২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ভারতের গোসসা, আমেরিকার অসহায়ত্ব

- ছবি : সংগৃহীত

কোনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী যেমন একজন প্রধানমন্ত্রী কোনো প্রিন্টেড পত্রিকায় নিজের রাষ্ট্র-সরকারের মনোভাব-অনুভব নিয়ে কলাম লিখবেন তা সাধারণত আমরা দেখতে অভ্যস্ত নই। তবে তাই বলে তিনি লিখতে পারবেন না, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়; বরং এমন সরাসরি লেখার ভেতর দিয়ে একধরনের স্বচ্ছতা আর অনেককে বা অনেক ইস্যুকে কিভাবে তিনি দেখেন, দেখতে চান তা নিয়ে আর কোনো লুকোছাপা গোপন ডিলিং নয়, এর বদলে ইস্যুটাকে ওপেনহ্যান্ড ডিলিং করার সাহস দেখানো যায়।

তেমনি একটি কাজ করেছেন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি আমেরিকার ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় মতামত কলাম লিখেছেন ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১। বলাবাহুল্য, তাতে প্রসঙ্গ হলো, এ সময়ের মুখ্য ইস্যু আফগানিস্তান এবং ২০ বছরের দখলমুক্তিতে একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পাকিস্তানির ফিলিং ও মূল্যায়ন।

সেকালের পাকিস্তান আমলের এক পশতুন এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ার একরামুল্লাহ খান; এমন বাবার অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট ছেলে ইমরান খান। প্রচলিত অর্থে ইমরান রাজনীতিবিদ নন, মূলত আন্তর্জাতিক লেভেলের ক্রিকেট প্লেয়ার বা ক্যাপ্টেন। সেখান থেকে রিটায়ারমেন্টের পরে যেমনটি হয় আমরা দেখি, তিনি জীবন উপভোগকারী; কেউ কেউ যার ভেতর প্লেবয় ইমেজও খুঁজে পান। এর পরও তিনি সরাসরি রাজনীতিক হতে যাননি, বরং তার আগে সামাজিক চ্যারিটি বা দাতব্যমূলক কাজে নেমে গিয়েছিলেন; একেবারে এক ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার কাজে। এরই মধ্যে একবার হঠাৎ তিনি ১৯৯৬ সালে এক নয়া রাজনীতিক দল খুলে বসেন, নাম তেহরিক-ই-ইনসাফ। বাংলা করলে অর্থ হয় ‘ইনসাফের জন্য আন্দোলন’। দলের সংক্ষিপ্ত নাম পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ)।

আফগানিস্তান থেকে ২০ বছরের দখলদারিত্ব সম্প্রতি শেষ করেছে আমেরিকা। তবে ওই ২০ বছরেরও আগের (গত শতকে) ২০ বছরের ইতিহাসও কম লম্বা নয়। বলা যায় ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিলে ইরান বিপ্লব ছিল এর সুইচ-অন বা স্টার্টিং ঘটনা। ইরান নয়া ‘ইসলামী রিপাবলিক’ বলে নিজেকে ঘোষণা করেছিল সেই দিন। ইরানের ওই ‘খোমেনি বিপ্লবের’ সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হলো এই প্রথম ১৯০১ সাল থেকে ইরানের তেল চুষে খাওয়া ব্রিটিশ কোম্পানি আর পরে (১৯৫৩ সাল থেকে) আমেরিকান নেতৃত্বে ব্রিটেনসহ পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোর যৌথ লুটপাট বন্ধ হয়ে যায়। ইরান এখান থেকে তাদের গুটিয়ে চলে যাওয়ার শেষ দিন ঘোষণা করতে পেরেছিল। কিন্তু তাতে আরেক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয় ভীত সোভিয়েত ইউনিয়নের মনে। তার দুশ্চিন্তা হলো সেন্ট্রাল এশিয়া নিয়ে যা এখন আলাদা পাঁচ দেশ যাদের নামের শেষে ‘স্তান’ আছে যেমন কাজাখস্তান, কিরঘিজিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান; এরা। গত (১৭২১-১৯১৭) জার-সম্রাটের আমল থেকে সেন্ট্রাল এশিয়া রাশিয়ার দখলে আছে আবার পরেও স্টালিনের আমল থেকে এদের নিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়া হয়েছিল। মূল কারণ সেন্ট্রাল এশিয়ার জনগোষ্ঠী আব্বাসীয় আমল (৭৫০-১২৫৮) থেকে তাদের দখলে মুসলমান বা ইসলাম অনুসারী হয়েছিল। ফলে ইরানের খোমেনি বিপ্লবের পরে পড়শি এরা না প্রভাবে পড়ে যায় আর তাতে না তারা তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বের হয়ে স্বাধীন হয়ে যায়। এই ভয়ে কমিউনিস্ট সোভিয়েতরা ইরান আর সেন্ট্রাল এশিয়ার মাঝখানে এক প্রাচীরতুল্য বাফার স্টেট হিসেবে অবস্থানে থাকা আফগানিস্তানকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ সামরিকভাবে দখলে নিয়ে নিয়েছিলেন ওই বছরই, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত ঘটে যায়।

সেটি স্নায়ুযুদ্ধের আমল; ফলে সোভিয়েত ‘আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে আমেরিকা পাকিস্তানের ওপর ভর করে, পাকিস্তানকে ‘আমেরিকান স্বার্থে ইসলামী’ করে সাজিয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদিন’ আন্দোলন শুরু করেছিল। এতে পাকিস্তান নিজের জন্য আর দেশ-রাষ্ট্র থাকেনি। পাকিস্তান হয়ে যায় এক দিকে সিআইএর ঘাঁটি ও তৎপরতা; অন্য দিকে আফগান রিফুইজি আর আফগান মুজাহিদিন যোদ্ধাদের সুরক্ষার দেশ যাতে তারা সোভিয়েত উৎখাতে লড়তে পারে- এমনই এক লঞ্চিং প্যাড-ভ‚মি। শেষে ১৯৮৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে হার স্বীকার করে সোভিয়েত বাহিনী চোখের জলে কাবুল ত্যাগ করেছিল, ঠিক যেমন গত ১৫ আগস্ট ২০২১ আমেরিকা কাবুল ত্যাগ করেছে।

ফিরে আসি একালে। ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’ ইমরানের ওই মতামত-কলামের তাৎপর্য হলো তিনি আমেরিকাসহ পশ্চিমা মনের ওপর ঠিকমতো সওয়ার হতে পেরেছেন সেখানে। তিনি দেখিয়েছেন, আমেরিকা কিভাবে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে একেবারে নিজস্ব স্বার্থে বারবার পাকিস্তানকে ব্যবহার করে গেছে। তবে সেটি বলার চেয়ে ‘ব্যবহৃত হতে পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে’ বলা সঠিক হবে। পশ্চিমা মন পড়ে তাদের মনের ভাষায় কথা বলাতে ইমরানের এ লেখা আকর্ষণীয় হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের প্রপাগান্ডাসহ পশ্চিমা মন যারা ওয়ার অন টেররের প্রপাগান্ডায় ‘মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদ’- এ ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠায় ২০ বছর ধরে কসরত করে গেছেন; এদের মুখের ওপর এক কড়া জবাব হিসেবে। কারণ পাকিস্তান শুধু এই শতকের ২০ বছর নয়, গত শতকেরও ২০ বছর ধরে আমেরিকার স্বার্থে বলি হয়ে গেছে বারবার। যেন আমেরিকা নয় (তার স্বার্থ বা নীতি নয়), পাকিস্তানই ‘সন্ত্রাসবাদ’ আবিষ্কার করেছে আর চর্চা করে গেছে।

জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানে সামরিক ক্ষমতা দখল করেছিলেন ১৯৭৭ সাল থেকে। জিয়াউল হক, আমেরিকা তার ঘাড়ে সওয়ার হয়েই সোভিয়েত তাড়ানোর কৌশল হিসেবে ইসলাম প্রচার শুরু করেছিলেন। আর তাতেই পাকিস্তানকে আরো কথিত ইসলামী করে গড়ে তুলতে পুরনো পেনাল কোডের ২৯৫ ধারাকে নতুন করে ব্লাসফেমি আইন বলে একে প্রচারে আনা হয়েছিল। আর ওদিকে নতুন নতুন মাদরাসা খোলার জন্য অঢেল অর্থ দেয়ার এক কর্মসূচির পুরোটাই আমেরিকার ছিল সোভিয়েত তাড়ানোর কর্মসূচির অংশ। সৌদি ও কিছু বিশেষ পাকিস্তানি মাওলানার তত্ত্বাবধানে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। অথচ এখন মুসলমান মানেই জঙ্গি আর পাকিস্তান তাদের আঁতুরঘর যেন- এটিই আমেরিকান থিংকট্যাংকের প্রধান বয়ান ও অভিযোগ। আর এখান থেকেই ভারতের জঙ্গিবাদের বয়ানও শুরু হয়। বাংলাদেশেও এরা বলে, কথিত পশ্চাৎপদ বলে মুসলমানরা নাকি ব্লাসফেমি আইন চায়, মাদরাসাগুলো হলো জঙ্গি গড়ার আস্তানা প্রভৃতি প্রপাগান্ডা। ভারতকে সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ-বেøয়ার আর আমেরিকান থিংকট্যাংকের এই যে বয়ান, একেই ইমরান খান চ্যালেঞ্জ করেছেন, ওই লেখায়।

কেন এ সময়ে করতে গেলেন?
সাম্প্রতিককালে আফগান সেনা প্রত্যাহার-উত্তরকালে আমেরিকায় কংগ্রেসে এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে শুনানি চলেছিল। আমেরিকা লবিংয়ের দেশ, এ কাজ বৈধ। কারো কাছে থেকে কংগ্রেস সদস্যের কাছে লবিং করে দেবে বলে অর্থ নিতেও সমস্যা নেই। কেবল বিচার মন্ত্রণালয়ে রাখা একটি ফরম পূরণ করার সময় স্ব-উদ্যোগে আগাম তা উল্লেখ করে আসতে হবে। তবে এই লিখে স্বীকার করে নেয়া কোনোই অপরাধ নয়। তাই কোনো সমস্যা নেই। তবে ভবিষ্যতে এ কাজের ভেতরে অন্য কোনো আইনভঙ্গ করার বিষয় যুক্ত বলে প্রমাণিত হলে তখন সেই আইন ভঙ্গের কারণে এটি অপরাধ হতে পারে। এই কংগ্রেস বা সিনেটরদের লবিংয়ে ভারত খুবই শক্ত। ফলে তারা এই শুনানিতে পাকিস্তানের ওপর সব দায় চাপিয়ে বাইডেনকে মুক্ত করতে লেগে পড়েছে। আর এ কারণেই ইমরান নিজের হাতে ও নামে মতামত কলাম লিখেছেন।

তার ওই লেখায় প্রথম প্যারাটা এ রকম : ‘সাম্প্রতিককালের কংগ্রেসনাল শুনানি দেখে আমি আসলেই বিস্মিত হয়েছি। গত দিনগুলোতে (প্রায় ৪০ বছর, ইমরান কম করে কেবল চলতি শতকেরটা ধরে দুই দশক বলেছেন) আমেরিকার সহযোগী দেশ হিসেবে পাকিস্তানিরা আমেরিকার ওয়ার অন টেরর কর্মসূচিতে যে আত্মত্যাগ করেছে, এর কোনো উল্লেখ নেই দেখে বিস্মিত হয়েছি। অথচ এর বদলে আমরা দেখছি এই শুনানিতে আমেরিকার যেসব ক্ষতি হয়েছে, এর কারণে আমাদেরকে দায়ী করা হয়েছে।’

অথচ ‘আমি বারবার বলে এসেছি আফগানিস্তানে বিজয়-সম্ভব-নয় এটি এমন একটি যুদ্ধ। আফগানরা এমন এক লড়াকু জাতি, যারা কখনো নিজ ভ‚মিতে বিদেশী উপস্থিতি সহ্য করেনি। এমনকি সেই বিদেশী পাকিস্তান হলেও এই বাস্তবতা বদল হবে না।’ এরপর ইমরান ওই সব বিগত বছর পাকিস্তানের কী কী ক্ষতি হয়েছে, আত্মত্যাগ করেছে, এসবের পরিসংখ্যানগত লম্বা বর্ণনা সাথে জুড়ে দেন।

এসবের বর্ণনাযুক্ত বয়ান পাঠকরা ওই মতামত থেকে নিয়ে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু প্রথম এ ব্যাপারটি আমার নজরে এসেছিল পাকিস্তানের ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে। আমার হাতে আসে ইমরানের দলের ঘোষিত মেনিফেস্টো, যা সম্ভবত ২০১৬ সালে তৈরি করা; কারণ তাতে ওবামা আমলে ব্যাপক ড্রোন বোমা হামলা ঘটার পরিসংখ্যান দিয়ে নিন্দা জানানো হয়েছিল। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম এ জন্য যে, এই প্রথম আমেরিকান ওয়ার অন টেররকে একেবারে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানে পাকিস্তানকে কিভাবে বাধ্য করা হয়েছে আর এতে পাকিস্তানের স্বার্থে কিভাবে বিঘ্ন হয়েছে- এই বয়ান দাঁড় করানো হয়েছে।

গত ২০১৩ সালের দিকে বিদেশে এক প্রোগ্রামে অংশ নেয়ায় অনেক দিন পর কিছু পাকিস্তানি নারী-পুরুষের সাথে দু-তিন দিন কাটাতে হয়েছিল। ফলে একালের পাকিস্তানের তরুণ-যুবাদের সম্পর্কে নতুন অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছিল। এমনিতে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিদেশী চাকরি সূত্রে অনেক পাকিস্তানি আমার কলিগ ছিল, কখনো বাসা পাওয়ার সমস্যায় তাদের সাথে বাসা শেয়ার করেছি; তবু এসব লেটেস্ট পরিবর্তন তখনো তেমন জানা হয়নি। তবে ২০১৩ সাল থেকে আলজাজিরার কিছু রিপোর্ট থেকে প্রথম টের পাই আমাদের চেনা সেই পুরনো রক্ষণশীল পাকিস্তান বদলে গেছে। তরুণ বা নয়া প্রজন্ম আগের আমেরিকান বয়ানে আর আগ্রহী নয়। খুঁড়িয়ে হলেও পাকিস্তানে এক নয়া প্রজন্ম নয়া মধ্যবিত্ত হাজির হয়ে গেছে। পাকিস্তানের জন্য তারাই সম্ভবত আগামী দিনের বিরাট ভরসা। যেমন- দোষ আমেরিকার অথচ দেশ-বিদেশে প্রপাগান্ডা চলছে যেসব দোষ পাকিস্তানের, আর পাকিস্তানই জঙ্গি ইত্যাদি বয়ান শুনতে শুনতে তারা হতাশ ও বিরক্ত। ফলে আমার মনে হতো ইমরান তাদের সম্ভাব্য নেতা হবেন হয়তো। ২০১৩ সালের শেষের নির্বাচনে এর কিছু আলামত দেখেছিলাম। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে এসে এর সরাসরি ফল দেখলাম।

ইমরানের সাথে তুলনা করলে অপর দুই দল ও নেতা ভুট্টো বা নওয়াজ শরিফের দল, এদের ব্যর্থতা হলো- তারাও নিঃসন্দেহে প্রচণ্ডভাবে আমেরিকান চাপ সয়েছেন আর পাকিস্তানের উপরেই বোমাবাজিসহ যা ইচ্ছা আমেরিকা করতে চায়, তা সহ্য করতে হয়েছে। তারা বের হওয়ার পথ না খুঁজে বরং সে সময়টাতে আমেরিকার নামে দোষ চাপিয়ে নিজের সম্পত্তি বাড়ানো দখল ও লুটের দিকে গেছেন। এটি অকল্পনীয় যে, আমাদের মতো দেশের কোনো নেতা দুই বিলিয়ন ডলার সম্পদ গড়েছেন; অথচ এটিই পাকিস্তানে হয়েছে। আর ওদিকে সেনাবাহিনীও প্রচণ্ডভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল ট্রাম্প আমলের শুরু থেকেই। ট্রাম্পের লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে প্রতিদিন দুই হাজার ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় থেকে আমেরিকার নিজ প্রশাসনকে বাঁচানো; কিন্তু তিনিও ভারতের প্ররোচনায় পাকিস্তানকে এমনকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে দায়ী বলে মনে করে তার প্রপাগান্ডা শুরু করতে থাকেন। পাকিস্তান আর্মিকে বছরে ৬০০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার একটি প্রতিশ্রুতি ছিল, আমেরিকা তা অর্ধেক করে দেন। কিন্তু পরের বছর থেকে ট্রাম্প বুঝতে পারেন, আফগানিস্তান থেকে বের হতে গেলে একমাত্র ভরসা তালেবানদের সাথে একটি চুক্তি। কারণ যুদ্ধের ময়দান ফেলে কারো ভেগে যাওয়ার পরিকল্পনার মানে হলো পালানোর সময় কেউ আক্রমণ করলে সেটি কাভার দেবে কে? এর ব্যবস্থা করতেই এক চুক্তি করা। ফলে ট্রাম্প টের পেলেন যে, পাকিস্তানই একমাত্র দেশ যে তালেবানদের রাজি করাতে সাহায্য করতে পারে। তাই ট্রাম্প তালেবানদের সাথে আপসনামা রচনায় তার প্রতিনিধি হিসেবে জালমে খলিলজাদকে নিযুক্ত করার পরই পাকিস্তানের সাথে বিবাদ মিটিয়ে ফেলেন। তবে ২০১৮ সালে ইমরান প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে তালেবান আলোচনা গতি পায়। তবে তত দিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমেরিকা থেকে বহু দূরে চলে গেছে। আর যেতে পেরেছিল বলেই তারা ইমরানের সাথে সম্পর্ক গড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের ওপর আমেরিকান নির্ভরশীলতা এখনো বর্তমান। আফগানবিষয়ক বা ইরান ও সেন্ট্রাল এশিয়ার ওই অঞ্চলে আমেরিকার সব ধরনের স্বার্থের জন্যই আমেরিকার পাকিস্তানকে দরকার। এ কারণে ভারত যতই চেষ্টা করুক, মার্কিন কংগ্রেসকে দিয়ে পাকিস্তানবিরোধী চাপ সৃষ্টি করবে ইত্যাদি যাই করুক; কিন্তু বাইডেন প্রশাসন জানে পাকিস্তানকে তার কেন দরকার।

এরই মধ্যে দোহায় আমেরিকান-তালেবান চুক্তিতে কী কী হারিয়েছে বা কী কী নেই, তাদেরকে জানানো হয়নি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভারত আপত্তি তোলা শুরু করেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল ওয়াশিংটনে ভারত-আমেরিকা ‘কৌশলগত পার্টনার’ ফোরামের চতুর্থ বৈঠক। সেখানে ভারতে আমেরিকার এক সাবেক রাষ্ট্রদূত ফ্রাংক জি উইজনারের প্রশ্নে এসব মতভিন্নতা বাইরে চলে আসে। ভারতের ক্ষোভ হলো- তাদের জানানো হয়েছিল যে, এক ইনক্লুসিভ সরকার হবে (ভারতের কাছে এর ব্যাখ্যা সম্ভবত, গণি সরকারেরও প্রতিনিধি তালেবান সরকারে থাকবেন)। এ ছাড়া নারীদের কী হবে? আর সর্বোপরি ভারতের প্রশ্ন, তালেবানের আমলে কি ভারতীয় কাশ্মিরের মুসলমানরা তালেবান সহায়তা পাবে? তবে কথাটি অন্য ভাষায় বলা হচ্ছে যে, তালেবানের মাটি কি অন্য দেশে সন্ত্রাস চালানোর কাজে ব্যবহৃত হবে? কিন্তু এই একই প্রশ্নের অন্য দিক আছে, আগে যেভাবে গনি সরকারের আমলে আফগান মাটি ব্যবহার করে চীন ও পাকিস্তানে সাবভারসিভ আক্রমণ চলত, প্রজেক্টে হামলা চলত, চীনা প্রকৌশলী নিহত হতেন, সেসবের কী হবে?
তবে ওই স্ট্র্যাটেজিক সভা শেষ হয়েছে ভারতের এ মর্মে অসন্তোষে যে, আংশিকভাবেই গনি সরকারের আমলের কোনো সুযোগ-সুবিধা ফেরত আসছে না।

এ ব্যাপারে আমেরিকান ব্যাখ্যা হলো, আমরা ৩০ আগস্টের আগেই সব অস্ত্র ও রসদ নিয়ে ফিরে চলে আসব, কোনো কিছু আর আফগানিস্তানে ব্যবহার করব না। চুক্তির এই ফেরে পড়েও তালেবানরা চুক্তির কোনো অংশ বাস্তবায়ন না করলেও আমরা চিপায় পড়ে গেছি। মানে এখন কিছুই করার নেই, ‘মাফ চাই’ ধরনের।

আর ভারতের ততই গোসসা। কংগ্রেসের শুনানি চলাবস্থায় বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের সাথে তাদের অনেক কথা বলা দরকার হলেও তা করতে যাননি। অবশেষে আমেরিকান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরমানের ভারত সফরে গত ৬ অক্টোবর ফরমালি ভারতের গোসসা শোনা হলো। ভারত এবার সুযোগ পেয়ে আফগান হাক্কানি নেটওয়ার্কের আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি জানিয়েছে।

এ বিষয়ে আসলে কিছু কড়া কথা বলতেই হয়। বিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার পর বাজনা বাজাতে মানুষের বিরক্তই লাগবে। ট্রাম্প কি জানতেন না যে তালেবান বলতে তাদের সাথে হাক্কানি গ্রুপও থাকবে? না জানলেও আগাম তাদের আপত্তির কথা বলা যেত। তা তিনি বলে নেননি কেন? এফবিআই কিংবা ইউএনের খাতায় হাক্কানি নেতা সিরাজুদ্দিনের মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে নাম আছে তো! তাতে কী? ট্রাম্প তখন চুক্তি করেই ফেলেছেন যেখানে সিরাজুদ্দিন বা ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ নেতাদের সম্পর্কে কী হবে এ নিয়ে আমেরিকার কোনো আপত্তি করা নেই অথবা থাকলেই তা বাস্তবায়নে তালেবানদের বাধ্য করার জন্য আমেরিকার হাতে কোনো উপায় রাখা হয়নি- এর সোজা অর্থ, এসব ফালতু আলাপ। আমেরিকা চুক্তি করেছে মানেই এদের তালেবান সরকারে থাকতে পরোক্ষে হলেও অ্যাপ্রুভাল দিয়ে দিয়েছে। কাজেই ভারতের এখন এখানে সেখানে ‘তালিকায় নাম আছে’- এসব নিয়ে কিছু দিনের প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কোনো মূল্যই নেই।

আর পাকিস্তান নিয়ে নালিশের ব্যাপারে ওয়েন্ডি বহু কিছু বলে দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, তিনি বলছেন, সেই রাধাও নেই আর তার নাচের মন-মর্জিও নেই। মানে ওই সব বাদ দিতে হবে। তিনি সোজা করে বলেছেন, দেখুন এত একুশ শতক আর গত ২০ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। এখন যতটুকু যা হতে পারে তা হলো, আমরা সবাই (ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি) যদি এক থাকতে পারি, একসাথে চেপে ধরতে পারি তা হলে কিছু হতে পারে। এরপর তিনি সরাসরি স্বীকার করে নেন যে, ‘সেই আফগানিস্তান আর নেই যেমনটি কেউ কেউ চাচ্ছে।’ মানে কথা সোজা, ও দিন গত, আমাদের সেই মুরোদও আর নেই। কাজেই বিরক্ত কইরেন না...।’

শেষে আর কিছু না পেয়ে এবার শেরমানকে চেপে ধরেছে ভারত। কেন? কী নিয়ে? কারণ আপনাতেই প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি ভারত থেকে পাকিস্তান যাচ্ছেন। এখন ভারতীয় ছেচড়ামো শুরু হয়েছে, আপনারা তা হলে ভারত-পাকিস্তানকে এক পাল্লায় মাপছেন? এটি বলে ‘সে কী কান্না’! মানে ভারত বলতে চাচ্ছে আমরা তো পাকিস্তানের চেয়ে উঁচু জাতের ছিলাম তোমার কাছে। আর তার কী হলো?

এখন সমস্যা হলো, এই কান্না দেখেও আমেরিকার হাতে কিছুই করার নেই! তবে একটি সান্ত¡না বাক্য দিয়েছেন ওয়েন্ডি, বিশ্বাস করো বেশি মিশব না, ‘ভেরি স্পেসিফিক অ্যান্ড ন্যারো পারপাস’!

তবে ভারতকে এখন ভান করতেই হবে যে, আমেরিকার কাছে অনেকের চেয়ে দামি সে! তবু খুশি থাকুক, এ আমাদের কামনা!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনে উদ্বেগ টিআইবির যখন দলকে আর সহযোগিতা করতে পারবো না তখন অবসরে যাব : মেসি ইভ্যালির রাসেল-শামীমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যান আর নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ খণ্ডালেন ওবায়দুল কাদের আটকের পর নাশকতা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ইউপি চেয়ারম্যানকে বদর যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন পণবন্দী জাহাজ ও ক্রুদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝালকাঠিতে নিখোঁজের ২ দিন পর নদীতে মিলল ভ্যানচালকের লাশ বাল্টিমোর সেতু ভেঙে নদীতে পড়া ট্রাক থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার যুক্তরাষ্ট্রে ছুরিকাঘাতে নিহত ৪

সকল