১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থা

মাস্টার মুহিবুল্লাহ - ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক সময়ে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের’ চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহ খুনের পর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউমান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে।

আমাদের দেশের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। মুহিবুল্লাহকে কেন হত্যা করা হলো? কারা হত্যা করতে পারে? উদ্দেশ্য কী? এর আগেও আরো দু’জন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। অপরাধী ধরা পড়েনি বা শাস্তি হয়নি। এ ছাড়া অস্ত্র বেচাকেনা, মাদক কারবারি, ডাকাতি, নারী পাচার, আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, হ্নীলা ও টেকনাফের গহিন জঙ্গলে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, কাক্সিক্ষত অর্থ না পেলে হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ২২৬ জনের বেশি রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া মাদক ও অস্ত্র বহনের দায়ে দুই হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে এক হাজার ২৯৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

২০২০ সালে টেকনাফের জীমনখালী থেকে এক দিনমজুর ও দুই কৃষককে তুলে নিয়ে যায় এক সশস্ত্র গ্রুপ। পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। জনপ্রতি তিন লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে দু’জন কৃষক ফিরে আসেন। তবে দিনমজুরের পরিবার টাকা দিতে না পারায় তাকে হত্যা করা হয়। পরে মাটিচাপা লাশ মেলে জীমনখালীর পাহাড়ে। কেউ এ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস দেখান না। প্রতিবাদ করলে নিশ্চিত মৃত্যু। একবার একজনের শরীর ও মাথা পাহাড়ের দুই স্থান থেকে উদ্ধার করা হয় (বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ২ অক্টোবর ২০২১)। চলতি সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত তিন বাংলাদেশী নির্মাণশ্রমিককে কক্সবাজারের টেকনাফের নয়াপাড়া মোছনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করেন র‌্যাব-১৫-এর সদস্যরা। সন্ত্রাসীরা তিন নির্মাণশ্রমিককে কাজ দেয়ার কথা বলে অপহরণ করে পাহাড়ের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটকে রাখে। সন্ত্রাসীরা তাদের মারধর করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে জীবন নাশেরও হুমকি দেয়া হয় (ইত্তেফাক, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১)। অপহৃত তিন নির্মাণশ্রমিক উদ্ধার হলেও সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে চা-বিস্কুট, তরকারি ও মনোহারি মালের ছোটখাটো যেসব দোকান আছে, প্রতিটি দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পগুলোর বাইরে-ভেতরে সর্বদা আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় জীবন কাটছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের। নেতাদের (মাঝি) নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। আগামীতেও সহিংসতা ও নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটবে না, এমন নিশ্চয়তা কে দেবে? রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারকে এ মুহূর্তে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বর্ডার সিল করতে হবে। অভিযান পরিচালনা ও নিরাপত্তা জোরদার করে ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাসীমুক্ত করতে হবে। এর আগে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করা অত্যন্ত জরুরি।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা এতটাই দুর্বল যে, ঘাতকরা সেখানে ঢুকে, ঠাণ্ডা মাথায় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে সহজেই বেরিয়ে যায়। তারা এতটা বেপরোয়া ছিল যে, মুখোশ পরারও গরজ অনুভব করেনি। নিহত মুহিবুল্লাহর অনুজ থানায় যে মামলাটি করেছেন; সেখানে কোনো আসামির নাম পর্যন্ত উল্লেখ করার সাহস করেননি; শুধু লিখেছেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি। এতে অপরাধী চক্রের দাপটের আঁচ পাওয়া যায়। বেশ কিছু দিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মুহিবুল্লাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তার পরিবারসহ ৯ রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, ‘কর্তৃপক্ষ মুহিবুল্লাহর উদ্বেগের বিষয়টি আমলে নেয়নি, তদন্তও করেনি এবং সুরক্ষাও দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শিবিরে অনেক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করেছে, কিন্তু তারা শরণার্থীদের রক্ষার পরিবর্তে দমন ও নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত’ (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০২১)। এ ছাড়া রাজধানীর একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে মুহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা ও মেয়ে শামিমা বলেছেন, ‘আমরা এ হত্যার বিচার চাই না। কার কাছে বিচার চাইব? শরণার্থী শিবিরে আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। আমরা কেবল আমাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা চাই। আমাদের গৃহকর্তার (মুহিবুল্লাহ) স্বপ্ন পূর্ণ হোক- এটিই কামনা করি’ (ডেইলি স্টার, ২ অক্টোবর ২০২১)।

রোহিঙ্গাদের আরাকানে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুহিবুল্লাহ। এ দাবি জেনেভা ও ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দেখা করে বলেছিলেন, ‘আমরা (রোহিঙ্গারা) দ্রæত মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। এ বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাই।’ ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাস্তুচ্যুত হয়ে মংডু থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। তার পরিবারের সাক্ষাৎকারে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, এগুলো হালকাভাবে না নিয়ে গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে উপলব্ধি করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে নানা গ্রুপ সক্রিয়। তাদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচিও আলাদা। একটি গ্রুপ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী। আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে জীবন, সম্পত্তি ও নাগরিক অধিকার ফিরে পাওয়ার আশ্বাস পেলে তারা আরাকানে বাপ-দাদার বাস্তুভিটেতে প্রত্যাবর্তনে সম্মত। বাংলাদেশ ক্যাম্প ছেড়ে রাখাইনের ক্যাম্পে তারা থাকতে চায় না। অনেকে মনে করছেন, মুহিবুল্লাহর হত্যা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় একটি বড় আঘাত। দ্বিতীয় গ্রুপ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আরাকান জয় করতে চায়। এ গ্রুপের একটি উপদল মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। তাদের ‘আত্মরক্ষামূলক’ হামলার মূল টার্গেট মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী’। তাদের প্রধান দাবি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও মর্যাদা দিতে হবে। তাদের গ্রুপ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত নয় বলে দাবি করে থাকে। সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসীও নয় তারা। বিশ্বের কোনো সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সাথেও সম্পর্ক নেই। এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির মানুষকে এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে (প্রফেসর মো: জাকির হোসেন, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ২ অক্টোবর ২০২১)।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। রাখাইনে অধিকার আদায় করতে গেলে ভেতরের জনগোষ্ঠীকে উদ্দীপিত ও সম্পৃক্ত করা ছাড়া হবে না। কিন্তু সে সুযোগ এখন আর নেই। ভয়াবহ নিপীড়নে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। যারা আছেন তারা এত বড় ঝুঁকি নিতে চাইবেন কি না সন্দেহ আছে। আর নিলেও নেমে আসবে পাহাড়সম নির্যাতন। পরিশেষে পৈতৃক সম্পদ ও বাস্তুভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু শিবিরের অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে। রাখাইনের আশপাশে বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশ নেই। এ ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতা বা সমর্থন পাওয়ার আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। সেক্ষেত্রে এই উপদল বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের চেষ্টা চালাবে। ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এ পথে হাঁটতে চাইবে না। রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদকৃত বাস্তুভিটা ও কৃষিজমি মিয়ানমার সরকার জবরদখল করে চীনের সহযোগিতায় বিলিয়ন ডলার সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে। রাখাইনে ভারতের স্বার্থও জড়িত। বিনিয়োগও বিপুল অঙ্কের। কিছু দিন আগে মিয়ানমারের কয়েকটি সামরিক বিমান সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের আকাশে চক্কর দেয় বেশ ক’বার। মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে আর কিছু করা হয়নি। আরাকানে কোনো সশস্ত্র বা নিরস্ত্র গ্রুপকে বাংলাদেশ সহায়তা করতে পারে না এবং করবেও না। ভারত ও চীনের আর্থরাজনৈতিক টানাপড়েনের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান।

যারা কোনো অবস্থাতেই আরাকানে ফিরে যেতে আগ্রহী নন, তারা তৃতীয় গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। তারা মনে করেন আরাকানের চেয়ে বাংলাদেশ অধিকতর নিরাপদ। ধর্ম ও কৃষ্টির বন্ধন এক ও অভিন্ন। আশ্রয় শিবিরে কিছু অসুবিধা থাকলেও মগবাহিনীর লুণ্ঠন, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, নারী অপহরণ ও বলপ্রয়োগে শ্রম আদায়ের আতঙ্ক থেকে তারা মুক্ত। তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গারা নিয়মিত রেশন পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া এক শ’ বছর আগে থেকে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর কিছু আত্মীয়স্বজন হ্নীলা, টেকনাফ ও শাহপরী দ্বীপে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। তারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত। ক্যাম্পে আশ্রিতদের সাথে তাদের একটি বন্ধন থাকায় তারা বাংলাদেশকে উত্তম আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করেন। বিশ্বব্যাংক ও কিছু এনজিও চায় রোহিঙ্গারা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে থাকুক। এ দেশের নাগরিকদের মতো রোহিঙ্গাদেরও মৌলিক অধিকার দেয়া হোক। এমন দাবি তারা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করে। বাংলাদেশ এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের উপর সবিশেষ জোর দেয়।

চতুর্থ গ্রুপ হলো সামরিক জান্তার বৃত্তিভোগী চর। তাদের মধ্যে অনেকের উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্প থেকে নিয়মিতভাবে রাখাইনে যাতায়াতের রেকর্ড আছে। ক্যাম্পের বাইরের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রতি মুহূর্তে তাদের মাধ্যমে জান্তা কর্তৃপক্ষ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের সব মোবাইল থেকে আরাকানে কথা বলা সহজ। শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা ও হত্যা জিইয়ে রাখতে পারলে বর্মি জান্তার জন্য বহির্বিশ্বে প্রপাগান্ডা চালিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার সুযোগ হাতে আসবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ভাবমর্যদাও ক্ষুণ্ন হবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ করার বা নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো নেতা যদি মাথা তোলে, তাকে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা আছে মিয়ানমার সরকারের। উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বশূন্য করা। ক্যাম্পে বসবাসকারীদের সাথে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে। আন্তর্জাতিক আদালত ও জাতিসঙ্ঘ গঠিত স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী মিশনের তদন্ত কমিটির কাছে রোহিঙ্গা গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের তথ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মুহিবুল্লাহ। এতে মিয়ানমার সরকারকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহসহ আরো যেসব নেতা নিহত হয়েছেন এর পেছনে কারা সক্রিয়; তা বের করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার।

দিনের বেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এনজিও কর্মীদের তৎপরতায় ক্যাম্পগুলো সরব থাকে। সন্ধ্যা নামার পর দুর্বৃত্ত ও অপরাধী চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রাণের ভয়ে ক্যাম্পবাসী মুখ খুলে না। ৫ বা ১০ শতাংশ অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও বাকি রোহিঙ্গারা নিরপরাধ, শান্তিপ্রিয় ও নিরীহ। ১৫টির মতো সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয়। ক্যাম্পগুলোর চার দিকে কাঁটাতারের বেষ্টনী থাকলেও ফাঁকফোকর দিয়ে যে কেউ রাতে ঢুকতে ও বের হতে পারে। সিসি ক্যামেরার পরিধি সম্প্রসারণ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারি বাড়ালে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ক্যাম্পের বাইরে-ভেতরে শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা গেলে দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনা সহজ হবে। গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া এত বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর কার্যকর মনিটরিং অসম্ভব।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব, নৈতিকতার ঘাটতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষার কমতি, নেতৃত্ব না মানার মানসিকতা এবং বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমারের জান্তার নিগ্রহ ও উৎপীড়নে মনস্তাত্তি¡ক চাপজনিত অস্থিরতা ও প্রতিশোধপরায়ণতা রোহিঙ্গাদের জীবনধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অবিশ্বাস্য ধরনের গ্রুপিং রোহিঙ্গাদের দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ করা কঠিন। শরণার্থী শিবিরে সহিংস অস্থিরতা ও অস্ত্রের ঝনঝনানি উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয়দের ভীতিবিহ্বল করে তুলছে। তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু স্থানীয় অধিবাসী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।

রাখাইনে নাগরিক অধিকার দিয়ে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনই হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার তাগিদ দেয়ার পরও আশাব্যঞ্জক সাড়া না পাওয়ার কথা তুলে ধরে ৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে, যারা রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে বরাবরই ভালো সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু সংস্থার কর্মকাণ্ডে মনে হয়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে তাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে তাদের খুব বেশি আগ্রহ নেই। তারা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী করে রাখতেই বেশি আগ্রহী। মনে হয় রিফিউজি পালাটা একটি ব্যবসা কোনো কোনো সংস্থার জন্য। রিফিউজি না থাকলে তাদের চাকরিই থাকবে না। এটি হলো আসল কথা। অনেক প্রস্তাব আসে রোহিঙ্গাদের জন্য, এখানে অনেক কিছু করে দিতে চায়। আমি সোজা বলে দিই, যান মিয়ানমারে, ওখানে ঘর করেন, স্কুল করেন, এখানে করা লাগবে না’ (ডেইলি স্টার, ৫ অক্টোবর ২০২১)। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে। স্মর্তব্য যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ করে চীন ও ভারতের জোরালো ভূমিকা ছাড়া এ সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। মিয়ানমারকে অবশ্যই নিজের নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা আদায়ের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক ভূমিকা জোরদার করতে হবে। এর বিকল্প নেই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement