২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘গঙ্গা থেকে জমজম’-এর লেখক কালজয়ী এক প্রতিভা

‘গঙ্গা থেকে জমজম’-এর লেখক কালজয়ী এক প্রতিভা - ছবি : সংগৃহীত

পূর্ব নাম বাঙ্কেরাম। ১৯৪৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার বালরিয়াগঞ্জ গ্রামে এক হিন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম। শৈশব থেকে ধর্মীয় বিষয়ে ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। বিভিন্ন ধর্মের বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা ও অধ্যয়ন তাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে। ১৬ বছর বয়সে খাজা হাসান নিজামির হিন্দি ভাষায় রচিত পবিত্র কুরআনের অনুবাদ পড়ে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। হাকিম আইউব নদভি নামে এক ব্যক্তির কাছে কালিমা পড়ে মুসলমান হন। নতুন নাম জিয়াউর রহমান আজমি। বাবা ছিলেন আজমগড়ের বিত্তবান ব্যবসায়ী। তাকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে বাবা ব্যর্থ হন। অবশেষে কিশোর জিয়া নিজ এলাকা ছেড়ে বাদায়ুনের একটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে প্রাথমিক পড়ালেখা শেষ করেন। সেখান থেকে আজমগড়ের শিবলি কলেজ ও তামিলনাডুর ওমরাবাদ জামিয়া দারুস সালামে ভর্তি হন। পাঁচ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইতোমধ্যে নবীজী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনচরিত, ইতিহাস ও হাদিসের প্রতি তার আগ্রহ বাড়ে। শায়খ আবদুল আজিজ বিন বায়, শায়খ উসায়মিন, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, মাওলানা সাইয়েদ সোলায়মান নদভি, মাওলানা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি, মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী প্রমুখ সমসাময়িক চিন্তবিদের চিন্তাধারা তার মানস ও চেতনাকে প্রভাবিত ও ঋদ্ধ করে।

১৯৬৬ সালে স্কলারশিপ নিয়ে মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে প্রথম বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ১৯৭০ সালে মক্কার উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন। মাস্টার্সের থিসিস ছিল ‘আবু হুরায়রা ফি দাউই মারবিয়্যাতিহি ওয়া ফি জামালি শাওয়াহিরিহি ওয়া ইনফিরাদিহি’। এতে তিনি হজরত আবু হুরায়রা রা: সম্পর্কে প্রাচ্যবিদদের উত্থাপিত নানা প্রশ্নের গবেষণানির্ভর উত্তর দেন। অতঃপর মিসরের বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘দ্য জাজমেন্ট অব দ্য প্রফেট’। কর্মজীবনে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ খিদমত আঞ্জাম দেন। মক্কা মুকাররমায় অবস্থিত রাবেতা আল আলম আল ইসলামী’র গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৯৭৯ সালে মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। পরে হাদিস অনুষদের ডিন নিযুক্ত হন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট থিসিসগুলো নিরীক্ষণ করার গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পাদন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন সৌদি সরকার তাকে নাগরিকত্ব দেয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি প্রাচীন পদ্ধতিতেও বিভিন্ন শায়খের সান্নিধ্যে থেকে হাদিস ও শরিয়ার ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তার উল্লেখযোগ্য শায়খদের মধ্যে সৌদি আরবের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শায়খ আবদুল্লাহ বিন হামিদ রহ:, সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাজ রহ:, দক্ষিণ ভারতের শায়খুল হাদিস মাওলানা আবদুল ওয়াজিদ উমরি রহমানি ও মাওলানা আবুল বায়ান হাম্মাদ উমরি অন্যতম।

হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভির সিলসিলার অন্যতম বুজুর্গ শাহ হাকিম আখতারের সাথে তার আধ্যাত্মিক (তাজকিয়া) সম্পর্ক ছিল। গবেষণা ও দাওয়াহসহ নানা কাজে ভারত, পাকিস্তান, মিসর, জর্দান, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনতে সবজায়গায় ছাত্র-শিক্ষকদের ভিড় থাকত। ২০১৩ সালে তিনি নিয়মিত মসজিদে নববীতে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের দরস দান করতেন। আরবি ভাষায় তিনি ১৪টি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। হিন্দি, ইংরেজি, বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় এগুলোর তরজমা হয়েছে। বাংলায় অনূদিত চারটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। ১. ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মের ইতিহাস, ২. হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ জাতির ইতিহাস, ৩. কুরআনের শীতল ছায়া, রাসূলুল্লাহ সা:-এর বিচারব্যবস্থা। হাদিস বিষয়ে তার রচিত প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো, ‘জামিউল কামিল ফিল হাদিসিস সহিহ শামিল।’ ২০ খণ্ডের এ বিশাল গ্রন্থে তিনি ১৬ হাজার হাদিস সঙ্কলন করেন। অনেক বিজ্ঞ হাদিস বিশারদ ও মুসলিম পণ্ডিত মনে করেন, গত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে এ কিতাবকে অন্যতম গবেষণাকর্ম বলা যায়, যেখানে কোনো ধরনের পুনরাবৃত্তি ছাড়া কেবল সহিহ হাদিসগুলোই স্থান দেয়া হয়েছে। এতে শায়খ ড. জিয়াউর রহমান আজমি ১৫ বছরের কর্মসাধনা ব্যয় করেন এবং এই কর্মযজ্ঞে তিনি ২০০টিরও বেশি হাদিস গ্রন্থের সহায়তা নেন। তার অন্যতম আরেকটি বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে হিন্দি ভাষায় রচিত ‘কুরআন বিশ্বকোষ’। এতে তিনি ৬০০ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়াও ‘কম্পারেটিভ স্টাডি অব জুদাইজম, ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান রিলিজিওন্স’ গ্রন্থটি সৌদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকাভুক্ত। ইসলাম গ্রহণের অভিজ্ঞতা নিয়ে খুবই সুখপাঠ্য ও মুগ্ধতা ছড়ানো আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখেছেন ‘ফ্রম গঙ্গা টু জমজম’।

এক সাক্ষাৎকারে প্রফেসর ড. জিয়াউর রহমান আজমি বলেছেন, ‘আমার জন্ম একটি বনেদি হিন্দু পরিবারে। ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস এবং পালিত রেওয়াজগুলো সম্পর্কে আমি ভালোই অবগত ছিলাম। বলব প্রভাবিতও ছিলাম; বরং বললে ভালো হয় আমার অন্তরে হিন্দু ধর্মের প্রতি শক্ত সাম্প্রদায়িক বোধ বপিত ছিল। হিন্দু ধর্ম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মকে আমি সত্য মনে করতাম না। যখন আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়া শুরু করলাম তখন ইসলামের এই দাবি আমার সামনে এসে দাঁড়াল ‘আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র ধর্ম’। এর মানে হচ্ছে ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম। আমি এই ঘটনার পর পুনরায় হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে মনোযোগী হই। এই উদ্দেশ্যে আমি কলেজে সংস্কৃতির লেকচারারের শরণাপন্ন হই। তিনি গীতা এবং বেদ গ্রন্থের পণ্ডিত। তার সাথে এ বিষয়ে দিনের পর দিন কথা হতে থাকে। কিন্তু তিনি আমাকে যুক্তিতর্কে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। সত্য কথা কী, দেবদেবীকেন্দ্রিক হিন্দু ধর্মের আকিদা বিশ্বাস এবং অবোধগম্য রীতিনীতি কোনো সচেতন মানুষকে সন্তুষ্ট করবার মতো নয়ও। এ কারণেই হিন্দু ধর্মের যুবক শ্রেণী দেবদেবীকেন্দ্রিক কল্পনাপ্রসূত চিন্তা-বিশ্বাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত নয়; বরং তাদের অন্তরজুড়ে আছে তীব্র অস্বস্তি ও অস্থিরতা। আমি মনে করি যদি তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয় এবং তাদের চিন্তা ও বোধের উপযোগী করে লিটারেচার পরিবেশন করা হয় তাহলে তারা সহজেই ইসলাম কবুল করে নেবে। এটা আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।’

এক সাক্ষাৎকারে তিনি যে মন্তব্য করেন তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য, “ইসলাম গ্রহণের পর আমি উপলব্ধি করি ভয়ঙ্কর অন্ধকার থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি সীমাহীন আলোর দেশে। এখানে এসে প্রথমবারের মতো নিজের জীবন ও জীবনের মূলমর্ম উপলব্ধি করতে পারি। এটাও উপলব্ধি করতে পারি, ইসলাম এবং বর্তমান কালের মুসলিম সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। আমার যতটুকু ধারণা অমুসলিমরা একালে ইসলাম কবুল করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা অনুভব করেন এটাই। সত্যিকার অর্থে ইসলামের প্রতিটি বিষয়ই পৃথিবীর যেকোনো সুস্থ মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতে যথেষ্ট। বর্তমান মুসলিম সমাজে সেই শক্তি পূর্ণরূপে বিকশিত খুব কম ক্ষেত্রেই। তার পরও বলতে পারি, ইসলামের চলমান ভ্রাতৃত্ববোধ এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা আমাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে। এ কথা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যে, আজকের এই পতিত কালেও মুসলমানদের সমাজে ‘সকল মুসলমান ভাই ভাই’ (হুজুরাত-১০) এর চিত্র যে শক্তির সাথে বহমান তা সমকালীন দুনিয়ায় এক বিস্ময়। মুসলমান সমাজে সামাজিক সাম্য এখনো যতটুকু নজরে পড়ে পৃথিবীর তাবৎ সমাজব্যবস্থার বিচারে তা তুলনাহীন” (মাসিক আরমোগান, নভেম্বর, ২০১৯)।

এই বিদগ্ধ মুহাদ্দিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর একাগ্রচিত্তে অধ্যয়ন ও গবেষণা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই আরাফার দিন মদিনায় ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকিতে তাকে দাফন করা হয়। ইসলামের ইতিহাসে বহু স্কলার অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম গ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তাদের মধ্যে মুহাম্মদ আসাদ, মরিয়ম জামিলা, ড. মরিস বুকাইলি, মুহাম্মদ পিকথাল, মাইকেল ওলফ, মুরাদ উইলফ্রাইড হফম্যান, বেলাল ফিলিপস ও ড. পামেলা টেইলর অন্যতম। কিন্তু প্রফেসর ড. জিয়াউর রহমান আজমি যিনি গোড়া ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে উঠে এসে মদিনা, উম্মুলকুরা ও আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি নিয়ে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিসের অধ্যাপক ও ডিনের দায়িত্ব পালন এবং মদিনার মসজিদে হাদিসের দরস প্রদান প্রকর্ষ ও উৎকর্ষের প্রবাদপ্রতিম হয়ে থাকবেন ইতিহাসে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক।
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement