২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কৌশলগত সম্পর্ক নিয়ে চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ

-

অগ্রজতুল্য ভাই ফখরুল আলমের একটি স্ট্যাটাস এই লেখার প্রেরণা। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক গাঢ় হচ্ছে। তার তুলে ধরা একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের ২০ শতাংশ, রফতানি আয়ের ১৮ শতাংশ, গ্যাস সরবরাহের ৬৪ শতাংশ এবং বীমা বাণিজ্যের ৩৮ শতাংশের উৎস আমেরিকা ও সে দেশের কোম্পানি। এর বাইরে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতার আরো অনেক পরিসংখ্যান ও বিষয় রয়েছে। এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সহায়তার উৎসগুলোর মধ্যে এখনো নিয়ন্ত্রক অবস্থান বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের প্রায় ১৭ কোটি মুসলিমপ্রধান দেশের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতার অনেক কিছুই রয়েছে।

তবে এক দশক আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বিশ্বের একক পরাশক্তি ছিল সেই অবস্থা এখন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বিপরীতে চীন এবং রাশিয়া অনেকখানি জোটবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। এমনকি যে ইউরোপ-আমেরিকার একক নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি ছিল সেই অবস্থানেও চিড় ধরার উপক্রম হয়েছে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে আমেরিকার অকাস সামরিক জোট গঠনের পর। এর শুরুটা হয়েছে ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ১২টি ডিজেল সাবমেরিন কেনার চুক্তি বাতিল করে আমেরিকার কাছ থেকে পারমাণবিক সাবমেরিন কেনার চুক্তির মধ্য দিয়ে। এই ঘটনা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ন্যাটোনির্ভরতা পরিত্যাগ করে আলাদা ইউরোপীয় নিরাপত্তা জোট গঠনের চিন্তাভাবনার পথে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে।

নতুন পরিস্থিতি সারা বিশ্বের ছোট বড় দেশগুলোর নিরাপত্তার ওপর যে প্রভাব ফেলতে শুরু করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার বার্তা যে গভীর অর্থ বহন করে তাতে সংশয় নেই। প্রশ্ন হলো কী সেই গভীর অর্থ অথবা তার প্রভাবই বা কেমন হবে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায়।

বাংলাদেশের অর্ধশতকের ইতিহাসকে মোটা দাগে দেখা হলে, প্রথম সাড়ে তিন বছর দেখা যাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কমান্ড বা নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি গণতান্ত্রিক শাসন হিসেবে। এই পর্বের শেষ দিকে একদলীয় ব্যবস্থার সূত্রপাত করা হয়। ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি, এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং আবার খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চার দলের শাসন চলে। এই তিন দশকের শাসনকালে মৌলিক নীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে কম বেশি ধরন ছিল একই। এ সময় নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি থেকে বাজার অর্থনীতি এবং একদলীয় শাসন থেকে বের হয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন অনুসৃত হয়েছে।

২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে আগের শাসনের ধারাবাহিকতায় কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়। এ সময়টাতে মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্থান করে নেয় একধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র। ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও আগের রাতেই জবরদস্তিমূলকভাবে ভোট গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। এই নির্বাচনের ফলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। গড়পড়তা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ যেই দলের ভোট রয়েছে বলে মনে করা হয় সেই বিএনপির মাত্র সাতজন প্রার্থীকে বিজয়ী দেখানো হয়।

প্রশ্ন হলো, অভ্যন্তরীণ এই রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে পররাষ্ট্র কৌশল বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কী সম্পর্ক? বিশ্বব্যবস্থায় স্নায়ুযুদ্ধ যখন ছিল তখনকার পরিবেশ ছিল এক রকম। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক মেরুর বিশ্বব্যবস্থায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নেয়। এর পর গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সাথে প্রতিরক্ষা শক্তিধর রাষ্ট্র রাশিয়ার কৌশলগত বোঝাপড়া হয়। দুই দেশ বিভিন্ন স্থানে যৌথ অবস্থান গ্রহণ করে আমেরিকান বলয়ের প্রভাবের সামনে। এই দুই প্রধান শক্তিবলয় একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করছে। যার অংশ হিসেবে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে কোয়াড পরে অকাস জোট গঠন করে। এখন কোয়াড-প্লাস করে এশিয়ায় নিরাপত্তাবলয়কে আরো বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে। অন্য দিকে চীন ও রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন উদ্যোগ ও চুক্তি ছাড়াও হংকং-সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা ও ‘রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’-এর মতো উদ্যোগ নিয়েছে। ঠিক এ ধরনের একটি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন মাত্রার গুরুত্ব বহন করে।

চাপ বাড়ছে আমেরিকার?
গত বছর অক্টোবরে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফান বিগুন এক তাৎপর্যপূর্ণ সফরে বাংলাদেশে আসেন। তিনি তখন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে (আইপিএস) মূল অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের দিকে তাকিয়ে আছে। তার সফরকালে, বিগুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এবং কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের শীর্ষনেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

চীনের বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সদস্য বাংলাদেশ অবশ্য তার প্রতিক্রিয়ায় সতর্ক ছিল। কারণ আইপিএস চীনা বিআরআইয়ের পাল্টা একটি পদক্ষেপ হিসেবে এর মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। এই সময় ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত কোয়াডে অংশ নিলে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দেন। এর পর নিরাপত্তা ও কৌশলগত প্রভাব রয়েছে এমন একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগে যোগ দিতে বাংলাদেশ তাৎক্ষণিকভাবে আগ্রহ দেখায়নি। ঢাকার আশঙ্কা, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উদ্যোগে যোগদান দেশকে সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই সংশয় সত্ত্বেও, বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ সুযোগের একটি ক্ষেত্র খুলে দিতে পারে বলেও বিবেচনা করা হয়।

আইপিএস ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অঞ্চলগুলোতে বিস্তৃত এবং এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্যোগ। আইপিএসের অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবার সমৃদ্ধির সাথে উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রূপকল্প প্রচার করে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকে আরো বেশি করে সম্পৃক্ত করতে চায়। নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোও আইপিএসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বলা হয়, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহের একটি প্রধান কারণ। বাংলাদেশ হলো বঙ্গোপসাগরের একটি তীরবর্তী ও ভারত মহাসাগরের অবিচ্ছেদ্য অঞ্চল এবং একটি প্রধান সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ। এ ছাড়াও বাংলাদেশের চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন মার্কিন আগ্রহে যোগ করেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির দু’টি মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করা। আর এ প্রসঙ্গে বলা হয়, অবকাঠামো এমন একটি খাত যেখানে বাংলাদেশ আইপিএস থেকে যথেষ্ট লাভ করতে পারে। বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা চাইছে। বিআরআইতে বাংলাদেশের যোগদানের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তার অবকাঠামো প্রকল্পের অর্থায়ন।

তবে আইপিএসের উন্নয়নে জোর দেয়া সত্ত্বেও, এটিকে একটি নিরাপত্তা জোট হিসেবে বেশি মনে করা হয়। আর এটিই বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আইপিএসে যোগদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আশঙ্কা, তার কৌশলগত মিত্র চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে। আবার যুক্তরাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি পণ্য তৈরী পোশাকের একক বৃহত্তম গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারীও।

এই অবস্থায় আইপিএস বাংলাদেশকে একটি সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে ফেলেছে। বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো কিভাবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার স্বার্থ বিঘ্নিত না করে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। আজ অবধি, বাংলাদেশ সব বড় বৈশ্বিক শক্তির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে বলে মনে করা হয়; কিন্তু পরিস্থিতি এখন ক্রমেই যেকোনো একটি বলয়কে বেছে নেয়ার দিকে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ কি পারবে চীনের সাথে দূরত্ব তৈরি করে আমেরিকার একান্তভাবে কাছে যেতে?

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় চীনের ইতিবাচক ভূমিকা না থাকলেও পঁচাত্তর-উত্তর সময়ে এবং বিশেষভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক দুর্দান্ত অবস্থায় উপনীত হয়। কেউ কেউ এখন চীনকে বাংলাদেশের ‘সর্ব-আবহাওয়া বন্ধু’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। চীন ১৯৭৬ সালে ঢাকার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ছিল সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এবং পরে তা অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়। চীন এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সবসময় চীনের অনুকূলে ছিল। ২০১৯ সালে চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি ছিল ১৬.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত দুই দশকে ১৬ গুণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মোট আমদানির ৩১.১ শতাংশ চীন থেকে আসে, যা পরবর্তী বৃহত্তম অংশীদারের আমদানি থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) স্থিতি ২০১১ সালের শেষের তুলনায় ২০১৯-এর শেষে এসে ১০.৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ চীন থেকে ১.১৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিট এফডিআই পেয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রাপকদের মধ্যে একটি । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জ্বালানি খাত চীনের বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় প্রাপক। চীন বাংলাদেশের সাথে যৌথ উদ্যোগে একক বৃহত্তম বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণ করেছে।

জ্বালানি খাত ছাড়াও অবকাঠামো এমন একটি খাত যেখানে চীন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। চীনা বিনিয়োগ রয়েছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের বন্দরগুলোতে। চীন পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, যার আনুমানিক ব্যয় ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বন্দরটি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর এবং ২০১৬ সালে এর কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালে, বাংলাদেশ চীনকে তার বৃহত্তম দু’টি সমুদ্রবন্দর- চট্টগ্রাম এবং মংলাতে প্রবেশাধিকার দিয়েছে। চীন মংলা বন্দরের উন্নয়নে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। চীন সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে যাচ্ছিল; কিন্তু পরে ভারতের আপত্তির কারণে এটি বাতিল করা হয়। ভারতের জন্য প্রবল কৌশলগত প্রভাব রয়েছে এমন একটি বড় প্রকল্প হলো ভারত থেকে প্রবাহিত তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশকে চীনের প্রস্তাব। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় সীমান্তের কাছে নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ এবং আনুমানিক এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে, যার ৮৫ শতাংশ চীন ঋণ হিসেবে প্রদান করবে।

চীনা সংস্থাগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম হাই-স্পিড রেল প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে চীনা আগ্রহের মধ্যে রয়েছে আটটি- বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ, একটি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নদীর তলদেশের টানেল নির্মাণ, অর্থনৈতিক অঞ্চল, সিলেট বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ এবং ফ্ল্যাগশিপ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পসহ বিভিন্ন মহাসড়ক এবং রেল যোগাযোগ, যার আনুমানিক ব্যয় ৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চীন বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টর যেমন স্টক মার্কেট এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও এগিয়ে গেছে। সাংহাই এবং শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের চীনা কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশের প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জে ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছে। ডিজিটাল স্পেস একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থান যেখানে চীন উল্লেখযোগ্যভাবে বিনিয়োগ করেছে। চীন বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম ডাটা সেন্টার এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম স্তরের চতুর্থ ডাটা সেন্টার নির্মাণ ও অর্থায়ন করছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে চীন ও বাংলাদেশের গভীর সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ২০০২ সালে, দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যার মধ্যে প্রতিরক্ষা উৎপাদনও রয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির প্রায় ৭৪ শতাংশ হয় চীন থেকে। চীন ট্যাংক, ফাইটার জেট, সাবমেরিন, ফ্রিগেট, জাহাজবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। ২০১৪ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুসারে চীন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেবে এবং সরঞ্জাম দেবে।

বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং চীনের ওপর নির্ভরতার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন বলে মনে হয়। এ কারণে ঢাকা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলো দূর করার চেষ্টা করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাকামীদের দমন করার ব্যাপারে ভারতকে ঢাকা সর্বতোভাবে সহায়তা দিয়েছে। ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণকারী রাজনৈতিক শক্তি আর ধর্মীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ এইভাবে চীন ভারত দুই শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার সূক্ষ্ম রেখায় চলার চেষ্টা করছে। এ কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি সত্ত্বেও, দিল্লির নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে কম সংবেদনশীল প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে বলে ভারতের অবজারভার ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারসাম্য কি বজায় রাখা যাবে?

বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থ বজায় রেখে ভারত ও চীনের সাথে সমদূরত্বের কূটনীতিতে সাফল্য দেখিয়ে চলছে বলে ধারণা করা হয়। এখনকার পরিস্থিতিতে সেই ভারসাম্য কি বজায় রাখতে পারবে ঢাকা? শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব:) আ ন ম মুনিরুজ্জামান মনে করেন, পররাষ্ট্র সম্পর্কে বাংলাদেশকে অনুসৃত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে সামনে। তিনি মনে করেন, ‘ভারতের সাথে আমাদের রয়েছে বিশাল সীমান্ত। চীনকেও বলা যায় নিকটের প্রতিবেশী। দুই দেশের কোনোটির দিকে না ঝুঁকেই আমাদেরকে তাদের সাথে সমদূরত্বের কূটনীতি চালিয়ে যেতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া অন্য কোনো পন্থা নেই।’

পররাষ্ট্র সম্পর্কের ইস্যু এখন শুধু চীন বা আমেরিকার দিকে ঝোঁকা নয়। ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কেও নানামুখী চাপ এর মধ্যে তৈরি হয়েছে। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও তিস্তাচুক্তি সম্পাদন করতে না পারা, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার মতো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশের জনগণ হতাশ। তিস্তার হিস্যা না পাওয়ায় বাংলাদেশে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এর নিরসনে ভারতের উদ্যোগহীনতার কারণে তাদের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশ তার নিজস্ব উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিস্তায় চীনের একটা বড় ধরনের প্রকল্পে কারিগরি সহায়তা এবং বিনিয়োগ করার প্রস্তাব বিবেচনা করছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের জনগণ উপকৃত হবে। কিন্তু এই বিষয়ে তীব্র আপত্তি ভারতের।

বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবেষ্টিত রাষ্ট্র। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর তাৎপর্যপূর্ণ কৌশলগত বা ভূরাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, কোয়াডের সমুদ্রমুখী সক্রিয়তা, দক্ষিণ চীন সমুদ্রে উত্তরোত্তর উত্তেজনা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, এমনকি সঙ্ঘাতের বাস্তব আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মর্যাদা খুবই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ।

যখনই কোনো পরাশক্তির বিকাশ ঘটে, তখন সাধারণত সেটি সমুদ্রের ওপর ভিত্তি করে ঘটে। চীন ও ভারত এই দুই উদীয়মান পরাশক্তির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশকে খুবই সাবধানে পা ফেলতে হবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো দেশ বা ব্লকের সাথে যুক্ত না হয়ে মেরিটাইম স্ট্র্যাটেজিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কি সম্ভব হবে বাংলাদেশের জন্য?

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই অঞ্চলের নতুন করে একটা সম্পর্ক বা এনগেজমেন্টস তৈরি হতে যাচ্ছে। এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর যে কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, সেটি নতুন করে উপলব্ধিতে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা দেখছে, ভারতের সাথে এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর যে সম্পর্ক, সেটি কিছুটা হলেও টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক অপরিবর্তিত রেখে ভারতের প্রতিবেশীদের সাথে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়বে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য মরণপণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন পরাশক্তি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ভারত কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অনুকূলেই অবস্থান বজায় রেখেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গড়ে উঠছে গভীর সম্পর্ক। অন্য দিকে চীনের কাছে মিয়ানমারের যে কৌশলগত গুরুত্ব, তার মূল্য বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের চেয়ে অনেক গভীর। দীর্ঘ অভিন্ন সীমান্তসহ মিয়ানমারে চীনের নানা কৌশলগত স্বার্থ জড়িত। বিশেষ করে আরাকান রাজ্যে তারা বড় একটা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। চীনের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য তা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাই নিরাপত্তা পরিষদে চীন তাদের পক্ষে ভেটো দেয়। আর বাংলাদেশকে সমর্থন করে না ভারত।

রোহিঙ্গা সঙ্কট সৃষ্টি এবং এর জটিল রূপ গ্রহণে চীন ও ভারত দুই দেশের ভূমিকা ঢাকাকে আশ্বস্ত করার মতো নয়। আর এই সমস্যায় বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা আর ওআইসি সদস্য দেশগুলো। একধরনের বিপরীতমুখী স্বার্থদ্বন্দ্ব নিয়ে বাংলাদেশ উভয় সঙ্কটে পড়েছে। এই সঙ্কটে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কোন পক্ষ নেবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এর প্রভাব যে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পড়বে তাতে সংশয় নেই। গণতন্ত্র চর্চার ব্যাপারে চীন-রাশিয়ার কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমেরিকান এজেন্ডায় এখনো গণতন্ত্র চর্চা ও মানবাধিকার অগ্রাধিকারে রয়েছে। ইদানীং আমেরিকার সাথে বোঝাপড়ার সম্পর্ক সৃষ্টির জল্পনার সাথে সাথে সম্ভবত এ কারণে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের জোরদার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে হত্যা করা হয়েছে বলে যারা অভিযোগ করেন তারা এ জন্য চীনা ভূমিকাকে বিশেষভাবে দায়ী করেন।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান সাজেকে পাহাড়ি খাদে পড়ে মাহিন্দ্রচালক নিহত জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবার কবরে শুয়ে ছেলের প্রতিবাদ ইসরাইলি হামলায় গাজায় আরো ৭১ জন নিহত পানছড়ি উপজেলায় চলমান বাজার বয়কট স্থগিত ঘোষণা আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করেছে : দুদু

সকল