২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এক ভবঘুরের ফাঁদে পা দিলাম সবাই

- ফাইল ছবি

গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়ার দীঘিরপাড়ে পূজামণ্ডপে দুর্বৃত্তরা কুরআন অবমাননার যে ফাঁদ পেতেছিল, তাতে আজ পুরো জাতিই আটকে পড়েছে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে প্রায় ১৮টি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, পূজামণ্ডপ ও বাড়িঘরে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়েছে। একজন হিন্দু ভক্তসহ মোট ছয়জন নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০১টি মামলায় ৫০০ জনের বেশি গ্রেফতার এবং ২০ হাজারের বেশি অজ্ঞাত আসামি হয়েছে। জাতীয় নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ ও গালাগালি করছেন, প্রিয়তম প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছেন, দেশের সেক্যুলার পক্ষ অনেকটা যুদ্ধংদেহী হয়ে পড়েছেন। তাদের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে সংবিধানের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ সংশোধনীর এবং ‘মৌলবাদী’দের ওপর। অন্য দিকে এ ঘটনায় ইসলামিস্টরা দুর্বৃত্তদের প্রতিক্রিয়াকে পুরোপুরি অধর্মের কাজ বলে আখ্যা দিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করেছেন। তবে মূল পরিকল্পনাকারী জঘন্য দুর্বৃত্তরা সফলভাবেই বিভক্ত জাতির বিভক্তির রেখাকে আরো প্রশস্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

ভারতবর্ষ মুসলমানরা শাসন করেছে ৭০০ বছর। তখন এ দেশে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর কোনো বিভাজন ছিল না। ঔপনিবেশিক শক্তি এসে সমাজে এই বিভাজন টেনে দেয় লুটপাটের শাসন কায়েমের লক্ষ্যে। সেই থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ ইত্যাদি ঘটে। ফলে স্বাধীন দেশগুলোতে ধর্মভিত্তিক সংখ্যালঘুরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ‘ডাইনামিক্স’ হয়ে পড়ে। ভারতে মুসলমান, পাকিস্তানে শিয়া ও বাংলাদেশে হিন্দুরা হয় রাজনীতির দাবার ঘুঁটি। এ প্রক্রিয়ায় ভারতে সংখ্যালঘুরা চরম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলেও বাংলাদেশের চিত্র বিপরীত।

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি পদ-পদবিতে ধর্মনিরপেক্ষতার বাস্তবায়ন এবং মসজিদের পাশে মন্দিরের অবস্থান দেখলেই বোঝা যাবে সংখ্যালঘুরা এখানে কত সম্মানিত হচ্ছেন। তবে এর মধ্যেও রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হিসেবে মাঝে মধ্যেই তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে, যার সুযোগ নিচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের লুটেরা ও রাজনৈতিক মতলববাজদের দল। ফলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে গত দশকে তিন হাজার ৭১০টি হামলার খবর পাওয়া যায় সংখ্যালঘুদের ওপর। (ডেইলি স্টার : ১৯ অক্টোবর ২০২১) এর মধ্যে বড় বড় হামলা হয়েছে রামু, নাসিরনগর, সাঁথিয়া, ভোলা ও শাল্লাতে। ওই সব ঘটনায় পারস্পরিক দোষারোপের বাকযুদ্ধ হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, দোষী-নির্দোষ গ্রেফতার হয়েছে, মামলা দায়ের হয়েছে এবং তদন্তও হয়েছে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি এবং কোনোটিরই সুষ্ঠু বিচারও হয়নি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে এসব সংখ্যালঘু নির্যাতনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলেও ইসলাম ধর্মের সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা ঘটায় তারা দুর্বৃত্ত, লুটেরা ও রাজনৈতিক ড্রাইভিং ফোর্সের অপারেটিভ। কুরআন ও সুন্নাহে বিশ্বাসী প্রকৃত মুসলমানরা কখনো এই কাজ করতে পারে না। হামলা তো দূরের কথা আল্লাহ তায়ালা নিজে অন্য ধর্মের দেব-দেবীকে গালি দিতেও নিষেধ করেছেন। (সূরা আনআম ৬:১০৮) রাসূল সা: সব মানুষকে সমান আখ্যায়িত করে সবার রক্ত ও সম্পদকে হজ দিবসের মক্কা নগরীর মতোই পবিত্র ঘোষণা করেছেন। (বুখারি-১৬২৩ ও মুসলিম-৩১৮০) রাসূল সা: নিজে সব ধর্মের লোকদের নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি ঘোষণা দিয়ে সেখানে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। (মদিনা সনদ) তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, কোনো এক ব্যক্তির অন্যায় সেই ব্যক্তির সম্প্রদায়ের ওপর বর্তাবে না। (মদিনা সনদ) তা ছাড়া কুরআনে ঘোষণা এসেছে, কোনো অপরাধে শুধু সংশ্লিষ্ট অপরাধী ছাড়া অন্য কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। (সূরা-৬ আনআম-১৬৪, সূরা-১৭ বনি ইসরাইল-১৫ এবং সূরা-৫৩ সূরা নজম-৩৮) ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের সাথে প্রকৃত মুসলমানদের কোনো সংশ্রব নেই। অন্য দিকে ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, যার বহু উদাহরণ প্রতিনিয়ত স্থাপিত হচ্ছে।

এবার আমাদের দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অজুহাতের সূত্রপাত থেকে শুরু করে প্রায় ১০ দিন ধরে জেলায় জেলায় যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা সচেতন মহলে অসংখ্য প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ঘটনা ঘটল কুমিল্লায়, গুলি চালানো হলো চাঁদপুরে আর সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে, হামলা হলো রংপুরে। এসব হামলার নমুনা ও টাইমলাইন রীতিমতো রহস্যের সৃষ্টি করেছে। প্রথমেই প্রশ্ন আসে, নানুয়ার দীঘির পূজামণ্ডপে কেন প্রহরী ও সিসিটিভি ছিল না? রাত ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত কেন বিদ্যুৎ চলে যায়? সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো, কেন ওসি আনওয়ারুল আজিম পূজামণ্ডপ থেকে কুরআন শরিফ উদ্ধার করে তা নিজের হাতে রেখে জনৈক ফয়েজকে প্রায় এক মিনিটের লাইভ স্ট্রিম করতে দিলেন ফেসবুকে? লাইভ স্ট্রিমিংয়ের পর উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও কেন যথেষ্ট নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হলো না যেখানে কুমিল্লায় ‘বিজিবি’র এক সেক্টর ফোর্সসহ যথেষ্ট পরিমাণ নিরাপত্তা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। ঘটনাপরম্পরায় নোয়াখালীর চৌমুহনীতে বিক্ষোভ মিছিলের আগে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে; তার পরও কেন এই বিক্ষোভ মিছিল করতে দেয়া হলো এবং গুলি চালিয়ে পাঁচজন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করতে হলো? সেখানে দুপুর ১২টার মধ্যেই প্রতিমা বিসর্জনের পরপরই কেন হিন্দু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থানগুলো থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুটিয়ে নেয়া হলো? রংপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সহায়তা চাইলেও কেন ধ্বংসযজ্ঞের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাজির হলো? পীরগঞ্জে কেন নিরাপত্তা বাহিনী শুধু ফেসবুকে ঘৃণ্য পোস্ট দেয়া হিন্দু তরুণের বাড়ি পাহারায় থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরবর্তী হিন্দুপাড়া অরক্ষিত থাকতে দিলো? ফলে সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে হিন্দুদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালাতে সক্ষম হয়েছে। দেশব্যাপী এসব তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর শত মামলা এবং হাজার হাজার অজ্ঞাত আসামি করা হলো। এর মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন ‘বিএনপি’ নেতাকে আসামি করা হয় যারা ছয় মাস ধরে জেলে আবদ্ধ। এসব মামলায় আবার ‘যুব অধিকার আন্দোলনের’ ১০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের বিষয়টিও সমাজে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কাকতালীয়ভাবে সম্প্রতি জনৈক প্রতিমন্ত্রী ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’-এর বিরুদ্ধে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে এটিকে রহিত করার সঙ্কল্প ব্যক্ত করেছেন। সব শেষে ইকবাল নামক এক ভবঘুরের এই কুরআন অবমাননার অপারেটর হিসেবে চিহ্নিত হওয়াটা ব্যাপক কৌত‚হল সৃষ্টি করেছে! একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ কেন, কার ইন্ধনে এটি করল, সেটিই এখন মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রশ্ন! তা ছাড়া প্রতিটি স্থানে আক্রমণকারীরা ছিল দাড়ি-টুপিবিহীন তরুণ এবং অন্য এলাকা থেকে বহিরাগত, সেটিও একটা রহস্যজনক বিষয়! অন্য দিকে ‘জামায়াত’ গৃহবন্দী, ‘হেফাজত’ কারাবন্দী এবং দলবিহীন ইসলামিস্টরা দিগ্ভ্রান্ত, আর সাধারণ মুসলমানরা হতভম্ব! তবে কেন, কিভাবে কারা এসব তাণ্ডবের পরিকল্পনা করল? সেই প্রশ্নের উত্তরটিই এখন সব রহস্যের জট খুলতে পারে।

গত কয়েক দিনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এসব ঘৃণ্য হামলায় দেশ, জাতি ও ধর্মের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। বিশ্বদরবারে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু লাভবান হয়েছে দলীয় রাজনীতি আর লুটেরা-সন্ত্রাসীরা। পূজা উদযাপনকারীদের শীর্ষ সংগঠনের নেতারা গত ৪ ও ৬ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তাদের একটি ফুলপ্রুফ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল। (প্রথম আলো : ২৩ অক্টোবর ২০২১) কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। তারা ‘হুমকি যাচাই’ ও ‘প্রিএম্পটিভ’ অ্যাকশনে যেতে পারেনি। তাদের নিরাপত্তা কৌশলেও শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। যে গোয়েন্দা সংস্থা বিরোধী রাজনৈতিক দল ঢাকা নগরীর জনবহুল এলাকায় কোনো একটি ফ্ল্যাট বাসায় গোপন মিটিং করলে ও জেনে যায়, যারা বিরোধী নেতা-নেত্রীদের গোপন ফোনালাপ তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করতে সক্ষম, সেই গোয়েন্দা জাল এই প্রকাশ্য আক্রমণগুলোর পূর্ব খবর সংগ্রহ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। প্রথম আলোর ২৩ অক্টোবরের সংখ্যায় একটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক দিনে সংখ্যালঘুদের বড় বড় হামলা যেসব স্থানে হয়েছে (হাজীগঞ্জ, চৌমুহনী ও পীরগঞ্জ) সেসব জায়গাতেই সরকারি দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট রয়েছে। দলটির বিবদমান উভয় অংশই হয় নিষ্ক্রিয় ছিল অথবা অপর অংশের চেয়ে লাভবান হতে চেয়েছে এ ঘটনা থেকে। নইলে রাজনৈতিক বিরোধীরা যেখানে একটা মিছিল করার সাহস পায় না, সেখানে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দুর্বৃত্তরা কিভাবে এতগুলো স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর সমাজবিরোধী তাণ্ডব চালাতে পারে? এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করে দুর্বৃত্তরা আগে এ দেশে কখনো শাস্তির আওতায় আসেনি। এমনকি নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার চিহ্নিত আসামি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল থেকে মনোনয়নও পেয়েছিল। কাজেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সন্ত্রাসীদের বারবার এ ধরনের আক্রমণে উৎসাহিত করছে। দোষারোপের রাজনীতি সবচেয়ে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয় সন্ত্রাসীদের জন্য। এবারের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরপরই সরকারি দলের প্রথম সারির প্রভাবশালী মন্ত্রী মহোদয়রা বিরোধী দলকে দায়ী করা শুরু করেন। বিরোধীরাও প্রতিক্রিয়ায় সরকারকে দায়ী করতে থাকে। আর এ সুযোগেই পরিকল্পনাকারীরা অচিহ্নিত থেকে যাচ্ছে। বিরাজমান জাতীয় অনৈক্য বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের একটি বড় কারণ। রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের জাতিকে এমনভাবে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে যে, সংখ্যালঘুর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেও আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না। ফলে জাতি এই ভুতুড়ে আক্রমণ থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। আরো একটি প্রকট সমস্যা রয়েছে আমাদের সমাজে। সেটি হলো, ‘কিছু খোয়া গেলেই ওই কেষ্ট ব্যাটাই চোর’। সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো আক্রমণ সংঘটিত হলেই বলা হয় ‘এটি মৌলবাদীদের কাজ।’ প্রমাণ নেই, তদন্ত নেই, আলামত নেই শুধুই বিরোধিতার জন্যই মৌলবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হয়। বিশেষ করে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার জ্বরে ভোগেন, তারা পারলে এ ধরনের প্রতিটি ইস্যুতে মৌলবাদীদের কবর রচনা করতে প্রস্তুত হয়ে যান। তারা এখানে বুঝে বা না বুঝেই দোষ মৌলবাদীদের ওপর চাপান। অথচ দুষ্কৃতকারী আর মৌলবাদী এক নয়। প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদী হলো তারা, যারা কুরআন ও সুন্নাহকে অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ কোনোভাবেই অন্য ধর্মের ওপর আক্রমণকে অনুমোদন দেয় না, বরং পাপ বলে ঘোষণা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্ম মুসলিম অধ্যুষিত দেশে সংখ্যালঘুদের সর্বপ্রকার অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করে (মদিনা সনদ)। কাজেই কোনো মৌলবাদী মুসলমান এ ধরনের জঘন্য হামলা চালাতে পারে না। তবে করতে পারে মুসলিম নামধারী দুর্বৃত্তরা। দেশজুড়ে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন চলছে, কুমিল্লা মহানগরীতে মেয়র নির্বাচন সমাগতপ্রায়। এমন পরিবেশে এ হামলা কারো কারো জন্য সুবিধা বয়ে আনতে পারে। এরই মধ্যে হিন্দু মহাজোটের নেতা গোবিন্দ চন্দ্র স্থানীয় সংসদ সদস্যের দিকে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করেছেন। এমনকি তিনি নানুয়ার দীঘির পূজামণ্ডপের দুই প্রতিদ্ব›দ্বী হিন্দু গ্রুপের দ্বন্দ্বের ফসল হিসেবে সন্দেহ করছেন মূর্তিতে কুরআন রাখার ষড়যন্ত্রকে। আবার জানা যায়, হাজীগঞ্জে ফেসবুকে উসকানি দিয়েছেন ছাত্রলীগ কর্মী সাজ্জাদ। (ডেইলি স্টার : ২০ অক্টোবর ২০২০) আর পীরগঞ্জে পুরো আক্রমণটাই মঞ্চস্থ করেছেন ছাত্রলীগ নেতা সৈকত মণ্ডল। অন্য দিকে গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন লিখেছেন, ‘ক্ষমতাসীনদের উসকানি বা প্রশ্রয় ছাড়া দুনিয়ার কোথাও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয় না। তা যেখানেই হোক- বসনিয়া, কলকাতা, দিল্লি, গুজরাট, রাখাইন, নাসিরনগর, নোয়াখালী।’ (প্রথম আলো : ১৮ অক্টোবর ২০২১) হিন্দু মহাজোট, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যজোট, বাংলাদেশ পূজা কমিটি ইত্যাদি সব সংস্থাই এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক স্বার্থবাদিতার কথাই তুলে ধরছেন।

কুমিল্লায় ঘটনার সূত্রপাত ও প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে হামলার একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। আফগানিস্তানের তালেবানদের ক্ষমতারোহণ পশ্চিমা বিশ্ব ও সেক্যুলারগোষ্ঠী কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আমাদের দেশের সেক্যুলারদের একটি অংশ এতে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন। অযৌক্তিকভাবে তারা ভীতি ও ঘৃণা ছড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্য দিকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে চরম হিন্দুত্ববাদী প্রতিক্রিয়াশীল মোদি সরকার আফগান ক‚টনীতিতে সব হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন, এ অবস্থায় ভারতবাসীর মনোযোগ সরাতে তৃতীয় একটি দেশে হিন্দুত্ববাদী ধুয়া তোলা এবং তা লালন করা ‘দরকার’ হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া সামনেই ভারতের পাঁচটি প্রদেশে নির্বাচন যার জন্য বিজেপি সরকারের ধর্মীয় ট্রাম্প কার্ড দরকার। এর প্রতিফলনে দেখা যায়, বাংলাদেশের ঘটনায় ভারতের বিজেপি নেতাদের লম্ফঝম্ফ এবং বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের হুমকি। সব মিলে এমন একটি ইস্যু বা ঘটন-অঘটনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, যাতে কথিত মৌলবাদীদের শায়েস্তা করা সম্ভব হয়। এরই মধ্যে গত ১৬ মে মিরপুরে সাহাবুদ্দিন খুনের ভিডিওকে নোয়াখালীর হিন্দু ভক্ত যতন সাহা হত্যার ভিডিও বলে ভাইরাল করা হয়েছে সুকৌশলে কলকাতা থেকে। (প্রথম আলো : ২০ অক্টোবর ২০২১) অবশ্য এই ভিডিও ভাইরাল করার ঘটনায় আমাদের দেশের একজন শিক্ষিকা গ্রেফতার হয়েছেন। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, এই দেশে এমন পক্ষও আছে যারা দেশটিকে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে তুলে ধরতে চায়।

কুমিল্লায় নানুয়ার দীঘির পাড়ে যে কুরআন অবমাননার চেষ্টার ঘটনা মুসলমানদের কষ্ট দিয়েছে, সেই কুরআনই কিন্তু সন্ত্রাস সৃষ্টির অনুমতি দেয়নি। তবে একে পুঁজি করে দুর্বৃত্ত-সন্ত্রাসীরাই জয়ী হয়েছে। পরিকল্পনাকারী বা ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়েছে। পরাজিত হয়েছে দেশ ও জাতি। চুনকালি পড়েছে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুন্দর চেহারায়। কারণ আমাদের জাতীয় নেতারা এ ঘটনায় দায়িত্বশীল আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কাজেই এই কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতিকে অগ্রাধিকার দিতে পারলেই এ ধরনের ষড়যন্ত্রকারীদের থামানো সম্ভব হবে ইনশা আল্লাহ।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement