পরিচয় হয়েছিল মনে নেই। ১৯৬৯-৭০-এ হতে পারে, ১৯৭২-এও হতে পারে। তবে যতদূর মনে পড়ে, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তার সাথে পরিচয় হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর রাজনীতি করতেন। আমি ছিলাম এ দলের চেলা। ঢাকা কিংবা টাঙ্গাইল কিংবা অন্য কোনো শহরে মুঠিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে মিছিলের আগে আগে দৌড়েছি। ফিলার বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছি। এখন হাসি পেলেও সে সময়ে তা ছিল আগুনঝরা বক্তব্য। রাজনৈতিক সহকর্মীরা পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। অগ্রজরা ডেকে প্রশংসা করেছেন। সেটুকুই পাথেয় ছিল। সেই শক্তি নিয়ে অগ্রজদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তখন খুবই কম বয়স ছিল আমার। ১৬ কি ১৭। কিন্তু অগ্রজরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেননি। বরং কাছে টেনে নিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। অনেকে আবার বলেছেন, খালি বক্তৃতা দিলেই কিন্তু হবে না, লেখাপড়াও শেষ করতে হবে। মনের মধ্যে সে ইচ্ছাও প্রবল ছিল। এ প্রক্রিয়ায় আরো অনেকের মতো তরিকুল ভাইয়ের সাথেও আমার সখ্য গড়ে ওঠে। তার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান ছিল সাত বছর। কিন্তু বন্ধুত্ব দ্রুত জমে উঠল। শেষে মনে হতে থাকল- এ অগ্রজ আমার মাথার উপর হাত দিয়ে রেখেছেন মাতৃজঠর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই। সব সময় একটা স্নেহের দৃষ্টি আমাকে আগলে রেখেছে।

তারপর দীর্ঘ পথচলা। তরিকুল ভাই বারবার জেল খেটেছেন। আইয়ুব আমলে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম সরকারের সময় এবং এরশাদ আমলে। যশোর গেলে তার আড্ডাস্থলে দীর্ঘ সময় আড্ডা দিয়েছি। তার জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনী শুনেছি। কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। সিগারেট খেয়েছেন প্রচুর। আর গল্প- জীবনের গল্প; লড়াইয়ের গল্প। অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হওয়ার গল্প। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি। দিন যত গেছে আমি ব্যক্তিগতভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসেছি জীবন-জীবিকার তাগিদে। কিন্তু শহীদ জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি অনুসরণ করেছি। তরিকুল ভাইও তাই। দেখা হলেই কথা বলেছেন। এমনকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কী সে বিষয়ে তাত্তি¡ক আলোচনাও করেছি। সেটি সম্ভব হয়েছিল, তখন আমি বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছিলাম। এদেশের মানুষের জাতিসত্তার পৃথক বিন্যাস বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার মানুষের আলাদা জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার ধারাবাহিক ইতিহাস অনুসন্ধান করেছি। ফলে আমাদের আলোচনা জমে উঠতো। তরিকুল ভাইয়ের গল্প শুনে মনে হতো কী ডেডিকেশন থাকলে একজন মানুষ বিভিন্ন সরকারের এত অত্যাচার-নির্যাতন সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল। সম্পর্ক দৃঢ়তর হলো।

বিএনপির ১৯৯১-৯৬ শাসনকালে তরিকুল ভাই মন্ত্রী ছিলেন। আমি ছিলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা লেখক। আমাদের রুমগুলো ধূমপায়ীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তরিকুল ভাই সিগারেট হাতে আমাদের রুমে গিয়ে হাজির হতেন। আয়েশ করে বসে বলতেন, এই একটা জায়গা যেখানে নিঃশ্বাস ফেলা যায়। তারপর আড্ডা। একসময় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তার ডাক পড়ত। তিনি বলতেন- আছেন তো! কথাটা সেরে আসি।

২০০১-০৬ সালে বিএনপি যখন আবার ক্ষমতায় এলো তার বছর খানেক পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমার ডাক পড়ল। গিয়ে দেখি গাড়িবারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সেলিমা রহমান। সেলিমা আপা ধরে বললেন, আপনাকে শিল্পকলার ডিজি হতে হবে; ব্যাপারটি ফাইনাল। আমি হাসাহাসি করছিলাম। আপা এক বছর কেউ খোঁজ নেয়নি আর আজকে ডেকেই শিল্পকলার ডিজি করে দিয়েছেন! তিনি বললেন, হ্যাঁ, ম্যাডামের সাথে কথা বলে এসেছি। আপনি থাকুন আমিনুল হক চিঠি নিয়ে আসছেন। আমি সেখানে দাঁড়িয়েই ভাবছিলাম- যদি শিল্পকলার ডিজির দায়িত্ব নিতে হয় তাহলে কী করব? কোথা থেকে শুরু করব? শুরু করতে হবে নতুন স্টাইলে। সারা দেশে ঝাঁক ঝাঁক শিল্পী, গায়ক-গায়িকা, আবৃত্তিকার তৈরি করে দেবো; যারা বাংলাদেশী সংস্কৃতির জয়গান করবে ও এর বিকাশে কাজ করবে। তখনই তরিকুল ভাই এসে নামলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। আমার আর এক হাত ধরে বললেন, আপনার শিল্পকলায় যাওয়া হচ্ছে না। আমি বললাম- তরিকুল ভাই, আপনাদের সরকার গঠনের বছরখানেক পরই যাও একটা চাকরি পেলাম সেটাও শেষ! তিনি বললেন, আপনি শিল্পকলায় যাবেন তো তাহলে প্রেস ইনস্টিটিউট কে চালাবে? আমরা আলোচনা করে দেখেছি ওটি সঠিকভাবে চালাতে আপনার কোনো বিকল্প নেই। দু’জনে আমার দুই হাত ধরে রেখেছেন। তরিকুল ভাইকে আমি বললাম, শিল্পকলার অর্ডার তো হয়ে গেছে। তিনি বললেন, ওটা ক্যান্সেল করে দেবো। আমরা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ঢুকলাম। সেলিমা আপা প্রধানমন্ত্রীর ব্লকে, তরিকুল ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন প্রেস সেক্রেটারির রুমে। সেখানে গল্পগুজব চলছিল। ব্যারিস্টার আমিনুল হকও এলেন। হাতে শিল্পকলার চিঠি। তরিকুল ভাই বললেন, এ চিঠি বদলে আনুন। রেজোয়ান প্রেস ইনস্টিটিউটে জয়েন্ট করবে। আমি কোনো দিশা না পেয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। যা হওয়ার হবে। পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সচিব আরিফ চৌধুরী বললেন, রেজোয়ান ভাই চলে আসেন। গিয়ে দেখলাম, প্রেস ইনস্টিটিউটে নিয়োগের চিঠি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকতে থাকতেই তরিকুল ভাই ফোন দিলেন। বললেন, সোজা সচিবালয়ে চলে আসেন। তিনি তখন তথ্যমন্ত্রী। বললেন, জয়েনিং লেটার দেন। তখন বিকেল ৪টা বাজে। জয়েনিং লেটার দিলাম। তিনি একে ওকে দাবকিয়ে প্রেস ইনস্টিটিউটের গাড়ি সচিবালয়ে নিয়ে এলেন। বললেন, এবার প্রেস ইনস্টিটিউটে গিয়ে যোগদান করে কর্মচারীদের সাথে কথাবার্তা বলে আবার চলে আসেন। আমি বললাম, কালকে জয়েন করি। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আগে চেয়ার দখল করেন। বাংলাদেশে চেয়ার খালি থাকলে যে কেউ বসে পড়ার চেষ্টা করে। আমি জয়েন করে এলাম। দেখি তরিকুল ভাই মিষ্টি এনে রেখেছেন। উপস্থিত সবাই বসে মিষ্টি খেলাম।

লেখার কলেবর বড় হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে আমার প্রতি তার স্নেহ-মমতা ভালোবাসার প্রমাণ দিতে চাই। মাঝে মধ্যেই কাজ শেষে সচিবালয়ে তরিকুল ভাইয়ের ওখানে আড্ডা দিতে গেছি। আর রুম থেকে বেরিয়েই তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে লিফটের দিকে নিয়ে গেছেন। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা এই যে আপনাকে গলায় হাত দিয়ে নিয়ে আসি আপনি কি কিছু মনে করেন? আমি বললাম, না। এটা তো আমার অহঙ্কার। তিনি বললেন, এর কিন্তু কারণ আছে। আমলারা যখন দেখবে মন্ত্রীর সাথে এমন গলায় গলায় সম্পর্ক তখন সব বেটা আপনাকে সহযোগিতা করবে। নইলে পদে পদে ঘাঁটানোর চেষ্টা করবে। এ ছিল আমার জীবনের আরো একটি বড় শিক্ষা।

মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তরিকুল ভাইকে জান্নাতবাসী করেন।


আরো সংবাদ



premium cement