১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিদায়ী চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলের গল্প

অ্যাঞ্জেলা মারকেল - ছবি : সংগৃহীত

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা ডোরোটেয়া মারকেল রাজনীতির বিশ্বমঞ্চ থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন। ২৬ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত আছেন ক্ষমতায়। এরপর বিদায় জানাবেন রাজনীতিকে, চলে যাবেন অবসরে। তবে রাজনীতি বা ক্ষমতা ছাড়লেও ইতিহাস ছাড়ছে না অ্যাঞ্জেলা মারকেলকে। ইতিহাসে তার আসন পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। কারণ অনন্য এ রাজনীতিক এরই মধ্যে পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের উপাদানে, এক অবিচ্ছেদ্য অংশে।

অ্যাঞ্জেলা মারকেল দুই জার্মানির একত্রীকরণের দুই মাস পর ১৯৯০ সালে মধ্য দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নে (সিপিইউ) যোগ দিয়েছিলেন। পরের বছর চ্যান্সেলর হেলমুট কোহলের মন্ত্রিসভায় মহিলা ও বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রী হন। চ্যান্সেলর কোহল চাঁদাবাজি ও অবৈধ অর্থ লেনদেন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লে ১৯৯৯ সালে মারকেল তার পদত্যাগ দাবি করেন। কোহলের প্রস্থানের পর ২০০০ সালে অ্যাঞ্জেলা মারকেল সিপিইউ দলের নেতৃত্বে আসেন, চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এর পাঁচ বছর পর ২০০৫ সালে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন। তিনিই জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। মারকেল দলকে যেমন টানা ১৮ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি চার মেয়াদে ১৬ বছর ধরে জার্মানিকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।

২০১৮ সালে দলের নেতৃত্ব ছাড়ার পরই তিনি জানিয়ে দেন, চ্যান্সেলরের পদে থাকবেন না। ২০২১ সালের পর এ পদে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ জার্মানির ২০তম নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে। এরপর সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত তিনি ‘অন্তর্বর্তীকালীন চ্যান্সেলর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। নতুন চ্যান্সেলর নির্বাচিত হলে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় নেবেন মারকেল।

অ্যাঞ্জেলা মারকেল ১৬ বছর ধরে জার্মান রাজনীতিতে এক অপ্রতিদ্ব›দ্বী রাজনীতিক। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের প্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে এক আবেগময়ী ভাষণে তিনি দেশের ভেতরে ও বাইরে ‘জার্মানির উদার মূল্যবোধ’কে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাকে একজন বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একসময় বলা হতো তিনিই ‘জার্মানির রানী’। আবার তাকে ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ হিসেবেও ডাকা হতো। বাস্তবিক অর্থেই অ্যাঞ্জেলা মারকেল বিশ্বের একজন ক্ষমতাধর নারী। তাকে তুলনা করা হয় ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারের সাথে। কেউ বলেন থেচারকেও তিনি ছাড়িয়ে গেছেন।

জার্মানির রাজনীতিই শুধু নয়, অ্যাঞ্জেলা মারকেল ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সক্রিয় ও কার্যকর রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তিনি নেতৃত্বের পদে থেকেছেন। শতটি ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু সঙ্কট পার হতে সহায়তা করায় তাকে পুরো ইউরোপের ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসেবেও মনে করা হয়। কারণ ইউরোপ যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি ব্যয় সঙ্কোচনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। সমস্যা মোকাবেলায় বাজেট হ্রাসের নীতি নেন। অভিবাসন সঙ্কট, ইউরো সঙ্কট, ইউরোপের শরণার্থী সঙ্কট, গ্রিসের আর্থিক সঙ্কট, প্যারিস হামলা, কোভিড-১৯ মহামারী ও ব্রেক্সিটের সমস্যা সমাধানেও তার ভ‚মিকা ছিল অতুলনীয়। গ্রিসকে ইউরো জোনের ভেতরে রেখে ইউরো মুদ্রাকে বাঁচিয়ে দেন মারকেল। তেমনি জার্মানির স্বার্থ রক্ষার দিকেও ছিল তার কড়া নজর।

জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে চার মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে অ্যাঞ্জেলা মারকেল পাঁচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছেন। দেখেছেন চারজন ফরাসি প্রেসিডেন্ট, সাতজন ইতালিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে। জো বাইডেন চতুর্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যার সাথে মারকেলের কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ সময় জাপানেও আটজন প্রধানমন্ত্রীর পালাবদল হয়েছে। তেমনি বিশ্বের অনেক নেতা এসেছেন এবং চলেও গেছেন। কিন্তু মারকেল এখনো আছেন।

টাইম ম্যাগাজিন অ্যাঞ্জেলা মারকেলকে ২০১৫ সালে ‘সেরা ব্যক্তিত্ব’ নির্বাচিত করেছে। অভিবাসন সঙ্কট ও ঋণ সমস্যা মোকাবেলায় তার নেতৃত্বের প্রশংসা করে টাইম। টাইম সম্পাদক ন্যান্সি গিবস বলেন, ‘অ্যাঞ্জেলা মারকেল নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আজকের দুনিয়ায় তা বিরল।’ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান এবং নৈতিকতাকে ভিত্তি করে নেতৃত্ব দেয়া তার একটি বিরল গুণ। এ জন্যই তিনি সেরা ব্যক্তিত্ব। জাতিসঙ্ঘও মারকেলের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেছে। বিশ্বখ্যাত ‘ফোর্বস’ সাময়িকীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকার শীর্ষে তার নাম চারবার উঠে আসে।

শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো
অ্যাঞ্জেলা ডোরোটেয়া মারকেল ১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই পশ্চিম জার্মানির হামবুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হোর্স্ট কাসনার ও মা হারলিন। মা ছিলেন ল্যাটিন ভাষা ও ইংরেজির শিক্ষক। মায়ের পূর্বপুরুষরা পোল্যান্ডের অধিবাসী। হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়ালেখা করেছেন। মারকেলের ছোট এক ভাই ও এক বোন। জন্মের পরপরই মারকেলের পরিবার পূর্ব জার্মানিতে স্থানান্তরিত হয়। তার বয়স যখন দুই মাস, তখন বাবাকে পূর্ব জার্মানির এক ছোট্ট শহরের গির্জায় ধর্মযাজকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিউনিস্ট-পূর্ব জার্মানিতে বার্লিনের উপকণ্ঠে এক গ্রাম এলাকায় বড় হয়েছেন মারকেল। টেম্পলিন শহরের স্কুলে পড়ালেখা করেন। পরে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ল মার্কস বিশ্ববিদ্যালয়ে (এখন নাম লিপজিপ বিশ্ববিদ্যালয়) পদার্থবিজ্ঞানে পড়েন। সে সময় রুশ ভাষাও শিখে ফেলেন এবং অনর্গল তা বলতে পারেন। মারকেল বলেছেন, তার ছোটবেলা কেটেছে অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন, কিন্তু ক্লাসে তখন নারী কার্যত ছিল না। গবেষণাগারে কাজ করার টেবিল পেতেন না, মেয়ে বলে।

বার্লিন প্রাচীরের পতনই মারকেলকে নিয়ে এলো রাজনীতিতে
অ্যাঞ্জেলা মারকেলের শুরুটা কিন্তু রাজনীতি দিয়ে হয়নি। তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল একজন বিজ্ঞানী হিসেবে। কমিউনিস্ট-পূর্ব জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু। আর একজন সাধারণ বিজ্ঞানী থেকেই মারকেল বিশ্বের প্রভাবশালী একজন নারী হয়ে ওঠেন। তিনি কাজ করতেন পূর্ব জার্মানির তাত্ত্বিক রসায়নসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর থিউরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে। প্রথমে পদার্থবিজ্ঞান পড়লেও কোয়াল্টাম রসায়নে গবেষণায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর গবেষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার সহকর্মী ও বন্ধু মিচেল শিল্ডহেলমন্ড একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। অবশ্য এখন তিনি পুরোদস্তুর লেখক।

কয়েক বছর আগে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মারকেল সম্পর্কে বলেছিলেন, আমাদের তখনকার অফিসের পরিবেশটা ছিল পুরুষতান্ত্রিক। মারকেল ও আমি যে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করতাম, তার পরিবেশ ছিল রক্ষণশীল। মারকেল ও আমরা তিন বন্ধু দুপুরের খাওয়ার পর একসাথে টেবিলের চার পাশে বসে কফি খেতাম আর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে গল্প করতাম। মারকেল যতটুকু সম্ভব আমাদের জন্য ভালো কফি বানাতেন। সহপাঠী উলবিচকে মারকেল ১৯৭৭ সালে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ে টেকেনি। চার বছর পর বিচ্ছেদ হয়। তখন তার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। তাকে কখনো নারীবাদী মনে হয়নি। পুরুষের মতোই প্যান্ট পরতেন। একজন পুরুষের মতো আচরণ করতেন। খুব কৌত‚হলী ও রসিকও ছিলেন। তবে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে মারকেল ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।

বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করলেও অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। আর সেই সীমাবদ্ধতা ছিল সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণেই। আমরা পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম না। ওই সব দেশের ম্যাগাজিন পড়তে পারতাম না। যেসব বিজ্ঞানী কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেতেন, তারা বেশির ভাগই কমিউনিস্ট পরিবার থেকে এসেছিলেন।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সমর্থক তারা। তবে মারকেলের মতো কিছু সহকর্মী পাওয়ায় আমরা নিজেদের মধ্যে স্বাধীনভাবে কথাবার্তা বলতে পারতাম। মারকেল অপেরা দেখতে পছন্দ করতেন। পূর্ব বার্লিনে খুব বেশি থিয়েটার ও অপেরা ছিল না। একটিমাত্র সিনেমা হল ছিল। সেখানে কিছু পশ্চিমা সিনেমা দেখানো হতো। মারকেল তার বাড়িতে পশ্চিম জার্মানির রেডিও শুনতেন। পূর্ব জার্মানিতে বলা যায়, আমরা একপ্রকার বন্দী জীবনযাপনই করতাম। ফলে মারকেলসহ আমরা পূর্ব জার্মানিকে পছন্দ করিনি, সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করিনি। কখনো কোনো একসময় এ ব্যবস্থা থাকবে না, এর পতন ঘটবে এমন কল্পনা করাও কঠিন ছিল। তবে পর্দার আড়ালে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে মিখাইল গর্বাচেভ সংস্কারের নীতি গ্রহণ করলেন ‘পেরেস্ত্রোইকা’ যার নাম। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া পূর্ব জার্মানিতেও লাগল। মারকেল ছিলেন যাজকের মেয়ে। তখন বিভিন্ন সংগঠন সংগ্রামী কর্মকাণ্ড শুরু করল। মারকেলও এর সাথে যুক্ত হলেন। লিফলেট বিতরণ, খেলামেলা সমালোচনা শুরু হলো। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন মারকেল। এরই মধ্যে ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে বার্লিন প্রাচীরের পতন ঘটে। পূর্ব জার্মানির রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। এ পরিবর্তনের সাথে মারকেলের জীবনও বদলে যায়। আমি ভাবিনি মার্কেল রাজনীতিবিদ হয়ে উঠবেন। কিন্তু বার্লিন প্রাচীরের পতন তাকে রাজনীতিতে নিয়ে এলো।

পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিস্ট শাসনের কারণে কেউ রাজনীতির ব্যাপারে আকৃষ্ট ছিলেন না। কারণ কমিউনিস্টরাই সব নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর এটি সম্ভব হলো। মারকেলের বয়স খুব কম ছিল। তা ছাড়া তার ভাগ্যও ভালো ছিল। পূর্ব জার্মানির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার পরিচয় ছিল। ফলে পূর্ব জার্মানির শেষ দিনগুলোতে তার প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হলো। ঐক্যবদ্ধ একটি নতুন জার্মানি গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি পূর্ব জার্মানিতে ভ‚মিকা রাখতে পেরেছিলেন। ওই প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র হয়েছিলেন। সেটিই সূচনা। ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর ৪০ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের সমাপ্তি হয়। পতনের দিনটিতে ৩৫ বছর বয়সী অ্যাঞ্জেলা মারকেল নেচে-গেয়ে খুব আনন্দ করেছিলেন।

মারকেলের উত্থান
দুই জার্মানির একত্রীকরণের পরপরই অ্যাঞ্জেলা মারকেল হেলমুট কোহলের নজরে পড়েন। এর আগে পূর্ব জার্মানিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর সেই সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছিলেন। কোহল মারকেলকে মেয়ে হিসেবেই দেখতেন। কোহলের মধ্য ও দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে যোগ দিয়ে পুরোদমেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আসলে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করলেও অন্তরে রাজনীতিকেই তিনি লালন করে রেখেছিলেন। ফলে সুযোগটা যখন এলো, তার সদ্ব্যবহার তিনি করতে সমর্থ হন। প্রথম দিকে মারকেল অনাকর্ষণীয় একজন সাদামাটা রাজনীতিক ছিলেন। সেই ভাবমর্যাদা তিনি বদলাতে থাকেন। পোশাক আশাক ও চেহারায় পরিবর্তন আনেন। বদলে ফেলেন চুলের স্টাইল। পরতে থাকেন উজ্জ্বল রঙের পোশাক। দলের ও দেশের নেতৃত্ব দক্ষতার সাথে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শুধু জার্মানিই নয়, পুরো ইউরোপ ও পৃথিবীজুড়েই তিনি জনপ্রিয় ও আলোচিত হন। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই নির্বাচনগুলোতে জয়লাভ করেন এবং টানা ১৬ বছর জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করেন।

লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার
পূর্ব জার্মানিতে থাকাকালে অ্যাঞ্জেলা মারকেলের স্বপ্ন ছিল লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অর্থাৎ পার্লামেন্ট ভবন দেখা। ফলে প্রথম বিদেশ ভ্রমণে লন্ডনেই যান। হিথ্রো থেকে প্রথমে তিনি যে কাজটি করেছিলেন তা হচ্ছে পার্লামেন্ট স্কয়ারে এস্কেলেটরে ওঠা এবং চার্চিলের মূর্তি ও পার্লামেন্ট ভবন দেখা। এরপর তিনি স্পিকার্স কর্নারে গিয়ে বিতর্ক শোনেন।

২০০৫ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার পর গত জুলাই ২০২১ মারকেল ২২তম বারের মতো লন্ডন সফর করেন। অবশ্য ক্ষমতাসীন অবস্থায় এ সফরটাই তার শেষ সফর। এ সময় তিনি উইন্ডসোরে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। ইউরোপীয় সমন্বয় প্রক্রিয়ায় অবদানের জন্য তাকে স্পেনের একটি পুরস্কার দেয়া হবে তার বিদায়ের আগেই।

হার্ভাডের স্নাতকদের উদ্দেশে
অ্যাঞ্জেলা মারকেল যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাডের স্নাতকদের উদ্দেশে ২০১৯ সালের ৩০ মে একটি উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দেন। স্নাতকদের তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়ো। অজ্ঞানতা ও সঙ্কীর্ণতার দেয়াল ভেঙে ফেল।’ বার্লিন প্রাচীরের কথা উল্লেখ করে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘ইস্পাত ও কংক্রিটের বাধা এ বার্লিন দেয়ালের পাশ দিয়ে যখন গেছি হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছি। কারণ এ দেয়াল শহরকে, জনগণকে ও পরিবারকে বিভক্ত করে রেখেছিল। বার্লিন প্রাচীর আমার সুযোগ সীমিত করেছিল। পরে বার্লিন ওয়ালের পতনই নতুন সম্ভাবনা এনে দেয়। এ জন্যই বলছি বিভেদের দেয়াল ভেঙে ফেলতে হয়।

অবসরে মারকেল যা করবেন
ব্যক্তিজীবনে অ্যাঞ্জেলা মারকেল দ্বিতীয়বার ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ইয়োফিম সয়ারকে বিয়ে করেন। মারকেল নিঃসন্তান। তবে পুরো দুনিয়ার শিশুদের জন্য তিনি কাজ করেছেন। নারী ও পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। আলুর স্যুপ ও পাম কেক বানাতে খুবই দক্ষ। কুকুরকে খুব ভয় পান। ১৯৯৫ সালে একবার কুকুর তাকে কামড়ে দিয়েছিল। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তাই তাকে ভয় দেখানোর জন্য একটি অনুষ্ঠানে তার পোষা কুকুর নিয়ে এসেছিলেন। অ্যাঞ্জেলা মারকেল অবসর কিভাবে কাটাবেন একজন সাংবাদিক সম্প্রতি প্রশ্ন করেছিলেন। মারকেল বলেন, সবার আগে বিরতি। এরপর ভালো ভালো বই পড়ার চেষ্টা করব। একটু বেশি ঘুমাব, ক্লান্তি দূর করতে। তার পর দেখা যাক কোথায় আবার উদয় হই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement