১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রোহিঙ্গা আত্তীকরণের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র!

- ফাইল ছবি

সম্প্রতি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আশ্রিত অংশকে বাংলাদেশের জনগণের সাথে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে একীভ‚ত করার একটি কুটিল ও জটিল প্রক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। এই পরিকল্পনার কথা ‘ইউএনএইচসিআর’ এবং বিশ্বব্যাংক অস্বীকার করলেও প্রস্তাবটি প্রণয়নের ব্যাপারে সংস্থা দু’টি পরস্পরকে দায়ী করছে। কিন্তু উভয়ই প্রধানত পশ্চিমা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহজেই অনুমান করা যায় এ ধরনের চিন্তা কাদের উর্বর মাথা থেকে বের হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ, যদিও জাতিসঙ্ঘের হিসাব মতে, ১০ লাখ বলা হচ্ছে। কাজেই এই বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে একীভ‚ত হয়ে গেলে এ দেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।

মিয়ানমারের এই রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের নীলনকশা ১৯৬৬ সালেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর আরাকানে মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পুনর্বাসিত করে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ানো হয়। এমনকি কারাগারে বন্দীদের সাজা কাটছাঁট করে তাদেরকে আরাকানে পুনর্বাসিত করা হয়। এভাবে রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হলে ১৯৭৮ সালে ব্যাপকভিত্তিক রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয়। এরপর ১৯৯২ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে ব্যাপক গণহত্যা ও বাড়িঘর ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা সব ফেলে জীবন নিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নিধনযজ্ঞে ৭৩০ জন শিশুসহ প্রায় ছয় হাজার ৭০০ জন রোহিঙ্গা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার এবং তাদের ২৮৮টি গ্রাম আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় (বিবিসি নিউজ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। জাতিসঙ্ঘের মতে, এই বর্বরতা হলো “Text book example of ethnic cleansing” অর্থাৎ জাতিগত নিধনের পাঠ্য পুস্তকীয় উদাহরণ।

গত জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক শরণার্থী নীতির রূপরেখা (রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক- আরপিআরএফ) প্রেরণ করে বাংলাদেশের মতামত জানতে চায়। এই রূপরেখায় সুকৌশলে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের কথা উহ্য রেখে বলা হয়েছে, ‘যেসব দেশে শরণার্থী রয়েছে, সেখানে তাদের আত্তীকরণ করা দরকার।’ প্রস্তাব মেনে নিলে বাংলাদেশকে এ বাবদ ৫৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়া হবে। এর বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষা দিতে হবে। আর এই অধিকার সুরক্ষায় রয়েছে তাদের স্বাধীন চলাচল, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ভ‚মিক্রয়, শিক্ষা, ভোটাধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত করা। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ বা বিশ্বব্যাংক এই প্রতিবেদনে যে প্রস্তাবটি করেছে, তা তারা ভালোভাবেই বুঝে বা জানে যে, প্রস্তাবটি অন্যান্য শরণার্থী আশ্রয়দানকারী দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বিশ্বে ফৌজদারি কারণে ২২.৫ মিলিয়ন শরণার্থী রয়েছে। এরা মূলত সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও মিয়ানমারের উদ্বাস্তু। এর মধ্যে ৩.৭ মিলিয়ন তুরস্কে, ১.৪ মিলিয়ন পাকিস্তানে, ১.৪ মিলিয়ন উগান্ডায়, ১.২ মিলিয়ন জার্মানিতে, ১.১ মিলিয়ন সুদানে ও এক মিলিয়ন বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় আছে। আশ্রয় দানকারী এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে শরণার্থী আত্তীকরণের বিষয়টি একেবারেই অবাস্তব হবে কার্যক্ষেত্রে। কারণ তুরস্কের জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১১০ জন, পাকিস্তানে ২৮৭ জন, সুদানে ২৫ জন, উগান্ডায় ২২৯ জন ও জার্মানিতে ২৪০ জন হলেও বাংলাদেশে এই সংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ২৬৫ জন। এ অবস্থায় কী করে জাতিসঙ্ঘ এমন একটি আত্মঘাতী প্রস্তাব বাংলাদেশকে দিতে পারে? তা ছাড়া শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘের প্রণীত ‘১৯৫১ রিফিউজি কনভেনশন’ মূলত প্রস্তুত করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ইউরোপিয়ান শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য। ১৯৬৭ সালে তা আরো একটি প্রটোকল প্রণয়ন করে এই কনভেনশনকে বিশ্বব্যাপী কার্যকর করার জন্য বলা হয়। কাজেই আজ সময় এবং আঞ্চলিক বাস্তবতার ভিত্তিতে এই কনভেনশন কিছুতেই বাংলাদেশের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে না। এ ছাড়া ‘টেম্পোরারি প্রটেকশন’ নামে আরো একটি শরণার্থী সুরক্ষার কথা আছে, যা নব্বইয়ের দশকে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সেই ‘টেম্পোরারি প্রটেকশন’-এর আওতায় আশ্রয় দিয়েছিল। আর এই ‘টেম্পোরারি প্রটেকশন’ কোনোভাবেই ‘১৯৫১ কনভেনশন’-এর আওতায় স্থায়ী আশ্রয় বা আত্তীকরণের অজুহাত হতে পারে না। ইউএনএইচসিআর গত ২০১৯ সালের ১৬-১৮ ডিসেম্বর ‘গ্লোবাল রিফিউজি ফোরাম’ নামে একটি প্লাটফর্ম গঠনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সভা করেছিল আশ্রয়দানকারী দেশগুলোর শরণার্থীদের বোঝায় ন্যায়সঙ্গতভাবে অন্য দেশকে অংশীদার করার উদ্দেশ্যে। এই ফোরাম চারটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছিল- ক. আশ্রয়দানকারী দেশের ওপর চাপ কমানো; খ. শরণার্থীদের আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি; গ. তৃতীয় কোনো দেশে প্রবেশাধিকার প্রসারিত করা এবং ঘ. নিজ দেশে নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা। ওই সব উদ্দেশ্যের তিনটি বাদ দিয়ে শুধু শরণার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার লক্ষ্যই বর্তমানে আলোচিত বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে উঠে এসেছে। এতে উল্টো আমাদের দেশের ওপর চাপ প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা প্রথম লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। তা ছাড়া প্রস্তাবে তৃতীয় কোনো দেশে রোহিঙ্গাদের ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রবেশাধিকারের কোনো বক্তব্য নেই। আর মিয়ানমারের ফিরিয়ে নেয়ার পরিবেশ তৈরির চেয়ে পশ্চিমা ও প্রভাবশালী দেশগুলোর শুধু ‘লিপ সার্ভিস’ অথবা নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। তদুপরি বিশ্বের প্রভাবশালী এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিই করে যাচ্ছে অনবরত। আরো একটি বিষয় হলো- রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর উদ্বাস্তুদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিরিয়া, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ সুদানে যেখানে গৃহযুদ্ধের জন্যই উদ্বাস্তু হতে হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আধাসামরিক সরকার কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। কাজেই এখানে এ সমস্যার সমাধান মোটেও জটিল কোনো বিষয় ছিল না। সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর এখন আরো সরল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও সম্মানের সাথে পুনর্বাসিত করার। কিন্তু সদিচ্ছা না থাকায় বরং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তাদের পুনর্বাসন না করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর বাণিজ্যিক এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্যই আজ ‘ইউএনএইচসিআর’ ও বিশ্বব্যাংক এই রোহিঙ্গা আত্তীকরণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। চীন উত্তর রাখাইনের ‘কাইউকফিউ’তে ১.৩ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০১৯ সালে চীন মিয়ানমারে সিঙ্গাপুরের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ এবং মিয়ানমারে বর্তমানে সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রেতা দেশ। চীনের ভ‚-কৌশলগত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ জন্য রাখাইন অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত ‘কোয়াড’ মোকাবেলায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ রাখাইন অঞ্চল চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুবিধাজনক ভূমি। ফলে প্রায় ছয় দশক ধরে মিয়ানমার সামরিক জান্তাকে প্রশ্রয় দেয়া চীন একেবারে নগ্নভাবেই মিয়ানমারের সব পাপকাজকে নিরাপদ আবরণ দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যাবিরোধী প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একাধিকবার সে ভেটো দেয়। রাশিয়াও একই কায়দায় মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। তারাও মিয়ানমারের কাছে বড় অস্ত্র-বিক্রেতা ও সামরিক প্রশিক্ষণদাতা দেশ। অন্য দিকে আমাদের সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতও মিয়ানমারে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। কালাদান ‘মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে আরাকান রাজ্যের সিতওয়ে বন্দরের সাথে যুক্ত করা, সেখানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা, আরাকান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস নেয়া, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা ইত্যাদিতে রয়েছে ভারতের বিশাল লগ্নি। সম্প্রতি তারা মিয়ানমারকে সাবমেরিন সরবরাহ করেছে এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এসব কারণে ওই রাষ্ট্র তিনটি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার নিন্দা জানায়। এ ছাড়া জাপান ও পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গোপনে বা প্রকাশ্যে সমানতালেই জারি রেখেছে। এরা প্রথম দিকে খুব লম্ফঝম্ফ করে ‘লিপ সার্ভিস’ দিলেও বর্তমানে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ রয়েছে।

এ দিকে ঘনবসতিপূর্ণ এই বাংলাদেশে এত বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নিত্যনতুন আর্থসামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। বসতি স্থাপন ও রান্নার কাজের জন্য কক্সবাজারের বনভ‚মি উজাড় করে পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। স্থানীয়ভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি, পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তা ছাড়া মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং নারী ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে এসব উদ্বাস্তু জড়িত হয়ে পড়ছে। ক্যাম্পে তারা নিজেদের মধ্যে ‘গ্যাং’ সৃষ্টি করে প্রায়ই খুনোখুনি করছে। বেশ কিছু রোহিঙ্গা অবৈধ পাসপোর্ট সংগ্রহ করে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে বিদেশে গিয়ে আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ে এ দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে। আমাদের দেশে ইয়াবা প্রবেশের বৃহত্তম করিডোর টেকনাফ সীমান্তে বর্তমানে রোহিঙ্গারাই কুরিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তা ছাড়া পৈশাচিক নৃশংসতার শিকার এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহজেই ‘উগ্রবাদী’ হয়ে ওঠার উর্বর ক্ষেত্র বিরাজ করছে।

ষড়যন্ত্র তত্তে¡র আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বাংলাদেশে সামাজিকভাবে আত্তীকরণের একটি প্রয়াস চলছে। এতে জাতিসঙ্ঘ থেকে শুরু করে পশ্চিমা বিশ্ব ও প্রাচ্যের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ইন্ধন রয়েছে। নইলে কোন যুক্তিতে তারা জনবহুল এই দেশে ১০ লাখ উদ্বাস্তুকে স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছে? এখানে তাদের বাণিজ্যিক, ধর্মীয় ও ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থই বেশি ক্রিয়াশীল রয়েছে। এসব শক্তিধর বিশ্বমোড়ল প্রথমত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশীদের অনুরূপ ধর্মাবলম্বী নয়। কাজেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নির্মূল হয়ে গেলেও তাদের কিছু যায়-আসে না। আর বাংলাদেশে এদের অন্তর্ভুক্তিকরণ করলে বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতি হলেও তাদের স্বার্থের কোনো হানি ঘটবে না। এখানে একটি ধর্মীয় বৈষম্যের ভিত্তিতেই বিশ্বায়নটাকে বিবেচনা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা শূন্য ভূমিতে তাদের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের কর্মকাণ্ড সফলভাবে চালু রাখতে পারবে। অথচ রোহিঙ্গাদের এই আত্তীকরণ ঘটলে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল এ দেশ আরো ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, আবাসন ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার ওপর প্রচণ্ড চাপ ফেলবে। তদুপরি বহু রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী বলে জানা যায়। এ অবস্থায় বেশির ভাগ অশিক্ষিত, এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দেশের শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমাদের অতিরিক্ত সংখ্যার শ্রমিকের বাজারে আরো শ্রমিক যুক্ত হবে। অবাধ চলাচলের সুযোগে এরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ধরনের আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যার সৃষ্টি করবে। চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই, ভিক্ষাবৃত্তি, দেহব্যবসায়, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়, খুন-খারাবি ইত্যাদির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে আমাদের সমাজ অস্থির হয়ে উঠবে। নারী পাচার, ‘আদম ব্যবসায়’ ইত্যাদি বহুগুণে বেড়ে গিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে। সব মিলে, বিশ্বব্যাংকের এই উদ্ভট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। মুখ থুবড়ে পড়বে আমাদের অর্থনীতি; ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামাজিক ভারসাম্য। কাজেই বাংলাদেশ সরকার সর্বোত্তম ক‚টনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এই প্রস্তাবের বিপক্ষে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে।

সত্যিকারার্থে একটি দেশের জন্য এ ধরনের বিধ্বংসী প্রস্তাব বিশ্বব্যাংক একা উত্থাপন করতে পারে না। এতে জাতিসঙ্ঘ তথা বিশ্ব সংস্থাগুলোর পর্দার আড়ালের ক্রীড়নকরা অবশ্যই তৎপর। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের যতই ক্ষয়ক্ষতি হোক না কেন, তাদের স্বার্থ শতভাগ অক্ষুণ্ন থাকবে।

বিশ্বব্যাংক বা জাতিসঙ্ঘের এই প্রস্তাব কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়; বরং বিশ্বমোড়লদের উচিত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা, তাদের সামরিক নেতাদের বিচারের মুখোমুখি করা। যেটা নেতাদের জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের ওপর সম্মিলিত অবরোধ আরোপ করলেই এই পথ সুগম হতে পারে। অথবা নবগঠিত ‘গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামের’ প্রস্তাব মোতাবেক এসব রোহিঙ্গাকে তৃতীয় দেশগুলোতে ন্যায়সঙ্গত সমতার ভিত্তিতে প্রবেশাধিকার দিয়ে তাদের অন্তর্ভুক্তিকরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই দু’টি ব্যবস্থার কোনোটিই না করে শুধু বাংলাদেশের ওপর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার চাপিয়ে দিলে তা হবে বিশ্ব নেতৃত্বের নিদারুণ অন্যায় ও নির্মম রসিকতা, যার সুদূরপ্রসারী বিশ্বের জন্য কখনোই সুখের হবে না।

আজকে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসঙ্ঘ রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে দরদি হয়ে উঠেছে, অথচ রোহিঙ্গারা যখন নিজ দেশে নাগরিকত্বহীন জীবন নির্বাহ করেছে, যখন তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, ভোটাধিকার, চাকরির অধিকার ইত্যাদি কিছুই ছিল না, তখন তারা ছিল কোথায়? নাকি এসব বনি আদম মুসলিম জনগোষ্ঠী বলে তাদের মানবাধিকার থাকা-না-থাকায় তাদের এত দিন কিছুই যায় আসেনি? তদুপরি এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আরেকটি সমস্যাসঙ্কুল মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের সর্বনাশের ব্যবস্থা করার লক্ষ্যেই এসব বিশ্ব সংস্থা আয়োজন করেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত পাবনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে হতাহত ২২

সকল