২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

তুরস্ক-ইরান : শত্রু-মিত্র সম্পর্কের ঝুঁকি

- ফাইল ছবি

দ্বিতীয় পর্ব

কুর্দি ইস্যুতে টানাপড়েন
কুর্দি ইস্যু এ অঞ্চলের চার দেশ তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া ও ইরানের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সাম্রাজ্য ভাগ করার সময় ব্রিটেন-ফ্রান্স কুর্দিস্তানকে এ চারটি দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয়। প্রতিটি দেশেই কেন্দ্রীয় শাসনের সাথে কুর্দি জনগোষ্ঠীর কোনো না কোনো মাত্রায় দূরত্ব রয়েছে। আবার কুর্দি দলগুলো একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাখতে বিদ্রোহী কুর্দি গোষ্ঠীগুলোকে ‘প্রক্সি’ হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়।

২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে ইরান তার কুর্দি অঞ্চলে সুপ্ত বিদ্রোহের একটি স্বল্পকালীন পুনরুজ্জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করে। তেহরানের ধারণা, সৌদি আরবের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›দ্বী তাদের ‘পেছনের উঠোনে’ ইরানি হস্তক্ষেপের প্রতিশোধ হিসেবে এটিকে উসকে দিয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে জড়িত গোষ্ঠীগুলো ইরানে বা উত্তর ইরাকে তাদের অবস্থানস্থলে লড়াইকে টিকিয়ে রাখতে যথেষ্ট সমর্থন উপভোগ করে কি না, তা অস্পষ্ট। সরকার কুর্দি অঞ্চলে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তাদের দীর্ঘ দিনের দাবি নিয়ে সংশোধনমূলক কিছু ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে।

প্যান-কুর্দি জাতীয়তাবাদী অনুভূতি মোকাবেলায় ইরান ও তুরস্ক প্রায়ই পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে তারা একধরনের দ্ব›েদ্বর মধ্যে রয়েছে। আঙ্কারা ইরাকে কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের (কেআরজি) প্রেসিডেন্ট ও কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (কেডিপি) নেতা মাসুদ বারজানিকে সমর্থন করে। তেহরান বারজানির প্রতিদ্ব›দ্বী জালাল তালাবানির প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তান (পিইউকে), মুভমেন্ট ফর চেঞ্জ (গোরান) ও পিকেকেকে সমর্থন করে; যা সিনজার ও কিরকুকের দক্ষিণে উত্তর ইরাকে তার উপস্থিতি বিস্তৃত করেছে।

উত্তর সিরিয়ায়ও তারা বিভিন্ন কুর্দি গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছে। শক্তিশালী পিকেকে ও এর সহযোগীরা তাত্ত্বিকভাবে উভয়ের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়ালেও পিকেকের সাথে সংযুক্ত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) এবং এর সামরিক শাখা, পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি) সরাসরি তুর্কিদের মুখোমুখি। অথচ এসব গোষ্ঠী ইরান সমর্থিত সিরিয়ার শাসনের সমর্থনে অনেকটা স্বাধীন ধরনের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে সিরিয়ার এক বিরাট এলাকায়। আঙ্কারার ধারণা, এ সুবিধা তুরস্কে আক্রমণের জন্য পিকেকের জন্য কার্যকর সহায়তা সৃষ্টি করে থাকে। এটি আরব বিশ্ব থেকে তুরস্ককে বিচ্ছিন্ন করে পিকেকে ও এর স্থানীয় সহযোগীদের উত্তর সিরিয়ায় ‘রোজাভা’ (পশ্চিম কুর্দিস্তান) স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য গঠনের লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম করে দেয়।

কুর্দিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিলকে (কেএনসি) সমর্থন করেছে, বারোটি ছোট সিরিয়ান কুর্দি পার্টির জোট, যার সাথে ইরাকি কুর্দি দলগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পিওয়াইডির কাউন্টারওয়েট হিসাবে কেডিপি ইরাকি ও সিরিয়ান কুর্দিস্তানের সীমানা নিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত হয় আর এটি হলো বাইরের বিশ্বের জন্য পিওয়াইডির লাইফ লাইন। ২০১৬ সালের আগস্টে উত্তর সিরিয়ায় সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল আঙ্কারা। অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ড নামের এ অভিযানে ওয়াইপিজিকে তার দুই পূর্ব ক্যান্টন, জাজিরা ও কোবানিকে আফরিনের সাথে সংযুক্ত করতে বাধা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া আলেপ্পোর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ক্যান্টন, সীমান্ত থেকে আইএস চালান এবং সিরিয়ার বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার অংশ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিরাপদ একটি জোন তৈরি করা হয়।

সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সিরিয়া সরকারের অবস্থানের সমর্থনে এবং তুরস্ককে বিদ্রোহীদের সমর্থন করা থেকে বিরত রাখতে ইরান গত পাঁচ বছরে পিওয়াইডি নেতৃত্বের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। এমনকি সশস্ত্র বিরোধীদের সেসব অঞ্চলের বাইরে রাখতে কুর্দি গোষ্ঠীটির নিয়ন্ত্রিত এলাকা সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে পিওয়াইডির সম্পর্ক এবং মার্চ ২০১৬ সালে তার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলকে একটি ফেডারেল ব্যবস্থা ঘোষণা দলটির প্রতি তেহরানের কৌশলগত মিত্রের ধারণাকে সম্ভাব্য কৌশলগত হুমকিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন : ‘স্বশাসন সংক্রামক। একটি স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি অঞ্চল [সিরিয়ায়] ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্ককে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।’

ইরান একটি কুর্দি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে তুরস্কের সাথে একমত, কিন্তু কুর্দিদের প্রতি আচরণের ব্যাপারে তুরস্কের পদ্ধতির সাথে মৌলিকভাবে একমত নয় বলে উল্লেখ করেন একজন ইরানি কর্মকর্তা। তবে ইরান ও পিকেকের মধ্যে যোগসাজশ দেখে তুরস্ক শঙ্কিত, যার মধ্যে পিওয়াইডি-ওয়াইপিজির কার্যকলাপে তেহরানের চুপচাপ থাকা শুধু একটি বিষয়। ইরান ও পিকেকে উভয়পক্ষ তাদের মধ্যে সরাসরি সহযোগিতার বিষয় অস্বীকার করেছে। পিকেকের একজন সিনিয়র নেতা সেমিল বায়ুক বলেন, ‘যে দেশ কুর্দিদের অধিকারকে সম্মান করে না, তাকে সহযোগিতা করা পিকেকের পক্ষে অসম্ভব। ইরান বা পিকেকে কেউই এখন নতুন ফ্রন্ট খুলতে চায় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইরানে পিজেএকে আবার সক্রিয়করণ এবং ইরাকে পিকেকের ওপর কেআরজির চাপ ইরাক ও সিরিয়ায় আরো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেবে এবং গুরুতর অভ্যন্তরীণ প্রভাব ফেলবে।’

ইরাক ও সিরিয়ায় অংশীদার ও সহযোগী সংগঠনের সাথে সম্পর্ক সুসংহত করার সময় ইরান ও পিকেকের মধ্যে আইএসকে পরাজিত করতে স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত আগ্রহ থাকলেও তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ একত্রিত হয় না। পিকেকে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সংরক্ষণ করতে চায়; ইরান কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগকে উল্টে দেয়ার চেষ্টা করে। আঞ্চলিক সমীকরণ, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমর্থন এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী সিরিয়ান ও ইরাকি প্রতিপক্ষের দুর্বলতা পিকেকে ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে এ আস্থা দিয়েছে যে, তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো তুর্কি-ইরানি জোট অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। সেই আত্মবিশ্বাস আরো বাড়তে পারে এবং তাদের আরো আঞ্চলিক লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে তুরস্ক ও ইরানের সাথে তারা সংঘর্ষের পথেও যেতে পারে যদি আইএস বর্তমানে যেসব জায়গায় আছে, সেখান থেকে বিতাড়িত হয়।

পরিস্থিতিকে গভীরভাবে অবলোকন করলে মনে হবে, দীর্ঘ সম্পর্ক থাকা সত্তে¡ও তুরস্ক ও ইরান পারস্পরিকভাবে গভীর অবিশ্বাস পোষণ করে। তুরস্ক ও ইরান যথাক্রমে এ অঞ্চলের বৃহত্তম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম কুর্দি জনগোষ্ঠীর বাসস্থান। তারা কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবকে ভয় পায়। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) ১৯৮৪ সালে তুরস্কে বিদ্রোহ শুরু করার পর অন্তর্ঘাতী লড়াইয়ে ৪০ হাজার মানুষের জীবনক্ষয় হয়েছে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে শান্তি আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এই দ্ব›েদ্বর সর্বশেষ অবস্থা ক্রমেই রক্তক্ষয়ী রূপ নিচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের বিরাট অংশ এখন হুমকির মধ্যে রয়েছে। ইরানও দীর্ঘ দিন ধরে কুর্দি বিদ্রোহীদের আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু তাদের বিদ্রোহ হয় বিক্ষিপ্ত ও ক্ষণস্থায়ী। ইরানের কুর্দি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (কেডিপিআই) ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পরে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু সেটি দমন হয়ে যায়। কেডিপিআই ও অন্য একটি গ্রুপ, ‘কমলাহ’ ১৯৯৬ পর্যন্ত নিম্নস্তরের বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে। ২০০৪ সালে, পিকেকের নেতৃত্ব ও আদর্শের অনুসরণকারী একটি নতুন গোষ্ঠী, পার্টি ফর ফ্রি লাইফ ইন কুর্দিস্তান (পিজেএকে) সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ২০১১ সালে এটিও যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেয়, মাঝে মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া সত্তে¡ও সেই যুদ্ধবিরতি এখনো বহাল রয়েছে।

প্রক্সি সঙ্ঘাত
ইরান-তুরস্ক দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা থাকলেও আঞ্চলিক কৌশলের ব্যাপারে অবিশ্বাস বিশেষভাবে তীব্র। একে অন্যকে আধিপত্য খুঁজছে বলে মনে করে তারা। ইরান সিরিয়ার শাসনের পতনের প্রচেষ্টায় বিরোধীদের প্রতি তুরস্কের সক্রিয় সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে এবং মনে করে, এটি লেবাননে হিজবুল্লাহর সাথে ইরানের কৌশলগত সম্পর্ককে বিপন্ন করবে।

সিরিয়া সীমান্তে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তৈরিতে পিকেকে ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর প্রতি ইরানি সমর্থন এবং একই ঘরানার ইরাকি শিয়াদের কর্মকাণ্ড দেখে তুরস্ক উদ্বেগ প্রকাশ করে। উত্তর ইরাকের ইলিতিয়াস, একসময়ের অটোমান প্রদেশের অংশ মসুলকে (মসুল বিলায়েত) এখনো আঙ্কারা তার ‘টার্ফ’ হিসেবে দেখে। অন্য দিকে এলাকার সুন্নি অধিবাসীদেরকে সিরিয়া ও ইরাকের সাথে তার সীমান্তের স্থিতিশীলতার জন্য তেহরান সরাসরি হুমকি বলে মনে করে।

তেহরান তুরস্কের সিরিয়া নীতিকে প্রাথমিকভাবে নব্য-অটোমান উচ্চাকাক্সক্ষার একটি পণ্য হিসেবে ব্যাখ্যা এবং উসমানীয় খেলাফত শাসিত অঞ্চলে তুরস্কপন্থী সুন্নিদের আঙ্কারা ক্ষমতায়ন করে বলে উল্লেখ করে। ইরানের একজন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, ‘সিরিয়ায় [২০১১ সালের পরে] যা পরিবর্তন হয়েছে, তা না সরকারের কারণে ছিল এবং না ইরানের সাথে এর সম্পর্ক ছিল।’

অন্য দিকে আঙ্কারার কর্মকর্তারা বলেন যে, ইরান পারস্য সাম্রাজ্যকে এবার শিয়া ধারাবাহিকতা দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। প্রেসিডেন্ট এরদোগান ২০১৫ সালের মার্চে ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করার নামে ইরান ‘কেবল তার জায়গা করে নিয়েছে’ বলে অভিযুক্ত করেন। তুরস্ক আরো বলেছে, সিরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ-সুন্নি জনসংখ্যার ওপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আলাবিদের শাসন রক্ষার জন্য ইরান শিয়া মিলিশিয়াদের একত্রিত করেছে; সম্প্রদায়গত উত্তেজনাকে আরো ঘনীভূত করে সুন্নি জিহাদিদের শক্তিশালী হবার উপকরণ সরবরাহ করছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রপের এক পর্যালোচনা অনুসারে তুরস্ক ও ইরান উভয়ে এমনভাবে কাজ করেছে যার জন্য একে অন্যকে দোষ দেয় আর কঠোর শক্তির ব্যবহার এবং অ-রাষ্ট্রীয় অভিনেতাদের সমর্থন করে। সন্দেহ, ভুল ধারণা ও ভুল হিসাবের কারণে সাধারণ ভিত্তি নির্মাণের প্রচেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকার সিরিয়ার সঙ্কট সমাধানে একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছিলেন, তা তার বিপ্লবী গার্ড কোরের ‘অভিজাত’ কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি তুর্কি প্রতিপক্ষ আহম্মেত দাভুতোগলুর কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। সে সময় কয়েক মাসের শাটল কূটনীতিতে কোনো ফল হয়নি। তুর্কি কর্মকর্তারা আসাদকে বোঝাতে পারেননি তিনি এমন একটি উত্তরণে নেতৃত্ব দিতে রাজি হবেন, যার ফলে তার ক্ষমতাচ্যুতি হবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা হিসাব করেছিল যে, সামরিক গতিশীলতা এবং সময় তাদের পক্ষে ছিল। আঙ্কারার দৃষ্টিকোণ থেকে, আসাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয় সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা দূর করবে অথবা কমপক্ষে চুক্তির শর্তাবলি উন্নত করবে। রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে পরে সব কিছু অবশ্য পাল্টে যায়।

সিরিয়ায় প্রায় তিন বছর পারস্পরিক উত্তেজনার পর, তুরস্কে জুলাই ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তুরস্ক-ইরান সংলাপের দ্বিতীয় সুযোগ দেখা দেয়। এরদোগানের প্রতি ইরানের তাৎক্ষণিক সমর্থন সিরিয়ার বিষয়ে সম্পর্কের উষ্ণতা এবং আবার আলোচনা শুরু হতে সাহায্য করে। উত্তর সিরিয়ায় ওয়াইপিজির অগ্রগতিতে তুর্কি-রাশিয়ান পুনর্মিলন, সম্ভবত আঙ্কারার সিরিয়া নীতির পুনর্বিবেচনায়ও ভূমিকা রাখে।

তারা যুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়ায় কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা (রাষ্ট্রপতি বা সংসদীয়) এবং ক্ষমতার ভাগাভাগি পদ্ধতি যাতে কাজ করতে পারে সে দিকে মনোনিবেশ করতে সম্মত হয়। কিন্তু দু’টি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর, উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপ- ‘অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ড’ আলোচনাকে ব্যাহত করে এবং অবিশ্বাসকে আরো বাড়িয়ে তোলে।

জটিল অবস্থা সহযোগিতায়
সমাধান খুঁজে পেতে প্রতিটি ব্যর্থতার সাথে তুরস্ক ও ইরানের প্রতিদ্ব›িদ্বতার প্রেক্ষাপট আরো জটিল হয়ে উঠেছে। সিরিয়ায় তাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো, তারা কেউই একটি বিভক্ত দেশ বা সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা তাদের জন্য অনুকূল হবে মনে করে না। ইরান যেকোনো ব্যবস্থাতেই সিরিয়ার ভূকৌশলগত দিককে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ এর অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করতে চায়। সাধারণত লেভান্টে ক্ষমতা প্রদর্শন করা এবং ইসরাইলের সাথে কৌশলগত গভীরতা বজায় রাখাও তার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর সাথে সংযোগের মাধ্যমে এটি বজায় রাখতে চায় তেহরান। তুরস্ক বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে চাইলেও দামেস্কে সুন্নি-নেতৃত্বাধীন একটি শাসন তার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ হবে। তবে তুরস্কের মূল অগ্রাধিকার হলো, একটি স্থিতিশীল সীমানা এবং পিকেকের নেতৃত্বাধীন কুর্দিদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দমন করা, যা তারা তুরস্কের অখণ্ডতার স্বার্থে অর্জন করতে চায়। ইরান ও তুরস্ক উভয়েই ইরাকের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে চায়। কিন্তু শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসন নিশ্চিত করা ইরানের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয়; অন্য দিকে ইরাক শাসনে সুন্নিদের আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ভূমিকা তুরস্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সিরিয়ার স্বার্থগুলো সম্ভবত আগের পাঁচ বছরের চেয়ে আজকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। উভয়েই আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দিকে মনোনিবেশ করেছে। তবে তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে মতপার্থক্য মেটানোর জন্য সংলাপের প্রয়োজন : তুরস্কের জন্য পিওয়াইডি-ওয়াইপিজি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে থাকা আর ইরানের জন্য আসাদকে বাঁচানোর ইস্যু নিয়ে বিশেষভাবে এটি দরকার, যাতে কোনো পক্ষ এখনো ছাড় দিতে চাইছে না।

বিশ্বাস অবিশ্বাসের টানাপড়েন
আপাতত এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, দুই দেশ তাদের চলমান পথেই চলবে। তুরস্ক এখন ইরানকে তার ঐতিহাসিক প্রভাবের ক্ষেত্র বিশেষ করে আলেপ্পো ও মসুলের যুদ্ধক্ষেত্রের আশপাশে ক্রমবর্ধমানভাবে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখছে। তারা আইএসের দখলে আলেপ্পোর পূর্বে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আল-বাব পৌঁছায়, কিন্তু ওয়াইপিজি তার কোবানি ও আফরিন সেনানিবাসের মধ্যে একটি স্থল সেতু প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটি হলে তারা সিরিয়ার সেনাবাহিনী এবং ইরানি-মিত্র বাহিনীর বিপজ্জনকভাবে কাছাকাছি চলে আসবে। অন্য দিকে মার্কিন সমর্থিত, ওয়াইপিজি-অধ্যুষিত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) আলেপ্পোর উত্তরে রয়েছে। ইরাকেও একই গতিশীলতা বিদ্যমান। বার্সানির তুর্কিপন্থী কেডিপির পেশমার্গার পাশে মসুলের পূর্বে সুশনি আরব আল-হাশদ আল-ওয়াতানি (যা ‘মসুল নাইটস’ নামেও পরিচিত) মসুলের পূর্বে তার বশিকা সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষিত প্রক্সি মিলিশিয়ার ভূমিকার জন্য তুরস্কের সমর্থন রয়েছে। আইএসের কাছ থেকে মসুল পুনরুদ্ধারের অভিযান আঙ্কারা-বাগদাদ যুদ্ধের সূচনা করেছিল। তুর্কি কর্মকর্তারা দাবি করেন যে, উত্তরে তুর্কি ভূমিকা ও উপস্থিতির জন্য বাগদাদের বিরোধিতা তেহরানের সাথে তার জোট থেকে উদ্ভূত।

এ দিকে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া (আল-হাশদ আল-শাবি) আইএস যোদ্ধাদের সিরিয়ার সীমান্তের দিকে পালাতে বাধা দেয়ার জন্য মসুলের পশ্চিমে একটি পুরনো অটোমান গ্যারিসন শহর তেল আফারের দিকে ঠেলে দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। তেল আফারে শিয়া মিলিশিয়াদের প্রবেশের সম্ভাবনা আঙ্কারাকে শঙ্কিত করেছে, যারা ইরাকের সীমান্তের কাছাকাছি সিলোপিতে ট্যাংক ও কামান মোতায়েন করেছে, যাতে শহরের সুন্নিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক করা যায়। এটি ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর প্রতিক্রিয়াকে উসকে দেয়, যিনি সতর্ক করেছিলেন : ‘আমরা তুরস্কের সাথে যুদ্ধ চাই না... কিন্তু যদি কোনো সংঘর্ষ হয়, আমরা তার জন্য প্রস্তুত... সিরিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি মসুলের পশ্চিমে সিনজারে পিকেকে ও ওয়াইপিজি যোদ্ধাদের উপস্থিতিতে তেহরানের হাতও দেখে আঙ্কারা।

সঙ্ঘাত পরিহারের বিকল্প পথ
সঙ্ঘাত পরিহারের বিকল্প পথ দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আঙ্কারা ও তেহরান পারস্পরিক প্রতিযোগিতা কমাতে আবার সক্রিয় হতে পারে। সাময়িকভাবে অনেক ডিনামিকস দুই দেশের জন্য স্বল্পমেয়াদি লাভ নিয়ে আসে, তবে সেগুলো পরে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে। এখন যে প্রক্সি দ্ব›দ্ব চলছে, তা সঙ্ঘাতকে আরো বৃদ্ধি করতে পারে, এমনকি যদি অসাবধানতাবশত, উত্তর সিরিয়া বা ইরাকে সামরিক সংঘর্ষ হয় তা হলে পরিবেশের আরো অবনতি ঘটবে। এটি ছাড়াও ক্রস-আঞ্চলিক জোটগুলো আরো বেশি আক্রমণাত্মক অভিনেতাদের সাথে জড়িত হলে অবিশ্বাস ও জাতিগত কোন্দল আরো গভীর হবে আর বিরোধকে দীর্ঘায়িত করবে। আঙ্কারা ও তেহরানের কর্মকর্তারা পারস্পরিক সহযোগিতা পুনঃসক্রিয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন; কিন্তু তাদের মধ্যে এ সংশয় কাজ করে যে, অন্যপক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাবে কি না। ইরানি কর্মকর্তারা তুরস্কের মতভেদ নিরসনে নমনীয় কতটা হবে, সে বিষয়টিকে অনিশ্চিত বলে মনে করেন। তুর্কিরা বলছেন, ইরানিরা তুরস্কের বৈধ স্বার্থকে স্বীকৃতি দেয় না এবং আসাদ-পরবর্তী উত্তরণ বা ইরাক ও সিরিয়ায় ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো নমনীয়তা প্রদর্শন করে না। এর পরও উভয়েই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অতীতে প্রদর্শন করেছে।

উত্তর সিরিয়ায়, ক্রমবর্ধমান পিওয়াইডি-ওয়াইপিজি শক্তি, তুরস্কের অভ্যন্তরে হামলা চালানো জিহাদিদের অনুপ্রবেশ এবং ৩০ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীর উপস্থিতি তুরস্কের জন্য গত এক দশকে জাতীয় নিরাপত্তায় সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইরান সুন্নি বিশ্বের শত্রæতা বহন করার একধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের একসাথে কাজ করতে না পারা আঞ্চলিক অংশীদারদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা কমাবে। দেখা যাবে ইরানের জন্য রাশিয়া, তুরস্কের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে তাদের স্বার্থকে বিবেচনায় নেয়ার পরিবর্তে তাদের আকাক্সক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসেবে তুরস্ক ও ইরানকে তাদের চার পাশে এখন যে দ্ব›দ্ব জ্বলছে, তার পরিণতি নিয়েই বাঁচতে হবে। যেকোনো টেকসই সমাধানের জন্য উভয়ের জন্য সহনীয় একটি আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্য প্রয়োজন হবে। এটি তখনই সম্ভব যখন তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে, তাদের প্রক্সিদের লাগাম টেনে ধরবে আর সিরিয়া ও ইরাকে একে অপরের মূল কৌশলগত ও নিরাপত্তা স্বার্থকে স্বীকৃতি দেবে।

তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে আজকের ভূতাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা একটি পুরনো শক্তি খেলার সর্বশেষ পুনরাবৃত্তি, কিন্তু তা ক্রমবর্ধমানভাবে অশুভ মোড় নেয়ায় ইরাক ও সিরিয়ায় একে অপরের পদক্ষেপের দিকে নজর রাখছে। এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ যে, দুই দেশ কিভাবে তাদের ক্ষমতা মোতায়েন করতে পছন্দ করে, কার সাথে তারা একত্রিত হয় এবং তারা তাদের মতপার্থক্যগুলো পরিচালনা বা অতিক্রম কিভাবে করছে। তা কেবল তাদের জন্যই নয়, তাদের প্রতিবেশী এবং মধ্যপ্রাচ্যের অংশীদার অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলের যুদ্ধে জড়িত অভিনেতাদের মধ্যে তুরস্ক ও ইরানের রয়েছে বিস্তৃত যোগাযোগমাধ্যম এবং দীর্ঘস্থায়ী ভূকৌশলগত চুক্তিতে থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা।

এ অঞ্চলের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের অবস্থা যদি আরো খারাপ হয়, ভবিষ্যৎ আরো অনির্দেশ্য হয়ে ওঠে, তা হলে কোনো অভিনেতাই সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে না। তাই আজকের প্রলোভনসঙ্কুল সুযোগ আগামীকালের স্মৃতিময় ফাঁদে পরিণত হতে পারে। শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের যোগ্যতা, পরিপক্বতা ও দীর্ঘ ইতিহাস আছে এমন ব্যক্তিদের আগ্রহী হওয়া উচিত; যাতে তারা নিজেদের আরো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে না নিয়ে যেতে পারে। তবে একটি সমালোচনামূলক পথ সংশোধনে সম্মত হতে পারে, যা সব দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি না হলেও অন্তত সামগ্রিক উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে।

এটি করার জন্য একটি অগ্রাধিকার হিসেবে তাদের উচিত তাদের আঞ্চলিক ভঙ্গির ওপর ক্রমাগত উচ্চস্তরের আলোচনার জন্য একটি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করা। অতীতে এ ধরনের বৈঠকের গতি সমস্যাযুক্ত ছিল : পর্যায়ক্রমিক সিনিয়র নীতিপ্রণেতাদের আলোচনা এক বা দুই দিন স্থায়ী হয়, তারপর অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় ধরে কূটনৈতিক শূন্যতা থাকে, যা প্রক্সি যুদ্ধ বৃদ্ধি করে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি কূটনৈতিক চ্যানেল পরিচালনায় ব্যক্তিগত প্রতিনিধি নিয়োগ করতে পারেন। এটি আঙ্কারা ও তেহরানকে কেবল দুর্ঘটনার ঝুঁকি, ভুল হিসাব ও ভুল যোগাযোগের সাথে জড়িত মতপার্থক্য ম্যানেজ করা এবং খোলাখুলিভাবে তাদের একে অপরের স্বার্থ ও নিরাপত্তা উদ্বেগ শেয়ার করতে সহায়তা করবে। এ ধরনের কৌশলগত বোঝাপড়া ছাড়া, টুকটাক লেনদেনের ব্যবস্থা কোনোভাবেই পছন্দসই ফলাফল দেবে না, কারণ একটি বিষয়ে অগ্রগতি অন্যত্র ধাক্কা দিয়ে সেটিকে নষ্ট করে দিতে পারে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement