২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নতুন দল আসছে, কী আছে আশা করার

-

চলতি মাসেই দেশে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে আরো একটি রাজনৈতিক দল। ৪১টি নিবন্ধিত ও ডজন দেড়েক অনিবন্ধিত দলের সঙ্গে যোগ হতে যাচ্ছে আরেকটি নতুন নাম। এবারে নতুন দল নিয়ে মাঠে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। দলের সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘গণঅধিকার পরিষদ’ অথবা ‘বাংলাদেশ অধিকার পার্টি’। নাম যাই হোক, দলটি এমন একসময় ময়দানে নামতে যাচ্ছে, যে মুহূর্তে দেশে রাজনীতি বলে কার্যত তেমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। সংসদীয় বিরোধী দল বলে যারা আছেন তাদের এখন আর গৃহপালিত বলা হয় কি না জানা নেই। গত নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ও গুটিকয়েক সদস্য নিয়ে সংসদে হাজিরা দেয়ার পর থেকে এই অভিধাটি আর কাউকে তেমন একটা উচ্চারণ করতে শুনি না। সংসদীয় বিরোধী দলের ঘাড় থেকে গৃহপালিতের জোয়াল সম্ভবত নেমে গেছে।

নানা সূত্রে জানা যাচ্ছে, নতুন দলের সংগঠকরা চাইছিলেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দলীয় প্রধান করতে। তিনি নতুন দলের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছুক, কিন্তু সঙ্গত কারণেই দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নিতে চাননি। একটি জাতীয় দৈনিককে তিনি বলেন, ‘আমার সেই বয়স নেই। একটি দল করতে হলে সারা দেশে ছোটাছুটি করতে হবে, যার প্রতিপক্ষ হলো একটি ফ্যাসিস্ট সরকার।’ এ বিষয়ে আর কিছু বলার দরকার আছে মনে হয় না।

আলোচনার ভেতরে ঢোকার আগে আমরা ভিপি নুরের ব্যক্তিজীবন ও রাজনীতি বিষয়ে একটু জেনে নিতে চাই। নুরুল হক নুরের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায়। বাবা ইদ্রিস হাওলাদার ব্যবসায়ী এবং সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পড়ালেখা প্রথমে গ্রামে, পরে গাজীপুরে ও ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালে বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক নেতার মেয়ে। তাদের একটি মেয়ে আছে।

নুরুল হক নুর ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় আসেন। সে সময় ছিলেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে ছাত্রলীগের উপ-মানব উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক এবং স্কুলজীবনে ছাত্রলীগের স্কুল কমিটির দফতর সম্পাদকও ছিলেন।

২০১৯ সালে ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ডাকসু নির্বাচন প্রভাবিত করার বেপরোয়া চেষ্টা চালায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। সেসব উড়িয়ে দিয়ে নুর যে ময়দানে অটলভাবে টিকে ছিলেন এবং দায়িত্ব বুঝে নিতে সক্ষম হন সেখানেই তিনি অর্জন করেন প্রথম বিজয়। ভিপির দায়িত্ব পালনেও তিনি পদে পদে বাধার মুখে পড়েছেন। পুলিশ ও সরকারি পেটোয়া বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ১৩ বার। রাজপথে রক্তাক্ত হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন। এমনকি রাজনীতি কতটা নোংরা ও কলুষিত সেই পরিচয়ও পেয়েছেন যখন তার ও সহকর্মীদের বিরুদ্ধে ছাত্রী ধর্ষণের মামলা দেয়া হয়। পরে মুচলেকা নিয়ে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়।

গত বছর জুন মাসে নুর একটা নতুন রাজনৈতিক দল তৈরির প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। এই মাসে সেটি হতে যাচ্ছে। দলের চেয়ারম্যান বা সভাপতি যেই হন না কেন, নুরই হবেন প্রধান আকর্ষণ বা মূল ব্যক্তি। তার চিন্তাচেতনার আলোকেই দল চলবে।

নুরুল হক একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ভাবছেন। মানুষ যাতে তাদের বিকল্প শক্তি হিসেবে ভাবে সে জন্যই এমন ভাবনা। তাদের প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি হবে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলন। বলেছেন, এ বিষয়ে বড় চাপ তৈরি করা না গেলে সরকারি দল তাদের অনুগত ইসি গঠন করবে।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও নাগরিকের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে শক্তভাবে মাঠে নামবে নতুন দল। এমনটাই বলেছেন সংগঠকরা। দলের স্লোগান হবে ‘জনতার অধিকার, আমাদের অঙ্গীকার’। লক্ষণীয়, সব দলই গণতন্ত্র-অধিকার রক্ষার বা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে জনগণের সামনে আসে। সে দিক থেকে দেখলে গণতন্ত্রের নামে আন্দোলন-সংগ্রাম, জ্বালাও-পোড়াও করা দল আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় কেউ এ দেশে আর নেই। কিন্তু দলটি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই তাদের ভিন্ন রূপ দেখতে পেয়েছে মানুষ। এখন ক্ষমতায় আছে সেই দলটি। এ সময় রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অবস্থা কী? নিজেদের দলীয় দাবিদাওয়া ছাড়া আর কোনো জাতীয় ইস্যু নিয়ে তারা রাস্তায় নামতে পারেনি। হরতাল-অবরোধ দূরের কথা একটি মিছিলও করতে পারে না। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটি ব্যানার নিয়ে নির্বিরোধী মানববন্ধন করেও তারা মনে করেন, আহা বিরাট একটা কাজ করে ফেললাম। এই পরিণতির কারণ, তারা সব সময়ই ডিফেন্সিভ অবস্থান নিয়ে খেলেছেন। প্রতিপক্ষের যেসব জায়গায় ঐতিহাসিক দুর্বলতা সে জায়গাগুলোতে আঘাত করেননি। নিজেদের দুর্বলতাগুলো নিয়ে লজ্জা বোধ করেছেন। অথচ প্রতিপক্ষের সঙ্গে তুলনায় বিএনপির ইতিবাচক রেকর্ড অনেক বেশি উঁচু। সেটি জোর গলায় বলতে পারেননি।

এখনো মন্ত্রীরা বলে যাচ্ছেন, বিএনপির মুখে গণতন্ত্রের কথা শোভা পায় না। অথচ গোটা জাতি জানে, এ দেশে বিএনপিই গণতন্ত্রের একমাত্র চ্যাম্পিয়ন। মন্ত্রীদের মন্তব্যের কোনো জবাব দেয়ার দরকার মনে করেন না বিএনপি নেতারা। এ দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতির সঞ্চার করেছেন বিএনপির অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। তিনিই তিলে তিলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন অর্থনীতির নানা ইতিবাচক আইন করে, নীতি ও বিধি তৈরি করে। বাজার অর্থনীতি, মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন তার সেরা অবদান। সেসব কথা বলতে পারে না দলটি। তাদের কোথায় দুর্বলতা, কেন তারা জবাবটাও দিতে পারেন না, আমাদের জানা নেই। হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হামলা, মামলা, জেল-জুলুম চলছে অথচ বিএনপি কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে ব্যর্থ। নিজের নেতাকর্মীদের যারা সুরক্ষা দিতে পারে না জনগণ তাদের হাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতা তুলে দেবে এমন আশা করার কোনো কারণ কি অবশিষ্ট আছে? মনে হয় না। দলের বহু নেতাকর্মী, সমর্থক গোপনে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় যাচ্ছে এটা আর কারোরই অজানা নেই।

এমনই এক পরিস্থিতিতে মাঠে নামছেন নুর। তার অতীত আওয়ামী সংশ্লিষ্টতার কারণে তার পক্ষে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না এমন মনে করার কারণ নেই। তবে বেশি কিছু আশা করার আছে এমনও বোধ হয় নয়। তিনি ডাকসু ভিপি ছিলেন, এটুকুই তার পরিচয়। তার মত এমন অনেক ভিপি রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে গেছেন। কেউ কেউ খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করছেন। দেশের অন্যতম প্রধান ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতা কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক দল করতে গিয়ে থৈ পাচ্ছেন না এমন দৃষ্টান্ত চোখের সামনেই। এবি পার্টি বা আমার বাংলাদেশ পার্টির কথাই বলছি। তাদের অন্যতম সমস্যা তারা জামায়াত থেকে বেরিয়ে যাওয়া অথবা বহিষ্কৃত। তাই পিঠে যে সিলমোহর আঁকা হয়ে আছে সেটি তাদের পিছুটান হিসেবে কাজ করেছে। জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন কোনো নেতাও তাদের সামনে ছিল না। আবার ময়দানে নামার পর আন্দোলন-সংগ্রামে তারা কোনো চমকও দেখাতে পারেননি।

নুর কি সেটি দেখাতে পারবেন? আওয়ামী লীগকে ব্যতিব্যস্ত করার মতো ঝাঁকুনি কি দেয়া সম্ভব এই নতুন দলের পক্ষে? নুর বলেছেন, ‘আমরা যখন রাজনৈতিক দল হবো, তখন আমরা মানুষের জন্য কাজ করব, কথা বলব। আমরা যেভাবে চলছি দেখবেন আগামী দেড় বছরে বিপ্লব ঘটে যাবে।’ এটি একটি হাঁকডাকের মতো ব্যাপার। কুস্তির রিংয়ে নামার আগে পালোয়ানরা প্রতিপক্ষের উদ্দেশে নানা রকম হাঁকডাক ছাড়েন, হুমকি-টুমকিও দেন। সে কথা ধরি না। তবে নুর গত তিন-চার বছরে যতবার পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন, যতবার রক্তাক্ত হয়েছেন ততই তার প্রতি মানুষের সহানুভ‚তি ও সহমর্মিতা বেড়েছে। এই সুবিধাটুকু তিনি সবসময় পাবেন। আরেকটি বিষয় আছে লক্ষ্য করার মতো।

এবি পার্টি প্রতিষ্ঠার দেড় বছরের মাথায় বেশ কিছু নেতাকর্মী ওই দল ছেড়ে গেছেন। কিন্তু নুর তার দলে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ ও বিভিন্ন রাজনীতিক এবং অরাজনৈতিক সংগঠনকে টানার চেষ্টা করছেন। এই মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় সাবেক রাজনীতিকদেরও কাছে টানছেন। আত্মপ্রকাশের আগেই কয়েকটি দল ও সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছেন। নতুন দলে ছোট ছোট অন্তত চারটি সংগঠন একীভূত হতে পারে বলেও জানা গেছে। দলগুলো যত ছোটই হোক, এটি নুরুল হক নুরের বড় সাফল্য বলেই মনে করি।

বিশেষ করে যখন মনে রাখি যে, জনগণের প্রকৃত ভোটে তিনতিনবার ক্ষমতায় আসা বিএনপি গত ১৩ বছরে একটি অনির্বাচিত, অসফল, নিপীড়ক ও ভয়াবহ রকমের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে ন্যূনতম কোনো কর্মসূচির ভিত্তিতে একটিও রাজনৈতিক দলকে কাছে টানতে পারেনি। বরং যারা কাছে ছিল, জোটে ছিল তারাও দূরে সরে গেছে। এ যে দলটির কত বড় ব্যর্থতা তা বোঝা যাবে আরো কয়েক মাস পর। যখন তারা আরো নিঃসঙ্গ হবে। এ নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলার লোভ সংবরণ করছি। সময় সুযোগ হলে বলব।
mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement