২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আফগানিস্তান নিয়ে সবাই প্রশ্নের মুখোমুখি

-

শেষ পর্যন্ত আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে গুটিয়ে চলেই গেল এবং তা পক্ষ-বিপক্ষের সবাইকে অবাক করে। বিশেষ করে পক্ষের লোকেরা নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, আমেরিকারও দিন শেষ হয় তাহলে! এবার সবাই বুঝে গিয়েছিল এটা শুধু আফগানিস্তান ছেড়ে গুটিয়ে চলে যাওয়া বা পালিয়ে যাওয়া নয়। এটা শুরু। এটা শুধু আমেরিকার আগফানিস্তান ছেড়ে যাওয়া নয়, এটা গত কমপক্ষে ৫০০ বছরে ধরে অন্যের দেশে গিয়ে সে দেশ দখল, লুটপাট, বাহাদুরি দেখানো আর সভ্যতা শেখানোর যে ভণ্ডামি এখন থেকে এই পুরো প্রক্রিয়াটারই গোটানো, বন্ধ বা সমাপ্তির ইঙ্গিত করছে এটা। আমেরিকার নেতৃত্বের দিন শেষ- মানে পশ্চিমের নেতৃত্বের দিন শেষ! এটাই হলো সেই অবিশ্বাসের ঘটনা যা এখানে বাস্তবায়িত হয়ে গেছে!

রাষ্ট্র আর রাজনীতি সাধারণত আমার লেখার মূল প্রসঙ্গ হয়ে থাকে। তবে রাষ্ট্র আর রাজনীতির দেশীয় দিকের চেয়ে বৈদেশিক বা গ্লোবাল দিকটা এ লেখায় অনেকসময় ভারী থাকে বলে অনেকে আমাকে আন্তর্জাতিক ইস্যুর লেখক বলে মনে করে যদিও আমার লেখার মূল প্রসঙ্গ রাষ্ট্র আর রাজনীতিই।

গত ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরাশক্তির প্রভাব’ নিয়ে একটা সিরিজ লিখেছিলাম। ফলে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন আমি আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে লিখছি। আসলে তখন থেকেই মূলত যে কথা বলতে চেষ্টা করেছি তা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দুনিয়ায় একটা গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম তৈরি হয়েছে, আমেরিকা যার প্রথম নেতা। এই সিস্টেমে কে নেতৃত্ব দেবে তা নির্ভর করে অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্নে সে দেশের শীর্ষে থাকার ওপর। যতই এই শীর্ষ অবস্থান ঢলে পড়ার দিকে যেতে থাকবে ততই তার নেতাগিরির দিন শেষ হবে। আবার ওই ঢলে পড়া অবস্থান বিপরীতে ক্রমেই যার দখলে যাবে, তার অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে, সেই-ই নতুন গ্লোবাল নেতার আসন নেবে। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতার বৃদ্ধির ব্যাপারটা সামরিক ক্ষমতার বলে অর্জনের বিষয়ই নয়। আমার লেখার প্রসঙ্গ ঠিক এই গ্লোবাল নেতৃত্বের পালাবদলও নয়। বরং জানা যে, এই পালাবদলের কালে তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী কী পরিবর্তন আনবে অথবা নতুন কী কী ফ্যাক্টরের আবির্ভাব হয়ে থাকবে।

২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে এ কথাগুলোই আমি বলে আসছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, মানুষের পুরনো চিন্তার ফ্রেম তাকে আমার কথাগুলো বুঝতে বাধা দিয়ে গেছে। বিশেষত যেমন এক প্রধান বাধা হলো কমিউনিস্ট-ননকমিউনিস্ট ফ্রেমে ফেলে আমার কথা বুঝতে চাওয়া। দুই. যারা আবার নিজেদের কমিউনিস্ট ফ্রেমের বাইরের চিন্তার লোক মনে করেন তারাও আমার কথা মানতে চাননি। কারণ আমি বারবার দেখিয়েছি, পালাবদলে আমেরিকার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। আর ওদিকে তাদের আমেরিকা-প্রীতি বা শক্ত আস্থা ততই দুর্বল হলেও তারা আমার কথা অস্বীকার করে থেকেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হয়েছে এক প্রপাগান্ডা যে, আমি ‘চীনের পক্ষের লোক’; অতএব এ কারণে নাকি আমি আমেরিকাবিরোধী। আমি যতই বলি, আমি অবজেকটিভ দর্শক-পূর্বাভাসদাতা মাত্র। তারা মানেনি। বিশেষ করে ভারতের প্রপাগান্ডা যে, আমারটা নাকি চীনা ভাষ্য।

অথচ একমাত্র আমিই গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম তৈরি হওয়ার ইতিহাসটা প্রসঙ্গ করে সবার সামনে এনেছি। গ্লোবাল নেতৃত্ব ব্যবস্থা, আবার এই নেতৃত্বের পালাবদলের প্রসঙ্গটাও এনেছি। ইতিহাসে এ ঘটনাটা প্রথমে ঘটেছে আমেরিকার নেতৃত্বেই। ফলে অকৃপণভাবে বাস্তবের সেই আমেরিকান গৌরবের কথাই আমাকে বলতে হয়েছে। বাংলাদেশে আমার চেয়ে বেশি সেই ইতিহাসের আমেরিকান গৌরবের কথা আর কেউ তুলে আনেনি, তাদের এটা অজানা থাকার কারণে। কলোনিয়াল কারণে আমরা ইউরোপিয়ান-ব্রিটিশ ইতিহাস পড়ে ও ফলো করে অভ্যস্ত, আমাদের একাডেমিগুলোতে পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসুচিও তাতেই ভারাক্রান্ত। যেমন অনেক কমিউনিস্টকে দেখেছি, যে মনে করে গ্লোবাল নেতা বা পরাশক্তি ব্রিটিশ রাষ্ট্র, আমেরিকা নয়।

যাই হোক, আমার দিক থেকে সেটা ছিল গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেমটা (ত্রুটি-সীমাবদ্ধতাসহ) তৈরির পেছনে আমেরিকান অবদানটাকে তুলে এনে দেখানো। কিন্তু সেটি আমেরিকান-প্রীতি দেখানো অবশ্যই নয়। ইতিহাসের ফ্যাক্টস বলার জন্য বলতেই হয়েছিল। আবার উল্টো দিকে পালাবদলে চীনের নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে তার বড় অযোগ্যতাগুলো কী- এর তালিকা আমিই সবার আগে ও বিস্তারে লিখেছি। কারণ মূল বিষয়টি আমেরিকা বা চীন একেবারেই না। ব্যাপারটা হলো- আমাদের সময়কালকে আমরা ঠিকভাবে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে পারছি কি না! এটাই মূল বিষয়। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ এখানে আবার কেন?

বাইডেনের আমেরিকার আফগানিস্তান ছেড়ে পালানো দেখে বর্তমান ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি ‘আমেরিকাকে আর কোনো পরাশক্তি মনে করেন না।’ কেন? আসলে সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিল ব্রিটিশ ‘স্পেকটেটর’ নামে ম্যাগাজিন। সেটি নিয়ে লন্ডন ‘গার্ডিয়ান’ পরে এক রিপোর্ট করেছে। মূল সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘গ্লোবাল রঙ্গমঞ্চে আফগানিস্তান থেকে প্রস্থানটা ব্রিটিশ শক্তিরও সীমাবদ্ধতা প্রদর্শন করে কি?’ মন্ত্রী এই জিজ্ঞাসার জবাবে প্রথমে স্বীকার করে নেন যে, ‘ব্রিটেন স্পষ্টতই একটি পরাশক্তি নয়।’ এরপর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে মনোযোগ দিয়ে চেপে ধরেন। ওয়ালেস বলেন, ‘যে দেশ বা শক্তি যেকোনো একটা কিছু করব বলার পরে আর সেটি করবেই বলে আঁকড়ে থাকার মুরোদ রাখে না সে আসলে পরাশক্তিই নয়।’ কিন্তু এত কঠিন করে আমেরিকাকে নিচু দেখানো কথা মন্ত্রী বললেন কেন?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি ১৯৪২ সাল থেকে ওই যুদ্ধসহ গ্লোবাল নেতৃত্বই আমেরিকার হাতে চলে গিয়েছিল। অর্থাৎ ১৯৪২ সালের আগের টানা ৩০০ বছর সারা দুনিয়া ছিল ইউরোপের পাঁচ রাষ্ট্রের অধীনে কলোনি দখলে চলে যাওয়া দেশ। আর এই পাঁচের মধ্যে ব্রিটিশ-ফরাসি ছিল সেরা- যে দুয়ের মধ্যে আবার ব্রিটিশরা সেরা। আর বিশ্বযুদ্ধ শেষে সারা ইউরোপকে স্বেচ্ছায় কলোনি শাসন ত্যাগ করতে হয়েছিল। কারণ আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

তবু আমেরিকা-পরাশক্তির আড়ালে থেকে তারই ছোট পার্টনার হিসেবে, কিংবা ন্যাটো-জোটের সদস্য হিসেবে থাকার কারণে তারাও পরাশক্তি ভান করার সুযোগ পেয়ে এসেছে। করে গেছে। অথচ এসব কমন বাহিনী (যেমন- ন্যাটো) অথবা জার্মানি, জাপানে বা দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যারাক গড়ে সেখানে আমেরিকান সেনাবাহিনী পুষে সেই ১৯৪৫ সাল থেকে এসবের খরচের বেশির ভাগ এখনো একা আমেরিকা বহন করে আসছে। খুব সম্ভবত আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পরে এখন আমেরিকা এসব খরচ বইতে অপারগতা দেখাবে, ফলে ইউরোপের যে ক্ষমতার জৌলুস সেসব কিছুতে এখন টান পড়বে।

ইইউর ফরেন পলিসি চিফ
তাই ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফরেন পলিসি ও নিরাপত্তা পলিসি ইস্যুতে প্রধান প্রতিনিধি জোসেপ বোরেলের মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন, বাইডেনের দুর্বল পরিকল্পনায় আফগানিস্তান ত্যাগ করার পর সারা মহাদেশজুড়ে এ নিয়ে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়েছে। ‘এটা পশ্চিমা দুনিয়ার জন্য বিরাট পরাজয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে সবকিছু ওলটপালট করে খেলা বদলে দেয়ার মতো এক ঘটনা।’ ইইউ’র এখন ‘আপন স্বার্থ বুঝে নিতে সক্ষম হতে নিজেই এগিয়ে আসা ও সক্ষম হওয়া উচিত, বিশেষত যখন আমেরিকা আর সংশ্লিষ্ট থাকতেই চাচ্ছে না।’

আর ওদিকে বাইডেন সম্ভবত ভাবছেন, ‘গত ৭৫ বছর ধরে তোমরা কেউ খরচের দায় নাওনি। কাজেই যেখানে আমেরিকার একার পক্ষেই আর খরচ বইবার ক্ষমতা নেই সেখানে তোমাদের সাথে কথা বলে আমার কী লাভ?’

কথাগুলো সত্য বটে! কিন্তু ট্রাম্প যখন আগে একইভাবে ও ভঙ্গিতে ইইউ এবং ন্যাটো লেভেলে কথা বলেছিলেন আর ট্রাম্পের আমল থেকেই ইতালি-জার্মানি ও পরে ফরাসিদের উদ্যোগে ইইউ চীনের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে ফেলেছিল- ইইউ-চীনের কম্প্রিহেনসিভ ইনভেস্টমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর শেষ হয়ে গিয়েছিল। অথচ বাইডেন শপথ নেয়ার পরই ইইউ’র সাথে ট্রাম্প সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছেন- এ কথা বলে দাবি করেছিলেন, তিনি ২০০১ সালের আগের পারস্পরিক সম্পর্কের সবকিছুর দিকে তিনি আবার গড়বেন- এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেন? আর ইইউ এই প্রতিশ্রুতিতে এতই আস্থা-বিশ্বাস রেখেছিল যে, চীনের সাথে তাবত চুক্তি ও কথাবার্তা সবকিছু স্থগিত রাখা হলো; তারা সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল চীনকে! এখন সেসবের তাহলে কী হবে?

অর্থাৎ বুঝাই যাচ্ছে, ইইউ-আমেরিকা পারস্পরিক আস্থা কত নিচে নেমে গেছে। আসলে মূল ঘটনা হলো- বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একাই। ব্রিটেন বা ন্যাটোকেও সাথে নেননি। কেবল প্রত্যাহারের শেষদিন, ৩১ আগস্টের কদিন আগে জি-৭ পর্যায়ে একটা নামকাওয়াস্তে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছিল। যেখানে কারো কোনো অনুরোধ-পরামর্শ বাইডেন আমল করেননি।

এক কথায় বললে, কার্যত দু’দিন আগেই আমেরিকা সব ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাওয়ার পর সারা পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রচণ্ড হতাশা আর ক্ষোভ নেমে আসে এবং সর্বগ্রাসী এক ‘লস্ট’ মানে সব হারানো অনুভব তাদের সবাইকে একেবারে ‘খেয়ে ফেলেছে’। যেমন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস কত চেষ্টা করেছিলেন, তার সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম সফরকে বিরাট হাইলাইট করবেন। কিন্তু আফগানিস্তানের পরাজয়সম প্রত্যাহার সব কিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল, আর তাতে গ্লোবাল মিডিয়া থেকেই এই সফর আউট হয়ে গেছে। গ্লোবালি বাহাদুরি করে বেড়ানো আমেরিকা এমন হতাশায় হারিয়ে যেতে পারে এটা এর আগে কেউ কল্পনাও করেনি।

সবার নিচে খারাপ অবস্থায় ইন্ডিয়া
‘অবশেষে সব দোলাচল, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দোটানার অবসান। ঢাকঢাক গুড়গুড়ের ঘোমটা সরিয়ে গত মঙ্গলবার কাতারের রাজধানী দোহায় ভারতীয় দূতাবাসে তালেবানের মুখোমুখি হলেন রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল এবং ভারতের ‘উইশ লিস্ট’ বা ইচ্ছা তালিকা তিনি পেশ করলেন। গোপনীয়তার ঘেরাটোপ সরিয়ে নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রচারও করল। সন্ত্রাস বন্ধে সন্ত্রাসীদের সাথে সরাসরি দর-কষাকষির এক নতুন অধ্যায়ও শুরু হলো। ‘আগামী দিনে এই গতিপথের চরিত্র কী হবে, এখনই অনুমান করা কঠিন।’ এটা কোনো অ-ভারতীয়ের লেখা নয়। এক বাংলাদেশী দৈনিক পত্রিকায় দিল্লির প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট এটি যিনি সবিস্ময় ভারতীয় উগ্র দেশপ্রেমের রঙে লেখা লেখা পাঠিয়ে থাকেন। অথচ এই লেখায় তিনি মোদির ভারতের দেউলিয়া হয়ে পড়া ‘আফগান নীতি’ থেকে নিজের দূরত্ব রচনা করে লিখেছেন। তার সব চেয়ে কড়া সমালোচনার বাক্য ওই ‘সন্ত্রাস বন্ধে সন্ত্রাসীদের সাথে সরাসরি দর-কষাকষির এক নতুন অধ্যায়ও শুরু হলো।’

কেন লিখেছেন? কারণ আট বছরে পা দেয়া মোদির সরকারের পাকিস্তান-আফগানিস্তান নীতি হলো- মুসলমানবিদ্বেষ ততই চরমে নাও আর ঘৃণা ছড়াও যত বেশি সম্ভব। কারণ এতে ততই হিন্দুত্ববাদ ফলবতী হয়ে ভোটবাক্স ভরাবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে ভারত-রাষ্ট্রের ক্ষতি হলেও সেটি সেকেন্ডারি ও তুচ্ছ। কারণ ক্ষমতায় থাকতে পারাটাই মোক্ষ!

এখান থেকেই সাজানো মোদি-নীতি হলো, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা ব্যক্তি বলে ভারত সরকার যাদেরকে ঘোষণা করেছে তাদের সাথে কোনো কথা বা যোগাযোগ নেই। কিন্তু এই নীতিই মোদির গলায় এখন ফাঁস হয়েছে। সরকার এখন তালেবানের সাথে কোনো ফরমাল ডায়ালগ করতে পারছে না। কারণ তারা আগেই তালেবানকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে নিষিদ্ধ করে রেখেছে।

গত আগস্টের শুরুতে বা তারও আগের দু-একবার তাই ভারত কাতারে তালেবানের সাথে কথা বলার সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তা কখনো স্বীকার করেনি। ফলে ডায়ালগের কোনো কার্যকর ফল ভারত পায়নি। আবার গত ১৫ আগস্ট তালেবানদের কাবুল দখলের পর এয়ারপোর্ট পার হতে গিয়ে আটকেপড়া ভারতীয়রা বুঝে যায়, ‘মোদিকে ফোন করে লাভ হচ্ছে না। এর চেয়ে কাছের তালেবান কমান্ডারই নিরাপত্তা পাওয়ার জন্য আসল ভরসা।’ তা আমরা কলকাতার বাঙালি তমালের ভাইরাল হওয়া বয়ানে দেখেছি। কাজেই এখানেও প্রমাণিত যে, ইসলামবিদ্বেষ বা তালেবান-ঘৃণা ভারতেরই নিজস্বার্থের বিরোধী। কাজেই চরম নিরুপায় হয়ে আর নিজের পায়ে দেয়া নিজের বেড়ি ভেঙে এবার কাতারে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল তালেবান নেতা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্ট্যানিকজাইয়ের সাথে বৈঠক করেছেন, প্রকাশ্যেই। তবে যে উসিলায় বৈঠক করেছেন তা ঝুটা। কারণ ওই রিপোর্টার লিখেছেন, ‘জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৩-২ বিভাজনে যে প্রস্তাব পাস করে...’, এটি একটি মিথ্যা কথা। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ ভেটো সদস্যের যেকোনো এক সদস্য যদি ভেটো দেয় তো ওই প্রস্তাব বাতিল। তাতে মোট ১৫ সদস্যের ১৪ সদস্য কোনো প্রস্তাবের পক্ষে আর এক সদস্য বিপক্ষে থাকলেও ওই প্রস্তাব গৃহীত হবে না। এটাই তো ‘ভেটো’র অর্থ। অথচ লেখা হয়েছে ‘জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৩-২ বিভাজনে যে প্রস্তাব পাস করে’, অর্থাৎ যেন পাঁচ ভেটো সদস্যের তিন সদস্য পক্ষে আর দুই সদস্য বিপক্ষে থাকলেই প্রস্তাব পাস করা যায়; যেন নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ ভেটো-সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই প্রস্তাব পাস হয়। আসলে এ কথাটাই ভিত্তিহীন। কাজেই দীপক মিত্তাল নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া কোনো প্রস্তাবের ভিত্তিতে তৈরি করা ভারতের কোনো দাবিনামা নিয়ে তালেবান নেতার সাথে দেখা করতে যাননি। দেখা করেছেন, ভারতের কামনা-নামা নিয়ে।

তবে জেনে না জেনে ওই রিপোর্টার পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, আফগানিস্তানে আমেরিকার স্বার্থ আর ভারতের স্বার্থ একেবারেই আলাদা। তাই আমেরিকা তালেবানের সাথে ডিল করেছে এবং চুক্তি করে ফেলেছে। অথচ ভারতের সামনে কোনো দিশা নেই। আসলে ভারতই এখনো তালেবানদের সাথে সম্পর্ক করবে কি না, সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

আর ভারতের সিদ্ধান্ত না নিতে পারার প্রধান কারণ ইসলামবিদ্বেষ ও গভীর মুসলমান- ঘৃণা। কারণ এ দু’টিকে মোদি ও তার দল, হিন্দুত্ববাদের পক্ষে ভোট জোগাড়ের চাবি বলে ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছে এবং সহসাই এখান থেকে সরে আসতে পারবে না, তা চায় না।

যদিও মুখে বলছে তালেবানদের হাক্কানি গ্রুপে তার আপত্তি, কারণ এরা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত। বাস্তবতা হলো- তালেবান মূল লিডারের তিন ডেপুটি আছেন যার একজন হাক্কানি গ্রুপের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। আর ভারত দাবি করছে যে, তাকে মানে ওই গ্রুপকেই বাদ দিতে হবে! অর্থাৎ ভারত নিজেকে তালেবানদের কাছে নিজেকে এতই ওজনদার মনে করে?
আসলে ঘটনাটা উল্টো। ভারত তালেবানদের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ফলে কোনো গ্রæপকে বাদ দেয়ার কথা তালেবানদেরও ভাবতেই হবে না।

তালেবানের নিজের সমস্যা
‘তালেবানের নিজের সমস্যা অন্যখানে এবং সেটি প্রধান কেউ থাকল না।’ ১০ জনের কমিটি ক্ষমতায় থাকল। মূল কারণ, এগুলো তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাদের নিয়ে হবে সে প্রশ্ন। এই সরকার সাময়িক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে তা তো এক-দু’বছর ক্ষমতায় থাকতেই পারে- তা একা কেউ অথবা একটা কমিটি। মূল সমস্যা হলো- এরপর স্থায়ী সরকার যেটা হবে সেটি কেমন হবে। এ পর্যন্ত দুনিয়ায় দেখা গেছে, শাসনক্ষমতা হয় রাজতন্ত্রের না হয় রিপাবলিক (প্রজাতন্ত্র)। সাধারণত রাজতন্ত্রগুলো তাকে শাসনক্ষমতা কে দিয়েছে তা বলতে পারবে না, এমন ধরনের হয়। আমিরের আমিরাত তেমনই এক শাসনক্ষমতা যা ‘রাজতন্ত্র’ শব্দ ব্যবহার করেনি। তবু এটা রাজতন্ত্র বা মনার্কিই। এমনকি সমাজের কিছু এলিট যেমন ধরুন গুলশান-বারিধারার বাসিন্দাদের নিজেদের মধ্যে ঠিক করা এক শাসনক্ষমতা বা সরকার- এরাও কে তাদের ক্ষমতা দিয়েছে বলতে পারবে না বা চায় না।

আসলে কে তাদের ক্ষমতা দিয়েছে বা দেবে- এই প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে থাকতে হবে। নিজেকেই নিজে দিতে পারতে হবে। এর জবাব যার কাছে নেই, দিতে চায় না; এর মানে হবে এটা রাজতন্ত্র অথবা একটা এলিট গ্রুপ।

প্রশ্নটার আরেকভাবে জবাব দেয়া যেতে পারে। ওই দেশে পাবলিক বা জনগণের ভ‚মিকা কী হবে? সরকারের সাথে পাবলিকের সম্পর্ক কী হবে কিভাবে হবে? পাবলিক কি ভোট দিতে পারবে? ভোটের ব্যবস্থা কি আদৌ দেশে থাকবে? এসব প্রশ্নের জবাব থাকতেই হবে।

নিজেকেও প্রশ্ন করা যেতে পারে, আমাদের রাতের ভোটের সরকার হলে আমরা এতে আপত্তি দেখাই কেন? সরকারের জবাবদিহিতা না থাকলে, ইচ্ছামতো গুম-খুন করা হলে আপত্তি করি কেন?

আর রিপাবলিক রাষ্ট্র ও সরকার বলে নিজেকে ঘোষণা না করলে জাতিসঙ্ঘের অনুমোদন পাওয়া অসম্ভব। তাতে ‘ইসলামী রিপাবলিক’ ঘোষণা দিলেও চলবে। অজস্র প্রশ্নের ঠেলায় বিভেদ শুরু হবে। যারা আমেরিকা বা পশ্চিমের বিরুদ্ধে সমর্থন জানিয়ে আসছে, তারাই দুর্বল হয়ে যাবে একপর্যায়ে।

আসলে ব্যাপারটা আমার যেমন ইচ্ছা তেমন শাসনক্ষমতার সরকার গড়া নয়। মূল কারণ, একালে গ্লোবাল বাণিজ্য। আপনার দেশকে গ্লোবাল বাণিজ্যে অংশ নেয়া সদস্য হতে হবে। না হয়ে দেশ চালানো একালে খুবই কঠিন। অনেকটা ইরানের তেল আছে; কিন্তু তা বেচে অন্য দেশ থেকে অন্য পণ্য কিনতে পারবে না- এ ধরনের সমস্যা হবে; যেটা মারাত্মক। এটা অনেকটা গ্রামে আপনাকে একঘরে করে রেখে দেয়ার মতো হবে। যদি এতেও আপনার কোনো সমস্যা না হয়, সহ্য হয়, তবে ঠিক আছে। আপনার যা ইচ্ছা শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অন্য দেশ থেকে কিছুই কিনতে বেচতে পারবেন না যার সোজা মানে, গ্লোবাল পণ্যবিনিময় মানে মুদ্রাব্যবস্থায় আপনি সদস্য না হয়েই থাকতে চাওয়ার পথ বেছে নিলেন।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement