১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লেবানন ইতিহাসের গভীরতম সঙ্কটে

- ছবি : সংগৃহীত

গত বছর আগস্টে বৈরুতে বিধ্বংসী এক বিস্ফোরণে কমপক্ষে ২০০ জন নিহত এবং প্রায় পাঁচ হাজার জন আহত হওয়ায় জনরোষ আবারো বৃদ্ধি পায়। জনরোষসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত সরকার পদত্যাগ করে। এক দিকে অতিমারীর বিস্তার এবং অভ‚তপূর্ব অর্থনৈতিক দুর্যোগ হাজার হাজার মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়িত। এসব দুরবস্থা লেবাননবাসীকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে উজ্জীবিত করছে। বিক্ষোভের সময় সরকারি পুলিশ ও জনগণের মধ্যকার সংঘর্ষ পরিস্থিতিকে আরো অবনতি করছে।

লেবাননের এই অসন্তোষ বছরের পর বছর ধরে চলছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে আয়ের উৎস বাড়ানোর জন্য সরকার হোয়াটসঅ্যাপ কলের ওপর ট্যাক্স ধার্য করে সাধারণ মানুষের দুর্দশাকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে দেয়। এ অস্থিরতায় মানুষ ভীত হয়ে পড়ে। অন্য দিকে সরকারের লোকজন আকণ্ঠ দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে। জনগণ রাজনৈতিক অভিজাতদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তবে সরকার পদত্যাগ করলেই জনমানুষের রাগ-বিক্ষোভ কমছে না, সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না।

লেবাননে এসব সমস্য এক দিনে হয়নি; বহু বছরের পুঞ্জীভ‚ত সমস্যার বিস্ফোরণ বলা যায়। দুর্নীতির কোনো বিচার হচ্ছিল না। দুর্নীতির কারণে কেউ গ্রেফতার হয়নি। লেবানন এখন দরিদ্র দেশ হলেও প্রধানমন্ত্রী বিশেষ করে সাদ হারিরি গরিব নন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক স্থানে তার বড় বড় প্রকল্প রয়েছে, তিনি এক ধনাঢ্য ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রী দিয়াব সিস্টেমকে দোষারোপ করেছেন, ‘দুর্নীতিতে নিমগ্ন এক সিস্টেম- যার শিকড় রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে প্রোথিত।’ দুর্নীতির নানা কাহিনী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জগতে ঘুরপাক খাচ্ছে, সাথে আরো অনেক দুর্যোগ দেশকে শেষ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, অকার্যকর রাষ্ট্র, ব্যর্থ রাষ্ট্র ইত্যাদি বলা হচ্ছে।

অতিমারী হওয়ার আগেও মানুষ মনে করত, লেবানন কোনো এক দুর্ঘটনার দিকে যাচ্ছে। সরকার মৌলিক সেবা দিতেও ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ ক্রমেই বিক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পড়ছিল। জনগণ দৈনন্দিন বিদ্যুৎ সংযোগ, নিরাপদ পানীয় জলের অভাব, সীমিত জনস্বাস্থ্য ও বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ইন্টারনেট সংযোগের সাথে মোকাবেলা করছিল। এগুলোতে একসময়ের সম্পদশালী লেবাননিরা মোটেও অভ্যস্ত ছিল না।

অনেকেই দায়ী করেছেন শাসকগোষ্ঠীর লোকজনকে যারা বছরের পর বছর ধরে রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে কিন্তু দেশের সমস্যা সমাধানে কোনো সংস্কার করেনি। অথচ তাদের নিজেদের সম্পদ সংগ্রহের মাত্রা কখনো কমেনি। বিক্ষোভ বৃদ্ধির আরো কারণ রয়েছে। লেবাননের পাউন্ডের স্থায়ী বিনিময় হার বজায় রাখতে বাজারের উপরে সুদের হারে বিনিময় করছিল মার্কিন ডলার। ২০১৯ অক্টোবর মাসে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি হয়, লেবাননের পাউন্ডের ডলারের বিপরীতে মূল্য হ্রাস পায়। যখন গম ও জ্বালানি আমদানিকারকরা ডলারে অর্থ দেয়ার দাবি করে, তখন ইউনিয়ন ধর্মঘটের ডাক দেয়। তার পর দেশের পশ্চিমাঞ্চলে অভ‚তপূর্ব দাবানলে ফায়ার সার্ভিসের অদক্ষতা ও অপ্রতুলতা জনগণের সামনে উঠে আসে। কোনো সরকার যেন মনেই করেনি, লেবাননে কোনো দিন দাবদাহ হবে; তাই যন্ত্রপাতিও নেই। এ সুযোগটি যেন কাজে লাগিয়েছে শত্রুরা। বড় বড় দু’টি অগ্নিকাণ্ড লেবাননের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে! অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার তামাক ও পেট্রলের ওপরও কর বসায়, কিন্তু কোনো অদৃশ্য কারণে সেটি বাতিল করে। এসব কারণে পাশ্চাত্যের সহযোগী তখনকার প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি ও তার সরকার পদত্যাগ করে।

কোভিড-১৯-এ মৃত্যু ও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন দেয়া হলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা রাস্তা থেকে সরে গেলেও, অর্থনৈতিক সঙ্কট আরো খারাপ করে তোলে। তেলের সমস্যা কত জটিলাকার ধারণ করেছে, তা দেখুন। একজন লেবাননি সাইকোলজিস্ট রোগীদের অনলাইনে, তাও বিদ্যুৎ থাকলে চিকিৎসা দিচ্ছেন; রোগীরা তেলের অভাবে গাড়ি চালিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারছেন না। রয়টার্স জানায়, ‘অনেক লেবাননি হতাশা এবং বার্নআউটের সাথে লড়াই করছে, কিন্তু অনেক মানুষের জন্য চিকিৎসা নাগালের বাইরে কারণ তাদের আয় সঙ্কুচিত হচ্ছে।’ বেশির ভাগ মনোরোগের ওষুধ- অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট থেকে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা পর্যন্ত সহজ নয়; গত মার্চ থেকে ফার্মেসিগুলোতে ওষুধও পাওয়া যাচ্ছে না। কী করুণ অবস্থা!

১৯৭৫-৮৯ সালের গৃহযুদ্ধ শেষে বিক্ষোভ থেমে যায় এবং দেশ শান্ত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব জানান, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ‘সঙ্কটজনক ও বিপজ্জনক’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাবলিক ঋণ ও মোট দেশজ উৎপাদন ছিল বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ; বেকারত্ব ২৫ শতাংশে, জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে।

অনেক ব্যবসায় কর্মী ছাঁটাই করে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। পণ্যের দাম বাড়তে থাকে, অনেক পরিবার মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তখন আবারো বিক্ষোভ শুরু হয়। অনেক ব্যাংকে জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়।

সরকার অবশেষে একটি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা অনুমোদন করে অর্থনৈতিক সঙ্কট অবসান এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ‘বেলআউট’ প্যাকেজের সমর্থন অর্জনের চেষ্টা করে। মে মাসে করোনাভাইরাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কারণে কিছু খাদ্যদ্রব্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়, দেশ বড় খাদ্যসঙ্কটের ঝুঁকিতে পড়ে। ওয়াশিংটন পোস্টে সংবাদ প্রকাশিত হয়, অনেক লেবাননি গোশত, ফল ও শাকসবজি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে এবং শিগগিরই রুটি কিনতেও অসুবিধার সম্মুখীন হবে। বিদেশী সহায়তার বড় অংশ প্যাকেটে যায়, সমাজসেবা ও গরিবদের জন্য আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না। দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক; তার ওপর হাজার হাজার উদ্বাস্তু। আধুনিক ইতিহাসে লেবানন সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটে।

বিশ্লেষকরা ইঙ্গিত করেছেন, রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা চলছে অর্থাৎ গোষ্ঠীগুলো তাদের নিজস্ব স্বার্থ দেখাশোনা করছে। লেবানন ১৮টি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দিয়েছে; মুসলিম চারটি, খ্রিষ্টানদের ১২টি, দ্রুজ সম্প্রদায় ও ইহুদি ধর্ম। তিনটি প্রধান সরকারি অফিস- রাষ্ট্রপতি, সংসদের স্পিকার ও প্রধানমন্ত্রী- তিনটি বৃহত্তম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত। ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান থেকে রাষ্ট্রপতি, শিয়া মুসলিম থেকে স্পিকার ও সুন্নি মুসলিম থেকে প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৩ সালের একটি চুক্তি অনুসারে এই বিধান চলে আসছে। সংসদের ১২৮টি আসন খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের (দ্রুজসহ) মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত। এই ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত বৈচিত্র্যই দেশটিকে বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপের জন্য একটি সহজ লক্ষ্য করে তুলেছে, যেমন- শিয়া হিজবুল্লাহ আন্দোলনে ইরানের ব্যাপক সমর্থন। ইহুদিরা সরাসরি কথা বলে ইসরাইলের সাথে। হিজবুল্লাহ লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী। নেতারা যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের স্বার্থ রক্ষা করতেই ব্যস্ত। ‘ওয়াচ ডগ’-এর মতে, সাম্প্রদায়িক ক্ষমতা ভাগাভাগির সাম্প্রদায়িক পদ্ধতি লেবাননের শাসনব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ধস নামাচ্ছে।

কয়েক দিন আগে লেবাননের জাহরানি তেল স্থাপনায় তেল সংরক্ষণকারী ট্যাঙ্কেও আগুন লেগেছে। ট্যাঙ্কটিতে বেনজিন ছিল। বিস্ফোরণে ২৮ জনের মৃত্যু ও ৭৯ জন আহত হয়। গত মাসের শেষের দিকে প্রায় ১৬ হাজার টন ইরাকি তেলভর্তি ট্যাঙ্ক লেবাননের জাহরানি তেল স্থাপনায় এনে জমা করা হয়েছিল। অন্যান্য সঙ্কটের সাথে জ্বালানির সঙ্কটও তীব্রতর হওয়ায় দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গাড়ি চলাচল অচল হয়ে পড়েছে। জ্বালানি স্বল্পতায় দু’টি বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটে থাকা দেশটি ৯ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে পতিত হয়েছে। এই ‘ব্ল্যাকআউট’ আরো চলতে পারে। গত কয়েক মাসে জ্বালানি সঙ্কটে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বেশির ভাগ বাসিন্দা বিদ্যুতের জন্য জেনারেটরের ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করেছেন; কিন্তু জেনারেটরের তেলও বাজারে সামান্যই পাওয়া যাচ্ছে।
ইউনিসেফ সতর্ক করে দিয়েছে, তীব্র জ্বালানি সঙ্কটে লেবাননের ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ পানির সঙ্কটজনক ঘাটতির সম্মুখীন হতে পারে অথবা আগামী দিনে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। ৬০ লাখ জনসংখ্যার লেবাননে দুই বছরের আর্থিক মন্দা চলছে। জ্বালানি তেল ও গ্যাসোলিনের অভাবে ব্যাপক ব্ল্যাকআউট অব্যাহত রয়েছে।

ইউনিসেফ আরো জানায়, ‘বিদ্যুৎ ঘাটতিতে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা কেন্দ্রগুলো নিরাপদ পানির অভাবে ধুঁকছে; মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যদি ৪০ লাখ মানুষ পানির অনিরাপদ ও ব্যয়বহুল উৎস অবলম্বন করতে বাধ্য হয়, তা হলে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধির সাথে আপস করা হবে এবং লেবাননে কোভিড-১৯ বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাবে।’ সরকার হাল না ধরলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০১৯ সালের দুর্নীতি সূচকে লেবানন ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৩৭তম স্থানে। ওয়াচডগের মতে, লেবাননে দুর্নীতি ‘সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে’ এবং রাজনৈতিক দল, সংসদ ও পুলিশ ‘দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ইসরাইলের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ হিজবুল্লাহর জন্য হয়ে উঠছে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তাই হিজবুল্লাহর ওপর অসন্তুষ্ট। পশ্চিমাদের সন্ত্রাসী তালিকায় এদের নাম উপরে। ‘ইরান লেবাননে হিজবুল্লাহকে গোপন আস্তানা বানানোর নির্দেশ দিয়েছে, যেখান থেকে গাইডেড মিসাইল ছোড়া যাবে, যে মিসাইল ইসরাইলের অভ্যন্তরে আঘাত করবে, আক্রমণ হবে নিখুঁত, ১০ মিটার ভেতর থাকবে। হিজবুল্লাহ তিনটি গাইডেড মিসাইল বসিয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি।’ ইসরাইল বলেছে, ‘যদি হিজবুল্লাহ মিসাইল ছোড়ে, তবে আমরা লেবাননকে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দেবো।’
উল্লেখ্য, গত বছর ৭ জুলাই ইসরাইল ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এবং ১৫ জুলাই ইরানের সাতটি জাহাজ পুড়িয়ে দেয়। এখনো এসব আগুন লাগাকে ‘রহস্যময়’ বলা হচ্ছে। তবে ইরান সরাসরি ইসরাইলকে দায়ী করে বলেছে, তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। এখন চার দিকেই আগুন আর আগুন। ইরাকের নাজাফে ২০টি গুদামে ৬ আগস্ট ২০২০ সালে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। দুবাইয়ের আজমানে ১০০টি দোকানঘর পুড়ে ছাই হয়েছে একই তারিখে। বৈরুত বন্দরের একটি পরিত্যক্ত জাহাজে প্রায় তিন হাজার টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণ হয়! এতে ১৬০ জন মারা যায়, পাঁচ হাজার জন আহত হয়, চার দিকে আধা মাইল বর্গক্ষেত্রের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। বিস্ফোরণে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার, গৃহহীন হয় তিন লাখ মানুষ। মৃত, আহত ও গৃহহীনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, বিস্ফোরণে দেশের ৮৫ শতাংশ খাদ্যশস্য ‘বাষ্প’ হয়ে গেছে। সহায়তা না পেলে যেকোনো সময় লেবাননে দুর্ভিক্ষ নেমে আসতে পারে। আজ এক বছর পর সেটিই দেখা যাচ্ছে। এই পরিমাণ নাইট্রেট ব্যবহার করে পুরো বৈরুত মহানগর উড়িয়ে দেয়া যায়। এখন পুনর্নির্মাণ শুরু করা হলেও ১০ বছরের বেশি সময় লাগবে পুরনো চেহারা ফিরিয়ে আনতে।

ইসরাইল ২০০৬ সালে লেবাননের দাহিয়ায় বেসামরিক ঘরবাড়ি ভেঙে ধূলিসাৎ করে দেয়। বলা হয়, কমান্ডোরা এসব সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িতে অবস্থান করে গোলাগুলি চালায়। ইসরাইলি সেনারা বৈরুতের দাহিয়ার আশপাশের এলাকা জনশূন্য করে দেয়। জনসাধারণের ওপর এমন নির্মম আক্রমণকে ইসরাইলিরা বলে ‘দাহিয়া ডকট্রিন’, রাজনীতি ও যুদ্ধের আধুনিক কৌশল। লেবানন সীমান্তে ওয়াজ্জানি গ্রামের পশুপালকরা কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে পশু ধরে নেয়ার অভিযোগ করে আসছে, গ্রামটি ইসরাইল থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে। বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে একটি গরুর মূল্য প্রায় দুই হাজার ডলার। পৌরসভা প্রধানের মতে, ‘এটিই তাদের জীবিকা’। লেবানন ও ইসরাইল আনুষ্ঠানিক যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে এবং দীর্ঘ দিন ধরে তাদের স্থল ও সামুদ্রিক সীমানায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। লেবাননের লিরা মার্কিন ডলারের চেয়ে তার মূল্যের ৯০ শতাংশেরও বেশি হারিয়েছে।

লেবাননের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের ক্রাইসিস অবজারভেটরি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, লেবাননিরা অনেকেই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। সঙ্কটের তীব্রতা ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যের অভাব তাদের তাড়িত করছে। এক জরিপে দেখা যায়, তরুণদের মধ্যে অভিবাসনের উচ্চ সম্ভাবনা, যুবক শ্রেণীর ৭৭ শতাংশ অভিবাসনপ্রত্যাশী।

আরেকটি কারণ, উপযুক্ত কাজের সুযোগ হ্রাস। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন তার চাকরি হারিয়েছে এবং লেবাননের ৬১ শতাংশ কোম্পানি তাদের স্থায়ী কর্মচারী গড়ে ৪৩ শতাংশ হ্রাস করেছে। উন্নত কাজ ও আয়ের সন্ধানে ডাক্তার, নার্স, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষকরাও দেশ ছাড়ছেন। এদের মধ্যে গত বছর এক হাজার ৬০০ জন দেশ ছাড়েন। শুধু আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের ১৯০ জন অধ্যাপক উত্তর আমেরিকায় অভিবাসী হয়েছেন।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, লেবানন ২০১৭ সালের জিডিপির স্তরে ফিরে আসার জন্য ১২ বছর প্রয়োজন। লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিফ হিট্টি ‘লেবানন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে সরকারের পদত্যাগের অনেক আগেই পদত্যাগ করেছেন। খোদ ইসরাইলি পত্রিকা হারেজ ৬ আগস্টে লেবানন বিস্ফোরণের জন্য ইসরাইলের সমালোচনা করেছে! রিচার্ড সিলভারিস্টিন লিখেছেন, বৈরুতের বিস্ফোরণের জন্য ইসরাইল দায়ী! জিওনিজমের একটি মতবাদ হলো- আরব বিশ্বে কোনো দেশকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেয়া। লেবানন ধ্বংসের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে কি তারই সাক্ষ্য দেবে?

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement