১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আবার কবে আসবেন একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবি

-

পৃথিবীর ইতিহাসে ভাগ্যবিড়ম্বনার সবচেয়ে বড় নজির সম্ভবত ফিলিস্তিন। কী অমানবিক আচরণ একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি! প্রতিনিয়ত তারা নিজের বাস্তুভিটা হারাচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে শুধু একটি চাকরি করতে গিয়ে প্রতিদিন ইসরাইলিদের বন্দুকের নল ঠেলে কাজে যেতে হয়। কাজ শেষে বিকেলে বা সন্ধ্যায় জীবন নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে কি না তা সে জানে না। এটি একদিন-দুদিন, একমাস-দুমাস বা বছরের ব্যাপার নয়। ৭২ বছর ধরে চলছে এ অমানবিক জীবনযাপন। পৃথিবীতে একটি পাখিরও বাসা আছে। অথচ অতি প্রাচীন এ জাতিটির নিজের ঘরে থাকার অধিকারটুকুও নেই। হাজার বছর ধরে বসবাস করা এ বাড়ি ও আবাস নাকি তাদের নয়! প্রতিনিয়ত তাদের বাস্তুচ্যুত করে রাস্তায় বের করে দেয়া হচ্ছে। আর সেখানে নতুন ঘর বানিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা ইহুদিদের।

এসব ইহুদি এবং তাদের পূর্বপুরুষরা কখনো ফিলিস্তিনের অধিবাসীই ছিল না। যেখানে আজকের ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত সেখানে ১৯৪৮-এর আগে কখনোই ইহুদি রাষ্ট্র ছিল না। সেই প্রাচীনকাল থেকে এ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড শত শত নবী-রাসূলের কর্মকেন্দ্র ছিল। আর তাই ইসলামের মহান নবী হজরত মোহাম্মদ সা: বলেছিলেন, আলকুদসের (জেরুসালেম) এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে একজন নবী সালাত আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।’ (তিরমিজি) আল্লাহর অতিপ্রিয় হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ আ:, তাঁর পুত্র হজরত ইসহাক আ:, তাঁরই পুত্র হজরত ইয়াকুব আ:, তাঁর পুত্র হজরত ইউসুফ আ:, হজরত ইবরাহিম আ:-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হজরত লুত আ:, এ ছাড়াও পরবর্তীতে হজরত মুসা আ:, হজরত হারুন আ:, হজরত দাউদ আ:, তাঁর পুত্র হজরত সোলায়মান আ:, হজরত জাকারিয়া আ: ও হজরত ঈসা আ: সবারই আল্লাহর ধর্ম প্রচারের প্রধান কর্মকেন্দ্রই ছিল তথা ইসলামের চারণভূমিই ছিল এ ফিলিস্তিন।

ইবরাহিম আ: মক্কায় কাবা শরিফ পুনর্নির্মাণের ৪০ বছর পর তাঁর পৌত্র হজরত ইয়াকুব আ:-ই ফিলিস্তিনের জেরুসালেমে বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এ বায়তুল মোকাদ্দাস বিভিন্ন সময়ে মসজিদে ইলিয়া বা উরুশালেম অথবা ইয়াকুস নামে পরিচিতি পায়। তবে এসব নামের পরিবর্তে মসজিদুল আকসা নামটি আল্লাহ প্রথম ব্যবহার করেন কুরআন শরিফের সূরা ইসরায়। মোহাম্মদ সা:-এর কাবা শরিফ থেকে মেরাজে যাওয়ার যাত্রাস্থল হিসেবে আল্লাহ কাবা থেকে দূরের এ প্রিয় মসজিদটিকে বেছে নিয়েছেন বলেই সম্ভবত এর নাম দেন মসজিদ আল-আকসা। আরবি আকসার অর্থ দূর। মসজিদুল আকসাই ছিল ইসলামের প্রথম কিবলা। তাই কাবা শরিফ এবং মদিনার মসজিদে নববীর পর মসজিদুল আকসাই ইসলামে তৃতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল মসজিদ। এ ছাড়া হজরত ঈসা আ:-এর জন্মস্থান বেথেলহেমও জেরুসালেম নগরীতেই মসজিদুল আকসা সংলগ্ন। তাই মুসলমান এবং খ্রিষ্টান উভয় ধর্মের অনুসারীদের কাছে জেরুসালেম (আল কুদস) এবং মসজিদুল আকসা অত্যন্ত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।

ইহুদি সম্প্রদায় তাদের তীর্থস্থান ‘Temple Mount’-এর উসিলায় জেরুসালেমের ওপর অধিকার দাবি করলেও ঘটনা পরম্পরায় তা এখন আর আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত নয়। এর অনেক কারণ। নবী ইয়াকুব আ: যাঁর আরেক নাম ইসরাইল, তাঁরই অনুসারী হিসেবে পরিচিত বনি ইসরাইল জাতি। তারা ইয়াকুব আ:কে বৃদ্ধ বয়সে রেখে উন্নত জীবনের সন্ধানে মিসরে যায়। ফেরাউনের নির্যাতন সইতে না পেরে পরবর্তীতে তারা যখন মুসা আ:-এর আহ্বানে তাঁর সঙ্গী হয়ে স্বদেশে ফিরছিল তখন তারা নবীর সাথে বেঈমানি ও অবিশ্বাসের কাজ করে বসে। মুসা আ: তাদেরকে তিহ প্রান্তরে রেখে আল্লাহর সাক্ষাতের উদ্দেশে তুর পাহাড়ে যান, তখনও এ জাতি বেঈমানি করে। তারা ধর্ম ত্যাগ করে গো-পূজায় লিপ্ত হয়। মুসা আ: ফিরে এসে তাদের এ কাণ্ড দেখে খুবই ক্ষুব্ধ হন। মুসা আ: ও হারুন আ: দু’ভাই-ই জেরুসালেমের অদূরে এ তিহ প্রান্তরেই মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন।

এতসব অপরাধের কারণে বনি ইসরাইলকে জেরুসালেম পৌঁছার আগেই মরুময় তিহ প্রান্তরে আল্লাহ প্রদত্ত ৪০ বছরের শাস্তি ভোগ করতে হয়। জেরুসালেম বা মসজিদুল আকসার সেবায়েত হওয়ার কোনো অধিকার এই ইহুদিদের নেই। মুসলিম জনগোষ্ঠীই জেরুসালেম এবং মসজিদুল আকসাকে আগলে রাখে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০৪ অব্দে সোলাইমান আ: আল-আকসা মসজিদের পুনর্নির্মাণ ও ব্যাপক সংস্কার করেন। আরো প্রায় দেড় হাজার বছর পর ৬৩৮ খ্রি. ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর রা: এবং আরো পরে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান মসজিদের আমূল সংস্কার করেন। ফলে এ মসজিদের ভেতরে এবং বাইরের বিশাল আঙ্গিনায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষ একত্রে সালাত আদায় করতে পারেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১০৯৯ খ্রি. ইংল্যান্ডের সম্রাটের নেতৃত্বে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা এক অভিযানে ফিলিস্তিন দখল করে মসজিদুল আকসায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মসজিদের গম্বুজ ভেঙে একে গির্জায় পরিণত করে। মসজিদের এক অংশে নিজেরা থাকার ব্যবস্থা করে এবং অপর অংশকে ঘোড়ার আস্তাবল বানায়। তবে তাদের এ অপবিত্র দখল বেশি দিন টেকেনি। ৮৮ বছর পর ১১৮৭ সালে হিত্তিনের যুদ্ধে মহাবীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ক্রুসেডারদের পরাজিত করে জেরুসালেম পুনরুদ্ধার করেন। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল কর্তৃক দখলের পূর্ব পর্যন্ত একটানা প্রায় ৯০০ বছর ধরে জেরুসালেম ও মসজিদুল আকসা মুসলিম অধিকারেই ছিল। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে জেরুসালেম ও মসজিদুল আকসা মুসলমানদেরই পবিত্র স্থান।

মুসা আ: ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক হলেও বনি ইসরাইল জাতি ধর্ম ত্যাগ করে বিশ্বাসঘাতকতা করায় ইহুদি ধর্মের সাথে তাদের আর সম্পর্ক রইল না। এ ছাড়া ক্ষুব্ধ হয়ে মুসা আ: জেরুসালেম প্রবেশ না করায় জেরুসালেমের ওপরও বনি ইসরাইলিদের অধিকার আর থাকল না। সবচেয়ে বড় কথা হলো- ফিলিস্তিনের ৯৫ ভাগ অধিবাসীই মুসলমান, মাত্র ৫ ভাগ ইহুদি ও খ্রিষ্টান। তাই তো ধর্মীয় বা ঐতিহাসিক কোনোভাবেই ফিলিস্তিন, জেরুসালেম ও মসজিদুল আকসার ওপর ইহুদি অধিকারের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই ইউনেস্কো ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর মসজিদুল আকসাকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান ও হেরিটেজ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এত কিছু জেনেও ইহুদিরা ১৯৪৮ সালে অতর্কিত হামলায় ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। এ ব্যাপারে অবশ্য খ্রিষ্টান-ইহুদিদের পরিকল্পনা ছিল বহুদিন আগে থেকেই। শুধু সুযোগের অপেক্ষা করছিল। তাদের সে সুযোগও এসে গেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষাবলম্বনের অজুহাতে সম্মিলিত মিত্রশক্তির বিশাল বাহিনী একযোগে মুসলিম বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসে। সাম্রাজ্যটিকে ভেঙে ৩৭টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এত সবের উদ্দেশ্যই ছিল মুসলমানদের শক্তি দুর্বল করা।

আবার তুরস্কেও বসানো হয় তাদের সমর্থিত ক্রীড়নক সরকার যার পরিণতিতে বহু মুসলিম স্কলার ও ধর্মীয় নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ইসলামী খেলাফতের এই যখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা তখন এ দুর্বলতার সুযোগ বুঝে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ অধিকৃত অংশে হঠাৎই ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণাই ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত। ধীরে ধীরে এ ঘোষণার আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়নের কাজও তারা চালাতে থাকে। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জার্মানিতে হিটলার বহু ইহুদিকে হত্যা করে। এই ঘটনাকে পুঁজি করে ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতি স্বরূপ ব্রিটিশ-আমেরিকান গোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে জাতিসঙ্ঘে ‘১৮১ নং’ প্রস্তাব নামে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে পাস করিয়ে নেয়। এতে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। ইহুদিদের জন্য ইসরাইল ও মুসলমানদের জন্য ফিলিস্তিন। কী অদ্ভুত! যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটিকে ভাগ করার প্রস্তাব করা হয় অথচ সে রাষ্ট্রের জনগণের কোনো মতামতই নেয়া হলো না। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো- প্রস্তাবটি পাস হওয়ার সাথে সাথে ইহুদি নেতা ডেভিড বেন গোরিয়ান ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ফলে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সাথে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। ইহুদিরা তো পরিকল্পনা মাফিক প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী ও বিশাল অস্ত্রসম্ভারসহ প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষাই করছিল। সুতরাং যুদ্ধের ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। ফিলিস্তিন ও গাজার অংশ বিশেষসহ আরব দেশগুলোর বিরাট ভূখণ্ড ইহুদিদের দখলে চলে গেল। এরপর আবারো ১৯৬৭ সালে ইসরাইলিরা অতর্কিত আক্রমণ করে জর্দান নদীর পুরো পশ্চিমতীর, গাজা ও সিনাইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেয়। নিজেদের বিস্তীর্ণ এলাকা হারানোর পরও অজ্ঞাত কারণে মিসর, জর্দান ও সিরিয়া অনেকটা চুপ হয়েই রইল। কিন্তু এ অঞ্চলের আদিবাসী ফিলিস্তিনিরা তো আর চুপ থাকতে পারল না। কারণ তাদের পৈতৃক ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি কি তারা নিতে পারে? সুতরাং অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তাদেরকে প্রতিরোধ সংগ্রামে নামতে হলো।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আরব লিগের উদ্যোগে ১৯৬৪ সালের ২৮ মে প্রতিষ্ঠিত হলো Palestine Liberation Organization (PLO). জেরুসালেমে এর প্রধান কার্যালয়। সিংহপুরুষ ইয়াসির আরাফাত নির্বাচিত হলেন এর চেয়ারম্যান। তার সাহসী ও গতিশীল নেতৃত্বে বিশ্বে মুক্তি সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়াল পিএলও। বিশে^র প্রায় সব দেশের স্বীকৃতি পেল সংস্থাটি। ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসঙ্ঘে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও পেল। পৃথিবীর ১০০টিরও অধিক রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থাপন করল। কিন্তু কার্যত পূর্ণ স্বাধীন একটি ভূখণ্ড তারা পেল না। সুতরাং নিজেদের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলল। এ প্রতিরোধে দিশেহারা হয়ে ইসরাইল তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের দিয়ে ১৯৮৭ সালে জাতিসঙ্ঘে পিএলওকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করায়। জাতিসঙ্ঘের পক্ষে এটি খুবই অন্যায়। যে যুদ্ধ খ্রিষ্টান-ইহুদি চক্র ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দিলো, যে যুদ্ধ ১৯৬৭ সালের একতরফা ইহুদি বর্বর আক্রমণের মাধ্যমে আরো বিস্তৃত করা হলো, সে যুদ্ধে শুধু আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে ফিলিস্তিনিরা হয়ে গেল ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী’! কী অন্যায় সিদ্ধান্ত! আক্রান্তরা কি আক্রমণের প্রতিবাদ প্রতিরোধটুকুও করতে পারবে না? তাদের ভিটেমাটি রক্ষার অধিকার কি তাদের নেই? এ কেমন কথা? যাই হোক বিচার পৃথিবীবাসীর কাছে পাওয়া যাবে না এটি বোঝাই গেল। এতে পিএলও একটু বেকায়দায় পড়ল ঠিকই কিন্তু দমে যায়নি।

এরই মধ্যে পশ্চিমতীর, গাজা ও ১৬৫টি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর পিএলও একটি স্বাধীন ‘ফিলিস্তিন’ রাষ্ট্রের ঘোষণা দিলো। ইয়াসির আরাফাত নির্বাচিত হলেন এ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এরপর বন্ধুরাষ্ট্রগুলো ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যস্থতায় ১৯৭৯ সালের US Camp David চুক্তি ও ১৯৯৩ সালের অসলো (নরওয়ে) চুক্তির আওতায় পিএলও জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ ও ৩৩৮ নং প্রস্তাব মেনে নেয়। অর্থাৎ ‘ইসরাইল’ নামের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে। ফলে জাতিসঙ্ঘও সন্ত্রাসী সংগঠনের ঘোষণা প্রত্যাহার করে ‘ফিলিস্তিন’কে অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়। একই সাথে ইসরাইলও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঘোষণা করে। এভাবে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে চলতে থাকে। এরই মধ্যে পিএলও এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনে গঠিত র‌্যাডিকেল সংগঠন হামাসও একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে। এক পর্যায়ে ২০০৭ সালে হামাস অবরুদ্ধ গাজা দখল করে নিলে নবগঠিত ‘ফিলিস্তিন’ কার্যত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিমতীরে রামাল্লাকেন্দ্রিক পিএলও শাসিত অংশ এবং গাজায় হামাস শাসন। অবশ্য ২০১১ সালে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে একত্রিত হয়ে ২০১৪ সালে ‘ঐক্য সরকার’ কার্যক্রম শুরু করে। এদিকে ফিলিস্তিনের ধ্রুপদী নেতা ইয়াসির আরাফাতের রহস্যজনক অকাল মৃত্যুর পর পিএলও নেতা মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এতসব আনুষ্ঠানিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতা চললেও ফিলিস্তিন ও তার অধিবাসীরা কার্যত ১৯৪৮ সাল থেকে পরাধীনতার নাগপাশেই আবদ্ধ হয়ে আছে। কার্যকর বাস্তব স্বাধীনতা এখনো তারা পায়নি। এমনকি তাদের পবিত্র মসজিদুল আকসাও ইহুদিদের দখলে। চল্লিশোর্ধ্ব বয়স না হলে ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসায় জুমার নামাজও আদায় করতে যেতে পারে না। প্রতি শুক্রবার ইসরাইলি সেনার বাধা পেরিয়ে বিক্ষোভ করতে করতে এবং কখনো বা গুলি খেতে খেতে তাদের জুমার জামাতে যেতে হয়। এরই মধ্যে আবার গত মে মাসেও ১১ দিনব্যাপী ইসরাইলি বর্বরতায় নারীÑশিশুসহ ২৩৮ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারায়। গাজার শত শত অট্টালিকা মাটিতে মিশে গেছে। হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হাসপাতালে বা রাস্তায় এখানে-সেখানে পড়ে কাতরাতে দেখা যায়। আর এ পুরো ধ্বংসলীলা ও হত্যাযজ্ঞ ঘটে পবিত্র রমজান মাসে, এমনকি ঈদুল ফিতরের দিনও। এ মানবেতর অবস্থায়ও তাদের জন্য বিশ^মানবকুলের পাঠানো সাহায্যটুকুও গাজায় ঢুকতে দেয়নি ইসরাইলিরা। মে মাসের ধ্বংসযজ্ঞের পরও কিন্তু বর্বরতা এখনো থামেনি। বাবার সাথে পথে বেরিয়ে ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারিয়ে ১২ বছরের শিশুর নিথর দেহ বাবারই কোলে ঢলে পড়ার মতো ঘটনার চিত্র আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্বের বাকি অংশে আমরা যখন দৈনন্দিন কর্মজীবনে ব্যস্ত, আহার-নিদ্রা আর বিনোদনে আয়েশি সময় পার করছি, রোজা শেষে দিনান্তে বাহারি ইফতার নিয়ে টেবিলে বসছি ঠিক তখনই গুলি খেয়ে আমাদের নিরীহ ফিলিস্তিনি ভাইদের নিথর রক্তাক্ত দেহগুলো আল কুদসের পবিত্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। কী করোনা, আর কী রোজা-ঈদ সবকিছু ছাপিয়ে তাদের দেহ ঝাঁঝরা করে ফিনকি দিয়ে বেরুনো রক্তে আজ পুরো ফিলিস্তিন, জর্দান নদী আর আরব সাগরের জলরাশি রঞ্জিত। মানুষগুলোর কারো মুখে হাসি নেই, নেই কোনো স্বস্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এভাবে আর কত দিন? কবে আবার এ চমৎকার ফুটফুটে মুখগুলোতে একটু হাসির ঝলক দেখা যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর কি কারো জানা আছে? সম্ভবত নেই। আর নেই বলেই আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ, তিনি আবার কবে একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবিকে পাঠাবেন ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষগুলোকে রক্ষার জন্য? একই সাথে তাঁর প্রিয় মসজিদুল আকসাকে অপবিত্র হাত থেকে এবং মানবতাকে পঙ্কিলতা থেকে উদ্ধারের জন্য?

লেখক : প্রফেসর, রসায়ন, প্রাক্তন মহাপরিচালক, নায়েম এবং প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড


আরো সংবাদ



premium cement