২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মহানবী সা:-এর জীবনচরিত অধ্যয়ন হোক পাথেয়

মহানবী সা:-এর জীবনচরিত অধ্যয়ন হোক পাথেয় - প্রতীকী ছবি

আরবি রবিউল আউয়াল মাস আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনের স্মৃতিধন্য। এ মাসেই মহানবী সা: পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাঁর ওপর অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব শেষে এ মাসেই মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।

বেশির ভাগ ওলামায়ে কেরাম ও সিরাত গ্রন্থ রচয়িতার মতে, নবী করিম সা: মক্কার প্রসিদ্ধ কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার মা আমিনার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবার হিজরি একাদশ বর্ষে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে ১২ রবিউল আউয়ালের সোমবারই তিনি ইন্তেকাল করেন। জন্ম ও ওফাত ছাড়াও রবিউল আউয়াল মাসেরই ১০ তারিখ হজরত খাদিজাতুল কুবরা রা:-এর সাথে রাসূল সা:-এর পরিণয় হয়েছিল। নবীজী সা: রবিউল মাসেই জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। তিনি মদিনায় পৌঁছান ১২ রবিউল আউয়াল। এরপর তিনি ১৬ রবিউল আউয়াল মসজিদে কুবা নির্মাণ করেন।

জগতের আদর্শ মহামানবের জন্মের দিনটি তাই স্মরণীয় করে রাখতে, তাঁর আদর্শে জীবন গড়ার জন্য মুসলিম বিশ্ব প্রতি বছর ১২ রবিউল আউয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী সা: বা সিরাতুন্নবী সা: ইবাদত বন্দেগি ও তাঁর সিরাত আলোচনার মধ্য দিয়ে পালন করে। পবিত্র দিনটি আমাদের মাঝে সমাগত। ২০ অক্টোবর বুধবার বাংলাদেশে এ দিনটি পালিত হবে। দিনটি ঘিরে মহানবী সা:-এর জীবনচরিত অধ্যয়নই হোক আমাদের পাথেয়।

আরব বিশ্ব যখন পৌত্তলিকতার অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল, তখন মহান আল্লাহ রাসূল সা:-কে বিশ্বজগতের রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। এরপর বিশ্ববাসীকে মুক্তি ও শান্তির পথে আহ্বান জানান। সব ধরনের কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্যায়, অবিচার ও দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মানবসত্তার চিরমুক্তির বার্তা বহন করে এনেছিলেন তিনি। এরপর নবীজী সা: দীর্ঘ ২৩ বছর এ বার্তা প্রচার করে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব শেষে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

মহানবী সা:-এর আগে যেসব পয়গম্বর এসেছিলেন, তাঁরা এসেছিলেন বিশেষ বিশেষ গোত্র কিংবা অঞ্চলের জন্য। কিন্তু রাসূল সা: এসেছিলেন মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত বার্তা পৃথিবীর সব মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।

মানবসমাজকে সর্বকালের জন্য প্রেরণা দিতে এবং সত্যে উৎসাহিত করতে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক। পৃথিবীর কোনো উপার্জন তিনি কামনা করেননি, পার্থিব প্রতিষ্ঠা তিনি গ্রহণ করেননি, সম্মানের অহমিকার প্রয়োজন তাঁর ছিল না। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তথা বিবদমানতা দূর করা, আল্লাহর অংশীদারিত্বে অকল্যাণকর সাধন পদ্ধতি থেকে মানুষকে সরিয়ে আনা, মানুষকে কল্যাণব্রতী হতে উদ্বুদ্ধ করা, পার্থিব জীবনকে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় আনা, একই সাথে পারলৌকিক জীবনের স্বস্তি কামনা করা।

ছোটবেলায় লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত একজন অক্ষরজ্ঞাহীন ও এতিম মানুষের জীবন যে কত বৈচিত্র্যপূর্ণ হতে পারে, নবীজী সা:-এর জীবনই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি একাধারে সংসারী, ব্যবসায়ী, সেবক, ধর্মপ্রচারক, প্রাজ্ঞ শিক্ষক, সমাজ-সংস্কারক, ক‚টনীতিবিদ, বিচারক, সেনানায়ক ও রাষ্ট্রনায়ক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সাফল্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এক কথায় বলতে গেলে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক পরিত্রাণে তিনি এসেছিলেন এবং তাঁর সেই মিশন তিনি অত্যন্ত সুন্দর সুচারুভাবে সফল করে গেছেন; কারণ স্বয়ং আল্লাহ ফেরেশতা জিব্রাইল আ:-এর মাধ্যমে তাঁকে শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষিত করেছিলেন। এ জন্য মহানবী সা: ছিলেন জ্ঞানের আঁধার।

ন্যায়নিষ্ঠা, সততা ও সত্যবাদিতার জন্য হজরত মুহাম্মদ সা: নবুয়ত প্রাপ্তির আগেই ‘আল-আমিন’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক গুণাবলি হিসেবে তাঁর এসব সদগুণ সব কালে, সব দেশেই স্বীকৃত। শুধু তা-ই নয়, তাঁর মধ্যে সম্মিলন ঘটেছিল করুণা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, দানশীলতা, শান্তিবাদিতার মতো মানবিক গুণাবলির। আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি কর্মময়তাও ছিল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা প্রিয়নবীকে স্পর্শ করেনি। এমন কোনো অনুভূতি নেই, যা তিনি অনুভব করেননি। কী ব্যবহারিক, কী আধ্যাত্মিক, কী ইহলৌকিক, কী পারলৌকিক সব কিছুই তাঁর জীবন ও সাধনা ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। ফলে তাঁর জীবনাদর্শ সর্বকালের সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। জীবন পথের আলোর মশাল ও দিকনির্দেশনাস্বরূপ। পবিত্র কুরআনে চল্লিশেরও অধিকবার নবীজি সা:-কে অনুসরণের জন্য বলা হয়েছে। মহানবী সা:-কে বলা হয়েছে ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বা মানব চরিত্রের সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে। সূরা আহজাবের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনের মধ্যেই রয়েছে অনুপম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রত্যাশা করে এবং মহান প্রভু আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে। এ জন্য রাসূলের সা:-পরিপূর্ণ, নিখুঁত অনুসরণের জন্য সিরাত অধ্যয়নের গুরুত্ব অনস্বীকার্য; কারণ রাসূল সা:-এর সিরাত হলো ইসলামের সব বিষয়ের সত্যাসত্যের অন্যতম মানদণ্ড। পবিত্র কুরআন শরিফ অনুধাবনের অন্যতম সহায়ক হলো সিরাত চর্চা করা। জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল আল কুরআন। মহানবী সা:-কে তাই বলা হয় কুরআনের প্রতিচ্ছবি। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা:-কে রাসূল সা:-এর চরিত্র সম্পর্কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘পবিত্র কুরআনই রাসূল সা:-এর চরিত্র’। এর মর্মার্থ হচ্ছে পবিত্র কুরআনে উত্তম চরিত্র ও মহান নৈতিকতার যে বৈশিষ্ট্য প্রদর্শিত হয়েছে, রাসূল সা:-এর মধ্যে সবই বিদ্যমান ছিল। তাই তাঁর অতুলনীয় চরিত্র মাধুর্য বিশ্বমানবের জন্য অনুকরণীয়। এ জন্য মহান আল্লাহ কুরআন মজিদে ঘোষণা করেছেন, ‘রাসূল সা: তোমাদের যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলেন, তা থেকে বিরত থাকো।’ (সূরা হাশর, আয়াত ৭) আসলে রাসূল সা:-এর জীবনী হলো কুরআনের আমলী রূপরেখা।

সিরাত অধ্যয়ন রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসারও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাসূল সা:-এর এই ভালোবাসাকে আমাদের ওপর আবশ্যক করে দিয়েছেন। সূরা আলে ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তা হলে আমার রাসূল সা:-কে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: নিজেই বলেছেন, সেই আল্লাহর শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতামাতা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক প্রিয় না হই। (সহিহ বুখারি, হাদিস-১৪) আর রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা হৃদয়ে রোপণ করতে হলে সিরাত অধ্যয়নের বিকল্প নেই।

ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ: বলেন, যেহেতু দুনিয়া ও আখেরাতের একমাত্র সফলতা আর সব সৌভাগ্য রাসূল সা:-এর পদাঙ্ক অনুসরণের মধ্যে নিহিত; কাজেই প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত নিজের জীবনের কল্যাণ, সফলতা ও সৌভাগ্য অর্জনের জন্য সে যেন নবীজীর সা: সিরাত অধ্যয়ন করে। এতে সে রাসূল সা:-কে চিনতে পারবে এবং তার সত্যিকার অনুসারী তথা নবীপ্রেমিক হতে পারবে।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মহামহিম আল্লাহর যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তাঁর আখলাক বা চরিত্র মাধুর্যও নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠতম। আগেই বলেছি মহান রবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই রাসূল সা: প্রশিক্ষিত হন।

পৃথিবীর মানুষকে মহান আল্লাহ কুরআন মজিদের মাধ্যমে নবীজী সা:-এর সর্বোত্তম গুণের কথাই জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতুল্লিল আলামিন।’ অর্থাৎ (হে নবী) আমি আপনাকে বিশ্বজাহানের জন্য রহমত বা করুণার নিদর্শন হিসেবে পাঠিয়েছি। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)

সূরা কলমের ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকুন আজিম’, অর্থাৎ হে রাসূল, আপনি সর্বোত্তম চারিত্রিক মাধুর্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছেন। সূরা আহজাবের ৪৬ নম্বর আয়াতে নবীজী সা:-কে বলা হয়েছে ‘সিরাজাম মুনিরা’ অর্থাৎ আলোকবর্তিকারূপে পাঠানো হয়েছে। মহানবী সা: নিজেই বলেছেন, ‘ইন্নামা বুইসতু মুআল্লিমুন’, অর্থাৎ আমাকে পাঠানো হয়েছে মানবতার শিক্ষকরূপে। ইসলামে নারীর মর্যাদা সুউচ্চ। জাহিলি যুগে নারীদের মানুষ বলেই গণ্য করা হতো না। কন্যাসন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হতো। মহানবী সা: এই কুপ্রথার অবসান ঘটান নারীকে অপরিসীম মর্যাদা দেয়ার মাধ্যমে। নারীকে মর্যাদা দান শুধু কথায় নয়, কেমন করে তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে হয়, তা মহানবী সা: তাঁর নিজের জীবনে দেখিয়ে গেছেন। শিশুদেরও তিনি খুব ভালোবাসতেন। তিনি বলেছেন, ‘যারা ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না; তারা আমার আদর্শের অনুসারী নয়।’

পিতামাতার প্রতি সন্তান ও সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্যের কথা তিনি বলে গেছেন। শ্রমিকের সাথে, অধীনস্থ কাজের লোকের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে, তা তিনি বলে গেছেন। মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদ নেই এ কথা মহানবী সা:-ই উচ্চারণ করে গেছেন।

সিরাত গ্রন্থ ও পাঠ্যপুস্তকে মহানবী সা: প্রসঙ্গে
আমাদের ছোটবেলায় বা তারও আগে পাঠ্যপুস্তকে মহানবী সা:-এর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা থাকতে দেখেছি। আদর্শ জীবন গড়তে এসব লেখা শিক্ষার্থীদের উপকারে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে মহানবী সা:-এর জীবনী খুব একটা দেখা যায় না। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রজন্মকে গড়ে তুলতে মহানবী সা:-এর জীবনচর্চা অপরিহার্য। এ নিয়ে বেশি বেশি লেখা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। সেটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের পাঠ্যপুস্তকেই।

গত দেড় হাজার বছরে দেশ, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে অজস্র সাহিত্যিক, সমাজনেতা, শিক্ষাবিদ, সমরবিদ, গবেষক, রাষ্ট্রনায়ক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এমনকি বিরুদ্ধচারীরাও মহানবী সা:-এর জীবনী লিখেছেন। একক ব্যক্তি হিসেবে এত বেশিসংখ্যক জীবনী অন্য কারোর ওপর লেখা হয়নি।

আরবি, উর্দু, ফারসি ও ইংরেজি ভাষাতেই রাসূল সা:-এর জীবনী গ্রন্থ বেশি লেখা হয়েছে। বাংলা ভাষায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী যে খুব লেখা হয়েছে, তা নয়। পাঠ্যপুস্তকে মহানবী সা:-কে নিয়ে তেমন প্রবন্ধ নিবন্ধ সংযোজিত না হলেও বর্তমানে মহানবী সা:-কে নিয়ে নানা বিষয়ে বাংলা ভাষায় একের পর এক গ্রন্থ রচিত হচ্ছে, এটি আশার কথা। ‘পয়াম্বর’ গ্রন্থের লেখক ইরানের বিখ্যাত পণ্ডিত জয়নুল আবেদিন রাহনুমা বলেন, ‘লেখক বা সাহিত্যিক যারা, তারা অন্তত একবার হলেও রাসূল সা:-কে নিয়ে লেখা উচিত। একজন লেখক বা সাহিত্যিক তার সাহিত্যচর্চা ও রচনায় যদি মহান রাসূল সা:-এর জীবনকে অবলম্বন করে লেখেন, তা হলে তিনি একই সাথে পুণ্যবান ও সফলকাম সাহিত্যিক বা লেখক হবেন বলে আমি মনে করি।’

আগেই বলেছি মহানবী সা:-কে জানার প্রথম উৎস হলো কুরআন। কুরআনজুড়ে প্রসঙ্গক্রমে নবীজীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির উল্লেখ আছে। প্রাচীন সিরাত গ্রন্থের কথা উঠলে সিরাতে ইবনে ইসহাক এবং ‘সিরাত ইবনে হিশাম’-এর নাম আসে। এ গ্রন্থ বাংলায়ও প্রকাশিত হয়েছে। অসংখ্য সংস্করণও বেরিয়েছে। আধুনিক যুগে আরবি ভাষার অন্যতম সিরাত গ্রন্থ হলো নাসিরুদ্দিন আলবানি রচিত ‘সাহিহ আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা’। ভারতের বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত আবুল হাসান আল নদভি রচিত আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যা যা ‘নবীয়ে রহমত’ নামে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থটি খুবই জনপ্রিয়। ১৯৪২ সালে এটি লেখা হয়।

আবেগময় ভাষায় মহানবীর জীবনকে তিনি পাঠকের কাছে উপস্থিত করেছেন। তেমনি ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মওলানা আকরম খাঁর ‘মোস্তফাচরিত’। মওলানা আবদুল খালেকের ‘ছাইয়েদুল মুরছালিনও’ উল্লেখযোগ্য সিরতি গ্রন্থ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘শেষ নবীর সন্ধানে’ নামে একটি বই আছে। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মরু ভাস্কর’, ইয়াকুব আলী চৌধুরীর ‘মানব মুকুট ও ‘নূরনবী’ নামে গ্রন্থ, কবিতার বই কবি নজরুল ইসলামের ‘মরু ভাস্কর’ ও কবি মোজাম্মেল হকের হজরত মুহাম্মদ, কাজী আবদুল ওদুদের ‘হজরত মুহাম্মদ ও ইসলাম’ ড. ওসমান গণির ‘মহানবী’, উর্দুতে লেখা আল্লামা শিবলী নোমানীর ‘সিরাতুন্নবী’ গ্রন্থও বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। তেমনি শেখ আবদুর রহীমের ‘হজরত মুহম্মদ সা:-এর জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’, ডা: সৈয়দ আবুল হোসেন রচিত ‘মোসলেম পতাকা’, শেখ মোহাম্মদ জমীর উদ্দীনের ‘মাসুম মোস্তফা সা:, মোবিনুদ্দীন আহমদ জাহাঙ্গীর নগরীর ‘নবীশ্রেষ্ঠ’, খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁর ‘শেষ নবী,’ মুহাম্মদ বরকতুল্লাহর ‘নবী গৃহ সংবাদ’, শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসেনের ‘হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা: সমকালীন পরিবেশ ও জীবন, সৈয়দ আলী আহসানের ‘মহানবী’, কবি আল মাহমুদের ‘মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:’ কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:’, মোস্তফা জামান আব্বাসীর ‘মুহম্মদের নাম’, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদার ‘মহানবী’ বাংলা সাহিত্যিক সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক সময়ে কয়েকজন নারীর লেখা গ্রন্থ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ‘ক্যারেন আর্মস্ট্রং’ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ‘মুহাম্মদ : অ্যা বায়োগ্রাফি অব প্রফেট’ নামে তার গ্রন্থটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘মুহাম্মদ : এ প্রফেট ফর আওয়ার টাইম’ গ্রন্থটিও খুব সমৃদ্ধ।

জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যানেমারি শিমেলের ‘এ-মুহাম্মদ ইন হিজ মেসেঞ্জার : দ্য ভ্যানারেশন অব দ্য প্রফেট ইন ইসলামিক পিইটি’ এবং ব্রিটিশ লেখক নেফলি হাজলেটন রচিত ‘দ্য ফার্স্ট মুসলিম : দ্য স্টোরি অব মুহাম্মদ’ গ্রন্থ দু’টিও জনপ্রিয়। বাংলা ভাষায় সারা তাইফুরের ‘স্বর্গের জ্যোতি, খাদিজা আক্তারের ‘তিনি চাঁদের চেয়েও সুন্দর’ মাসুদা সুলতানা রুমির ‘আমি বারোমাস তোমায় ভালোবাসি’। মজিদা রিফার ‘মহানবী’ গ্রন্থগুলোও আলোচিত।

ইংরেজি ভাষায় রচিত সিরাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মার্টিন লিংগসের ‘মুহাম্মদ : হিজ লাইফ বেজড অন আরলিয়েস্ট সোর্সেস’ জামাল বাহারির ‘মুহাম্মদ এ ব্লেসিং ফর ম্যানকাইন্ড’, ওয়াহিদ উদ্দিন খানের ‘প্রফেট অব রেভ্যুলেশন’, হোসাইন হায়কলের ‘মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সা:’, আদিল সালাহির ‘মুহাম্মদ : ম্যান অ্যান্ড প্রফেট’, ফেতুল্লাহ গুলেনের ‘দ্য মেসেঞ্জার অব গড : মুহাম্মদ’ তারিখ রামাদানের দ্যা মেসেঞ্জার : ‘দ্যা মিনিং অব দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ’ উল্লেখযোগ্য।

ইসলামের সংস্পর্শে আঁধার বিলীন হয়ে যায়। আরশে আজিমের মহিমান্বিত রওশন থেকে ইসলাম উৎসারিত হয়েছে। জাহেলিয়াতকে পরাজিত করেছে। আত্মাকে করেছে প্রশান্ত, চরিত্রকে করেছে ‘নিষ্কলুষ’। জীবনকে করেছে সার্থক এবং মানবতাকে দিয়েছে মুক্তি। মহানবী সা:-এর জীবনীই এই ইসলামের বাস্তব প্রতীক। আদর্শ হিসেবে ইসলাম যা, বাস্তবতার নিরিখে রাসূলে করিম সা:-এর জীবন ঠিক তাই। ইসলামী আদর্শের বাস্তব রূপ দেখতে হলে রাসূল সা:-এর জীবন সামনে প্রোজ্জ্বল করে রাখতে হবে; অন্যথায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী অধ্যয়ন বা শ্রবণ অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। শুধু ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বা খণ্ডিত আকারে নবীজী সা:-এর জীবনপাঠ নয়, মহানবী সা:-এর অখণ্ড জীবনাদর্শ অধ্যয়নই আমাদের কল্যাণ বয়ে আনবে।

স্বয়ং আল্লাহ ও ফেরেশতারা বিশ্বনবী সা:-এর জন্য রহমতের দোয়া করেন। সূরা আহজাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নবীর ওপর রহমত নাজিল করেন এবং ফেরশতারা তাঁর জন্য রহমতের দোয়া করেন। সুতরাং হে মুমিনগণ! তোমরাও তার প্রতি দরুদ পড়ো এবং অধিক পরিমাণে সালাম পাঠাও।’ তাই ১২ রবিউল আউয়ালের পুণ্যময় দিনকে সামনে রেখে নবীজী সা:-এর শানে পেশ করছি হাজারো দরুদ ও সালাম।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব।


আরো সংবাদ



premium cement