২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন

পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে

-

পৃথিবীতে মানুষ আছে ৭০০ কোটির বেশি। আর মানুষের বসবাসের উপযোগী জায়গা মাত্র একটি। সেটি এই ‘পৃথিবী’ নামের গ্রহটি। বিশাল এই বিশ্ব জগতের কোথাও এমন একটিও জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়নি যেখানে গিয়ে মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। তার মানে হলো- এই পৃথিবীই মানুষের অবিকল্প বাসস্থান। কিন্তু কোটি কোটি বছর ধরে ব্যবহারের কারণে পৃথিবী ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর অবচয় হয়েছে। এই অবচয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যতটুকু হওয়ার কথা ততটুকু নয়। হয়েছে অনেক বেশি। কারণ মানুষ নিজ হাতেই এর ক্ষতি করেছে।

পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পৃথিবীর পরিবেশ মানুষের বাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে এবং শিগগিরই পুরোপুরি অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী মানুষেরা। আর এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মানুষেরই নানা কর্মকাণ্ড। পৃথিবীর যে প্রাকৃতিক প্রতিবেশ ব্যবস্থা সেটি ধ্বংস করা হয়েছে। ওজোনস্তরে ক্ষয়ে গেছে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি অধিক হারে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে। ফলে পৃথিবী হয়ে উঠেছে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত। এর ফলে ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। দেখা দিচ্ছে নানা রকমের প্রাকৃতিক অসঙ্গতি। প্রকৃতি হয়ে উঠেছে চরমভাবাপন্ন। দাবানল, মেরুর স্থায়ী বরফ আচ্ছাদনে ধস ব্যাপকতর হয়ে উঠেছে। তাবদাহ, ঝড়-ঝঞ্ঝা, দাবানল ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া তীব্রতর হচ্ছে। গত একটি দশকে উষ্ণতার রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ কমিয়ে রাখতে না পারলে তা গোটা মানব জাতির জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। বিজ্ঞানীরা বারবার এ ব্যাপারে সতর্কতা উচ্চারণ করে আসছেন। বিশ্বের সরকারগুলো একমত, এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে যৌথ পদক্ষেপ দরকার।

এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিশ্বের মানুষ একজোট হয়েছে এ জন্য কাজ করার লক্ষ্যে। কিন্তু ৭০০ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এক হয়েছেন একটি সম্মেলনে। তারা একমত যে, এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে বিশাল আয়োজনে একটি সম্মেলন এই মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্কটল্যান্ডের অন্যতম শহর গ্লাসগোতে। কনফারেন্স অব পার্টিজ (সিওপি বা কপ) ২৬ নামের এই সম্মেলন হলো জলবায়ু ইস্যুতে একটি বার্ষিক উদ্যোগ। এটি শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। সেই হিসাবে এবার হচ্ছে ২৬তম সম্মেলন। বলতেই হবে, এর আগে যে ২৫টি সম্মেলন হয়েছে তাতে খুব একটা সুফল পাওয়া গেছে, এমন নয়। নেতারা আলোচনা করেছেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে ক্ষণিকের ছুটি নিয়ে বিলাসবহুল সম্মেলনস্থলে কিছুটা হাত-পা মেলে অবকাশ যাপন করেছেন এবং নিজ দেশে ফিরে নব উদ্যমে আগের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। সম্মেলনের কথা হয়তো ভুলেই গেছেন। ফলে ওই সম্মেলনগুলোকে অনেকে বিশ্ব নেতাদের বার্ষিক বনভোজন বলতেও দ্বিধা করেননি। তবে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যে সম্মেলন হয় সেখানে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়। সেখানে বিশ্বনেতারা একমত হন যে, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ যাতে দুই শতাংশের বেশি না হয়, তা নিশ্চিত করতে ওই বৃদ্ধির পরিমাণ দেড় শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার চেষ্টা তারা করবেন। এই সীমিতকরণ হবে বিশ্বে শিল্পায়নের আগে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার যেমন ছিল তারই প্রতি তুলনায়। আর সেই তুলনা মনে রেখে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতেও তারা সম্মত হন।

বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো- বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের বিস্তার। প্রধানত আমরা যে জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি) পোড়াই তা থেকেই কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হয়ে বাতাসে মিশে যায়। এই কাজটি সবচেয়ে বেশি হয় শিল্প-কারখানায়। সহজেই বোধগম্য, শিল্পোন্নত বিশ্ব কার্বন নিঃসরণের জন্য বেশি দায়ী। সবচেয়ে বেশি দায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সুতরাং কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায়িত্বও বেশি। এই দেশগুলোকে আমরা একনজরে চিনে নিতে পারি ‘জি-২০’ নামে। এই ২০টি দেশের ২০ জন নেতার দিকেই বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকে নজর রাখতে হবে। তারা কতটা কী করবেন কার্বন নিঃসরণ কমাতে, সেটাই দেখার বিষয়।

এই প্রেক্ষাপটে গ্লাসগো সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্যারিস চুক্তির পর এবারের এই সম্মেলন বিশ্ববাসীর জীবনে স্বস্তি আনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। এই সম্মেলনে ২০০টি দেশের নেতাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা কতদূর কী করতে পারবেন বা এ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা কী? জি-২০ গ্রুপের নেতারা তাদের সর্বশেষ রোম সম্মেলনে চলতি শতকের শেষে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্যের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তবে তা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কী কী পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করবেন, তা স্পষ্ট করে বলেননি। বিশেষ করে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা অস্পষ্টই রয়ে গেছে।

গত রোববার (৩১.১০.২০২১) কপ-২৬-এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণকারী ব্রিটিশ মন্ত্রী অলোক শর্মা ঘোষণা দিয়েছেন, প্যারিসের অঙ্গীকার গ্লাসগোতে পূরণ হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) নির্বাহী সচিব প্যাট্রিসিয়া এস্পানেজা বলেন, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে একটি দিনও দেরি করার মানে হচ্ছে, সেই দিনটির অপচয়।

জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) চেয়ারম্যান ড. হুসেং লি এবং জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি আবদুল্লাহ শহীদ বলেন, ‘আমাদের আরো উচ্চাকাক্সক্ষী হতে হবে, বিশেষ করে জি-২০র সেই সব উচ্চ দূষণকারী দেশকে, যারা বিশ্বের মোট গ্যাস নিঃসরণের ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী।’

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে বরাবরের মতোই সোচ্চার বহু মানুষ। গ্লাসগোতেও বিক্ষোভ করেছেন শত শত মানুষ। বিশ্বনেতাদের প্রতি একই দাবি নিয়ে বিক্ষোভে সামিল হন বহু পরিবেশ অধিকারকর্মী। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে বিশ্বনেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চান তারা। গত শনিবার গ্লাসগোর বিক্ষোভে যোগ দেন জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্দোলনে সাড়া জাগানো সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। দেশটির রাজধানী এডিনবার্গে বিক্ষোভ করেন শতাধিক মানুষ। বিক্ষোভকারীদের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘শুধু মুখের কথা নয়, পদক্ষেপ চাই’ এবং ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করুন।’

বিক্ষোভে সামিল ১৯ বছরের এক শিক্ষার্থী বলেন, আগের ২৫টি কপ সম্মেলন হওয়ার পরও ‘জলবায়ু পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। তাই আমরা ভিন্ন কপ সম্মেলন চাই... যেখান থেকে প্রকৃত সমাধান আসবে।’

কপ-২৬ সম্মেলনে বিশ্বের ২০০টি দেশের কাছে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে তাদের পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হবে। জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে এই দেশগুলো ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাকশিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়ে, সে ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। এরই মধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত না রাখতে পারলে বিপর্যয় এড়ানো যাবে না। এ বিষয়ে কপ-২৬ থেকে জোরালো সিদ্ধান্ত আসার আশা করছে বিশ্ববাসী।

কিন্তু বিজ্ঞানীদের শত সতর্কতার পরও জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাবার বিষয়ে ভিন্ন মতও আছে। কারো ধারণা জলবায়ু পরিবর্তন আসলে তেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নয়। কেউ মনে করেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। তবে এসব ভিন্ন মতের পেছনে অনেকটাই জোরালো ভূমিকা রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিগত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চলতি বছরের শুরুতে এক টুইটে ট্রাম্প বলেন, তীব্র শীত প্রমাণ করে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া আশঙ্কাজনক নয়। তীব্র শীতের কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প সে সময় এমনও বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়লেও তা উদ্বেগজনক নয়।’

তবে সাধারণভাবে বিশ্ববাসী বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর নির্ভর করে।

বিজ্ঞানীদের গবেষণা, জরিপ ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এটি নিশ্চিত যে, জলবায়ু বিপর্যয়কর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। আর এই পরিবর্তনের জন্য মানুষই দায়ী। গত ৫০ বছরে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের তুলনায় দ্রুততর হারে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। শিল্পবিপ্লবের আগের সময় এবং ১৮৫০ সালের রেকর্ড করা তাপমাত্রার ভিত্তিতে এ ধরনের তথ্য দিয়েছে আইপিসিসি। এ সময়ের পলি, বরফ, গাছপালার যৌগিক বিশ্লেষণও করেছে আইপিসিসি।

চীনে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হার যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু নিঃসরণ হারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। তবুও জলবায়ু সম্মেলনে চীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে অনেকের ধারণা। এর পেছনে বৈশ্বিক রাজনীতির ভূমিকা থাকতে পারে। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে একচেটিয়া প্রভাব সম্প্রতি খর্ব হয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। দেশটি পদে পদে চীনকে প্রতিহত করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্লাসগো সম্মেলনেও ঘটতে পারে তারই প্রতিফলন।

তবে এই সম্মেলন থেকে বড় অর্জন কতটুকু হবে বলা মুশকিল। কারণ, বিপন্ন এই পৃথিবীকে রক্ষা করতে যেসব ব্যবস্থা নেয়া দরকার তার জন্য ব্যয় হবে কোটি কোটি ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থ। স্বীকার করতে হবে বিপুল জাতীয় স্বার্থত্যাগ। বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশেও নাকি কার্বন নিঃসরণের হার ২০৩০ সালের মধ্যে ২২ শতাংশ কমাতে ব্যয় হবে ১৫ লাখ কোটি টাকা বা ১৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। তাহলে গোটা বিশ্বের ব্যয় হিসাব করলে এটিকে এক অসম্ভব লক্ষ্য বলেই মনে হবে। তবুও বিশ্ববাসীর মতো আমরাও আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকব সম্মেলনের ফলাফলের দিকে।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement