২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অনিবার্য ইবনে খালদুন

-

(দ্বিতীয় কিস্তি)

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইবনে খালদুন রচনা করেন বহুসংখ্যক গ্রন্থ। অনুসন্ধান এখনো চলছে তার গ্রন্থাবলির। কারণ সব গ্রন্থ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ধর্মতত্ত্ব, ইলমুল কালাম ও তাসাউফে তার লুবাবুল মুহাসসাল ফি উসূলিদ্দীন ও শিফাউস সাঈল ওয়া তাহযিবুল মাসাইল অসামান্য রচনা। গ্রিক ও আরব দর্শনে তার রয়েছে পর্যালোচনা ও বিস্তৃত সমীক্ষা। যখন তার বয়স ২০ বছর, তখনই ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর (১১৪৯-১২১০) দার্শনিক ও ধর্মতাত্তি¡ক বিশ্বকোষ মুহাসসালু আফকারিল মুতাকাদ্দিমীন ওয়াল মুতাআখখিরীন মিনাল হুকামা ওয়াল মুতাকাল্লিমীন তথা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দার্শনিক ও ধর্মতাত্তি¡ক-নৈয়ায়িকদের চিন্তাধারার সারগ্রন্থ-এর অনুকরণে ধর্ম ও দর্শনের সারাৎসার রচনায় ব্রতী হন। রাযীর বইটিতে ছিল ধর্ম ও দর্শনের আন্তঃসম্পর্ক এবং বিশ্বাস ও যুক্তির মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং এর প্রভাব নিয়ে একটি বৈশ্বিক পর্যবেক্ষণ। ইবনে খালদুন এর সারগ্রন্থ রচনার জন্য নির্দেশিত হন মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আল আবিলীর পক্ষ থেকে, যিনি ছিলেন সেকালের আফ্রিকায় দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও বিবিধ জ্ঞানের গুরুব্যক্তিত্ব। ২০ বছর বয়সে ইবনে খালদুন পাণ্ডিত্যে যে আস্থা অর্জন করেন, পরবর্তী জীবনে তা প্রসারিত হয়েছে বহুমাত্রায়। বিস্তৃত একটি আত্মজীবনী ইবনে রুশদের সাথে সম্বন্ধিত। আত তারিফ বি ইবনি খালদুন ওয়া রিহরাতিহি নামে বিখ্যাত এ গ্রন্থে ইবনে খালদুনের সময়ের ঘটনা পরিক্রমার অনুষঙ্গে তিনি উপস্থাপিত। নিজের জীবন থেকে কিছু ঘটনা তুলে এনে এর মধ্যে ইতিহাস কিভাবে কাজ করে এবং ইতিহাসে তা কিভাবে ক্রিয়াশীল, সেটিই যেন দেখাতে চেয়েছেন তিনি। এখানে ব্যক্তি তিনি কমই ধরা দেন। বইটি তার ব্যক্তিজীবনের তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করে না। তিনি যা, কিভাবে তা হলেন, সেই জার্নির চেয়ে বরং তার সমকালের যে সম্পর্কজালে তিনি যুক্ত ছিলেন, বইটিতে সেটিই ব্যক্ত করেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। ফলে তার শিক্ষক ও অন্যরা সেখানে প্রবলভাবে হাজির। ইসলামী জ্ঞানকলায় আপন সিলসিলা ও সনদ সেখানে পেয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। এতে নিজের স্বীকারোক্তি কম, আবেগ ও আত্মপ্রকাশের ভাষা সচেতনভাবে উপেক্ষিত। নিজের বন্ধুরা সেখানে কম হাজির হন। মিসরে তার নিকটতম শিষ্য তাকি উদ্দীন আহমদ বিন আলী আল মাকরেজিও গরহাজির থেকে যান। এমনকি গ্রন্থটি তার স্ত্রী ও সন্তানাদির নামও জানায়নি। তার রচিত গ্রন্থাবলিকেও উপস্থাপন করে না।

তার গ্রন্থাবলির তথ্য আমাদের তালাশ করতে হয় অন্যত্র। খুব যে পাওয়া যায়, তাও নয়। ঐতিহাসিক লিসানুদ্দীন ইবনুল খতিব আল ইহাতা ফি আখবারিল গারনাতা গ্রন্থে উল্লেখ করেন ইবনে খালদুনের এমন কিছু গ্রন্থের, যা আমাদের জানায় ইবনে খালদুনের নানামুখী সৃষ্টিসক্রিয়তা সম্পর্কে। গ্রন্থগুলো কাব্য, ন্যায়শাস্ত্র, গণিত ও দর্শনবিষয়ক। ইমাম আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে সাঈদ আল-বুসীরীর (১২১১-১২৯৪) কাসিদাতুল বুরদার একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ, মানতিক বা যুক্তিবিদ্যার একটি রূপরেখা, গণিতের জটিল বিষয়াবলি নিয়ে রচিত আল হিসাব, আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে রুশদের (১১২৬-১১৯৮) কয়েকটি ভাষ্যগ্রন্থ এবং উসূলে ফিকহের ওপর একটি শরাহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইবনে রুশদের রচনা হিসেবে উল্লেখ করেন ইবনুল খতিব, যার সবই বিলুপ্তির শিকার হয়েছে। নানাবিধ সূত্রে তার কাব্য, ভাষ্যগ্রন্থ, গণিত প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রন্থগুলোর সন্ধান মেলেনি কোথাও।

ইবনে খালদুন যে গ্রন্থের জন্য বিশ্বমনীষায় বরেণ্য, সেটি হলো কিতাবুল ইবার ওয়া দিওয়ানুল মুবতাদা ওয়াল খবর ফি মা’রিফাতি আইয়া-মিল আরাবি ওয়াল আজমি ওয়াল বারবার (Book of Lessons, Record of Beginnings and Events in the History of the Arabs and the Berbers)। ঝড়কবলিত তার জীবনে এ কিতাবুল ইবার রচনা ছিল চিন্তার বিস্ফোরণের মতো। ১৩৭৪ সাল থেকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে চার বছর সামাজিক ইতিহাস রচনায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। অস্থির ও চোখরাঙানো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৩৭৭ সালের মে-অক্টোবর, পাঁচ মাসের মাথায় তিনি তার ধ্রুপদী মুকাদ্দিমার রূপরেখা প্রণয়ন করেন। যার বিশদ ব্যাখ্যার জন্য তাকে অন্তত আরো সাত বছর সময় ব্যয় করতে হয়। তিউনিসিয়ার রাজধানী শহরের প্রসিদ্ধ লাইব্রেরিগুলোর নিঃশব্দ প্রহর থেকে জন্ম নেয়া তার যে চিন্তাপুঞ্জ মরুভ‚মির প্রাচীন প্রাসাদে প্রবল স্রোতে প্রকাশ পেয়েছিল, সেই প্রকাশ মিসরের জ্ঞানাগার অবধি প্রসারিত হয় ১৩৭৮ সালে। নীল নদের তীরবর্তী প্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া ও কায়রোয় অবস্থান করে তিনি একে দেন পরিমার্জনা, সমৃদ্ধি ও সম্পন্নতা। এখানে তিনি ইবার ও মুকাদ্দিমাকে দেন আরো প্রসার। তথ্যগুলোকে করেন হালনাগাদ। মৃত্যুর আগের বছরেও জারি ছিল এ প্রক্রিয়া।

আল ইবার সাত খণ্ডে রচিত। এর ভ‚মিকার শিরোনাম ‘মুকাদ্দিমা’। মুকাদ্দিমা এত ব্যাপক আকারে লেখা যে, এটি প্রথম খণ্ডের প্রায় পুরোটা জুড়ে বিস্তৃত। সর্বজনীন মানবেতিহাসের নতুন প্রস্তাবনা এখানে বিভাষিত। এমন সব সাধারণ নিয়মের তাত্তি¡ক বয়ান এখানে সজ্জিত, যার পকেট থেকে বেরিয়ে আসে জ্ঞানদৃষ্টি ও জ্ঞানভাষ্যের বিচিত্র শৃঙ্খলা। মুকাদ্দিমার প্রথম অধ্যায়ে সাধারণ মানবসমাজের আলোচনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে আপনি প্রবেশ করবেন যাযাবর জীবনে, তৃতীয় অধ্যায়ে রাষ্ট্র, রাজনীতি, শাসক প্রশাসক আর জনগণ, চতুর্থ অধ্যায়ে সভ্যতা, নগর জীবন; আরবান প্রগতি, পঞ্চম অধ্যায়ে ব্যবসায়, তেজারত, জীবন-জীবিকার পথ ও প্রক্রিয়া আর তার ইতি-নেতি, ষষ্ঠ অধ্যায়ে রয়েছে কলা ও বিজ্ঞানের সর্বজনীন সমীক্ষা। খণ্ডগুলো কোনোভাবেই এক কথায় প্রকাশিত হতে নারাজ। কারণ এসবের ব্যাপ্তি ও অভিপ্রকাশ সমন্বয় ও অধীনতার নিখুঁত যৌথতায় গ্রথিত। ধারণাগুলো ধার ও ভার নিয়ে গম্ভীর ও বর্ণিল। গতিমান নদীর মতো তারা প্রবাহিত উচ্ছ¡াসে তরঙ্গায়িত, কিন্তু শৃঙ্খলার স্থাপত্যে সুবিন্যস্ত। যুক্তি ও শব্দ-বাক্য সমান মনোযোগ দিয়েছে পরস্পরকে। গদ্য সাদাসিধা থেকেও অর্থকে দিয়েছে বাঁক-প্রতিবাঁক। আল মুকাদ্দিমা পাঠককে ম্যাজিক কার্পেটে উঠিয়ে নেবে, কিন্তু এখানে অবাস্তব দুনিয়া নয়, বাস্তবতার মধ্যেই তিনি থাকবেন। ম্যাজিক কার্পেট উড়ে উড়ে তাকে নিয়ে যাবে বাস্তবতার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, ভেতর থেকে বাইরে। দেখাবে সেই বাস্তবতাকেও, যা আসলে বাস্তবতা নয়। আল মুকাদ্দিমার সাথে আপনি যাযাবর জীবনে থাকেন কিংবা নগরে; আনকোরা বোধ, বিচার ও বহুদর্শিতার উপসংহার খাবার হিসেবে আপনার পাতে থাকছেই।

এর রচনায় ইবনে খালদুন সমকালীন লিখিত সূত্রগুলো পর্যালোচনা করে বহু উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। আবার উত্তর আফ্রিকার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কিত তার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সন্নিবেশিত করেন। কোনো মুহাফেজখানায় সংরক্ষিত তথ্য ও দলিল-দস্তাবেজ তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তিনি বরং প্রাপ্ত তথ্যকে নতুন দৃষ্টিতে পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করেন। এতে তিনি প্রকৃতি ও ইতিহাস দর্শন প্রসঙ্গে আপন অভিমতগুলো সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করেন। অত্যন্ত আকস্মিকভাবেই মুকাদ্দিমা নতুন বিষয়গুলোর অবতারণা করে। যার মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞানের বিবিধ বিষয়, যা নতুন দৃষ্টি, অভিব্যক্তি ও উন্মোচনের প্রতিভাসে আমাদের চিত্তকে জাগিয়ে দেয়। অনুসন্ধানী চোখ লক্ষ করে, মুকাদ্দিমা সামাজিক বিজ্ঞানের জননী এবং এর অন্তত তিনটি প্রধান শাখাকে সে স্তন্যদান করে বিশেষ আকার অবধি নিয়ে যায়। সেগুলো হচ্ছে- সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি। যদি শুধু সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে মুকাদ্দিমাকে মূল্যায়ন করা যায়, তা হলে গ্রন্থটির ছয়টি অংশকে সমাজবিজ্ঞানের ছয়টি ক্ষেত্র হিসেবে সহজেই বিভাজিত করা যায়। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে সামাজিক ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, জাতিতত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞান, রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান বা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান, সমাজকাঠামো ও সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং শিক্ষার মনোবিজ্ঞান। পণ্ডিত ও দার্শনিকদের মতে, মুকাদ্দিমা হচ্ছে তথ্য সরবরাহের এক জ্ঞানভাণ্ডার- বহনযোগ্য একধরনের বিশ্বকোষ। এতে সব বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়; যেমন- জ্যোতির্বিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, নীতিবিদ্যা, নৃবিদ্যা, শিক্ষাবিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, দ্বান্দ্বিকবাদ, অধিবিদ্যা, গূঢ়বাদ, ভবিষ্যৎ কথা, মনোবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব ক্রিয়াবহিভর্‚ত ব্যাপার বা অবস্থাদি (যথা : ইন্দ্রিয়াতীত প্রক্রিয়ার জ্ঞান জানাজানি, পূর্বাহ্ণে লব্ধ জ্ঞান, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতিরেকে প্রত্যক্ষকরণ চিকিৎসা বিদ্যা, সঙ্গীতবিদ্যা, কৃষি, রসায়ন, যুক্তিবিদ্যা) প্রভৃতি।

এ গ্রন্থ রচিত হয় এমন একসময়ে, মুসলিম চিন্তাচর্চার ঐতিহ্য যখন তার বর্ণিল পালকগুলো হারাতে বসেছে। পশ্চিমা দুনিয়া আরবদের অনুবাদের দীর্ঘ এক পর্ব অতিক্রম করেছে। তারা তখন নবসৃষ্টি ও নববিন্যাসের দিকে এগিয়ে চলছে। মুসলিম দুনিয়ায় চিন্তার মূল্য ও আবেদন নানাভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে ইবনে খালদুন পাদপ্রদীপের আলোয় থাকেননি। কিন্তু তার চর্চা ও আলোচনার স্পন্দন স্তব্ধ ছিল না। জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে বহুবিদ্যাবিশারদ, স্পেনের উজির লিসানুদ্দিন ইবনুল খতিব (১৩১৩-১৩৭৪) আলোচনা করেন আল ইহাতা ফি আখবা-রি গারনাতা গ্রন্থে। যে গ্রন্থ আপনকালে মুসলিম ইতিহাস পাঠের মনোযোগকে নিজের দিকে নিবদ্ধ করেছিল। মিসরে তার একান্ত সাগরিদ ঐতিহাসিক আহমদ বিন আলী আল মাকরেজি তাকে নানাভাবে ব্যক্ত করলেও এবং তাকে অনুসরণের চেষ্টা করলেও ইবনে খালদুনের মেথডলোজিকে ধারণ করেননি। মালেকী ফকিহ মুহাম্মদ ইবনে আম্মার (১৩৬৭-১৪৪১) ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমাকে ‘অন্যতম মহান’ বলে আখ্যা দেন এবং তা সাহিত্যের বিচারে। বিশেষজ্ঞতার ব্যাপক নিরীক্ষণ হিসেবে তিনি এর প্রশংসা করেন। অন্য দিকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে সমকালীন ও নিকটকালীন বিদ্যায়তনিক পরিসর থেকে। যেখানে ব্যক্তি ইবনে খালদুন নিন্দিত হয়েছেন বাজে অভিধায়, প্রশংসিতও হয়েছেন কমবেশি। ইবনে হাজার আসকালানি (১৩৭২-১৪৪৯), বদর উদ্দিন আইনি (১৩৬১-১৪৫১) জামালুদ্দিন ইউসুফ বিন আমির ইবনে তাগরিবির্দি (১৪১১-১৪৭০) শামসুদ্দিন মুহাম্মদ আস সাখাবি (১৪২৭-১৪৯৭) প্রমুখের ভাষা তাকে চিত্রিত করেছে। যেখানে প্রশংসা আছে, সাথে আছে কঠোর নিন্দা। সেই নিন্দা এমন সব বিষয়ও অনুসন্ধান করেছে, যার জন্য ইবনে খালদুনকে দায়ী বলা যায় না। যেমন ইবনে খালদুন বিয়ে করেছিলেন এমন এক নারীকে, যার ছিল মানসিক অসুস্থ এক ভাই! ‘আর বেইজ্জতি বেড়েই চলছিল!’

তিউনিসিয়ায় তার বিরুদ্ধে নিন্দা ছিল বটে! সেখানকার প্রধান কাজী ইবনে আরাফার সাথে তৈরি হয় তার দ্ব›দ্ব। তার নেতৃত্বে পরিচালিত প্রচার অভিযান ইবনে খালদুনের জন্য তিউনিসিয়ায় অবস্থানকে অনেকটা কঠিন করে থাকবে। কিন্তু একজন বহিরাগত হিসেবে মিসরে এসে তিনি যখন মামলুক প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা পেলেন এবং ক্ষমতাশালী আমির আলা উদ্দিন আলতুনবাঘার উচ্ছ¡সিত সহায়তায় মালেকী প্রধান কাজী পদে নিয়োগ লাভ করলেন, নির্দয় নিন্দা তার পিছু ধাওয়া করতে লাগল। পরবর্তীতে তাকে বিদ্ধ করা হয়েছে বিভিন্ন অভিযোগে। যেমন বুড়ো বয়সে তিনি নীল নদের তীরে এক বাড়িতে থাকতেন, সেখানে মেতে থাকতেন যুবক-যুবতীদের সাথে, ‘অভদ্র, অহঙ্কারী, ব্যভিচারী ছিলেন’, ‘তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল এবং তিনি সমকামী ছিলেন।’ ‘তিনি ইসলামী আইনে পারদর্শী ছিলেন না, যা দিয়ে বিচার করতে পারেন।’ কিন্তু আমরা দেখি, ইবনে হাজার আসকালানি ইবনে খালদুনের কাছ থেকে শিষ্য হিসেবে ইজাজাহ বা সনদ গ্রহণ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে মিসরে তিনি শাফেয়ী বিচারপতি, আর ইবনে খালদুন মালেকী বিচারপতি। চার দিকে নানা অপবাদ সত্তে¡ও মিসরে পাঁচবার তাকে বিচারপতি বানানো হয়। এ তার যোগ্যতাই প্রমাণ করে এবং নৈতিকতাও। কারণ মামলুক মিসরে যোগ্যতম আলেমদের উপস্থিতিতে একজন ‘ব্যভিচারী’ প্রধান মালেকী বিচারক হতেই পারেন না! যুবতীদের নিয়ে মেতে থাকার অভিযোগ যার যৌবনে নেই, বুড়ো বয়সে এর সম্ভাব্যতা কতটুকু? মজার ব্যাপার হলো, ইবনে খালদুনকে কায়রোর অন্যতম প্রধান খানকার প্রধান বানানো হয়েছিল, যেখানে তিনি ছিলেন সূফিদের তত্ত্বাবধায়ক, শিক্ষক ও গুরু! বস্তুত ইবনে খালদুনের ব্যক্তিত্ব ও আনুষঙ্গিক প্রচার এবং তর্ক নিয়ে তার সমকাল ও নিকটকালীন মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল অধিকতর; তার বৈপ্লবিক চিন্তার অবগাহন সেখানে অলক্ষণীয়। ১৫ শতকে ইবনে আজরাক্বের বাদাইউস সিলক গ্রন্থে ইবনে খালদুনের প্রচুর উদ্ধৃতি দেখা যায়। কিন্তু তার বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে অবলম্বনের কোনো চেষ্টা এতে ছিল না। ওসমানী সালতানাত যখন সমাজ ও রাষ্ট্রতত্ত্ব পাঠের মূল্যকে আপন জায়গায় স্থাপন করতে চাইল, ইবনে খালদুনের দিকে দৃষ্টি গেল অবধারিতভাবেই। কাতিপ চেলেবি ওরফে হাজ্জী খলিফা ১৬৫৩ সালে ইবনে খালদুনকে অবলম্বন করে সাম্রাজ্যের একটি জৈব জীবনচক্রের ধাঁচ তৈরি করেন। ১৪ হাজার ৫০০ গ্রন্থের উল্লেখ সংবলিত তার গ্রন্থ কাশফুজজুনূনে ইবনে খালদুনের উল্লেখ করেন বিশেষভাবে। তার শিষ্য ইবনে খালদুনের ধারায় রচনা করেন ইতিহাসগ্রন্থ। যার শুরুতে ছিল সমাজের উত্থান-পতন বিষয়ে আলোচনা। তার পঠন ও অনুধাবনের চেষ্টা ওসমানীয় জ্ঞানমণ্ডলে জারি ছিল। ১৭৪৯ সালে শায়খুল ইসলাম পীরজাদা মেহমেদ আফেন্দির মুকাদ্দিমা অনুবাদ এরই এক নমুনা।

পাশ্চাত্যে তিনি যাত্রা করেন মরক্কোর ফেজের কারাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক পণ্ডিতের হাত ধরে। তিনি জলদস্যুদের হাতে বন্দী হয়ে ইউরোপে যান, খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য হন, তার নাম হয় লিউ আফ্রিকানাস। তিনি চেষ্টা করেন পশ্চিমে নিজেকে পরিচিত করতে এবং ব্যর্থ হন। ১৫৫০ সালে ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত তার ডেসক্রিপশন অব আফ্রিকা গ্রন্থে ইবনে খালদুনের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাখথেলেমি দি হারবোল্ট হাজ্জী খলিফাকে অবলম্বন করে ১৬৯৭ সালে যে বিবলিউথিক অরিয়েন্টালে প্রকাশ করেন, ইবনে খালদুনের উপস্থিতি ছিল অল্প কথায়। ১৮০৬ সালে ফরাসি প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ স্যাল ভেস্ট্রে দে স্যাসি মুকাদ্দামার কয়েকটি পরিচ্ছেদ অনুবাদ করেন এবং ইবনে খালদুনের জীবনী প্রকাশ করেন। অস্ট্রীয় প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ফন হ্যামার পার্গস্টল (Von Hammer Purgstall : Thar Hunderten der Hidschort) ইসলামী শক্তির পতন সম্পর্কে ১৮১২ সালে বিরাটকায় এক পুস্তক প্রকাশ করেন। এতে ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রের পতন সম্পর্কীয় মতবাদ উল্লেখ করেন। ইবনে খালদুনকে বোঝাতে মন্তেস্কুর সহায়তা নেন। কারণ তিনি আরবদের তাই, ইউরোপের যা মন্তেস্কু। ফরাসি এ দার্শনিক দ্য স্পিরিট অব দি ল গ্রন্থে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠন এবং আইন প্রণয়ন ও এর সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে যে বিস্তৃত সমীক্ষা পেশ করেন, সংস্কৃতির হয়ে ওঠার মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে যে আলোকপাত করেন, সেখানে ইবনে খালদুন ধ্বনিত হন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ মন্তেস্কু ইবনে খালদুনের স্মরণদরোজা হয়ে উঠলেন। কিন্তু পরবর্তী শতকগুলোতে পশ্চিমা দুনিয়া লক্ষ করল, ইবনে খালদুন তাদের যুগপ্লাবি অর্থনৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বসমূহের গোড়ায় বসে আছেন। ইবনে খালদুনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে সেই ম্যাকিয়াভেলির (১৪৬৯-১৫২৭) রচনায়, তেমনি চার শ’ বছর পরের গামবাতিস্তা ভিকো (১৬৬৮-১৭৪৪), মন্তেস্কু (১৬৬৯-১৭৫৫), এডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০), অগাস্ট কে্যাঁতে (১৭৯৮-১৮৫৭), অটোকার লরেঞ্জ (১৮৩২-১৯০৪) প্রমুখের রচনায়।

লেখক : কবি, গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement