২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মসজিদের জন্য অর্থ সংগ্রহ

-

মসজিদ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ইবাদতের ঘর। মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করা হয়। প্রতি শুক্রবার মসজিদে জোহরের নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করা হয় এবং জুমার নামাজে মুসল্লির সংখ্যা যেকোনো ওয়াক্তের নামাজের মুসল্লির চেয়ে কয়েকগুণ অধিক হয়ে থাকে। রমজান মাসে মসজিদে এশার নামাজ পরবর্তী জামায়াতের সাথে তারাবির নামাজ আদায় করা হয়। তারাবির নামাজের ক্ষেত্রেও দেখা যায় মুসল্লির সংখ্যা যেকোনো ওয়াক্তের নামাজের চেয়ে অনেক বেশি হয়।

আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি লোকালয়েই মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একক ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত দানে গড়ে উঠেছে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশ ব্যক্তিগত দান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা নির্বাহ করা হয়। আমাদের রাজধানী শহর ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোতে কিছু কিছু মসজিদ রয়েছে যার নির্মাণ ব্যয় ও রক্ষণাবেক্ষণ সরকার প্রদত্ত অনুদানের অর্থে নির্বাহ করা হয়। একক ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত দানে গড়ে ওঠা মসজিদে দানবাক্সের মাধ্যমে অর্থ আদায় করা হয়। জুমার নামাজের সময় এ ধরনের প্রতিটি মসজিদে দেখা যায় কাবলাল জুমার সুন্নাত নামাজ আদায় পরবর্তী প্রতিটি কাতারের সম্মুখ দিয়ে দানবাক্স চালু করে অর্থ আদায় করা হয়। মসজিদের জন্য অর্থ প্রদান পুণ্যের কাজ মনে করায় মুসল্লিদের প্রায় সবাই জুমার দিন কিছু না কিছু অর্থ দানে সচেষ্ট থাকেন। ওয়াক্তের নামাজের সময় কিছু কিছু মসজিদে ব্যতিক্রম ব্যতীত সচরাচর অর্থ আদায়ের জন্য দানবাক্স চালু করা হয় না। অর্থ দানের মাধ্যমে মসজিদ নির্মাণ বা মসজিদের উন্নয়ন, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ দানকে সদকায়ে জারিয়া বলা হয়।

ইসলাম ধর্মমতে জীবিত অবস্থায় একজন ব্যক্তির দান হলো সদকায়ে জারিয়া। সদকায়ে জারিয়া আরবি শব্দ। সদকা শব্দের অর্থ দান করা এবং জারিয়া শব্দের অর্থ সদাস্থায়ী। সদকায়ে জারিয়া এমন ধরনের দান যার কার্যকারিতা কখনো শেষ হয় না। সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং সদকাকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পরও কবরে শুয়ে এর সওয়াব পেতে থাকেন।

আল্লাহ তায়ালা বিত্তবানদের ওপর সম্পদের জাকাত এবং ওশর ফরজ করেছেন। সে সাথে সদকার ব্যাপারেও তাগিদ দিয়েছেন। ইসলামে জাকাত ও ওশরের বিধান নির্ধারণ করে দেয়া আছে অপর দিকে সদকার ব্যাপারে কোনো সীমারেখা দেয়া নেই। সদকার ব্যাপারে ধনী-দরিদ্রের কোনো শর্ত নেই এবং যেকোনো ব্যক্তি সদকা করতে পারেন। হাদিসের ভাষ্য মতে, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমল জারি থাকে, যথা (ক) সদকায়ে জারিয়া (খ) উপকারী জ্ঞান এবং (গ) নেক্কার সন্তানের দোয়া।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের অভ্যন্তরস্থ সড়ক এবং মহাসড়কের পাশে প্রায়ই দেখা যায় চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে কিছু ব্যক্তি মাইকের মাধ্যমে পথচারী ও বিভিন্ন যানবাহনে চলমান যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে মসজিদের নামে অর্থ আদায়ে সচেষ্ট। এভাবে এমন অনেক মসজিদের নামে অর্থ আদায় করা হয় যেগুলোর অবস্থান আদায়কৃত স্থান থেকে অনেক দূরে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন শহরে বা জেলায়। আবার এমন দেখা যায় জমা রসিদ বই হাতে নিয়ে পথচারী ও যানবাহনের অভ্যন্তরে যাত্রীদের কাছে থেকে অর্থ আদায়ে লিপ্ত। মাইকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেপরেকর্ডারে ধারণকৃত বক্তব্য প্রচার করে দানের আহ্বানে সাড়া দিতে বলা হয়। রাস্তার পাশে অনবরত সকাল থেকে রাত অবধি মাইকে আহ্বান জানিয়ে মসজিদে দানের জন্য অর্থ চাওয়া একধরনের গণ-উপদ্রব যা দেশের প্রচলিত দণ্ড আইন অনুযায়ী শান্তিযোগ্য অপরাধ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এভাবে যারা অর্থ আদায় করেন তাদের অনেকে বিভিন্ন মসজিদ কর্তৃক দৈনিক নির্ধারিত অংঙ্কের মজুরির বিনিময়ে আদায়ের কাজে লিপ্ত আবার অনেকে দৈনিক বা মাসিক মসজিদে নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ জমা দেবেন এমন শর্তে নিয়োজিত। এমন অনেক এভাবে অর্থ আদায় করছেন যার সাথে মসজিদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এভাবে আদায়কৃত অর্থের সম্পূর্ণ অংশই তারা লোপাট করছেন যা প্রতারণা বৈ অন্য কিছু নয়।

আমাদের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিকদের প্রচারিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাস্তার পাশে টেবিলচেয়ার নিয়ে বসা অবস্থায় এবং রসিদ বই হাতে যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীদের কাছ থেকে মসজিদের নামে যারা অর্থ আদায় করছেন এরা আদায়কৃত অর্থের একটি সামান্য অংশ মসজিদে জমা দিয়ে অবশিষ্ট অংশ আত্মসাৎ করছেন। তাদের অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এভাবে অনেক মসজিদের নামে অর্থ আদায় করা হচ্ছে যেগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই। আবার দু-একটির অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও এগুলো এতই জরাজীর্ণ যে দানের সামান্যতম অংশও মসজিদের উন্নয়ন বা সংস্কারের কাজে ব্যবহার হয় না।

আমাদের দেশের প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান দু’টি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজের প্রধান জামায়াত রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হয়। এ জামায়াতটিতে রাষ্ট্রপতি, কিছু মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, উচ্চাদালতের বিচারক, ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী এবং সাধারণ জনমানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এ প্রধান জামায়াতটি যেমন খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় অনুরূপ প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলা শহরে খোলা মাঠে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। উভয় ঈদের নামাজ শেষ হওয়া পরবর্তী ইমাম সাহেব খুতবা দেয়ার প্রাক্কালে অথবা খুতবা দেয়াকালীন অথবা খুতবা শেষ হওয়ার পর মুনাজাত পরিচালনার আগমুহূর্তে দেখা যায় একশ্রেণীর ব্যক্তি রসিদ বই হাতে বড় আকৃতির রুমালের দু’প্রান্ত ধরে মুসল্লিদের সম্মুখ দিয়ে হেঁটে অগ্রসর হয়ে মসজিদের জন্য অর্থ দানের আহ্বান জানায়। মুসল্লিদের একটি বড় অংশ তাদের এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে অর্থ দিয়ে থাকেন। দু’-একজন মুসল্লির অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন থেকে জানা যায়, এভাবে যেসব মসজিদের নামে অর্থ আদায় করা হয় এগুলোর কোনোটিই রাজধানী শহরের কোনো এলাকার মসজিদ নয়। দূর-দূরান্তের মসজিদের নামে এভাবে যে অর্থ আদায় করা হয় এগুলোর আদৌ অস্তিত্ব আছে কি না বা অস্তিত্ব থেকে থাকলে সে অর্থ মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছে কি না এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজতে গেলে দানকারী ব্যক্তির বিশ্বাসের মধ্যে চিড় ধরার উপক্রম হয়।

অনেক এলাকায় নতুন মসজিদ নির্মাণকালীন দেখা যায় সড়ক বা মহাসড়ক দিয়ে চলমান যানগুলোকে থামতে বাধ্য করে মসজিদের নামে অর্থ চাওয়া হয়। দান সবসময় একজন ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বিষয়। এভাবে জোরপূর্বক গাড়ি থামিয়ে গাড়িচালক বা যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় বা অর্থ দিতে বাধ্য করা ইসলামিক রীতিনীতির পরিপন্থী।

যেকোনো মসজিদ প্রতিষ্ঠাকালীন এটির প্রতিষ্ঠার সাথে যারা সম্পৃক্ত তারা মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের বিষয়টিকে মাথায় রেখে আয়ের উৎস হিসেবে কিছু স্থাবর সম্পত্তি মসজিদের নামে ওয়াক্ফ করে থাকেন। বেশির ভাগ মসজিদের ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি থেকে অর্জিত আয় দ্বারা সফলতার সাথে মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করা যায়। এর অতিরিক্ত মুসল্লিদের ইচ্ছাধীন ব্যক্তিগত দান থেকে যে অর্থ আসে তা দিয়ে মসজিদের উন্নয়ন, আধুনিকায়ন এবং মুসল্লিদের সুযোগ-সুবিধার কাজগুলো সমাধা করা হয়। ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত দান থেকে একটি মসজিদের যে পরিমাণ অর্থ আয় হয় তা রক্ষণাবেক্ষণ ও যাবতীয় উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত বিধায় অন্য কোনোভাবে মসজিদের নামে অর্থ আদায় প্রত্যাশিত নয়।

আমাদের দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার মসজিদেরও উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে ঢাকাসহ জেলা শহরের প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মসজিদে মুসল্লিরা যেন স্বস্তিতে নামাজ আদায় করতে পারে সে জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং হয়ে চলছে। এসব শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বিভিন্ন বিত্তবানের দানে সংস্থান করা হয়েছে বা হয়ে চলছে।

আমাদের দেশের বিভিন্ন মসজিদে প্রাত্যহিক দান বাক্সের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন বিত্তবানের দানে যে পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয় তা মসজিদগুলোর উন্নয়ন, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত বিবেচিত হয়। এ বাস্তবতায় রাস্তার পাশে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে মাইকিংয়ের মাধ্যমে বা হাতে রসিদ বই নিয়ে মসজিদের নামে অর্থ আদায়ে জনমানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এ বিভ্রান্তিতে পড়ে যারা অর্থ দান করছেন তারা একধরনের প্রতারণার শিকার। যেকোনো রাষ্ট্রের স্বীকৃত ব্যবস্থা এভাবে অর্থ আদায় অনুমোদন করতে পারে না। আমাদের দেশের স্বীকৃত ব্যবস্থাও এ ধরনের অর্থ আদায়ের অনুমতি দেয় না। স্বীকৃত ব্যবস্থার অনুমতির অনুপস্থিতিতে এভাবে অর্থ আদায় আইন, নীতিজ্ঞান ও নৈতিকতার পরিপন্থী। অথচ অপরাধ দমনে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সম্মুখেই প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদের নামে এভাবে অর্থ আদায়ের কাজ চলছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে যেহেতু এটি আজ প্রতিষ্ঠিত যে, এভাবে মসজিদের নামে আদায়কৃত অর্থের অতি সামান্য অংশ মসজিদে জমা হচ্ছে অথবা কোনো অংশই মসজিদের উন্নয়ন, সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যবহার হচ্ছে না সেহেতু এভাবে অর্থ আদায় যে গর্হিত কাজ অন্তত এ সত্যটুকু উপলব্ধি করে এভাবে অর্থ আদায়ের পথ রুদ্ধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
শেখ হাসিনা সব প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা বন্ধে বিশ্ববাসীকে সোচ্চার সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির মৃত্যু নীলফামারীতে তিন হাজার ১৭০ চাষির মাঝে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ কারাগারে কয়েদির মৃত্যু উজ্জ্বল হত্যার বিচার দাবিতে সরিষাবাড়ীতে মানববন্ধন পাবনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত ১ আহত ২১ খাবারের সন্ধানে বসতবাড়িতে হরিণ, মহামায়ায় অবমুক্ত সিঙ্গাপুর প্রবাসী ফিরোজ মাহমুদের লাশ দেশে ফিরেছে ফরিদপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকের মৃত্যু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সব ধর্মের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে: ড. সুকোমল বড়ুয়া

সকল