২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাইডেন ডকট্রিন : চীন-রাশিয়া ও পশ্চিমের হাইব্রিড যুদ্ধ

- ফাইল ছবি

সদ্যপ্রকাশ হওয়া বাইডেন ডকট্রিন এখন বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনোনিবেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই মতবাদে অন্যান্য দেশের সমাজ পুনর্নির্মাণ এবং বিদেশে জাতিগঠনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়/এগারো-পরবর্তী নীতি পরিত্যাগ করা হয়েছে। আমেরিকান বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে বাইডেন ডকট্রিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক।

প্রকৃতপক্ষে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পদক্ষেপগুলো মূলত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক এবং চূড়ান্ত বাস্তবায়ন। বারাক ওবামাই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি জর্জ ডব্লিউ বুশের অধীনে ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকার যমজ যুদ্ধের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে তালেবানের সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছেন। ওবামা এবং ট্রাম্প উভয়েই বাইরে আমেরিকান ঘাঁটি কমিয়ে আনার জন্য ওয়াশিংটনের মনোযোগকে পুনর্নির্দেশিত করতে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপায় সন্ধান করেন।

আমেরিকান প্রত্যাহার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনকে সঠিকভাবে অনুধাবন ও মূল্যায়ন করা বাকি বিশ্বের জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তান ত্যাগ করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঠিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত। যদি তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে অতিমাত্রায় বিলম্বিত হতো তাহলে এটি আমেরিকান লক্ষ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারত। আবেগবশে আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়াকে অবশ্যই বিশ্বব্যাপী পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সমাপ্তি মনে করা ঠিক হবে না। এটি কেবল আপেক্ষিক এবং ধীরগতির প্রত্যাহারকে অব্যাহত রাখবে। আর এটিকে আমেরিকান জোট এবং অংশীদারিত্বের ধ্বংসের ঘটনাও বলা যাবে না। আফগানিস্তানের ঘটনাবলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কোনো রাজনৈতিক ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাবনা কম যা প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা যে ধরনের অভিজ্ঞতা পেয়েছিল সে মাত্রার বিপর্যয় হওয়ার সম্ভাবনা এখানে নেই। বরং ওয়াশিংটন তার বৈশ্বিক সম্পৃক্ততা নিয়ে নতুন করে হিসাব-নিকাশ করতে ব্যস্ত। এটি একভাবে বলা যায়, আমেরিকান ভিত্তিকে শক্তিশালী করার দিকে আরো বেশি মনোযোগ সৃষ্টি করছে।

নতুন নীতির আওতায় বিদেশে, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের নামে বৈশ্বিক ক্রুসেড থেকে সরে এসে দেশ এবং বিদেশে পশ্চিমা অবস্থানগুলোতে উদার মূল্যবোধের সক্রিয় প্রতিরক্ষার দিকে এখন এগিয়ে যাচ্ছে।

আফগানিস্তান একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক তর্কের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, যা বাইডেনের হোয়াইট হাউজকে উদার গণতন্ত্রের বৈশ্বিক জয় অদূর ভবিষ্যতে অর্জন করা যায় কি না সে বিষয়ে প্ররোচিত করেছিল। নতুন নীতি অনুসারে এইভাবে বুশ প্রশাসনের ভাষায় সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টিকারী ‘জলাভূমি নিষ্কাশন’ এর সমস্যাযুক্ত দেশগুলোকে পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা বৃথা। মার্কিন সামরিক বাহিনী একটি শক্তিশালী অস্ত্র, কিন্তু এটি আর প্রথম অবলম্বনের মাধ্যম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে নিরাপদ রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতেছে, গত বিশ বছরে মার্কিন মাটিতে কোনো বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়নি। এই সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ভূ-রাজনৈতিক, ভূ -অর্থনৈতিক, আদর্শিক এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে।

চীন চ্যালেঞ্জার, রাশিয়া মার্কিন কর্তৃত্বে অন্তরায়
কেউ কেউ বলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রধান অস্তিত্ববাদী চ্যালেঞ্জার আর রাশিয়া কর্তৃত্বের পথে প্রধান ব্যাঘাতকারী। এক্ষেত্রে ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং মৌলবাদী বা চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিপক্ষের একটি তালিকা থাকতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মহামারী মার্কিন নিরাপত্তা উদ্বেগের শীর্ষে উঠে এসেছে। অতএব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতির কাজ হলো শক্তিশালী মার্কিন নেতৃত্বে ‘যৌথ পশ্চিম’কে শক্তিশালী করা। আর এটি বাইডেন ডকট্রিনের প্রধান দিক।

২০০৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার উৎপত্তি হয়েছিল তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অর্থনৈতিক ও আর্থিক মডেলকে আঘাত করেছিল; ২০১৬-২০২১ সময়ের তীব্র অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের প্রতি আস্থায় চিড় ধরায় আর যুক্তরাষ্ট্রে কঠোরভাবে আঘাত হানা কোভিড-১৯ দুর্যোগ আমেরিকান সমাজ এবং রাজনীতির মধ্যে গুরুতর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সমস্যা ও ফাটলগুলোকে প্রকাশ করে দেয়। বিদেশে ব্যয়বহুল জাতি-নির্মাণ অনুশীলনে অংশ নেয়ার সময় দেশটির নিজস্ব ভিত্তিকে অবহেলা করার একটি বিষয় এ সময় সামনে চলে আসে। এখন বাইডেন প্রশাসন বিশাল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প এবং আমেরিকান মধ্যবিত্তদের সহায়তার মাধ্যমে এর সংশোধন শুরু করেছে।

আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট, ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুরূপ কিছু সমস্যা এবং ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতি থাকাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান এমন আশঙ্কা তৈরি করে যে চীন ও রাশিয়া অবশেষে মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘটাতে পারে। এমনকি ভেতর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা সমাজের সংযুক্তিকে দুর্বল করতে পারে। এই ধারণার পেছনে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাঞ্চলের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে বেইজিং এবং মস্কো থেকে রক্ষা করার একটি কৌশল।

বাইডেন ডকট্রিনের প্রভাব
প্রশ্ন হলো, বাইডেন মতবাদের অন্তর্নিহিত প্রভাবগুলো কী কী হতে পারে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল সম্পদ নিয়ে একটি পরাশক্তি রয়ে গেছে, যে এখন সেই সম্পদগুলোকে নিজেদের শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। আমেরিকা এর আগে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে এবং আবারো তা করতে সক্ষম হতে পারে। পররাষ্ট্রনীতিতে, ওয়াশিংটন পশ্চিমের নেতা হিসেবে নিজেকে যুদ্ধের ভঙ্গিতে তুলে ধরে বিশ্বের সৌম্য আধিপত্যবাদী হিসেবে তুলে ধরার স্টাইল থেকে সরে এসেছে।
আমেরিকান নতুন উপলব্ধি হলো, যৌথ পশ্চিমের মধ্যে, মার্কিন আধিপত্যের জন্য বিপদ নেই। পশ্চিমা দেশগুলোর কেউই একা যেতে বা অন্যদের সাথে একটি বøক গঠনে সক্ষম নয় অথবা মার্কিন নেতৃত্বের বিকল্প উপস্থাপন করার অবস্থায় তারা নেই। পশ্চিমা দেশগুলো এবং সংশ্লিষ্ট এলিটরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ রেখেছে। তারা যা চায় তা হলো, দৃঢ় মার্কিন নেতৃত্ব; তারা যেটা ভয় পাচ্ছে তা হলো যুক্তরাষ্ট্র নিজের গণ্ডির মধ্যে আবার ফিরে যাচ্ছে কি না। এটি ঠিক যে, যেসব অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থের জন্য অত্যাবশ্যক বলে মনে করা হয় না সেখানে ওয়াশিংটনের অংশীদারদের জন্য, আমেরিকান সমর্থন সেই স্বার্থ সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শর্তাধীন থাকবে। আর যেখানে সত্যিকারার্থে নতুন কিছু নেই সেটি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু নেতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ থেকে যেতে পারে। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে ওয়াশিংটন ইউক্রেন এবং তাইওয়ানের মতো উন্মুক্ত অংশীদারদের সমর্থন ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদকে আলিঙ্গন করার অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন নেই। অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোতে পুরোপুরি ফোকাসের জন্য, বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বা কমপক্ষে প্রাধান্য বিস্তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আর উদার ও গণতান্ত্রিক আদর্শকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রধান চালক হিসেবে বিদায় দেয়া হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘স্বাভাবিক’ দেশে পরিণত হবে না যা শুধুমাত্র রিয়েলপলিটিকের নিয়ম অনুসরণ করে। বরং নতুন নীতি অনুসারে ওয়াশিংটন তার মিত্রদের আরো সংহত করার জন্য এবং তার প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে অস্ত্র হিসেবে মূল্যবোধকে সংযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করবে। এটি মার্কিন মিত্র ও অংশীদার যাদের অধিকাংশেরই মস্কো বা বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ভয় বা ক্ষোভ রয়েছে এবং তাদের ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা হয় তাতে হোয়াইট হাউজের এক ধরনের সুরক্ষা পেতে সাহায্য করবে।

মোট কথা, বাইডেন মতবাদ এমন সব কর্মকাণ্ডকে দূরে সরিয়ে দেয় যা এখন আর ওয়াশিংটন দ্বারা আশাব্যঞ্জক বা এমনকি টেকসই বলে বিবেচিত হয় না; অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি আরো সুযোগ তৈরি করবে; যুক্তরাষ্ট্রের চারপাশে যৌথপশ্চিমকে একত্রিত করার চেষ্টা করবে আর আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে চীন ও রাশিয়ার দিকে মনোযোগ বাড়াবে। এসবের মধ্যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ঘরোয়া। এখন আফগানিস্তান নয়, বরং আমেরিকার পুনর্নির্মাণের সাফল্য বা ব্যর্থতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

নতুন ডকট্রিনের সম্ভাব্য ক্ষেত্র
প্রশ্ন হলো বাইডেন মতবাদের প্রভাবে বাকি বিশ্বে কী হতে পারে। মোটা দাগে এর চারটি ক্ষেত্র রয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্রদের ওপর প্রভাব, দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র বলয়ের মুখ্য প্রতিপক্ষ চীন-রাশিয়ার ওপর প্রভাব। তৃতীয়ত, দুই মুখ্য বলয়ে আশ্রিত দেশসমূহের ওপর প্রভাব। চতুর্থত, দুই বলয়ের মধ্যে ভারসাম্যরক্ষাকারী বা মধ্যবর্তী দেশসমূহের ওপর প্রভাব। এর বাইরে একটি সমন্বিত ক্ষেত্র হলো জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্বব্যাংকসহ বৈশ্বিক সংস্থাসমূহে প্রভাব।

বাইডেন ডকট্রিনের মূল ধারণাটিই হলো কোন দেশের পুনর্বিন্যাস বা পুনর্বাসনে য্ক্তুরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক অংশগ্রহণ থাকবে না। এর পরিবর্তে পশ্চিমা মিত্রদেশগুলোকে সাথে নিয়ে পশ্চিমা মূল্যবোধ ও স্বার্থভিত্তিক একটি ব্যবস্থার অবয়ব দানে ভূমিকা রাখা। আফগানিস্তানের সর্বসা¤প্রতিক ঘটনাকে সামনে রেখে উদাহরণ দিলে বিষয়টা দাঁড়ায়, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহারের পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, অবরোধ-বয়কট এবং সম্ভাব্য প্রক্সিযুদ্ধের হুমকির মাধ্যমে সেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করা এবং একেবারে চীন-রাশিয়া আশ্রয়ী নীতি গ্রহণ ও পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের প্রতি বড় রকমের হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা থেকে বিরত হওয়ার মতো রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন বা অনুসরণের প্রচেষ্টা নেয়া হবে। এসব টুলস যুক্তরাষ্ট্র একা প্রয়োগ করতে গেলে আফগানিস্তান বা অন্য যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হতে পারে। এজন্য ইউরোপ আমেরিকা তথা পশ্চিমা দেশসমূহের মধ্যে অভিন্ন ভূমিকা পালনের একটি বলয় নির্মাণ করা হবে। বাইডেনের স্বল্পসময়ের প্রশাসনের কার্যক্রম অবলোকন করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্র আর সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা আধিপত্যের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জার হিসেবে চীনকে মূল্যায়ন করার কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে দেশটির অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রযুক্তিগত ও উচ্চাভিলাষের উত্থান। বছর পাঁচেকের মধ্যে চীনের অর্থনীতি বড় কোনো ব্যাঘাত না হলে যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ে বা তা অতিক্রম করে যেতে পারে। সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও বাস্তব প্রভাব হিসাব করলে ব্যয়ের তুলনায় চীনা প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অধিকতর শক্তি অর্জন করছে। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের বৃহত্তম ১০ অর্থনৈতিক করপোরেশনের মধ্যে পাঁচটি চীনভিত্তিক। বিশ্বের শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনোটি চীনে না থাকলেও গবেষণার ক্ষেত্রে চীনাদের অগ্রগতি বেশ উল্লেখযোগ্য। আর চীনের বর্তমান নেতৃত্বের উচ্চাভিলাষ বৈশ্বিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব গ্রহণে ওয়াশিংটনের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। চীনা জনসংখ্যা এবং নিয়ন্ত্রক শাসন কাঠামোতে অস্থিরতার উপাদান তুলনামূলকভাবে কম।

অন্যদিকে রাশিয়ার পশ্চিমা কর্তৃত্বে ব্যাঘাতসৃষ্টিকারী প্রধান উপাদান হলো সামরিক ক্ষেত্রে তার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা। একই সাথে অর্থনীতিতে ঘাতসহনীয় একটি অবস্থা পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া জ্বালানি ও প্রতিরক্ষাসামগ্রী রফতানির মাধ্যমে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। পাশ্চাত্যের জন্য এককভাবে দুটি দেশকে মোকাবেলা করার চেয়ে দুই শক্তির যৌথ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।

চীন-রাশিয়ার সাথে পাশ্চাত্যের হাইব্রিড লড়াইয়ে ইতিবাচক নেতিবাচক দুই ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে উভয় প্রভাব বলয়ে থাকা দেশগুলো। বাইডেনের নতুন ডকট্রিনের আওতায় প্রত্যক্ষ সামরিক বাহিনী উপস্থিতির কৌশল থেকে সরে আসার কারণে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ হুমকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্মরণীয় মন্তব্য হলো, আমেরিকান সমর্থন ছাড়া সৌদি রাজতন্ত্র দুই সপ্তাহও টিকতে পারবে না। মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে দুই দশক সময়ে তৈরি হওয়া আফগান সরকারের পতনের দৃশ্যে মনে হয় ট্রাম্পর বক্তব্য আসলে কথার কথা ছিল না।

ট্রাম্পের চার বছরের শাসন আর আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান প্রত্যাহারের পর মার্কিন নিরাপত্তা আশ্রয়ে থাকা শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অস্তিত্ব- দুই ক্ষেত্রেই সঙ্কটে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ, এমনকি ইসরাইলও নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়েছে। এটি উপলব্ধি করে সৌদি আরব মিসরের মতো বড় দেশগুলো চীন রাশিয়ার সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে। এসব দেশ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিকে কমানোর চেষ্টা করছে। সৌদি আরব আঞ্চলিক ও মুসলিম বিশ্বের নিয়ন্ত্রক শক্তির ভূমিকা থেকে নিজেকে কতটা সরিয়ে এনেছে সা¤প্রতিক আফগানিস্তান পরিস্থিতিতে সেটি দেখা যায়। অন্যদিকে ইসরাইল তার পররাষ্ট্র সম্পর্ককে কৌশলগত ও বাণিজ্য এই দু’ভাগে ভাগ করেছে এবং চীনের সাথে সম্পর্ককে সীমিত করছে। নিছক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে ইসরাইল চীনা বিনিয়োগ নিচ্ছে না। রাশিয়ার সাথেও আমেরিকান আপত্তির ক্ষেত্রসমূহে ইসরাইল সম্পৃক্ত হচ্ছে না। এর ফলে বিগত গাজা যুদ্ধের সময় চীন রাশিয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে তুলনামূলক বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। সিমন পেরেজের মতো ইসরাইলের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ নীতি নিয়ে তেলআবিবকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ইরান বা রাজনৈতিক ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বা প্রতিপক্ষ আগামীতে নাও থাকতে পারে। কিন্তু ইসরাইলের অস্থিত্বের জন্য এ দুটি হুমকি হিসেবে অব্যাহত থাকবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত মিত্র এবং চীন অর্থনৈতিক মিত্র থাকা উচিত ইসরাইলের। ইসরাইলের বর্তমান সরকারের নীতি সেই ধারায় যাচ্ছে বলে মনে হয় না।

এদিকে এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে আমেরিকান মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর উত্তর কোরিয়ার সামরিক হুমকি আর জাপানের ওপর চীনা সামরিক হুমকি মাঝে মধ্যেই প্রবল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বাইডেন মতবাদের অপ্রত্যক্ষ সামরিক নিরাপত্তা প্রদান মিত্র দেশগুলোকে কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এর বিপরীতে ইরান সিরিয়া বা মিয়ানমারের মতো চীন-রাশিয়া বলয়ের প্রশ্রয়ে থাকা দেশগুলো পাশ্চাত্যের অস্থিরতা সৃষ্টির নানা প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে সেসব দেশের শাসন পরিবর্তনে আমেরিকা ও মিত্রদের ভূমিকা কতটা সফল হবে তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।

বেশি প্রভাব নিরপেক্ষ বলয়ে?
নতুন মার্কিন মতবাদের প্রভাব তুরস্ক পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া বাংলাদেশ ও মধ্য এশিয়ার কয়েকটি প্রজাতন্ত্রের মতো তুলনামূলক নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর ওপর বেশি পড়বে। তুরস্ক ন্যাটো সদস্যরাষ্ট্র হলেও দেশটির আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নীতিতে এক ধরনের মধ্যপন্থী অবস্থান ও ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা আছে। ২০২৩ সালের নির্বাচনে দেশটির ক্ষমতা থেকে বর্তমান সরকারকে বিদায় করার মতো একটি ধারণা ইসরাইল ও তার মিত্র কিছু পাশ্চাত্য দেশ লালন করে বলে মনে হয়। সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্য এরদোগানের সরকারের পররাষ্ট্রনীতিকে কিছুটা নমনীয় করার কার্যক্রম সম্প্রতি লক্ষ্য করা যায়। যদিও দেশটি এখনো সিরিয়া ও ইরাকের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংবেদনশীল নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে যার প্রভাব দেশটির অভ্যন্তরীণ জনমতেও পড়তে দেখা যাচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অন্য দেশে প্রভাব বিস্তারে কোনো প্রচেষ্টা না থাকায় হাইব্রিড যুদ্ধের প্রত্যক্ষ শিকার হতে দেখা যাচ্ছে না তাদের। তবে মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। পাকিস্তানকে চীনের সর্বআবহাওয়ার মিত্র হিসেবে দেখা হলেও দেশটি পাশ্চাত্যের সাথে এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক সব সময় বজায় রেখে এসেছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী চূড়ান্তভাবে প্রত্যাহারে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকায় এটি দেখা গেছে। দুই বৈশ্বিক বলয়ের সম্ভাব্য হাইব্রিড যুদ্ধে পাকিস্তান তার ভারসাম্য রক্ষাকারী এই ভূমিকা বজায় রাখবে বলে মনে হয়।

চীন-রাশিয়ার সাথে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চুক্তিতে ইরান আবদ্ধ হলেও নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরমাণু চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বোঝাপড়ায় আসায় মনে হয় তেহরান মার্কিনবিরোধী বলয়ে থেকেও এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা নিতে পারে। সরকারের একটি অংশ ভারতের সাথে মৈত্রী বজায় রাখার জন্যও পরামর্শ দিচ্ছে।

চীন-রাশিয়া বনাম মার্কিন-ইউরোপের সম্ভাব্য ছায়া লড়াইয়ে ভারতকে দৃশ্যত শেষোক্ত বলয়ের সদস্য বলে মনে হয় কোয়াড নিরাপত্তা জোটে সক্রিয়তার সুবাদে। কিন্তু দিল্লি একই সাথে ব্রিকস ও হংকং সাংহাই কো-অপারেশনের সদস্য হিসেবে চীন-রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রাখছে। পাশ্চাত্যবলয় থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহকে ভারত অগ্রাধিকার দিলেও রাশিয়া থেকে বিপুল প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়নি। তবে বৈশ্বিক ছায়াযুদ্ধ প্রকট হলে দিল্লির জন্য অবস্থান পরিষ্কার করার চাপ বাড়বে। ২০২৩ সালের পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন এবং তার আগে উত্তর প্রদেশের রাজ্য বিধান সভা নির্বাচন হতে পারে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত।

বড় চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ বৈশ্বিক দুই কেন্দ্রের হাইব্রিড লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে। এত দিন বাংলাদেশ দু’পক্ষের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে এসেছে। প্রতিবেশী ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসনে ভূমিকা রেখে তাদের সমর্থন এবং একই সাথে পাশ্চাত্যবলয়ের আস্থা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ভূমিকা নিয়ে ঢাকার সরকার পাশ্চাত্যের আস্থা যতটা সম্ভব ধরে রাখতে পেরেছে। অন্যদিকে বড় বড় কিছু অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো চুক্তি আর সে সাথে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ অব্যাহত রেখে বেইজিংয়ের সম্পর্ককেও সামনে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে। এ কারণে ২০১৮ সালের বিশেষ ধরনের নির্বাচনে সরকারের ক্ষমতা রক্ষার ক্ষেত্রে চীন ও ভারত দুই দেশেরই সমর্থন ছিল বলে মনে করা হয়।

এখন নতুন পরিস্থিতিতে সেই ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন বলে মনে হচ্ছে। দুই পক্ষই বাংলাদেশকে একান্তভাবে তাদের পক্ষে পেতে চাইছে। কিন্তু কোনো পক্ষই রোহিঙ্গা ইস্যু ও বঙ্গোপসাগরের বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে সামনে রেখে অন্যকে ছাড় দিতে রাজি বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে ভারতের কোস্ট লাইন বেস স্থাপন নিয়ে ঢাকা জাতিসঙ্ঘের কাছে আপত্তি জানিয়েছে। দেশের সেনাবাহিনী প্রধান ও সরকার প্রধান এই দুইজনই দীর্ঘ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন এবং আছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক মহলে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যও লক্ষ করা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে বৈশ্বিক নব স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশকে বেশ আলোড়িত করবে বলে মনে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা আর আগাম নির্বাচনের বিষয়ও আলোচিত হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোও কম বেশি বৈশ্বিক পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।

বৈশ্বিক সংস্থাগুলোকে পরাশক্তিসমূহের হাইব্রিড যুদ্ধ কতটা প্রভাবিত করবে সেটাও আলোচনায় চলে এসেছে। চীন-রাশিয়া বলয় তাদের তৎপরতার সামনে রেখেছে বিকল্প আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা। ভেতরে ভেতরে এটি অনেক দূর এগিয়েছে বলে মনে হয়। সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন দেশের প্রত্যক্ষ লড়াই থেকে সরিয়ে এনে বৈশ্বিক ব্যবস্থার প্রতি অধিক নজর দেবে বলে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপকে আমেরিকার নতুন যাত্রার পক্ষে পাবে বলে ধারণা বাইডেন প্রশাসনের। তবে ট্রাম্প আবার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নিজেকে প্রস্তুত করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ট্রাম্প আসা মানে আবার গৃহমুখী হয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের। যার সাথে নতুন বাইডেন ডকট্রিনের সম্পর্ক বিপরীতমুখী। সেই অনিশ্চয়তাটি এখনো রয়ে গেছে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement