২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইউরোপ-আমেরিকায় কৌশলগত ফাটল?

-

যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন ও এর ইংরেজিভাষী বন্ধু দেশগুলোর সাথে অবশিষ্ট পাশ্চাত্য ইউরোপের কৌশলগত মিত্রতায় কি ফাটল ধরেছে? এ প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন চুক্তি বাতিল করার ঘটনায়। নতুন ব্যবস্থায় অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে প্রচলিত সাবমেরিনের পরিবর্তে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পারমাণবিক সাবমেরিন কিনবে। কিছু বিশেষজ্ঞ এটিকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান বাড়ানোর মার্কিন প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে বর্ণনা করেছেন ‘ফ্রান্সের পেছনে ছুরিকাঘাত’ হিসেবে।

ফ্রান্সের ক্ষোভের রেশ কত দূর?
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাঁ-ইভেস লে ড্রিয়ান ইনফো ফ্রান্স ২ কে বলেন, ‘এটি একটি মিথ্যা ছিল, সেখানে দ্বৈধতা ছিল, বিশ্বাসের একটি বড় লঙ্ঘন হয়েছে, সেখানে অবমাননা হয়েছে। সুতরাং এমনটি আমাদের মধ্যে ঠিক নয়, এটি মোটেও ঠিক নয়। এর অর্থ, একটি সঙ্কট রয়েছে।’ লে ড্রিয়ান উল্লেখ করেন, পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়নের জন্য আমরা (ক্যানবেরা এবং ওয়াশিংটন) আমাদের দূতদের ডেকে পাঠিয়েছি। ব্রিটেনের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা তাদের নিরন্তর সুবিধাবাদী হিসেবে জানি। চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অধীনে লন্ডনের ভূমিকা ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’র মতো।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন অবশ্য বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তির পক্ষে সাবমেরিন সরবরাহে ফ্রান্সের সাথে চুক্তি বাতিল করায় তার কোনো দুঃখ নেই। তিনি মনে করেন, ফ্রান্সের অ্যাটাক সাবমেরিনগুলো সার্বভৌম স্বার্থ রক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল না। ফরাসিরা ২০১৬ সালে এক ডজন প্রচলিত ডিজেল-বৈদ্যুতিক সাবমেরিনের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেগুলো তৈরির কাজ এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফরাসি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নেভাল গ্রুপের সাথে চুক্তির মূল্য ছিল ৬৬ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের।

আমেরিকান পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ওয়াশিংটন ফ্রান্সের অবস্থান বুঝতে পেরেছে এবং প্যারিসের সাথে ‘ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ’ করছে। পরে বাইডেনের সাথে ম্যাক্রোঁর এই বিষয়ে লম্বা ফোনালাপ হয়েছে। যেখানে বাইডেন চুক্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে প্রক্রিয়াটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে মনে হয়।

লে ড্রিয়ান ডুবোজাহাজের ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপকে ‘পিঠে ছুরিকাঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছিলেন, বাইডেন প্রশাসনের আচরণ ট্রাম্পের সাথে তুলনীয় ছিল, যার নীতিতে হঠাৎ পরিবর্তন ইউরোপকে হতাশ করেছিল। ফ্রান্সের এ ঘটনায় বিস্ফোরণোন্মুখ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের আগ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ের সাথে ভেতরে ভেতরে যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল, তা অনুমান করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদের দেশে ফিরিয়ে আনার ঘটনা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর আর ঘটেনি। বিবিসির বিশ্লেষক বারবারা প্লেট-আশার লিখেছেন, এটি এক নজিরবিহীন ঘটনা। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল ব্রিটেনের বিরুদ্ধে এবং সেই সময় আমেরিকান মিত্র ছিল ফ্রান্স।

ভেঙে যেতে পারে ন্যাটো!
সাবমেরিনের এই ইস্যু সম্ভবত এখানে শেষ হচ্ছে না। এর রেশ চলতে পারে ন্যাটো জোট পর্যন্ত। যদিও বাইডেন-ম্যাক্রোঁ ফোনালাপের পর উত্তেজনা কিছুটা কমেছে। ফ্রান্সের আগের বক্তব্য হলো, আগামী বছর মাদ্রিদে শীর্ষ সম্মেলনে কৌশল পুনর্বিবেচনার সময় কী ঘটেছে তার হিসাব নিতে হবে ন্যাটোকে । ২০২২ সালের শুরুর দিকে এই ব্লকের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার সময় ফ্রান্স ইইউ নিরাপত্তা কৌশল তৈরিকে অগ্রাধিকার দেবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

ফ্রান্সের এত ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ প্রধানত তিনটি : একটা কারণ : এবার ‘অকাস’ চুক্তি করার আগে অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের সাথে করা ডিজেলচালিত ১২টি সাবমেরিন নির্মাণের চুক্তিটি বাতিল করে দেয় এবং এটি বাতিল হওয়ায় ফ্রান্সের ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। তা ছাড়া ফ্রান্সের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের কিছু না জানিয়ে অত্যন্ত গোপনে এ চুক্তি দ্বারা ফ্রান্সকে অপমান করা হয়েছে এবং ন্যাটো মিত্রদের মধ্যকার বিশ্বাস ও আস্থা এতে ভেঙে গেছে। আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ফ্রান্সের নিজস্ব স্বার্থ আছে। সেখানে নিউ ক্যালেডোনিয়ার মতো দ্বীপগুলোতে বহু ফরাসি নাগরিক বাস করেন এবং কয়েক হাজার ফরাসি সৈন্যও সেখানে মোতায়েন আছে। তাই অস্ট্রেলিয়ার সাথে সাবমেরিন চুক্তি বাতিল হওয়ায় ফ্রান্স ওই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির একটি সুযোগ হারাল।

ন্যাটো জোটের যে সমন্বিত সামরিক কমান্ড কাঠামো, ২০০৯ সাল থেকে, ফ্রান্স তার সদস্য হবার আগের ৪৩ বছর এতে ছিল না। অকাস সাবমেরিন চুক্তি নিয়ে এই বিপত্তি তোলার পর ইউরোপের কিছু মহলে এ কথাটা ঘুরছে যে, ফ্রান্স এই কমান্ড কাঠামো থেকে আবার বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এরকম সম্ভাবনা নেই। তবে বছর দুয়েক আগেই ম্যাক্রোঁ ন্যাটোকে ‘কার্যত মৃত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

ম্যাক্রোঁ মনে করেন, এই সাবমেরিন-কাণ্ডে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ন্যাটো জোট এখন পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবে পঙ্গু ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে জিনিসটি আঠার মতো সবাইকে একসাথে রেখেছিলÑ তা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ইউরোপকে নিজের পথ তৈরি করে নেয়ার কথাও বলছিলেন ম্যাক্রোঁ। তার কথা হলো, ন্যাটো জোট গঠিত হয়েছিল মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নকে মাথায় রেখে; কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন বিলুপ্ত। এখন সামরিক বা কৌশলগত জোটগুলোর মূল নজর এশিয়ার দিকে এবং অনেকের মতে, সেখানে প্রধান প্রতিপক্ষ হতে যাচ্ছে চীন। সে কারণেই ম্যাক্রোঁ অনেক দিন ধরেই ইউরোপের স্বতন্ত্র পথে চলার কথা, ‘ইউরোপের কৌশলগত স্বাধিকার’ ও ‘ইউরোপিয়ান সার্বভৌমত্বের’ কথা বলছিলেন। এমন আভাসও পাওয়া যাচ্ছে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য ইইউ প্রতিরক্ষা কমান্ড প্রতিষ্ঠা করবে। এর কাঠামো পুরো প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত ইউর দেশগুলো ন্যাটোর সদস্য থাকবে। সেটি বাস্তবে রূপ নিলে ইউরোপ আমেরিকার কৌশলগত রাস্তা আগামীতে অভিন্ন নাও থাকতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনে জার্মানির বিশাল অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে এবং বাইডেন চীনের প্রতি যে নীতি নিয়েছেন; তাতে তারাও উদ্বিগ্ন। জার্মানির সাথে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যকার বাণিজ্যের চেয়েও বেশি। তাই ফ্রান্স ও জার্মানি মিলে চীনের প্রতি মিত্রতাপূর্ণ অবস্থান নিতে পারে।

বাইডেন ডকট্রিনের কী হবে?
প্রশ্ন হলো, বাইডেন ডকট্রিনে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা বিশ্বকে একতাবদ্ধ করে এর নেতা হওয়ার কথা বলা হচ্ছিল, তার কী হবে? বাইডেন ডকট্রিনে বলা হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র যদি পশ্চিমা বলয়ের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য এগিয়ে না আসে, তা হলে অন্য কোনো পশ্চিমা গ্রুপ সেই স্থান পূরণ করতে পারবে না। এখন বোঝা যাচ্ছে, পাশ্চাত্যের মধ্যে পাঁচ ইংরেজি ভাষাভাষী দেশ (ফাইভ আই) যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে যে বলয় তার বাইরে ভিন্ন একটি মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানির নেতৃত্বে। নিউজিল্যান্ড অবশ্য পাঁচ ইংরেজ রাষ্ট্রের বলয়ভুক্ত হয়ে কোনো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চাইছে না। বাকি চার দেশ এখনো একাত্মই রয়েছে।

আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের দূরত্ব ভেতরে ভেতরে অনেক দূর বেড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রাসহ নানা সিদ্ধান্তে ভিন্ন অবস্থান নিতে নিতে একপর্যায়ে পুরো ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনায় এমনিতেই ব্রিটেনের সাথে ইইউর দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। ব্রেক্সিটের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত রূপ নেয়ার ক্ষেত্রে নেপথ্যে আমেরিকান সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ট্রাম্প তার সময় উগ্র ধারার আমেরিকান জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এমন কিছু পদক্ষেপ নেন, যাতে ইউরোপীয় নেতাদের সাথে একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। অবশ্য দুই প্রভাবশালী ইইউ নেতা ফ্রান্স ও জার্মানির সাথে বিরোধের স্বার্থ-দ্বন্দ্বটি ভিন্ন ছিল।

ট্রাম্প জার্মানির কাছে তার দোরগোড়ায় জার্মান নিরাপত্তা ঘাঁটির জন্য খরচ দাবি করেন। জার্মানির কাছে ন্যাটোর সামরিক ব্যয়ের বর্ধিত অংশীদারিত্বও দাবি করেন। আর এ সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রে জার্মান গাড়ি না কিনে আমেরিকান গাড়ি ব্যবহারের জন্য প্রচারণা চালান ট্রাম্প। এতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও অ্যাঞ্জেলা মারকেলের মধ্যে একটি বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়। ফ্রান্সের সাথে বিরোধের মূল কারণ হলো আমেরিকান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া। আন্তর্জাতিক প্রিমিয়াম প্রতিরক্ষা বাজারে জঙ্গিবিমান, সাবমেরিন আর স্থল প্রতিরক্ষাসামগ্রী পর্যন্ত আমেরিকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এখন পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সই সামনের সারিতে। এ নিয়ে স্বার্থ-দ্বন্দ্ব এত দিন অপ্রকাশিত থেকে গেলেও অস্ট্রেলিয়ার সাথে সাবমেরিন চুক্তি বাতিলের ইস্যুতে এটি আর গোপন থাকল না।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই ইস্যুতে ফ্রান্সের প্রতিক্রিয়ায় চুপ থাকার কৌশল নিলেও এটি যে পূর্ণমাত্রায় কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রূপ নিতে পারে সে শঙ্কা আমেরিকান পত্রপত্রিকায়ও ব্যক্ত করা হচ্ছে। অন্য দিকে ফ্রান্স ও জার্মানি ইউরোপভিত্তিক বিকল্প বলয় নির্মাণের কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স নয়াদিল্লির কাছে আমেরিকান-অস্ট্রেলিয়ান কোয়াডে সক্রিয় না থাকার গোপন বার্তাও দিয়েছে বলে জানা গেছে।

আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর বিষয় হলো, জার্মানি ও ফ্রান্স নতুন করে চীন ও রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে কৌশলগত বোঝাপড়ার বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। জার্মানি ও ফ্রান্সে চীনা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য অন্য অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়ার সাথে বোঝাপড়া এত গভীর যে, আমেরিকান অবরোধ আরোপের পর অনেক কিছু জার্মানি মানেনি। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি বাতিল নিয়ে ট্রাম্প তার পাশে কোনো দেশকেই পাননি। অধিকন্তু ফ্রান্স ও জার্মানি দুই দেশই ইরানে নানা ধরনের যোগসূত্র ও লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে।

ফ্রান্সের সাথে সর্বশেষ যে স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে সে বিষয়ে ম্যাক্রোঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরাও তার সরকারকে সমর্থন করছেন। আগামী নির্বাচনে কোনো কারণে ম্যাক্রোঁ সরকার গঠনে ব্যর্থ হলেও ফ্রান্সের এ বিষয়ে নেয়া নীতি বদলাবে বলে মনে হয় না। একই অবস্থা জার্মানির ক্ষেত্রেও। অ্যাঞ্জেলা মারকেল এবার অবসরে চলে যাচ্ছেন। তার দল সিডিইউ মধ্য বাম ঘরানার প্রতিদ্বন্দ্বী এসপিডির কাছে হেরে গেছে। নতুন কোয়ালিশনের নেতা যে দলই হোক না কেন মারকেলের নীতির পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিদায় নেয়ার পর মূলত এই জোটের নেতা হলো ফ্রান্স ও জার্মানি। এই দুই দেশের বাইরে অন্য দেশগুলোর পৃথক কোনো অবস্থান নিয়ে টিকে থাকার অবস্থা নেই।

পাল্টে যাবে সমীকরণ
পশ্চিমা বলয়ে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বনাম ফ্রান্স-জার্মানি বিভাজন বা ফাটল বাড়লে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সমীকরণও পাল্টে যাবে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপব্যাপী আমেরিকান বলয়ের প্রভাব শিথিল হয়ে পড়তে পারে। সে সাথে, চীনের প্রভাব সীমিত করার জন্য ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে যে কোয়াড এবং চীনের প্রতিবেশী দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে নিয়ে কোয়াড-প্লাস গঠনের প্রচেষ্টা নিয়েছে, তাও কিছুটা অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। কোয়াডের প্রধান অংশীদার ভারত এর মধ্যে ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার অংশীদার হিসেবে রাশিয়া ও চীনের সাথে ভারসাম্য রক্ষা শুরু করেছে। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি যুক্তরাষ্ট্র বলয় থেকে সরে আসে, বিশেষত ফ্রান্স যদি কোয়াডের বিরোধিতা করে; তা হলে ভারত এই সামরিক জোটের নিষ্ক্রিয় সদস্যে পরিণত হবে।

জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রকাশ্য কোনো বিরোধে না জড়ালেও আমেরিকান সামরিক ব্যয়ের একটি অংশ বহন করার চাপ এবং জাপান থেকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে ফেলার পর দেশটি নিজস্ব প্রতিরক্ষা নির্ভরতার কথা ভাবতে শুরু করেছে। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র অকাস জোটেও জাপান নেই। ফলে বাইডেন ডকট্রিনে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের নেতা হওয়া এবং সাধারণ স্বার্থ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা বলয় তৈরির বিষয়টি শুরুতেই দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

জো বাইডেনের প্রশাসন বা আমেরিকান গভীর ক্ষমতা বলয় কি এসব বিষয় না জেনেই অস্ট্রেলিয়ার সাথে সাবমেরিন চুক্তি করে ফ্রান্সকে বিক্ষুব্ধ করেছে? সম্ভবত বিষয়টি সে রকম নয়। বাইডেন বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির বিষয়টি বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই ফ্রান্সকে জানানো হয়েছে। তিনি এই আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন যে, ফ্রান্সের সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা নিরসন করা যাবে।

ফ্রান্সের জন্য, অবশ্যই তার সাবমেরিন চুক্তি বাতিল করা একটি বেদনাদায়ক অপমান এবং এর হাই-টেক প্রতিরক্ষা শিল্পের হাজার হাজার শ্রমিকের জন্য একটি গুরুতর আঘাত। এটি রাজনৈতিকভাবে একটি স্পর্শকাতর মুহূর্তে আসে, ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে যখন তার আন্তর্জাতিক অবস্থান তুলে ধরতে আগ্রহী। জোরালো অবস্থানের পরিবর্তে, ফ্রান্স এখন আরো একক এবং সম্মিলিতভাবে শক্তিশালী অকাসত্রয়ীর পাশাপাশি কৌশলগত ভূখণ্ডে একাকী হয়ে পড়েছে।

আমেরিকা কি এখন ফিরে এসেছে?
নতুন সাবমেরিন চুক্তি বাস্তবে পরিণত হতে এখনও অনেক পথ বাকি। অকাস ঘোষণায় দেখা গেছে যে চীনের ক্রমবর্ধমান কঠোর শক্তি এখন প্রকৃতপক্ষে কঠিন এবং কাঠামোগত রাজনৈতিক-সামরিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে।

এর মাধ্যমে ব্রিটিশ এবং অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী ‘কার্যত’ আটলান্টিকজুড়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বিশ্বব্যাপী বার্তা পাঠাতে অনুমতি দিয়েছেন যে আমেরিকা সত্যিই ফিরে এসেছে। আফগানিস্তান থেকে অবমাননাকর পশ্চাদপসরণ এবং কাবুল থেকে বিশৃঙ্খল প্রস্থান করার মাত্র তিন সপ্তাহ পরে ঘটে এটি। আর এটি তাকে বিশ্বকে মনে করিয়ে দেয়ার সুযোগ এনে দেয় যে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে তার প্রধান প্রচেষ্টা চালাবে।

অকাস এখন চীনের অনেকের বিশ্বাসকে নিশ্চিত করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার প্রধান মিত্ররা চীনের নিজের ‘উঠোনে’ তার উত্থানকে নিয়ন্ত্রণ করতে বদ্ধপরিকর, যেখানে দেশটি বিশ্বাস করে যে তার পেশিগুলোকে নমনীয় করার অধিকার রয়েছে। অন্যদের জন্য, এটি নিশ্চিত করবে যে শি জিনপিং অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষে পৌঁছে গেছে এবং চীন এখন তার অধিকতর দৃঢ় কৌশলের মূল্য পরিশোধ করছে। যেভাবেই হোক, চীনারা লক্ষ্য করছে যে এশিয়ায় ওবামা নীতির দ্বিধাবিভক্ত প্রকৃতি বাইডেনের অধীনে আরো নির্ধারিত নীতি কৌশল গ্রহণের পথ এনে দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের বিরোধ অতিক্রমযোগ্য না হলে বিশ্ব বহুমেরুর ক্ষমতাকেন্দ্রভিত্তিক ভাগে বিভাজিত হয়ে যাবে। আর এ অবস্থার বড় সুবিধাভোগী হবে চীন। ইউরোপ, আমেরিকার প্রভাব বিস্তার প্রতিযোগিতার ফাঁকে চীন ও রাশিয়া ছোট ছোট দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তা বিনিয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের পক্ষভুক্ত করে নেবে। আর ইউরোপ, আমেরিকার মধ্যে বিভাজন হলে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকে একতরফা নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে।

নতুন মেরুকরণে সুবিধা ও অসুবিধা
নতুন মেরুকরণে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই থাকবে। সুবিধার দিকটি হলো, বহুপক্ষে বিশ্ব বিভাজিত হলে সে ক্ষেত্রে ছোট দেশগুলো দরকষাকষি করে নিজেদের বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। অসুবিধা হলো একটি নির্দিষ্ট বলয়ে গেলে অন্য বলয়ের বৈরিতার মুখে পড়তে হতে পারে। এর মধ্যে আমেরিকান বলয়ে যাওয়ার জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার সহায়তা দানের ব্যাপারে নীতিগত সম্মতির কথা জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। আমেরিকান বলয়ে বাংলাদেশ গেলে এর তাৎক্ষণিক মূল্য হবে চীনা অর্থনৈতিক সহায়তা সীমিত হয়ে যাওয়া। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি আমেরিকান বলয়ের বাইরে চলে যায় তা হলে বাংলাদেশের জন্য চীনকে পরিত্যাগ করার মূল্য অনেক বড় হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের রফতানি আয়ের যতটা আমেরিকা থেকে আসে তার দ্বিগুণ আসে ইউরোপ থেকে।

পাশ্চাত্যের যে বিভাজনের ডঙ্কা বেজে উঠেছে, সেটি হলে আমেরিকানরা সত্যিকার অর্থে পাশ্চাত্যের নেতৃত্ব হারাবে। সে ক্ষেত্রে নতুন নতুন নেতৃত্ব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এগিয়ে আসবে। শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোও নিজেদের মধ্যে আলাদা বলয় তৈরি করে বিশ্বব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement