২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কোয়াডে ভারত-আমেরিকা অভিমান!

- ছবি : সংগৃহীত

ঘটনার ২০ বছর ‘কোয়াড’ শব্দটি কেবল আমেরিকার আফগানিস্তান দখলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে, তাই নয়। শব্দের আরেক বড় প্রয়োগ সামনে এসেছে। আমেরিকা-ভারতের গত ২০ বছরের বিশেষ সম্পর্ক এবার হেলে পড়েছে মনে হচ্ছে। তা-ও ক্ষোভ অভিমানকেও বোঝাচ্ছে। বিশেষ করে গত ২৪ সেপ্টেম্বরের পরের ঘটনায়। কেন?

আসলে ভারতের খুবই গর্বের ‘কোয়াড’ নিয়ে কথা বলছি। এত দিন কোয়াড প্রসঙ্গে এর উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বললে মানে হতো আপনি দুনিয়ার কথিত ‘বেস্ট ডেমোক্র্যাটিক’ রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু এখন খোদ লন্ডন ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনে এক আর্টিকেলের শিরোনাম ‘কোয়াডের কাজটা কী’?

গত ২৪ সেপ্টেম্বর ছিল হোয়াইট হাউজে কোয়াডের চার নেতার এই প্রথম মুখোমুখি কোনো মিটিং করতে বসার দিন। আগের লেখায় বলেছিলাম, এটিই প্রথম মুখোমুখি মিটিং; তবে এটিই শেষ মিটিংও হতে পারে। আর এখন ওই মিটিং শেষে যত দিন যাচ্ছে তাতে ভারতের ওপর আমেরিকার গোসসা আর চেপে রাখা নানান ক্ষোভ ও অভিমান ততই সামনে আসছে। তবে সম্পর্কটা আপাতত কেউই ভেঙে দিচ্ছে না। তবে অকার্যকর ফেলে রাখার ঝোঁকটাই বেশি। কেন?

ছোট্ট জবাব হলো, স্বামী সতীন নিয়ে এসেছে যেন! মানে হলো, আমেরিকা চীনের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু চালিত সাবমেরিনে সজ্জিত করতে ইংল্যান্ডকে সাথে নিয়ে ‘আউকুস’ (অটকটঝ) নামে এক ত্রিদেশীয় নয়া জোট ঘোষণা করেছে; অর্থাৎ চার সদস্যের কোয়াড অথচ এর দুই সদস্য মিলে যুক্তরাজ্যকে সাথে নিয়ে নতুন আরেক জোট গড়ার ঘোষণা করেছে আর এবার আগেভাগেই ঘোষণা করে দিয়েছে এটি ‘সামরিক জোট’। এতে যেন এক প্রকাশ্য ইঙ্গিত যে, আমরা ভারত অনেক অপেক্ষা করেছি আর না। এতে পাল্টা যেন বাইডেন বলছেন, ‘এখন তোমরা ভেবে দেখো, এই সামরিক জোটে যুক্ত হবে কি না, না হলে রাস্তা মাপো! আর এ নিয়ে কার্ড শো করো, তোমাদের মনে কী আছে ঝেড়ে কাশো। সেটি দেখতেই তো ২৪ তারিখে মিটিং ডেকেছি- এখানে মুখোমুখি হও!’

এখানে ভাষ্যটা অনুমান-কল্পনা করে লেখা। কিন্তু বাস্তবে ঘটনাটি ঘটেছে। নরেন্দ্র মোদির হোয়াইট হাউজ রওনা হওয়ার দুই দিন আগে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হর্ষবর্ধন শ্রীংলা যে প্রেস ব্রিফিং করেন, সেখানেই সুনির্দিষ্ট করে তিনি বলেছিলেন, কোয়াড অথবা মোদির কোয়াড মিটিংয়ে যোগ দিতে হোয়াইট হাউজে যাওয়ার সাথে ত্রিদেশীয় নয়া জোট আউকুসের কোনো সম্পর্ক নেই। ‘দ্য হিন্দু’ এ নিয়ে ২১ সেপ্টেম্বরে বিস্তারিত এক রিপোর্টে লিখেছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা এই নয়া জোটের কেউ নই। আমাদের চোখে কোয়াডের সাথে এই নয়া জোটের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। অথবা কোয়াডের তৎপরতায় এর কোনো সম্পর্ক ও প্রভাব নেই।’

কিন্তু শ্রীংলার এসব কথাতে মিডিয়ার কৌত‚হল মেটেনি। তারা আরো প্রশ্ন করেন তা হলে মোদির এই হোয়াইট হাউজ সফর কি নয়া জোটের প্রভাবের নিচে গুরুত্ব হারিয়ে চাপা পড়ে যাবে? অন্য এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেন, কোয়াড কি এখন থেকে তা হলে ‘নরম-সরম’ ধরনের ইস্যুতে নিজেকে নামিয়ে নেবে? শ্রীংলাকে তাই আবার এ নিয়ে মুখ খুলতেই হয় যদিও তাতে বিপদ আরো বেড়ে যায়, কমেনি। তিনি বলেন, “নয়া জোট একটি সামরিক জোট। আর কোয়াড আলাদা লক্ষ্য নিয়ে আলাদা কিছু দেশের গ্রুপ। তবে কোয়াডের চার সদস্য দেশ আবার মালাবার এক্সারসাইজ নামে আরেক সমমনাদের কাজের জোট, যারা প্রায়ই মূলত একসাথে যৌথ নৌমহড়ার আয়োজন করে থাকে। কিন্তু আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে ‘মালাবার নৌমহড়া গ্রুপের’ সাথে কোয়াডের কোনো সম্পর্ক নেই”- শ্রীংলা বলেন।
কিন্তু আমাদের কাছে এটি কৌতুকের যে, এখন ভারত কোনো সামরিক তৎপরতা বা সামরিক জোটের সাথে নেই বলে এখন হাত ধুয়ে ফেলতে চাচ্ছে; অথচ যতবারই ওসব নৌমহড়া হয়েছে মিডিয়া রিপোর্টে সবসময় তা কোয়াডের নামে হচ্ছে বলেই রিপোর্টেড হয়েছে। কিন্তু ভারতসহ কেউ এর বিরুদ্ধে কোনো সংশোধনী বা আপত্তি করেনি।

অভ্যন্তরীণভাবে ভারতের শাসক-নেতাদের মনে এটি পরিষ্কার না থাকার কারণ নেই যে, কোনো যুদ্ধে জড়ানোর মূল বিপদ হলো, নিজ খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরো খারাপ করে ফেলা। ফলে পাকিস্তানের ইস্যু ছাড়া কোনো যুদ্ধে না জড়ানোই অন্য সব দেশের মতো ভারতীয় মনের সাধারণ অবস্থান। কিন্তু এ দেশের নাম ভারত যার আরেক নাম হওয়া উচিত ‘ভান ও ভণিতা’র দেশ। এরা বাস্তবতাকে কখনো প্রকাশ পেতে দেবে না; বরং যা সে নয় তাই সে ‘শো’ করবে, যেটাকে আমরা শো-আপ করা বলি।

ভারত শো-আপ করা ছাড়া কিছুই করতে পারে না। এটি নেহরু কংগ্রেসের ভারতের প্রথম প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলা তথাকথিত কমিউনিস্ট অর্থনীতির (বিদেশের বিনিয়োগ নেয়া যাবে না) পরিণতি। গ্রামের মানুষ উন্মুখ হয়ে কাজের খোঁজে শহরে-রাজধানীতে এসে থাকে কিন্তু নেহরুর ভারতের ক্ষেত্রে চার প্রজন্ম পার হয়ে গেলেও সেই বস্তিবাস অথবা জীবনমানের নিম্ন ও স্থবির দশায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। খারাপ অর্থনীতিতে কাজের অভাবে পড়ে চরম দুঃখ-দুর্দশাগুলোর প্রকাশ অনেক ধরনের হয়ে থাকে। এর একটি হলো মধ্যবিত্তের উত্থান-পরিবর্তনগুলোকে স্টাডি করে সেটি বোঝার চেষ্টা অনেক পুরনো হলেও ভারতের এই চার প্রজন্মের খবর খুবই রেয়ার। বাংলাদেশের সাথে যদি তুলনা করা হয়, এখানে দেখব কোনো প্রথম প্রজন্ম যদি ঢাকায় এসে বাসের হেলপার হয়, তবে পরের প্রজন্মের কর্তা বাস ড্রাইভার হতে পারে। আর এখানে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো ঘটনা হলো, একালে বাস ড্রাইভারের মেয়ে কলেজে পড়ে! লম্বা সময় ধরে একই নিম্ন জীবনমান ধরে আটকে থাকতে বাধ্য হলে তখন সময়ে এর কালচারাল প্রভাব হয় মারাত্মক। যেমন- স্বল্প আয় বলে, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার রান্নার তেল কিনে আধাছটাক করে। তবে তা নিয়ে কথা বলার কিছু নেই। কিন্তু সে সেটি কিনবে পকেটে করে শিশি নিয়ে গিয়ে। কেন? কেউ যখন তা কিনে বাসায় ফিরবে, তা যেন পড়শি পরিবারের দেখে না ফেলে। কেন এমন হয়?

পড়শিও কি তার মতো একই অর্থনৈতিক জীবনমানের নয়? অবশ্যই। আসলে তারা নানা সামাজিক আসরে পরস্পরের কাছে ভান-ভণিতায় শো করেছে, তার জীবনমান অনেক ভালো বা উঁচু। আর এমন সবচেয়ে বিপজ্জনক ‘শো-আপ’ হলো যখন তারা পরস্পরকে শো-আপ করে যে, তাদের জীবন নিয়ে তারা খুশি, খুব ভালো আছে। সে কারণে এই মিথ্যা শো-আপটার সাথে আধাছটাক তেল কিনে আনাটা মেলে না বলেই সে পকেটে শিশি ঢুকায়! সব ঢেকেঢুকে ভণিতা করতে চায়। অথচ যেটা সবাই জানে আর যেটা পড়শি সবারই অবস্থা সেটি আর একে অপর থেকে লুকানোর চেষ্টার কী আছে? কিন্তু এখন এই যে শো-আপ এটি সম্ভবত মধ্যবিত্তের একটি ‘জাতীয় কালচারে’ পরিণত হয়েছে।

ভারতের ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর গান্ধী পরিবারের বাইরে নরসীমা রাও নতুন প্রধানমন্ত্রী হন। আর তারই অর্থমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। কিন্তু তত দিনে আগের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জেনে গিয়েছিলেন, দাদামশাই নেহরুর কমিউনিস্ট আকামটা কী করেছিলেন; কারণ এর আগেই মনমোহন অনেক দিন ব্যাংকের গভর্নরসহ ভারত সরকারের নানা অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ সব পজিশনের দায়িত্বে তিনি ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী রাজীবকে বোঝানোর সুযোগ নিয়েছিলেন যে, নেহরুর কথিত কমিউনিস্ট অর্থনীতির কাঠামোটা ফেলে এর সংস্কারই একমাত্র সমাধান। এরই মধ্যে ১৯৯০ সালে ভারত ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতির মুখে পড়ে যায়। ফলে আইএমএফ লোনের দ্বারস্থ হতেই হয়। কমিউনিস্ট অর্থনীতির বেকুবিপনা আর অচলতা উদোম হয়ে যায়। এ কারণে পরের বছর নতুন সরকারে সহজেই ড. মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী হয়ে সংস্কার শুরু করেছিলেন।
এ দিকে পরবর্তীতে নতুন শতকে, তত দিনে চীনের অর্থনীতি ডাবল ডিজিট গ্রোথে প্রবেশ করেছে। ফলে ডেভেলপড অর্থনীতির উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে ‘রাইজিং অর্থনীতি’ বলে নয়া টার্ম চালু হয়। দুনিয়ার বড় জনসংখ্যার দেশ হিসেবে চীন (১৩৯ কোটি) সবার উপরে আর তার পেছনে ভারত (১৩৫ কোটি)। এমন জনসংখ্যা বেশির দেশে অর্থনীতি খারাপ থাকলে ওদেশের লোক কম ভোগ করলেও অর্থনীতিটা সাইজে বড় গ্রæপে গিয়ে পড়ে। চীনের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটিই তত দিনে শুধু জনসংখ্যাতেই বড় নয়; আবার অর্থনৈতিক সামর্থ্য অর্থে বড় উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চীনের সাথে ভারতের ফারাক হলো, জনসংখ্যাতেও সে বড় অবশ্যই তবে চীনের মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য অর্থে বড় উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ের দেশ সে তখনো নয়। কিন্তু পটেনশিয়াল দেশ মাত্র। কিন্তু ওদেশের সরকারের কোনো লোভী বা ওভার-এস্টিমেটেড সিদ্ধান্ত এর সব সম্ভাবনা শেষ করে দিতে পারে। ওই সময়ই এই রাইজিং ইকোনমি টার্মটা চালু হলে ব্যাপারটা আমেরিকার নজরে আসে।

এমনিতেই নাইন-ইলেভেনের হামলার পাল্টা, আফগানিস্তানে আমেরিকার হামলার পক্ষে বিভিন্ন দেশের সমর্থন নিতে গিয়ে ২০০২ সালের মধ্যে কথিত সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে ভারত ও আমেরিকা, তাদের মধ্যে আঁতাত হয়ে যায়। ইসলামবিদ্বেষীভাবে কাদের ও কিভাবে সন্ত্রাসী বলবে, তা ঠিক হলো। আর সাথে রাইজিং ইকোনমি বিষয়ে ভারতের সাথে কাজ করার গ্রাউন্ড তৈরি করাও শুরু হয়েছিল। এখান থেকেই এশিয়ার দুই রাইজিং অর্থনীতির দু’টি চীন ও ভারতকে একসাথে মোকাবেলা করতে না গিয়ে, বরং একটিকে আরেকটির বিরুদ্ধে খাড়া করতে প্রলোভন ও প্রশ্রয়ের পিঠে হাত রাখার পরিকল্পনা করেছিল আমেরিকা। এখান থেকেই ভারতের পিঠে হাত রেখে ‘চীন ঠেকানোর’ পরিকল্পনা ও তৎপরতার শুরু। আর তাতেই তারা লোভী করে তোলা, ভারতের মাথা ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়ে যায়।

এ কাজটি আমেরিকা করেছিল কিছু আমেরিকান থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দু’ভাবে। ভারতে ওই সব থিংকট্যাংকের এক্সটেন্ডেড শাখা খুলে এবং এক চীনবিরোধী ক্যাম্পেইন দিয়ে তাদের প্রলুব্ধ করে। আর দ্বিতীয়টি হলো, স্কলারশিপ বিতরণ। হায়ার স্টাডিজে আকাক্সক্ষী (মাস্টার্স বা পিএইচডি) স্টুডেন্টদের স্কলারশিপ দিয়ে আমেরিকার চীনবিরোধী বয়ানের অংশ করে নেয়াটা এর লক্ষ্য; যাতে তারা বিশ্বাস করতে ও প্রচারণা করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। (এবারো হোয়াইট হাউজ মিটিংয়ে বাইডেন আবার এক স্কলারশিপ চালুর ঘোষণা দিয়েছেন।) এ বিষয়ে প্রথম কথাবার্তা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সাল থেকেই, মনমোহন সিং প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলে। আর পরে চুক্তি হয়েছিল ২০০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের ভারত সফরকালে। সে সময় ভারত ব্যাপারটাকে দেখেছিল নিজেকে আর থিংকট্যাংক খুলতে পয়সা খরচ করতে হলো না, এমনই সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে।

সেকালের ভারতে থিংকট্যাংক বলতে সামরিক বাহিনীই নিজ বাজেট থেকে অর্থ নিয়ে তাদের এক্সটেনডেড প্রতিষ্ঠান হিসেবে সীমিতভাবে চালানো কিছু স্টাফ দিয়ে খাড়া রেখেছিল। বাজেট স্বল্পতা থাকলে প্রতিষ্ঠান যেমন হয় তাই। আমেরিকান বয়ান ভারতে প্রবেশ করেছিল এভাবেই সুযোগ নিয়ে। আর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো একটা বয়ানে এসবের সমন্বয়ের নিয়ম তারা চালু করেছিল তখন থেকে। সেটি সম্ভব হয়েছিল যেসব কারণে যেমন, এখন ভারতে থিংকট্যাংক জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সবাই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত; কারণ তাদের প্রতিটি প্রোগ্রাম এই মন্ত্রণালয়েরই পূর্বানুমতিপ্রাপ্ত। ফলে সমন্বিত। আর থিংকট্যাংক জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বলতে সরকারি, একমাত্র (ব্যবসায়ীদের দেয়া দাতব্য অনুদানে চলা) ওআরএফ আর এবার এসবের সাথে আমেরিকান থিংকট্যাংকের ভারতীয় শাখা এবং ভারতীয় যারা আমেরিকান থিংকট্যাংকের ফেলো হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ও আমেরিকায় বা ভারতে থাকেন। এতে ভারতীয় মন্ত্রণালয় ও আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট (আমেরিকান থিংকট্যাংকসহ) যেটা সমন্বিত অবস্থান সময়ে নেয়, সেটিই সংশ্লিষ্ট সবার ওপর, তাই সবার কমন অবস্থানের গাইড লাইন হয়। তবে ট্রাম্প আমলে এসে তার আমেরিকা ফার্স্ট নীতিতে এসব স্কলারশিপ না এনজিও ফান্ড সব বন্ধ হয়ে যায়। তবুও আমেরিকান থিংকট্যাংকের তৎপরতা খুবই সক্রিয় ছিল মূলত জয়শঙ্করের কারণে, যাকে আড়ালে ভারতের সবচেয়ে বড় আমেরিকান থিংকট্যাংকের এজেন্ট বলেন অনেকে; ওদিকে আমেরিকান স্বার্থে স্কলারশিপের মূল অনুমোদনদাতা ভারতীয় যে মূলত আমেরিকানদের প্রধান লোক সে তখন থেকে ভারত ছেড়ে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চাকরি নিয়ে আছেন। তখন থেকে ভারতে আমেরিকান থিংকট্যাংক তৎপরতা কিছুটা ঝিমিয়ে ছিল। বাইডেন সম্ভবত চাচ্ছেন সেটিকে সবার আগে আবার চালু রাখতে।

এটি এত বিস্তারিত বললাম এ জন্য যে, এবারের মোদির হোয়াইট হাউজ সফর শেষে অথবা বলা যায় কোয়াডের চেয়ে যেন সতীন প্রতিষ্ঠান আউকুস খাড়া হওয়াতে, উপেক্ষিত বোধ করা ভারতের ক্ষোভ-অভিমান যা ক্রমেই বের হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, এবারই প্রথম আমেরিকান বয়ান আবার নীরবে খেতে, মেনে চলতে ভারত আপত্তি তুলবে; অর্থাৎ এটিই আফগানিস্তানে তালেবানে উত্থানের বাইরে আরেক প্রায় ২০ বছরের ঘটনা। এর পুরনো ‘সেটিংসের’ এবার ভেঙে পড়ার ঘটনা হবে এটি। এটিই ভারত-আমেরিকার এত দিনের থিংকট্যাংক সম্পর্ক ভেঙে পড়া।

এমন কোথায় কোথায় এখন ভারতের আঘাত লাগবে এর একটি তালিকা পাওয়া যায়- হর্ষ ভি পন্থ-এর লেখা থেকে। পন্থ মূলত লন্ডন কিংস কলেজের শিক্ষক। কিন্তু তিনি ভারতে সক্রিয় সবচেয়ে বড় থিংকট্যাংক ওআরএফ বা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টরও। তিনি এবার লেখাটা ছাপতে দিয়েছেন আমেরিকান ম্যাগাজিনে ‘ফরেন পলিসি’-তে।

ফরেন পলিসি (আমেরিকান এলিটদের পত্রিকা ফরেন অ্যাফেয়ার্স নয়। দু’টিই কাছাকাছি নামের বলে ভুল বোঝা থেকে সতর্ক করতে এ কথা বলছি। এ পত্রিকার পজিশন আগে যাই থাক না কেন, বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে এ পত্রিকাটা বিশেষভাবে অ্যাসাইন্ড এক পত্রিকা। সাধারণভাবে পত্রিকাটা বাইডেনের অঘোষিত এক পাবলিক মুখপাত্রের মতো তার সব পলিসির পক্ষে প্রচার করা এর অবস্থান। বিশেষত আরেক আমেরিকান প্রফেসর কুগেলম্যানকে হায়ার করা হয়েছে। আর তাকে কেন্দ্র করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাইডেনের নীতি-পলিসির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিন চার-পাঁচটি দেশে কী ঘটছে তা নিয়ে সরাসরি কুগেলম্যানের মন্তব্য এ পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। উল্টো করে বললে এতে- কুগেলম্যানের মন্তব্য থেকে বাইডেনের মনোভাবের কিছু হদিস মিলা সম্ভব।
এই ফরেন পলিসি পত্রিকাতেই হর্ষ পন্থের ভারতের ক্ষোভের তালিকাসমৃদ্ধ লেখাটা ছাপা হয়েছে। এর আক্রমণাত্মক শিরোনামটা হলো- ‘ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের টিকে যাওয়া এই কোয়াড টিকে কি না তার ভাগ্য পরীক্ষা’। এ ছাড়া এ লেখায় তিনি এশিয়ায় আমেরিকা তার বিদেশনীতি বদলে ফেলেছে বলে আমেরিকাকে অভিযুক্ত করেছেন। এমনকি খুবই কড়াভাবে ভারত-আমেরিকা বিরোধের কথা উল্লেখ করে আবার- এটিকে ‘কনফ্লিক্টিং অব প্রায়োরিটি’ ক্যাটাগরিতে ফেলেছেন। নাম ধরেই বলেছেন, ‘ভারতের প্রায়োরিটি পাকিস্তান’। মানে বলতে চাইছেন, বাইডেন ভারতের ইচ্ছার পক্ষে, (আসলে মূলত তালেবান ইস্যুতে) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চাপ দিচ্ছে না। আর আমেরিকান প্রায়োরিটি নাকি তাইওয়ান- মানে ভারত তাইওয়ানের পক্ষে সামরিকভাবে নামতে আমেরিকার নয়া সামরিক জোটে যাচ্ছে না।

কথাটি জমেনি বা অর্থ হয়নি। অনেকটা জোর করে মিলিয়ে বলা। কারণ তালেবান ইস্যু কি কেবল ভারত-পাকিস্তান ইস্যু? তা তো কখনো নয়, কারণ খোদ বাইডেনের আমেরিকার স্বার্থই তো অনেক বড়। সেটি পরোয়া না করে বাইডেন কেবল ভারতের ইচ্ছার পক্ষে কাজ করবে আশা করাটাই যে করে তারই সমস্যা! এটি না বোঝার তো কিছু নেই।

এ দিকে আমেরিকার জন্য কেবল ভারতের ক্ষোভই ‘একমাত্র’ নয়। এর থেকেও বড় বাইডেনের মাথাব্যথা হলো চীন। না নতুন করে আমেরিকা ও চীনের মাথাব্যথা এটি নয়; বরং তা থেকে ছুটবার আলো এটি। আসলে এটি চীনের সাথে আমেরিকার ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ যেটা ট্রাম্প শুরু করে দিয়ে গিয়েছিলেন এবং তা থেকে সব ধরনের যুদ্ধ লেগে যাওয়ার উপক্রম। আর ক্ষমতা ত্যাগের আগে ট্রাম্প বড়াই করে বলে গিয়েছিলেন যে, তা দেখানো পথই বাইডেনকে অনুসরণ করে যেতে হবে। কারণ এখন ‘শক্ত বাঁধন’ তিনি দিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা (অন্তত আমি নিজে) অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, বাইডেন বোকা হয়ে এই ইস্যুতে ট্রাম্পকেই অনুসরণের নীতি অনুসরণ করতে গেলেন। আর তাতে চীনের সাথে আলোচনার ‘আলাস্কা বৈঠকে’ই সব শেষে মারামারি লাগার অবস্থা। সেই থেকে বাণিজ্য যুদ্ধ বা আলোচনা একেবারেই বন্ধ ছিল। কিন্তু বন্ধ থাকলে যা হয়, চীন-আমেরিকা যত ধরনের শত্রুতা সম্ভব তা ডালপালা মেলতে থাকে।

নিজ অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির চাপের মুখে আর তিন ডজন ব্যবসায়ী ফেডারেশন কর্তৃক লিখিত অনুরোধ যে, চীনের সাথে বাণিজ্য আলাপে চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক সরাতে যেন দ্রুত শুরু করা হয়। মিডটার্ম নির্বাচনে নিজ ডেমোক্র্যাট দল হারবে এই পূর্বাভাস দেখে বাইডেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সাথে ফোনে কথা বলেন। অনেকে বলছেন এতে শি জিন শর্ত দিয়েছেন; অনেকে বলছেন, তিনি আবার বাণিজ্য আলোচনা করতেই চাননি। আর বাস্তবে আমরা দেখছি আলোচনা ফের শুরু করার পরিবেশ সৃষ্টির নামে বাইডেন চীনের বিরুদ্ধে- উইঘুরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বয়ান ঘুরে যাওয়ার ইঙ্গিত, হুয়াওয়ে ফোনের সিএফওকে তিন বছর ধরে কানাডায় আটকে রাখার পরে বন্দিবিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেয়াসহ সব কিছু শুরু হয়েছে। তা হলে হুয়াওয়ের ফাইভ-জি টেকনোলজিতে অবরোধও কি তুলে নেয়া হবে; চীনে পশ্চিমা মাইক্রোচিপস বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞাও কি? এটি কোথায় গিয়ে থামবে?

তবে এসব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের লিস্ট যত লম্বা হবে ততই আমেরিকার ওপর ভারতের ক্ষোভ বাড়বে বলেই অনুমান! কারণ বাইডেন ক্ষমতার শপথ নেয়ার পর থেকে মোদির কামনা ছিল চীন-আমেরিকা সম্পর্ক যত তিতা হবে, তা মোদির জন্য ভালো। কারণ যাতে সেই তিতা সম্পর্কের আড়ালে কমলা হ্যারিসের তোলা ভারতের বিরুদ্ধেও মানবাধিকারও খারাপ রেকর্ড (কাশ্মিরের স্ট্যাটাস, ভারতজুড়ে মুসলমান নিপীড়ন ও বিদ্বেষ প্রভৃতি) চাপা পড়ে যায়। দুনিয়া আসলেই আর আগের মতো সব সম্পর্কে থাকছে না।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement